22/07/2021
বুক রিভিউ -- মতিউর রহমান খান পাঠান
বইঃ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: দার্শনিক ভাবনা
লেখকঃ মোঃ নূরুজ্জামান ( অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় )
পৃষ্ঠা সংখ্যাঃ ১২৮
মানুষের সভ্যতার ইতিহাস অনেক প্রাচীন । সভ্যতার শুরু থেকে মানুষ এ পর্যন্ত নানান সংকটময় মুহূর্ত যেমন পার করেছে, তেমনি উন্মোচন করেছে অগণিত সম্ভাবনার দ্বার । খুব সহজ করে বলতে গেলে, চতুর্দশ শতকে রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মধ্য দিয়ে মানুষ নিজেদের উদ্ভাবনকে তুলে ধরেছে অনেকটা সফল করেই । এসময় মানুষ নিত্যদিনই নতুন নতুন প্রযুক্তির সন্ধান করে সফলকাম হয়েছে । শিল্পবিকাশের নানান পর্যায়ে শক্তিশালী প্রযুক্তির আবিষ্কারের প্রত্যক্ষ ফলস্বরুপ সংঘটিত হয়েছে বিভিন্ন শিল্পবিপ্লব । প্রথমে বাষ্পীয় শক্তির আবিষ্কার দিয়ে শুরু হলেও পরবর্তীতে বৈদ্যুতিক শক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তির আবিষ্কার পর্যায়ক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের সফল সূচনা ঘটায় । বর্তমানে ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যন্ত্র শিক্ষণ ইত্যাদির সংযোজনের ফলে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা হয়েছে বলে দাবী করা হয় । চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনালগ্নে প্রযুক্তির এমন উৎকর্ষতা কেবল শিল্পের ক্ষেত্রে সীমিত থাকেনি বরং তা ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা, রাজনীতি, অর্থনীতি এমনকি ধর্মেও ।
গ্রন্থের শুরুতেই লেখক তার গবেষণালদ্ধ জ্ঞানের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন । মানুষ যে তার চারপাশকে বদলে দেবার সাথে সাথে নিজেকেও বদলাতে শুরু করে সে বিষয়টিকে তিনি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন । পরিবর্তনের এই স্রোতে নতুন নতুন শ্রেণী তৈরি হয় । পুরানো সামন্ত প্রভুরা ধীরে ধীরে ক্ষমতা হারাতে থাকে । ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদে উজ্জীবিত হয়ে নতুন রাজনৈতিক মতাদর্শের আবির্ভাব, এমনকি রাজনীতির পাশাপাশি সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে । প্রযুক্তির এই শক্তি শুধু জীবনকে বদলে দেয় না, এ সময়ে সম্পদ স্থানিক সীমা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক রূপ লাভ করে । গ্রন্থের লেখক এতে শোষণ ভিন্ন রূপ লাভ করতে পারে বলে সতর্ক করলেও সার্বিকভাবে শিল্পবিপ্লব যে মানুষের জীবনকে সহজ করে জনকল্যাণ বয়ে আনবে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন । তিনি তার পাঠকের সহজবোধ্যতার জন্য মোট ছয়টি অধ্যায়ে তার আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রেখেছেন ।
প্রথম অধ্যায়ে শিল্পবিল্পবের ইতিহাস অর্থাৎ প্রযুক্তিকে কেন্দ্র করে কিভাবে শিল্পবিপ্লব সাধিত হয়েছে, কিভাবে আরও তিনটি ধাপ পেরিয়ে চতুর্থ শিল্পবিল্পবের সূচনা হলো তার একটি তথ্যভিত্তিক আলোচনা করেছেন । চতুর্থ শিল্পবিল্পবের আলোচিত প্রযুক্তি বস্তুর আন্তর্জাল, বিগ ডাটা, ভার্চুয়াল বাস্তবতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জীবপ্রযুক্তি ইত্যাদি বিষয়কে সহজপাঠযোগ্য করে উপস্থাপন করা হয়েছে । প্রযুক্তির এসব ব্যখ্যার পাশাপাশি, মানুষে মানুষে বৈষম্য, কাজ হারানোর সংকট, তথ্য নিরাপত্তা, মানবসভ্যতা ও নিরাপত্তা নিয়ে কিছু দার্শনিক পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করেছেন ।
দ্বিতীয় অধ্যায়ে লেখক তার পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসাবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ফলে সৃষ্ট সংকট ও সম্ভাবনাকে এক ফ্রেমে বেঁধে আলোচনা করেছেন । তিনি দেখিয়েছেন রোবটিক্স কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক বিকাশের ফলে যেমন নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি হবে ঠিক তেমনি কিছু পেশা বিস্মৃতির অতল গভীরে হারিয়ে যাবে । কাজ হারানো মানুষ সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করবে । এমন সংকট থেকে উত্তরণের জন্য নিত্য নতুন প্রযুক্তির সাথে তাল মেলাতে জীবনব্যাপী শিক্ষা অর্জনের বিষয়টিকে তিনি গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন ।
তৃতীয় অধ্যায়ে লেখক শিক্ষা সহায়ক পদ্ধতি ও তার বিকাশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন । শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যবহৃত ভার্চুয়াল শ্রেণিকক্ষ, ভার্চুয়াল গবেষণাগার, তথ্য ও প্রযুক্তি, অনলাইন শিক্ষা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, প্রযুক্তি ব্যবহারে সৃষ্ট সংকট, লিংগ বৈষম্য, ছাত্রকেন্দ্রিক শিক্ষা, মেধাস্বত্ব সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে দার্শনিক পর্যালোচনা করেছেন যা প্রতিটি পাঠককেই তার ভাবনার জগতে নিয়ে যাবে ।
চতুর্থ অধ্যায়ে বিগ ডাটা কী, এর ব্যবহার ও বিশ্লেষণ, পদ্ধতি ও দর্শন নিয়ে সহজ আলোচনা করেছেন । লেখক এসব ক্ষেত্রে এর নৈতিক দিক, গোপনীয়তা ও স্বচ্ছতাকে তুলে ধরে এর একটি দার্শনিক ফিরিস্তি তুলে ধরেছেন ।
পঞ্চম ও ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তার ইতিহাস ও ব্যবহার, চেতনা ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে দার্শনিক সমস্যা উত্থাপন ও তার একটি যুক্তিযুক্ত সমাধানের পথ অনুসন্ধান করেছেন ।
দু’য়েকটি বানান সমস্যা ও কিছু কিছু বিষয়ের অল্প-বিস্তর আলোচনা এই বইটির অন্যতম দুর্বলতা । গ্রন্থের ভূমিকা আলোচনা করার ক্ষেত্রে লেখক শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে রাজনৈতিক মতাদর্শের পরিবর্তনের বিষয়টি উল্লেখ করলেও পরবর্তীতে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুকে তিনি আলোচনার বাইরে রেখে পাঠকদের চাহিদাকে পাশ কাটিয়ে গেছেন বলে মনে হয়েছে । এসব বিষয় ছাড়া পুরো গ্রন্থটি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের একটি সহজপাঠ হিসাবে সকল পাঠকের কাছে সমাদৃত হবে এটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় । চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকে সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্ট করতে লেখক যে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে সকল পাঠক মনকেই পরিতৃপ্ত করবে ।