21/09/2019
মৃত্যু
- হুমায়ূন আহমেদ (সকল কাঁটা ধন্য করে)
তার পেটে ক্যানসার। দুবার অপারেশন হয়েছে। প্রথমবার দেশে, দ্বিতীয়বার কোলকাতায়। লাভ কিছু হল না। অবস্থা আরো খারাপ হতে লাগলো। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো ব্যাঙ্ককের আমেরিকান হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসা না-কি ভালো। অনেক সময় এমন হয়েছে, দেশের ডাক্তাররা বলেছেন ক্যানসার—ওখানে গিয়ে দেখা গেছে অন্য কিছু।
তিনিও হয়তো তেমন কিছু আশা করছিলেন। কিন্তু ব্যাঙ্ককের ডাক্তাররা বিনয়ের সঙ্গে বললেন, রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। এখন শুধু যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টাই করা যাবে। আর কিছু না।
তিনি হতভম্ব হয়ে ডাক্তারদের কথা শুনলেন। পাশে দাঁড়ানো তার বড় ছেলের দিকে তাকিয়ে নেত্রকোনার ডায়ালেক্টে বললেন–নাক চেপ্টা ডাক্তার, এইতা কি কয়?
ছেলে বলল, বাবা, তুমি কোন চিন্তা করবে না। আমি তোমাকে আমেরিকায় নিয়ে যাব। যে চিকিৎসা কোথাও নেই–সেই চিকিৎসা আমেরিকায় আছে।
তিনি বিরক্ত গলায় বললেন, গাধার মত কথা বলিস না। আমেরিকার মানুষ বুঝি ক্যানসারে মরে না? চল দেশে যাই। মরণের জন্য তৈয়ার হই।
ভদ্রলোক মৃত্যুর প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন।
গল্প-উপন্যাসে এরকম চরিত্র পাওয়া যায়। অমোঘ মৃত্যুর সামনেও দেখা যায় গল্প-উপন্যাসের চরিত্ররা নির্বিকার থাকে। একটা হিন্দী ছবিতে দেখেছিলাম, নায়ক জানতে পেরেছে ক্যানসার হয়েছে। অল্প কিছুদিন বাঁচবে। জানবার পর থেকে তার ধেই ধেই নৃত্য আরো বেড়ে গেল। কথায় কথায় গান। কথায় কথায় হাসি।
বাস্তব কখনোই সেরকম নয়। বাস্তবের অসীম সাহসী মানুষও মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারেন না। মৃত্যুকে সহজভাবে গ্রহণ করা তো অনেক দূরের ব্যাপার ।
আমরা বেঁচে থাকতে চাই। শুধুই বেঁচে থাকতে চাই। যখন শেষ সময় উপস্থিত হয় তখনো বলি–দাও দাও। আর একটি মুহূর্ত দাও। দয়া কর।
গলিত স্থবির ব্যাঙ আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে।
আরেকটি প্রভাতের ইশারায় অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
(আট বছর আগে একদিন)।
যে জীবনের জন্যে আমাদের এত মোহ, এত ভালবাসা, সেই জীবনটা যে কী তাই কি আমরা জানি? নিঃশ্বাস নেয়া, খাওয়া এবং ঘুমানো? না কি তার বাইরেও কিছু?
তত্ত্বকথায় না গিয়ে আগের জায়গায় ফিরে যাই। যে ভদ্রলোকের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার কাছে যাওয়া যাক। ভদ্রলোক শিক্ষকতা করেন। প্রাইভেট কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ান। তাঁর সারাজীবনই কষ্টে কষ্টে গেছে। শেষ সময়ে একটু সুখের মুখ দেখলেন। একজন ছেলে সরকারী কলেজে শিক্ষকতার কাজ পেল। আরেক ছেলে ব্যবসাতে ভালো টাকা পেতে লাগল। একমাত্র মেয়েটি মেডিকেল কলেজে ফোর্থ ইয়ারে আছে। এমন সুখের সময় সব ছেড়ে ছুটে চলে যাবার চিন্তাটাই তো অসহনীয়।
তারচেয়েও বড় কথা, তার যাত্রা এমন এক ভুবনের দিকে যে ভুবন সম্পর্কে কিছুই জানা নেই। সঙ্গী-সাথীও কেউ নেই যে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, ভদ্রলোক মৃত্যুর প্রস্তুতিপর্ব শুরু করলেন অত্যন্ত সহজ ভঙ্গিতে। এরকম ভঙ্গি যে থাকা সম্ভব তাই আমি জানতাম না।
তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি। ধরেই নিয়েছি, মৃত্যুভয়ে ভীত একজন মানুষকে দেখব, যিনি ডুবন্ত মানুষের মত হাতের কাছে যাই দেখছেন তাই ধরার চেষ্টা করছেন। যা ধরতে যাচ্ছেন তাও ফসকে ফসকে যাচ্ছে।
গিয়ে দেখি সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। ভদ্রলোক শুয়ে আছেন ঠিকই, কিন্তু মুখ হাসি হাসি। তার হাতে কি একটা ম্যাগাজিন। তিনি আমাকে দেখে হৈ হৈ করে উঠলেন।
আরে আরে, মিসির আলি চলে এসেছে!
আমি বললাম, কেমন আছেন?
খুবই খারাপ আছি। টাইমলি এসেছো। আর কিছুদিন পরে এলে দেখা হত না। ডাক্তার বলে দিয়েছে, আর বড়জোর একমাস।
আপনাকে দেখে কিন্তু ভালো লাগছে।
ভালো লাগারই তো কথা। চেহারা তো কোনদিন খারাপ ছিল না। হা হা হা।
আমি রীতিমত হকচকিয়ে গেলাম। কি নিয়ে আলাপ করব তাও বুঝতে পারছি না। মৃত্যুকে শিয়রে নিয়ে যিনি বসে আছেন তার সঙ্গে নিশ্চয়ই নাটক নিয়ে কথা বলা যায় না।
আমি বললাম, এখন চিকিৎসা কি হচ্ছে?
তিনি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, সবরকম চিকিৎসা চলছে। আধিভৌতিক চিকিৎসাই বেশি চলছে। বর্তমানে একজন জ্বীন ডাক্তার আমার চিকিৎসা করছেন।
কে চিকিৎসা করছেন?
জ্বীন। জ্বীনদের মধ্যেও ডাক্তার কবিরাজ আছে। তাঁদেরই একজন।
বলেন কি!
যে যেখানে যা পাচ্ছে ধরে নিয়ে আসছে। কবিরাজ, পানিপড়া, মন্ত্র-তন্ত্র সব চলছে। একজন বালক-পীরের সন্ধান পাওয়া গেছে। বয়স নয় বছর। টাঙ্গাইলে থাকে। সে তেলপড়া দিয়েছে। সেই তেলপড়াও পেটে মালিশ করলাম।
কোন লাভ হচ্ছে কি?
লাভ হবে কোত্থেকে? অনেকের ভালো ব্যবসা হচ্ছে। তবে আমি আপত্তি করছি না। যে যা করতে বলছে, করছি। অনেকে আবার বোকার মত জিজ্ঞেস করে–কি খেতে মনে চায়? আমি রাগ করতে গিয়েও রাগ করি না। কি হবে রাগ করে? আমি খাবারের নাম বলি–যা খুব সহজে পাওয়া যায় না–আবার একেবারে দুষ্প্রাপ্যও নয়। যেমন একজনকে বললাম, চালতার আচার খেতে ইচ্ছা করছে। সে অনেক খুঁজে পেতে এক হরলিক্সের টিন ভর্তি চালতার আচার নিয়ে এল। এবং এই আচার খুঁজে বের করতে তার যে কি কষ্ট হয়েছে সেটা সে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে বলল।
ভদ্রলোক কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আমি বললাম, আপনি আর কথা বলবেন না, বিশ্রাম করুন। আমি আবার আসব।
তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বললেন, এসো। এখন কথা বলতে এবং কথা শুনতে ভাল লাগে। আমি ইন্টারেস্টিং কিছু শুনতে চাই। কেউ ইন্টারেস্টিং কিছু বলতে পারে না। সবাই আমার কাছে এখন আসে তাদের সবচে বোরিং গল্পটা নিয়ে।
আমি চলে এলাম। চার-পাঁচ পর দিন তার ছেলে আমাকে এসে বলল, বাবার শরীর খুব খারাপ করেছে। আপনাকে শেষ দেখা দেখতে চায়।
আমি তৎক্ষণাৎ গেলাম। ভদ্রলোকের মুখ এখনো হাসি-হাসি। আমি বললাম–কেমন আছেন?
তিনি উত্তর দিলেন না। সম্ভবত এই প্রশ্নের উত্তর দিতে তার ইচ্ছা করছে না। আগেরবার আমার সঙ্গে আধশোয়া হয়ে গল্প করছিলেন–এবার শুয়েই রইলেন। ছেলেকে বললেন পাশ ফিরিয়ে দিতে। ছেলে পাশ ফিরিয়ে দিল। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, যাত্রার সব আয়োজন সম্পন্ন করেছি। একটা ইচ্ছা ছিল–আমার স্কুলের সব ছাত্রদের একবেলা দাওয়াত করে খাওয়াব–সে ইচ্ছাও পূর্ণ হচ্ছে। শনিবার দুপুরে এরা খাবে।
বাহ, ভাল তো!
তুমি এসো শনিবারে। তোমাকে দাওয়াত করছি না। দেখার জন্যে আসবে। ঐদিন শুধু বাচ্চাদের দাওয়াত।
জ্বি, আমি আসব।
তিনি অল্প খানিকক্ষণ কথা বলার পরিশ্রমেই হাঁপাতে লাগলেন। আমি বসে রইলাম। বিস্তর লোকজন আসছে-যাচ্ছে। অধিকাংশই কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলছে। তিনি সবার সঙ্গেই সহজভাবে একটা-দুইটা করে কথা বললেন। আমাকে নিচু গলায় বললেন, আল্লাহ পাক নিজেই মনে হয় সব মানুষকে মৃত্যুর জন্যে তৈরি করেন। এখন আর মানুষের সঙ্গ আমার ভালো লাগে না, অথচ কয়েকদিন আগেই অন্য ব্যাপার ছিল।
মৃত্যুর জন্যে আপনি তাহলে তৈরি?
হ্যাঁ।
ভয় লাগছে না?
লাগছে। আবার এক ধরনের কৌতূহলও হচ্ছে। এই প্রথমবার আমি এমন একটা জিনিস জানব যা তোমরা কেউই জানো না। মৃত্যু কি সেটা জানা যাবে। ঠিক না?
জ্বি ঠিক।
একটা মজার ব্যাপার কি লক্ষ্য করেছ–জন্ম সময়ের স্মৃতি মানুষ অন্যকে বলতে পারে না, আবার মৃত্যুর কথাও বলতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু দুটা স্মৃতিই এমন–যা অন্যকে দেয়া যায় না। দুটোই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত স্মৃতি।
ঠিকই বলেছেন।
অসুস্থ মানুষের সামনে বসে চা খাওয়া যায় না। আমাকে খেতে হল। তিনি চা না খাইয়ে ছাড়বেন না। চলে আসবার সময় হঠাৎ বললেন–তুমি জিজ্ঞেস করছিলে ভয় লাগছে কি-না। হা লাগছে, প্রচণ্ড লাগছে। তবে এক ধরনের ভরসাও পাচ্ছি।
ভরসা পাচ্ছেন কেন?
ভরসা পাচ্ছি, কারণ পবিত্র কোরান শরীফে কয়েকটা অসাধারণ আয়াত আছে। ঐ আয়াতগুলি থেকে ভরসা পাচ্ছি। তুমি তো লেখালেখি কর–কোন এক ফাঁকে এই আয়াত কটা ঢুকিয়ে দিও। এতে মৃত্যুপথযাত্রী মানুষরা ভরসা পাবে।
আমি বললাম, আয়াত কটি বলুন আমি লিখে নিচ্ছি।
সুরা আল-ওয়াকিয়া, আয়াত ৮৪ ও ৮৫—
“একজন মানুষ যখন মারা যায়– তোমরা তখন তাকে ঘিরে বসে থাকো। কিন্তু তোমরা জান না, তোমরা ঐ মৃত্যুপথযাত্রীর যতটা কাছে বসে থাকো আমি তারচেয়েও অনেক কাছে থাকি।”
ভদ্রলোক শান্তস্বরে বললেন–মৃত্যুর সময় পরম করুণাময় যদি আমার পাশে থাকেন, তা হলে আর ভয় কি?