18/06/2024
#ভিলেনস_সিরিজ--
বাংলাদেশের ফ্যান্টাসি সাহিত্যের অগ্রযাত্রায় যে কজন অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন,তাদের মধ্যে জুলিয়ান ভাই অন্যতম। ভিলেনস সিরিজের ভূমিকা অংশটুকুও তার লেখা--
ভূমিকা পড়লে অনেকেই সিরিজটির কলেবরের পাশাপাশি ফ্যান্টাসি সাহিত্যকে ভিন্ন এক আঙ্গিকে চিনতে ও বুঝতে পারবেন।
___________________________________
🔥🔥🔥🔥
এই প্রথম কোনো বইয়ের ভূমিকা লিখলাম। ফ্যান্টাসি জনরার বই নিয়ে আমার প্যাশন সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগত। বাংলাদেশে এই জনরার প্রচার এবং প্রসারে আমার অবদানকে অন্যরা কেমন নজরে দেখে জানি না, কিন্তু আমি বড় নজরে দেখি। তাই বিশ্বখ্যাত সুপারহিরো ফ্যান্টাসি সিরিজ 'দ্য ভিলেনস' এর জন্য ভূমিকা লেখার প্রস্তাব পেয়ে বেশ ভালো লেগেছিলো।
সিরিজের দুটো বই 'ভিশাস' এবং 'ভেঞ্জফুল' প্রকাশিত হতে চলেছে অনির্বাণ প্রকাশনী-Anirban Prokashoni থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন Sultan Azam Sazal
আগ্রহীরা সংগ্রহ করতে পারেন! প্রি-অর্ডার চলছে সকল বুকশপে!
--------------------------------
ভূমিকা
ফ্যান্টাসি জনরার একজন পাড় ভক্ত হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে ফ্যান্টাসি জনরার সাম্প্রতিক প্রসার দেখে আমি খুবই আনন্দিত। বর্তমানে বিভিন্ন ধরণের ফ্যান্টাসি নিয়ে কাজ হচ্ছে, লেখক থেকে শুরু করে অনুবাদকরা ফ্যান্টাসির নানা সাব-জনরা নিয়ে কাজ করছে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, একটা জনরা নিয়ে যত বেশি কাজ হবে, তত বেশি মানুষ সেইদিকে আকৃষ্ট হবে এবং যত বেশি মানুষ আকৃষ্ট হবে, তত বেশি ডাইভার্সিটি আসবে। যে বইগুলো নিয়ে লিখছি এখন, সেগুলোও এই ডাইভার্সিটি এর নতুন সংযোজন।
সরাসরি বইয়ের কথায় যাবার আগে ফ্যান্টাসি নিয়ে একটু আলাপ করি।
ফ্যান্টাসি সাহিত্যের এমন একটা জনরা যেখানে লেখক নিজের কল্পনাশক্তিকে বাঁধনহারা হতে দেন নিজের গল্পটা বলতে গিয়ে। তবে একটা কথা! লেখক তার কল্পনাকে অসীম সম্ভাবনার দিকে ঠেলে দেন ঠিকই, তবে লাগাম বলি আর লাটাই বলি, তা কিন্তু থাকে লেখকের হাতে। এখানে ভুল ধারণা করার কোনো সুযোগ নেই যে, ফ্যান্টাসি বলে লেখক বুঝি যা ইচ্ছা অবাস্তব জিনিস লিখতে পারেন। না, পারেন না। ফ্যান্টাসি সাহিত্যে লেখক নিজের কল্পনার স্বাধীনতা নেন ঠিকই, কিন্তু নিজেই নিজের জন্য একটা সীমানা নির্ধারন করেন, যা তিনি নিজেই অতিক্রম করেন না; নিজেই নিজের জন্য কিছু নিয়ম-নীতি তৈরি করেন, যা তিনি নিজেই ভাঙতে পারেন না। যদি সীমানা অতিক্রম করেন কোনো লেখক, বা নিজের তৈরি করা যুক্তিকে নিজেই ভঙ্গ করেন, তবে পাঠকেরা তাদের Suspension of disbelief কে আর ধরে রাখতে পারবে না, আর সেই লেখাটা সার্থক ফ্যান্টাসি হয়ে উঠবে না।
কল্পনাকে আশ্রয় করে লেখক কখনো কখনো সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতের কাহিনী পাঠকদের সামনে তুলে ধরেন, আবার কখনো আমাদের পরিচিত জগতেরই রোমাঞ্চকর এবং আপাত অসম্ভব বিষয়কে ভিত্তি করে গড়ে তোলেন নিজের বইয়ের জগত। বিদেশে, বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় সাহিত্যের এই জনরা নিয়ে আধুনিক কাজ আরও অনেক আগে শুরু হলেও আমাদের দেশে এই জনরার পরিচিতি খুব একটা নেই, বা বিশাল কোনো পাঠকগোষ্ঠী নাই, যা ফ্যান্টাসি ভিন্ন অন্যান্য জনরাতে ঠিকই আছে। পাঠক না থাকার পিছে অবশ্য কিছু বাস্তুব কারণ রয়েছে, যার একটা হলো এই জনরায় বাংলাতে বেশি কাজ না থাকা, হোক মৌলিক বা অনুবাদ। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু কাজ হচ্ছে দেখে আশা করা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে একটা জনপ্রিয় সাহিত্য জনরা হতে চলেছে ফ্যান্টাসি।
স্পেকুলেটিভ ফিকশনের মধ্যে ফ্যান্টাসি জনরারই বোধহয় সবচেয়ে বেশি সাব-জনরা আছে। ফ্যান্টাসি ফিকশনের ব্যপ্তি অনেক বড়। ফ্যান্টাসির অনেকগুলো সাব-জনরার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু সাব-জনরা হলো—হাই ফ্যান্টাসি, লো ফ্যান্টাসি, হিস্টোরিক্যাল ফ্যান্টাসি, রোমান্টিক ফ্যান্টাসি, কনটেম্পোরারি ফ্যান্টাসি, সোর্ড অ্যান্ড সর্সারি, গ্রিমডার্ক ফ্যান্টাসি, গথিক ফিকশন, মিথিক ফিকশন, ফ্যান্টাসি অব ম্যানারস, আরবান ফ্যান্টাসি, সুপারহিরো ফিকশন প্রভৃতি। প্রত্যেকটা জনরাতে অসংখ্য বই রয়েছে, যেগুলো বেশ জনপ্রিয়।
সুপারহিরো ফিকশন এমন একটা সাব-জনরা যাকে বৈজ্ঞানিক বাস্তবতার নিরিখে হার্ড ফ্যান্টাসি আর সফট সায়েন্স ফিকশনের মাঝামাঝি রাখা যায়। এখানে এমন কিছু মানুষ থাকে যারা সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রভূত শক্তির অধিকারী হয়। কমিক বুকগুলোর কথা চিন্তা করুন। আমরা সবাই সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান, হী-ম্যান, গ্রিন ল্যান্টার্ন, এক্স-মেন, টিনেজ মিউট্যান্ট নিঞ্জা টার্টলসহ আরও কত কত সুপারহিরোকে চিনি। এদের ক্ষমতাগুলোর দিকে তাকালে প্রায়শই দেখতে পাবেন যে সেখানে ফ্যান্টাসি (অবাস্তব) আর সায়েন্স (বাস্তব) এর মধ্যকার একটা গ্রে এরিয়া থাকে। আমরা সেগুলো উপভোগ করার জন্য আমাদের Suspension of disbelief টা ধরে রাখি।
ফ্যান্টাসি থ্রিলার রাইটার ভি ই শোয়াব-এর লেখা বিখ্যাত সুপারহিরো ফ্যান্টাসি সিরিজ- ‘দ্য ভিলেনস’। এই সিরিজের প্রথম উপন্যাস ‘ভিশাস’ তাকে খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে দেয়। ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এর মতো পত্রিকায় এই বই নিয়ে উচ্চ প্রশংসা করা হয়। ‘পাবলিশার্স উইকলি’ এই বইকে তাদের ২০১৩ সালের সেরা বইয়ের তালিকায় স্থান দেয়। এবং সাথে এটাও বলে যে, শোয়াব এর তৈরি করা চরিত্রগুলো ক্লিশে তো নয়ই বরং অনেক বাস্তবিক। সুতরাং, বুঝতেই পারছেন যে বইটা আর দশটা বইয়ের মতো নয়। আর এই সিরিজের দ্বিতীয় এবং শেষ বই ‘ভেঞ্জফুল’ দিয়ে নিজের খ্যাতির মান ধরে রাখেন শোয়াব। সুপারহিরো ফ্যান্টাসি জনরার অনবদ্য এক সংযোজন এই সিরিজ।
সিরিজের দুই মূল চরিত্র ভিক্টর এবং ইলাই ভার্সিটি জীবনের রুমমেট। দুজনেই তুখোড় মেধাবী, উদ্ধত স্বভাবের, আবার একই সাথে ব্যক্তিগত জীবনে ভীষণ একাকী। চরিত্রের এই মিলের কারণে দুজনের মধ্যে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। শেষবর্ষে এসে থিসিস করতে গিয়ে এক অভূতপূর্ব আবিষ্কার করে তারা। তারা বুঝতে পারে, সাধারণ মানুষের পক্ষে অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সম্ভব। আর সেই সম্ভাব্যতার পরীক্ষা করতে গিয়েই ঘটে এক চরম বিপত্তি। বন্ধু থেকে শত্রুতে পরিণত হয় তারা। নিতে চায় প্রতিশোধ। কী হয়েছিলো তাদের যে এমন অবস্থায় পতিত হলো তারা? কেন ইলাই দুনিয়া থেকে অসাধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন মানুষদের সরিয়ে দেবার মিশনে নেমেছে? এরকম নানা প্রশ্নের উত্তর আছে ‘ভিশাস’ বইতে।
"Plenty of humans were monstrous, and plenty of monsters knew how to play at being human."
ভালো মানুষ কি আসলেই সবদিক দিয়ে ভালো, আর খারাপ মানুষের কি কোনো ভালো গুণ নেই? ভালো-মন্দের সংজ্ঞা কী? ভালো আর মন্দের ভিতরের যে Thin Line আছে, এই জায়গার উপর কাজ করেছেন শোয়াব। উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতারণা, ঈর্ষাকাতরতার মতো ব্যাপারগুলো আমাদের জীবনকে খুব সহজেই যে উল্টেপাল্টে দিতে পারে, তা আমরা অনেকসময় নিজেরাও যেন উপলব্ধি করতে পারি না।
Hell hath no fury like women seeking vengeance against the men who wronged them.
সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘ভেঞ্জফুল’এ ভিক্টর আর ইলাই এর পাশাপাশি দেখা পাওয়া যায় আরেক শক্তশালী চরিত্র মার্সেলার। নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরা মার্সেলা রিগিনসের হাতে এসেছে এক অসীম ক্ষমতা- যে ক্ষমতার বলে ধ্বংস হয়ে যায় সবকিছু। আর সেই ক্ষমতার জোরে পুরো পৃথিবীকে নিজের নিয়ন্ত্রণে আনার স্বপ্ন দেখছে সে। মেরিট শহরকে নিজের পায়ের তলায় নিয়ে আসা তো তার বাম হাতের খেল। কুখ্যাত মাফিয়া বসের স্ত্রী থেকে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠা মার্সেলা এখন তৈরি করতে চায় নিজের সাম্রাজ্য। নিতে চায় প্রতিশোধ। আর তার এই কাজের সঙ্গী হিসেবে যোগ দেয় বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী আরো একগুচ্ছ এক্সট্রাঅর্ডিনারি। কিন্তু তার দলকে সম্পূর্ণ করতে প্রয়োজন আরো শক্তিশালী দুজন মানুষকে---ভিক্টর এবং ইলাই।
দ্বিতীয় বইতে যেন নারী চরিত্রের ভূমিকাই বেশি। প্রতিশোধে উন্মত্ত শক্তিশালী নারী আসলেই বেশ ভয়ঙ্কর হয় স্বভাবে। বইতে কিছু চরিত্রের পূর্বঘটনা বইকে আরও গভীর এবং শক্তিশালী করেছে।
অনুবাদক হিসেবে ঝিলম নদী নিজের জাত চিনিয়েছেন আগেই। তার অনুবাদে দ্য কুইন’স থিফ সিরিজ বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। কাজ করতে থাকলে সবারই কাজের মান ধীরে ধীরে উন্নত হয়। আর ঝিলম নদী সেটাই প্রমাণ করেছেন এই সিরিজে। সহজ, সাবলীল ভাষায় অনুবাদ করেছেন তিনি। একজন ঋদ্ধ ফ্যান্টাসি পাঠক হিসেবে তিনি যেন কাহিনী ‘বিটুইন দ্য লাইন’ পড়তে পারেন। অনুবাদের সময় তাই তিনি নিজের মতো করে কিছু ইনপুট দেবার চেষ্টা করেন, যা বাড়তি পাওনা হিসেবে কাজ করে বলেই মনে হয় আমার। একটা সেমি-রূপান্তর ধরণের কিছু হয় ব্যাপারটা।
পরিশেষে এটাই বলতে চাই পাঠকদের যে, বেশি বেশি ফ্যান্টাসি পড়ুন। জনরাটাকে সুযোগ দিয়ে দেখুন, দেখবেন যে আপনার প্রিয় জনরায় পরিণত হয়েছে এটা। ‘দ্য ভিলেনস’ সিরিজের দুইটা বইয়ের সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করছি। সবাইকে ধন্যবাদ।
জুলিয়ান
আজিমপুর, ঢাকা