04/06/2019
ঘটনার আড়ালেঃ ‘১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে’
‘১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে’ এবং কিছু কথা- শিরোনামে ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৪ দৈনিক জনকন্ঠে অধ্যাপক ড. আবদুল মান্নান চৌধুরীর একটি উপ-সম্পাদকীয় ছাপা হয়। যাতে তিনি উল্লেখ করেন, “প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম বইটির লেখক হিসেবে মঈদুলকে চিহ্নিত করেছিলেন।” আলোচক অনুষ্ঠানে বইয়ের লেখক হিসেবে বারবার মঈদুলের নাম বলছিলেন।
লেখক এ কে খন্দকার নিজেও তার বইয়ের ভূমিকায় মঈদুল হাসানের ২টি বই থেকে সাহায্য নেয়া এবং মূল্যবান পরামর্শ ও সহযোগিতার জন্য বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে গিয়ে প্রথমেই মঈদুল হাসানের নাম উল্লেখ করেছেন। ২০০৯ নভেম্বরে প্রথমা প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ বইয়ের ভূমিকা থেকে জানা যায়, ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ৯ টি পৃথক দিনে জনাব এ কে খন্দকার, জনাব মঈদুল হাসান এবং এস আর মির্জার মাঝে হওয়া কথোপকথন অডিও ক্যাসেটে ধারণ করা হয় এবং পরবর্তিতে তার অনুলিখন করে ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ বইটি প্রয়োজনীয় সংশোধন ও সম্পাদনা করা হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। বয়স্কজনিত কারণে এ কে খন্দকারের স্মৃতিভ্রম হওয়া খুব স্বাভাবিক ঘটনা, তিনি নিজেই ‘১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে’ বইটির ভূমিকায় তার উল্লেখ করেছেন। বইটির প্রথম প্রকাশের পর দেখা যায় তিনি লিখেছেন বঙ্গবন্ধু নাকি ৭ মার্চের ভাষণটি ‘জয় পাকিস্তান’ বলে শেষ করেছিলেন! সমগ্র দেশে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের ঝড় উঠলে, ৫ সেপ্টেম্বর প্রথমা প্রকাশন বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বের করে এবং তাতে কোনরূপ দুঃখ প্রকাশ না করে কথিত এক সংশোধনী এনে বলেন, বই প্রকাশের পর চারদিনে প্রথম সংস্করণের সকল কপি নিঃশেষিত হয়েছে, ... ৩২ পৃষ্ঠার দ্বিতীয় স্তবকে, “এই ভাষণের শেষ শব্দ ছিল ‘জয় পাকিস্তান’ ” আসলে তা হবে, “এই ভাষণের শেষ শব্দগুলো ছিল ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’।”
১ জুন ২০১৯ সংবাদ সম্মেলন করে এই অসত্য তথ্যের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন লেখক এ কে খন্দকার এবং তার অনুমতি নিয়ে তার স্ত্রী সংবাদিকদের জানান যে, মঈদুল হাসান এবং জাফররুল্লাহ চৌধুরীসহ একটি চক্র তাকে ঐ মিথ্যা তথ্য সংশোধন না করতে প্ররোচিত করে আসছিলো। বইটির প্রথম প্রকাশের পরপরই উদ্ভুত পরিস্থিতে অনুতপ্ত লেখকের পক্ষ থেকে তার স্ত্রী প্রকাশক মতিউর রহমানের সাথে যোগাযোগ করলেও ইতিবাচক সাড়া মিলেনি বলে জানা যায়। উপরোন্তু, লেখকের অনুমতি ছাড়াই প্রকাশক দাম্ভিকতার সাথে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণে আরও অধিকতর অসত্য ও বিকৃত তথ্য দিয়ে উপস্থাপণে উৎসাহি লক্ষ্য করা যায়।
কেন এই বিভ্রাট?
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে অন্তত দুটি পক্ষ রয়েছে, যাদের একটি হচ্ছে পাকিস্তান-আমেরিকাপন্থী সক্রিয় বিরোধীতাকারী অন্যটি হচ্ছে চীনপন্থী বামেদের একটি বড় অংশ যারা মুক্তিযুদ্ধকে বলে এসেছে দুই কুকুরের লড়াই। এরা দুই পক্ষই স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের ঘোর বিরোধী। প্রথমপক্ষটি ১৯৭১ এর আগে থেকেই বাংলাদেশের বিরোধীতা করে এসেছে, এই বিরোধীতা মোটা দাগে রাজাকারি বলে চিহ্নিত। দ্বিতীয় পক্ষটি বাংলাদেশ বাস্তবতাকে মেনে নিলেও এদের অশুভ কার্যক্রম পরিচালিত হয় মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক জায়গাগুলোতে। এদের প্রধান কাজ হচ্ছে ইনিয়ে বিনিয়ে পাকিস্তানের পক্ষে বলা, রিকনসিলিয়েশন থিওরি দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃতরূপে উপস্থাপণ করা, মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে বিভক্তি তৈরি করা, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের অবদানকে খাটো করে দেখানো এবং অসত্য অসার বক্তব্যের মাধ্যমে বিভ্রান্তি তৈরি করা।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর দল আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করার অপচেষ্টায় একটি মহল লিপ্ত সেই শুরু থেকেই। এদের সংঘবদ্ধ অপপ্রচারের বলি হয়েছেন বহু খ্যাতিমান লেখক, ইতিহাসবিদ, রাজনীতিক। যাদের মাঝে কবি শামসুর রহমান, বিচারপতি হাবিবুর রাহমান, আহমেদ ছফা, নির্মল সেন প্রমুখ প্রত্যেকেই তাদের জয় পাকিস্তান/ জিয়ে পাকিস্তান সংক্রান্ত বক্তব্য প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। যারা ‘জয় পাকিস্তান’ দিয়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করেছেন বলতে চেয়েছেন তারা কেউই কোন প্রমাণ উপস্থাপণ করতে সক্ষম হননি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ তার ‘জোছনা ওঁ জননীর গল্প’ বইয়ের ভূমিকা (পূর্ব কথা) আকারে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কিছু ঐতিহাসিক বিভ্রান্তি বর্ননা করার সময় জিয়ে পাকিস্তান সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে, “সমস্যা হল আমি নিজে ৮ এবং ৯ই মার্চের সমস্ত পত্রিকা খুঁজে এরকম কোন তথ্য পাই নি। তাহলে একটি ভুল ধারনা কেন প্রবাহিত হচ্ছে?”
তাহলে কারা তৈরি করছে বিভ্রান্তি?
২০০৯ সালের মার্চে প্রথমআলোর সহযোগী প্রতিষ্ঠান প্রথমা প্রকাশন এর যাত্রা শুরু হয়। প্রথমআলো সম্পাদক মতিউর রহমান যার প্রকাশক। একই গ্রুপের ইংরেজি দৈনিক ডেইলিস্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। যিনি প্রথমালোর প্রকাশক ছিলেন। প্রথমা প্রকাশনের শুরুর দিকের একটি বই, “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর”। বইটির লেখক আবুল মনসুর আহমদ ডেইলিস্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বাবা।
“বাংলাদেশের স্বাধীনতায় পাকিস্তানও ভাঙ্গে নাই, দ্বিজাতি তত্ত্বও মিথ্যা হয় নাই। এক পাকিস্তানের জায়গায় লাহোর প্রস্তাব মত দুই 'পাকিস্তান' হইয়াছে। ভারত সরকার লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়নে আমাদের সাহায্য করিয়াছেন। তারা আমাদের কৃতজ্ঞতার পাত্র।” - আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, আবুল মনসুর আহমদ, পৃ:৬৩৪
এই বইটি মুদ্রণ করে প্রথমা লিখেছে, “কৌতূহলী পাঠক, ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের কাছে বহুদিন ধরেই এ বই একটি মূল্যবান ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-আকর হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রথমা প্রকাশন থেকে গুরুত্বপূর্ণ এ বইটির একটি সুমুদ্রিত সংস্করণ প্রকাশ করতে পেরে আমরা আনন্দিত।” এই হলো উপরোল্লেখিত প্রকাশকদের “মূল্যবান ও নির্ভরযোগ্য তথ্য-আকর” এর নমুনা! পাঠকের মনে যদি এতদিন খচখচানি থেকে থাকে যে কেন ডেইলিস্টার পত্রিকাতে পাকিস্তান দিবসগুলোতে সমগ্রপাতা জুড়ে ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়, আশা করি তা পরিস্কার হয়েছে।
কে লিখেছে ‘১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে’?
লেখক সম্বন্ধে জানার আগে আমাদের কিছু তথ্য জানতে হবে যা আমাদের ঐ বইটি প্রকাশের পটভূমি এবং মূল ক্রিয়ানকদের কাছে পৌছাতে সাহায্য করবে। এ কে খন্দকার বইতে উল্লেখ করেছেন যে বই প্রকাশের বছরখানেক আগে থেকে তিনি লেখার কাজ হাতে নিয়েছেন। তার কাছে আত্মজীবনী লেখার মতো তথ্য উপাত্ত কিছুই ছিলো না, কারণ ১৯৭৫ সালের পর তিনি তার ভাষ্যমতে, ১২ বছরের জন্য দেশের বাইরে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তার লেখা নোটগুলো এক আত্মীয়ের কাছে রেখে যান যা তিনি আর ফেরত পাননি। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে এবং সংরক্ষণের অভাবে সেগুলো নাকি নষ্ট হয়ে যায়। তাহলে বই লিখতে তাকে অবশ্যই অন্যের স্মৃতির স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে।
আগস্ট ২০১৪ তে তিনি বইটি প্রকাশ করেছেন যার বছরখানেক আগে বাংলাদেশে টক অব দ্যা কান্ট্রি ছিলো ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের বিবিধ অনিয়ম, তার কারণে বাংলাদেশের জিএসপি সুবিধা স্থগিত ও পদ্মাসেতু প্রকল্পকে অর্থ না দিতে তার লবিং ইত্যাদি। পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে ১/১১ পরবর্তি সময়ে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে রাজনৈতিক দল (নাগরিক শক্তি) গঠনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, যার প্রস্তাবিত মহাসচিব ছিলেন ডেইলিস্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। একই সময়ে বাংলাদেশের তৎকালীন সদ্য সমাপ্ত সংসদের সরকার ও বিরোধী দলের দুই প্রধান নেতৃত্বকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করার পক্ষে প্রথমআলো সম্পাদক মতিউর রহমানের ধারাবাহিক কলামের কথা নিশ্চয়ই সবার মনে আছে। ২০১৪ নির্বাচনকে সামনে রেখে একই চক্র যা বাংলাদেশে পশ্চিমা একটি শক্তিধর দেশের অশির্বাদপুষ্ট তৃতীয় শক্তি হিসেবে পরিচিত তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে অপপ্রচারের মিশন নিয়ে নামে যেনো আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করা সম্ভব হয়।
নির্ভরযোগ্যসূত্রে জানা যায়, প্রথমআলোর যুগ্ম-সম্পাদক মিজানুর রহমান খান সহযোগী হিসেবে থাকলেও এ কে খন্দকারের বইটির মূল সম্পাদনার কাজটি করেন আলী রীয়াজ। যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এই লেখক ২৩ আগস্ট ২০১৪ ঢাকা আসেন। বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায় বইটি প্রকাশ করতেই মূলত এই লেখক ঢাকা আসেন এবং কাল বিলম্ব না করে বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের সাথে সাথেই তিনি দেশ ত্যাগ করেন। ১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তার ফেসবুকে এক খন্দকারের বইটির মোড়কের একটি ছবি প্রকাশ করে লিখেন, "If you are in Dhaka and free tomorrow Tuesday at 4:30 pm, please join the launching of A K Khandaker's book on 1971 at Bengal Gallery - where I will be speaking briefly."
২ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ‘১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে’ বইটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে বইটি নিয়ে তার বিশ্লেষণ সেইদিন দিবাগত রাত ১২ টা ২৪ মিনিটে, ‘মুক্তিযুদ্ধের বই-ইতিহাসের এক আকরগ্রন্থ’ শিরোনামে প্রথমআলোর অনলাইনে প্রকাশ পায়, যা পরদিন ছাপার অক্ষরে প্রথমআলোর উপ-সম্পাদকীয় পাতায় আসে। একই দিনে প্রথমআলো সম্পাদক মতিউর রহমানের লেখা ‘সরকারের হস্তক্ষেপ বন্ধ হোক - গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সংকট’ শিরোনামে সম্পাদকীয় ছাপা হয়। বই প্রকাশের প্রায় সাথে সাথে আলী রীয়াজ কীভাবে বইয়ে পৃষ্ঠা ধরে ধরে রিভিউ করছেন সে প্রশ্নে জবাব মিলেনি। ৩ সেপ্টেম্বর বিকেলেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে দেশ ছেড়ে যায় আলী রীয়াজ। উল্লেখ্য, ড. কামালের মেয়ে সারা হোসেনের স্বামী ডেভিড বার্গম্যান কর্তৃক মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের দায়ে আদালত কর্তৃক সাজার বিপক্ষে এবং বার্গম্যানের পক্ষে বিবৃতিদাতা ৫০ জনের মাঝে এই আলী রীয়াজ রয়েছেন, রয়েছেন জাফরুল্লাহ চৌধুরীও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের লাশ ফেলতে চাওয়া নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার প্যানেলে ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ আলী রীয়াজ । ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পার্সোনাল ফটোগ্রাফার শহিদুল আলমের স্ত্রী রেহনুমা আহমেদ ও গীতি আরা নাসরিনের একান্ত ঘনিষ্ট আলী রীয়াজ । ওয়াশিংটন ডিসিতে তাদের বিভিন্ন আড্ডায় একত্রে দেখা যায়।
আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করার মিশনে মতিউর রহমানের প্রথম পছন্দের তালিকায় সাবেক সেনা প্রধান মেজর জেনারেল সফিউল্লাহ থাকলেও গ্রহনযোগ্যতার ঘাটতি মেটাতে এ কে খন্দকারকেই বেছে নেয়া হয়। তবে, বইটির প্রকাশনা উৎসবে সরব উপস্থিত থেকে সকলের দৃষ্টি কাড়েন সফিউল্লাহ। বই প্রকাশের বিষয় জানা যায়, প্রথমা ব্যবস্থাপক জাফর আহমদ রাশেদ ‘মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর’ বইয়ে ব্যবহৃত অডিও আলাপচারিতার একটি কপি দেন মিজানুর রহমান খানকে। খান, সম্পাদক মতিউর রহমান এ বিষয়ে ভিডিও কনফারেন্সে আলী রীয়াজের সাথে বিস্তারিত আলোচনা করেন, এরপরই কাজ শুরু হয়। আলোচনার অংশ খন্ডিত আকারে দেশের বাইরে প্রফেশনাল স্টুডিওতে এমনভাবে এডিট করা হয় যাতে মনে হবে এ কে খন্দকারই কথোপকথনে জয় পাকিস্তান প্রসঙ্গটিসহ বিতর্কিত অংশগুলো বলেছেন। বাস্তবতা হচ্ছে বইয়ের বিতর্কিত একাধিক অংশ সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহল ছিলেন না লেখক। বিষয়গুলো বাদ দেবার উদ্যোগ নেয়া হলে পরবর্তিতে মঈদুল এবং ডা. জাফরুল্লাহর মাধ্যমে সেই অডিওর বিষয়টি প্রকাশ করে দেয়া হবে হুমকি দিয়ে সংশোধন না করার জন্য চাপ দিতে থাকেন প্রকাশনের লোকজন। বই প্রকাশের পর এ কে খন্দকারকে মঈদুল হাসান বলেন, 'গুলি ছুড়ে দিয়েছো, এখন কি গুলির পেছনে দৌড়াবা?'
বইটি এ কে খন্দকারের লেখা নয়
প্রখ্যাত লেখক, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল ‘১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে’ সম্পর্কে বলেন, বইটি পড়ে আমার ভেতরে এক ধরনের অস্বস্তি খচখচ করছিল, বারবার মনে হচ্ছিল, সত্যিই কি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে খন্দকার এই বইটি নিজের হাতে কাগজের উপর কলম ঘষে ঘষে লিখেছেন? আমার কৌতূহলটি মেটানোর জন্যে আমি ‘প্রথম আলো’র প্রকাশনা সংস্থা ‘প্রথমা’কে ফোন করলাম,
পাঠকদের জন্য সেই টেলিফোন সংলাপের শ্রুতি লিখন উপস্থাপণ করছি।
মুহম্মদ জাফর ইকবালঃ হ্যালো, আমি কি প্রথমা প্রকাশনে কথা বলছি?
অপরপ্রান্তঃ জ্বি, আসসালামু আলাইকুম আমি প্রথমা প্রকাশন থেকে বলছি, আপনাকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি?
মুহম্মদ জাফর ইকবালঃ আমি মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বলছি। একটি বইয়ের বিষয়ে কথা বলতে চাচ্ছি।
অপরপ্রান্তঃ স্যার, একটু হোল্ড করুন। আমি আমাদের ম্যানেজারকে দিচ্ছি।
মুহম্মদ জাফর ইকবালঃ আমি লাইনে আছি।...
অপরপ্রান্তঃ আসসালামু আলাইকুম স্যার আমি রাশেদ বলছি প্রথমা থেকে, ..
মুহম্মদ জাফর ইকবালঃ আপনাদের একটি বই বের হয়েছে ‘১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে’। বইটির লেখক এ কে খন্দকারের হাতে লেখা পাণ্ডুলিপিটি কি আমি এক নজর দেখতে পারি?
জাফর আহমদ রাশেদঃ উম.। স্যার, বিষয়টি হলো সেভাবে হাতে লেখা পুরো পাণ্ডুলিপি তো আমাদের কাছে নেই। কিছু রয়েছে। তবে কি স্যার, এ কে খন্দকার সাহেবের সাথে আলাপ-আলোচনা করেই পুরোটা প্রস্তুত করা হয়েছে ..
মুহম্মদ জাফর ইকবালঃ প্রস্তুত করার হয়েছে মানে!
জাফর আহমদ রাশেদঃ মানে স্যার এই বইয়ের পুরো বিষয়বস্তুর সাথে তিনি পুরোপুরি একমত, সে রকম সাক্ষ্য প্রমাণ আমাদের কাছে আছে।
মুহম্মদ জাফর ইকবালঃ বই কীভাবে ‘প্রস্তুত’ হয় আমি জানতে খুবই আগ্রহী। অনুগ্রহ করে বই প্রস্তুত করা সংক্রান্ত একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট কি আপনাদের কাছে পেতে পারি?
জাফর আহমদ রাশেদঃ (একটু ইতস্তত) স্যার আমি আমার উপর মহলে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি। এছাড়া আর কোন বিষয়ে কি সাহায্য করতে পারি?
মুহম্মদ জাফর ইকবালঃ জ্বি না, আপনাকে ধন্যবাদ।
জাফর আহমদ রাশেদঃ আপনাকেও ধন্যবাদ স্যার।
বাংলাদেশকে আলী রীয়াজ ও তার বন্ধুরা কী দিতে পরেছেন কিছু ভ্রান্ত ইতিহাস বর্ণনা ছাড়া? এসব বিভ্রান্তি তৈরিতে তাদের কী লাভ হচ্ছে? নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশিদের তারা কি বোকা মনে করেন? নিজের দেশের প্রভুত ক্ষতি সাধনের চেষ্টায় থাকলেও আলী রীয়াজ এক বক্তব্যে বলেন,
‘যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশিরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার পরেও নিজেদের এ সমাজের অংশ মনে না করবেন, তত দিন তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার নেতৃত্বে আসতে পারবেন না। আগে যে সমাজে আমাদের অবস্থান, সে সমাজকে কিছু দেওয়ার কাজে নিজেকে যুক্ত করতে হবে। এই যুক্ত হওয়ার কাজটা এখনো ঠিকমতো হচ্ছে না দেখে আমেরিকার মূলধারায় বাংলাদেশিদের কাঙ্ক্ষিত উত্থান ঘটছে না।’
দেশপ্রেমে ঘাটতি থাকলেও ভদ্রলোকের পরদেশ প্রেম সত্যি অতুলনীয়! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিরোধীতা করে যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান রক্ষায় সপ্তম নৌ বহর পাঠায়, সে যুক্তরাষ্ট্র প্রেমিকের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের কেমন সঠিক ইতিহাস যে বর্ণিত হবে তা সচেতন পাঠক মাত্রই অনুমান করতে পারেন। জাতির জন্ম ইতিহাস সত্য ও তথ্যনির্ভর হওয়া উচিত বলে ‘১৯৭১ ॥ ভেতরে বাইরে’ বইটির প্রকাশন উৎসবে বক্তরা অভিমত দিয়েছিলেন। আমরাও তাই মনে করি। কিন্তু যে কূটচাল ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বইটি রচিত হয়েছিলো তার থেকে জন্ম ইতিহাস সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই পাবার নেই। আশার কথা যে প্রথমা প্রকাশন দেরীতে হলেও বইটি বাজার থেকে তুলে নিয়েছে। কিন্তু, ইতিহাস বিকৃতর যে ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তারা রচনা করলো এর দায় থেকে প্রথমা কিছুতেই মুক্তি পেতে পারে না।