03/06/2022
দৈনিক ‘সমকাল’ পত্রিকায় আজ [৩ জুন ২০২২] প্রকাশিত আমার লেখা গল্প ‘রাজবুদ্ধি’। 💖
—————-
রাজ্যজুড়ে বাদ্যি বাজল। এলো নতুন ঘোষণা। মণিমাণিক্যখচিত সোনার সিংহাসনে বসবেন নতুন রাজা। ‘রাজা যায়, রাজা আসে। এ আর এমন কী!’ বলল গজাই।
মজাই হাসল। বলল, ‘তুই মানুষটা বোকাসোকা, চিন্তা-ভাবনাও একরোখা!’
বন্ধুর কথায় গাল ফোলাল গজাই।
মজাই বলল, ‘শোন রে গজা। যোগ্য মানুষ যোগ্য স্থানে না বসলে বিপদ। রাজা রাজ্যের প্রধান। যোগ্য রাজা না হলে রাজ্যের বিপদ।’
‘আদার বেপারির জাহাজের খবর! আমার রাজকাহিনি শুনে কাজ নেই। আমি যাই।’ হাঁটা দিল গজাই।
লালগালিচা সাজানো হলো। ফুলের পাঁপড়ি ছিটানো হলো। বাজল কাঁসর ঘণ্টা। প্রজাদের মধ্যে মিষ্টি বিতরণ হলো। জাঁকজমকভাবে রত্নশোভিত সিংহাসনে বসলেন রাজা।
নতুন রাজার রাজ্যাভিষেক হতে না হতেই রাজ্যে দেখা দিল জলের সংকট। রাজদরবারে সভাসদদের নানা মত। রাজা বললেন, ‘এত ভাবনা কিসের। বৃষ্টি নামলেই তো সব সমস্যা মিটে গেল।’
মহামন্ত্রী মশাই বললেন, ‘মারহাবা, মহারাজের বুদ্ধির তুলনা হয় না।’
সভাসদরা রব তুললেন, ‘জয় মহারাজ। মহারাজের জয় হোক।’
জলাধারে যতটুকু জল ছিল ফুরিয়ে আসছিল। মাঠ-ঘাট গেল শুকিয়ে। মানুষের চরম দুর্ভোগ। কৃষাণদের মাথায় হাত। জলের অভাবে চাষ না করতে পারলে তারা খাবে কী!
রাজদরবারে ছুটল একদল কৃষাণ। মহারাজ বললেন, ‘একবার চাষ না করলে কী হয়? আমরা অন্য রাজ্য থেকে খাদ্য আমদানি করব।’
‘জাঁহাপনা, দুবেলা দুমুঠো খাবার জোটে ওই ফসল থেকেই। দু’কানাকড়ি যা আসে, সেটাও যে আসবে না। আমরা খাবার কিনব কী দিয়ে!’
‘ওরে চাষাভুষার দল, মানুষ খাবার জল পাচ্ছে না। আর সেখানে কি না চাষের জলের আবদার! মহারাজকে শুধু শুধু বিরক্ত করা। রাজদরবারে আলোচনার কত্ত বিষয় পড়ে আছে!’ বললেন মহামন্ত্রী।
‘প্রহরী, কে আছিস! এদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বিদায় কর। যত্তসব মুর্খের দল!’ আদেশ দিলেন মহারাজ।
হুকুম তামিল করল প্রহরীরা।
রাজা-মন্ত্রীবর্গের চিন্তা কী! বহু ক্রোশ দূর থেকে আনা হচ্ছে ঝর্ণার সুপেয় জল। দিব্যি যাচ্ছিল দিন।
তবে একদিন, ভাঁজ দেখা দিল মহারাজের কপালে। চারদিকে হৈ চৈ। প্রজারা জড়ো হয়েছে রাজপ্রসাদের বাইরে। জলের দাবিতে। জলবৎ তরলং! শক্ত হাতে প্রজা বিদ্রোহ দমনের আদেশ দিলেন রাজা। কিন্তু মেরেকুটে, বন্দি করেও প্রজাদের থামানো গেল না!
রাজা বললেন, ‘ওরা আসলে কি চায়? কিছু মোহর দিয়ে দাও।’
‘ওরা মোহর চায় না, মহারাজ। জল চায়, জল!’ বললেন মহামন্ত্রী।
‘জল নিয়ে এত কিছু! সামান্য জল! দিয়ে দাও কিছু জল।’
‘এতে সমস্যা মিটবে বলে মনে হয় না, জাঁহাপনা।’
‘কী করা যায়, মহামন্ত্রী?’
‘ওরা রাজদর্শন চায়, মহারাজ।’
‘তোমার কী মত, জলমন্ত্রী?’
‘ওদের কথা শোনা তো যাক।’
‘ডাক তবে। চারজনের বেশি যেন না হয়!’ আদেশ মহারাজের।
‘জো হুকুম জাঁহাপনা!’ বলে মহারাজকে কুর্নিশ করে দরবার ত্যাগ করে কিছুক্ষণের মধ্যেই চারজনকে হাজির করল প্রধান সেনাপতি। সেন্যদের কড়া পাহারায় এলো একজন কৃষাণ, একজন কুমোর, একজন মজুর আর মজাই। মজাই সারাবছর নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ায়! মানুষকে বিনে পয়সায় নানা ধরনের বুদ্ধি দিয়ে বেড়ায়। কাজকর্ম যে কিছু করে না, তা-ও নয়! গ্রামের কৃষকদের কাছ থেকে মৌসুমী ফল-ফসল কিনে প্রধান নগরে বিক্রি করে।
‘আমাদের ক্ষেত জলের অভাবে চৌচির। এখনই জল চাই। না হলে মাঠে মারা যাব, জাঁহাপনা।’ বলল কৃষাণ।
‘জলের অভাবে মাটির কিছুই বানাতে পারছি না, মহারাজ। রোজগার বন্ধ। না খেয়ে আছি।’ বলল কুমোর।
‘জলের তেষ্টায় প্রাণ যায় যায়। বাচ্চারা কাঁদছে। কিছু একটা করুন মশাই।’ বলল মুটে-মজুর।
মহারাজ বললেন, ‘তোমাদের কথা তো শুনলুম। বৃষ্টি না হলে আমিই বা কী করতে পারি?’
মাথা নাড়াল মন্ত্রীবর্গ।
‘যদি অভয় দেন, একটি কথা বলব। যদি সমাধান হয়।’ বলল মজাই।
হাতিঘোড়া গেল তল, মশা বলে কত জল! হেলায় তাকাল মহারাজ। মনে মনে ভাবল, উপায়ও তো নেই, শুনেই দেখা যাক।
‘শুনি কী বুদ্ধি তোমার ঘটে!’
‘সমুদ্রকান্তা, নির্ঝরিনী ও রূপসী নদী খুব দূরে নয়। জলে টইটম্বুর। সেখান থেকেই তো জল আনা যায়।’
‘এই তোমার বুদ্ধি, বুদ্ধু! রাজ্যের এত মানুষের জন্য এত বড় পাত্র পাব কোথায়!’
‘আমি তা বলছি নে, মহারাজ। জল আনতে হবে না, জলই আসবে আমাদের কাছে।’
‘আহাম্মক বলে কী! জলই আসবে আমাদের কাছে! জলের কি হাত-পা আছে? হেঁটে, হামাগুড়ি দিয়ে আসবে!’
মহারাজের কথায় রাজসভায় হাসির রোল পড়ে গেল।
‘আমাদের জলাধার, জলাশয়গুলোর সঙ্গে নদীর যদি সংযোগ করা যায়।’
‘তা কী করে হয়?’ মুখ খুললেন জলমন্ত্রী।
‘সম্ভব, মন্ত্রীমশাই। মাটি খনন করে তা সম্ভব। হয়তো অনেক শ্রমিক লাগবে। অনেক সময় লাগবে। কিন্তু জলের স্থায়ী সমাধান হবে। চাষাবাদের সমস্যা দূর হবে। আর পুরনো কূপগুলো যদি আরও গভীর করা যায়, কয়েকটি নতুন কূপ খনন করা যায়, খাবার জলের সংকটও থাকে না।’
মহারাজ-মন্ত্রীবর্গের যে বুদ্ধি নেই, সেই বুদ্ধি কি না একজন সাধারণ প্রজার ঘটে! মহামন্ত্রী হুঁশিয়ার করলেন, ‘এই বুদ্ধি তুমি দিয়েছ ভুলে যাও। এটা মহামহিম মহারাজের বুদ্ধি।’
রাজার আদেশে পরদিনই মাটি ও কূপ খননের কাজে নেমে গেল হাজারো শ্রমিক। সানন্দে প্রজারাও হাত লাগালো। এ কাজে যোগ দিল মজাই ও গজাই। নদীর জলের দেখা মিলল অবশেষে। কূপেও এলো স্বচ্ছ জল। রাজ্যের মানুষের জলের অভাব মিটল।
রাজসভার কথা গোপন থাকে না! এ রাজবুদ্ধি যে মহারাজের নয়, মন্ত্রীবর্গের মাথা থেকেও আসেনি, জানাজানি হলো প্রজাদের মধ্যেও। মজাইয়ের নামডাক ছড়িয়ে পড়ল রাজ্যে। ধন্যি ধন্যি পড়ল চারদিকে।
গজাই বন্ধুর এ কাজে ভীষণ খুশি। মজাইকে বাসায় নেমন্তন্ন করল একদিন। মজাইয়ের পাতে গজাই তুলে দিল মজার মজার সব খাবার। গল্পচ্ছলে মজাই বলল, ‘কী বলেছিলাম না, যোগ্য মানুষ যোগ্য স্থানে না বসলে বিপদ। রাজা আর মন্ত্রীবর্গের নির্বুদ্ধিতায় কত দুর্ভোগ পোহাতে হলো সাধারণ মানুষের।’
—————
রাজবুদ্ধি
আরাফাত শাহরিয়ার
দৈনিক সমকাল, ৩ জুন ২০২২