28/03/2024
আপকামিং...
হেঁটেছি সুদীর্ঘ পথ; কতো কাঁটা, কত রক্তঝরা পথ, দু-পায়ে মাড়িয়ে এসেছি জীবনের এই পড়ন্ত বিকেলে। এখন, অমল প্রত্যুষে ঘুম ভাঙার পর নিত্য একটি প্রশ্ন দোল খেতে থাকে—কোথায় আমার গন্তব্য? কোথায় মনজিল?
যদি সেই গন্তব্য কবর ধরা হয়, তা হলে খুব বেশি দূরে নয় আমার গন্তব্য। যেকোনো দিন, যেকোনো সময় আমি পৌঁছে যাব সেখানে। কিন্তু জ্ঞানীজন বলে থাকেন, কবর মানুষের প্রকৃত গন্তব্য নয়, স্বল্পায়ু অবস্থানস্থল মাত্র; তারপর তাকে সরিয়ে নেওয়া হবে অন্যত্র।
যদি তাই হয়, তা হলে মানুষের গন্তব্য কোথায়? আমার মনজিল কোথায়?
আপনারা হয়তো আমার এসব কথা শুনে ভেবে বসে আছেন আমি কোনো দার্শনিক, বা বড় কোনো আলেম।
না ভাই, আমি কোনো আলেম বা দার্শনিক নই। আমার বিদ্যের-দৌড় সবেমাত্র ক্লাশ টেইন, মেট্রিক দিয়ে টেনেটুনে তারপর আর এগুইনি ও—পথে।
মেট্রিকের সার্টিফিকেট এখনো আমার ঘরে রক্ষিত রয়েছে।
হ্যাঁ, একথা সত্য, দশ বছর লাগিয়ে যা যা আমি পড়েছিলাম তার বিন্দুমাত্রও এখন আর স্মরণে নেই, ভুলে গেছি। বইপত্রে যেসব জ্ঞান আমি পড়েছিলাম হাড়ভাঙা খাটুনি লাগিয়ে, বহু আগেই ওসব ধূসর হয়ে পড়েছে—একবিন্দুও নেই করোটিতে আর!
এখন যে জ্ঞান আমার কাছে পুঞ্জীভূত তা নিতান্তই মানুষের থেকে নেওয়া। মানুষের কাছ থেকে আমি এসব অর্জন করেছি। বলা যেতে পারে, আমি আসলে মানুষকে পড়েছি।
পুরো পৃথিবীটাই হল উন্মুক্ত একটি বই। যে তার মনমস্তিষ্ক খোলা রাখে, সে এখান থেকে নিতে পারে—মুঠো মুঠো—জ্ঞান বুদ্ধি বিদ্যে; জীবনের আলো।
আমি পৃথিবীর পথে পথে হেঁটে, গায়ে মেখেছি সেই আলো, শরীরে যুক্ত হয়েছে রঙিন অনেক পালক।
একদিন যে বালক, উঠোন ছেড়ে দু-পা ফেলেছিল বোকা বোকা চোখে, ঘুরতে ঘুরতে সে-ই আবার থিতু হয়েছে আপন ঘরে—চোখভরা কৌতূহল, স্থিরচিত্র নিয়ে। অভিজ্ঞতায় ঝানু হয়ে।
আমি আমার পরিবারে, বন্ধুদের আড্ডায়, বহুবার আমার এই সফরনামার কথা বলেছি। তাদের শুনিয়েছি জীবনের লোমহর্ষক দিনগুলোর কথা; তবে, একে লিপিবদ্ধ করব কলমের আঁচড়ে—কোনো দিন ভাবিনি।
একবার একটি বই আমার হাতে পড়ে। ওটা ছিল মুহাম্মদ খানের আত্মজীবনী—‘রাত কে রাহী’।
বইটি পড়ে আমি বিমুগ্ধ হই, তারপর শুরু হয় মনের ভেতর উগ্র উত্তেজনা—দেখা করব তার সঙ্গে! দেখব একনজর লেখককে।
বহুকষ্টে মুহাম্মদ খানের বাসার ঠিকানা জোগাড় করে যাত্রা শুরু করি; কিন্তু ওখানে গিয়ে শুনি তিনি আর নেই, মাসতিনেক হল ইনতেকাল করেছেন!
আমি সুরা ফাতেহা পড়ে দোয়া-দরুদ যেগুলো মুখস্থ ছিল পড়ে কবর জিয়ারত করি। তারপর ফিরে আসি।
এর কিছুদিন পর, সেকান্দর সাহেবের আত্মজীবনীর চারখণ্ডই আমার হস্তগত হয়; আমি সবকটা খণ্ড পড়ে ফেলি।
সেকান্দর সাহেব ছিলেন অতিশয় বৃদ্ধ। মনের ভেতর আমার খচখচানি, তিনি আবার কখন ওপারের যাত্রী হয়ে যান; যাই, দেখা করে আসি।
এই ভেবে আমি গেলাম। নিজের পরিচয় কানে তুলে দিয়ে তাকে শোনাতে থাকি ফেলে আসা আমার দিনগুলোর কথা। তিনি আমার জীবনকাহিনি শুনে বলেন, “এই কাহিনি সঙ্গে করে নিয়ে যেয়ো না যেন কবরে, লিখে ফেলো, লিখে দ্রুত ‘হেকায়েত পাবলিকেশন’-এর ঠিকানায় পাঠিয়ে দাও—ওরা লুফে নেবে। মানুষের কাছে এমনতর সত্য ঘটনা পৌঁছানো দরকার।”
আমি তার সঙ্গে কথা বলে ফিরে আসি। প্রায় আড়াই মাস পর, আবার তার সঙ্গে দেখা করতে যাই; কিন্তু এবার গিয়ে শুনি, সপ্তাহখানেক হল তিনি ইনতেকাল করেছেন। সংবাদটি শুনে আমি ভীষণ মর্মাহত হই।
মুহাম্মদ খান এবং সেকান্দর সাহেবের কথা এজন্য আমি উল্লেখ করলাম, কারণ, তাদের বইদুটি পড়েই আমি আমার কাহিনি লেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়েছি।
আমার ভূমিকা এখানেই শেষ। এবার আমরা মূল কাহিনিতে চলে যাব।
তার আগে বলি, আপনারা আমার এই কাহিনি পড়ুন, তারপর নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিন কী নাম দেবেন একে; আত্মজীবনী, ভ্রমণকাহিনি, না অন্যকিছু?