25/02/2024
মডারেট স্কলারদের কাঠগড়ায় শবে বরাত...
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইন্তেকালের প্রায় ১৪০০ বছর পর আজ বিচারকার্য হতে চলেছে শবে বরাতের। বাংলাদেশের সাধারণ মুসলিমগণ দিশেহারা। তাদের কেউ শবে বরাতকে মাজলুম বা নির্যাতিত বলছেন। যুগ যুগ থেকে পালন করে আসা এ রাতের ভবিষ্যত নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। আবার সোসাল মিডিয়া কল্যাণে আধুনিক স্কলারগণ তার বিরুদ্ধে অনঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছেন। তারা শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও বাংলার মাটি থেকে শবে বরাতকে উচ্ছেদের সকল আয়োজন করে রেখেছেন। শবে বরাতের বিরুদ্ধে তারা একের পর এক অভিনব, অনভিপ্রেৎ আপত্তি তোলে যাচ্ছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বড় অভিযোগ হলো সে বিদ‘আত, কুরআন হাদীসে তার অস্তিত্ব নেই, নবী সা, সাহাবী-তাবেয়ী কেউই আমল করেননি এবং বর্তমান মক্কা-মদীনার আলেমগণ তারাও ইবাদত করেন না। তাছাড়া স্কলারগণ আরো বলেছেন এ রাতের ইবাদত তাওবার দরজা বন্ধ করে দিবে, এর একটি রোজা জাহান্নামে যাওয়ার কারণ হবে, আল্লাহর আযাব নিয়ে আসবে প্রমুখ। বাদী পক্ষের মডারেট, আধুনিক, স্মার্ট, সুদর্শন, মক্কী, মাদানী টাইটেলধারী এমনকি পি এইচ ডি হোল্ডার ইসলামিক স্কলারগণ সোচ্চার আছেন তাদের মসজিদে, মাহফিলে, বিশেষত ইউটিউব ও ফেইসবুকের পোস্টের মধ্যে। আর তরল টাকার বুস্টিংয়ের মাধ্যমে তা ছড়িয়ে পড়ছে যুবক-যুবতীদের মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। আজ শরী‘আতের কাঠগড়াতে শবে বরাতকে হাজির করা হয়েছে। স্কলারগণ কতৃক নির্ধারিত উকীল সাহেব ও শবে বরাতের মধ্যকার জেরার চৌম্বক অংশ পাঠকদের সামনে উপস্থাপন করা হলো।
উকীল: তোমার নামটাই তো বিদ‘আত। কেননা, তোমার উল্লেখ কুরআন হাদীসে নেই। এ ব্যাপারে তোমার বলার কিছু আছে?
শবে বরাত: উকীল সাহেব। আপনাদের দেশে প্রচলিত নামাজ, রোজা, বেহেস্ত, দোযখ শব্দগুলোও তো কুরআন-হাদীসে নাই। তাই বলে কোনো দিনতো তাদের ব্যাপারে আপত্তি আসলো না। কিন্তু এগুলোর আরবি নাম যেমন- সালাত, সিয়াম, জান্নাত, জাহান্নাম/নার ইত্যাদি কুরআন হাদীসে আছে। ঠিক তেমনি শবে বরাত বাংলাদেশে দেশে আমার প্রচলিত নাম। আমার আসল নামতো কুরআনের ভাষায় ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ ( বা বরকতময় রজনী) আর হাদীসের ভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা‘বান’ ( বা মধ্য শাবানের রজনী)। আরবি নামটার জায়গাতে আমার ফারসি নামটা বেশি প্রচলিত হয়ে গেছে। তাছাড়া কুরআন নাজিল হয়েছে আরবিতে আপনারা আমার ফারসি ভাষার নাম কুরআন হাদীসে কেমনে পাবেন? এটা কেমন কথা?
উকীল: আচ্ছা বুঝলাম। তোমার নাম লাইলাতুম মুবারাকা কিন্তু এটাতো শবে কদরের কথা বুঝানো হয়েছে। তোমার কথাতো না এটা স্পষ্ট বিভ্রান্তি।
শবে বরাত: ধন্যবাদ উকীল সাহেব। আপনি কিন্তু ‘শবে কদর’ বললেন, লাইলাতুল কদর বলেন নি। এটা আমাদের দেশে প্রচলিত আর এতে কোনো দোষ নেই। পরকথা সূরা দুখানের ৩ নং আয়াতে
{إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ}
‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বলতে কোন রাত সে সম্পর্কে প্রায় ২৯ টি তাফসীরের কিতাবে একথা স্পষ্ট করা হয়েছে যে এটা লাইলাতুল কদর। পাশাপাশি ২৯ টি তাফসীরে কিন্তু ইকরামা র. সহ অনেক তাবেয়ী মুফাসসিরের মতে এটা ‘মধ্য শাবানের রজনী’ বা শবে বরাতের কথাও বলা হয়েছে। শবে বরাতের অস্থিত্ব আছে বিধায়ইতো তা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, সালাতুল উসতা বা মধ্যবর্তী নামায কোনটি এ প্রসংগে অধিকাংশ সাহাবীর গ্রহণযোগ্য মত তা আসরের নামায। কিন্তু অন্যান্য সাহাবী যারা ফজর, যোহর, জুমা বলেছেন তা কি ছুড়ে ফেলতে হবে। একথা কি বলা যাবে এগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।
একথা সঠিক যে এ আয়াত দ্বারা শবে কদর উদ্দেশ্য। কিন্তু তাই বলে শবে বরাতের অস্থিত্বই নাই এটা বলা কতটুকু যৌক্তিক উকীল সাহেব?
উকীল: আচ্ছা শুনো। তোমার নামের অর্থ হলো বিচ্ছিন্নতা অর্থাৎ আল্লাহর রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার রাত। তাই এ রাতে যে ইবাদত করবে সে আল্লাহর রহমত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। বুঝছো?
শবে বরাত: উকীল সাহেব। আপনি মুখস্ত কথা বলছেন। বারাআত অর্থ অনেক। (এসকল শায়খদের অন্ধ তাকলীদ/অনুসরণ ছেড়ে দিয়ে) আপনি যদি বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত আরবি-বাংলা অভিধান ‘মু‘জামুল ওয়াফী’ খুলে দেখতেন, তাহলে খুব ভালো হতো। কেননা, তাতে এর অর্থ লিখা আছে, মুক্ত হওয়া, নিরপরাধ হওয়া, নির্দোষ হওয়া, দায়মুক্তি ইত্যাদি। তার মানে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করলে, তার কাছে মাফ চাইলে তিনি পাপ থেকে মার্জনা করবেন, নির্দোষ করবেন, জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন। আর সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুফাসসির আল্লামা শামসুদ্দীন কুরতুবী র. সূরা দুখানের তাফসীরে এর আরো ৪টি নাম দিয়েছেন। তিনি বলেন,
ولها أربعة أسماء: الليلة المباركة، وليلة البراءة، وليلة الصك، وليلة القدر
এ রাতের চারটি নাম আছে বরকতময় রজনী, মুক্তির রজনী, চেক প্রদানের রজনী, ভাগ্যের রজনী।
উকীল: তাহলে তোমাকে কেন ভাগ্য রজনী বলা হয়? তোমার মধ্যে ভাগ্য নির্ধারণ হয় এটাতো ঠিক নয়। কেননা, মানুষের ভাগ্যতো আল্লাহ সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর আগেই লিখে রেখেছেন।
শবে বরাত: উকীল সাহেব। যদি আল্লাহ তাই করে থাকেন। তাইলে শবে কদরকেও তো ভাগ্য রজনী বলা যাবে না। মূল কথা হলো আল্লাহ পাক ৫০ হাজার বছর আগে ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন এটা ঠিক। আবার প্রতি বছর শবে কদরের রাতে এবং শবে বরাতেও ভাগ্য লিখা হয় এটাও ঠিক। শুনুন এগুলোর আলোচনাতো অনেক আগেই মুফাসসিরগণ করে গেছেন। মহিউস্সুন্নাহ ইমাম বাগাবী র. (ইন্তেকাল- ৫১০ হিজরী) প্রণীত তাফসীরু বাগবীতে রয়েছে,
وروى أبو الضحى عن ابن عباس رضي الله عنهما: أن الله يقضي الأقضية في ليلة النصف من شعبان، ويسلمها إلى أربابها في ليلة القدر.
আবুদ্দুহা র. ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহ তা‘আলা বান্দার ব্যাপারে শাবানের মধ্য রাত তথা শবে বরাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আর তা শবে কদরে দ্বায়িত্বশীল ফেরেশতাদের কাছে অর্পন করেন।
ইমাম আবু সাউদ (ইন্তেকাল- ৯৮২হি) এর তাফসীরু আবিস সাউদে রয়েছে,
يبدأُ في استنساخِ ذلك من اللوحِ في ليلةِ البراءةِ ويقعُ الفراغُ في ليلةِ القدرِ فتدفعُ نسخةُ الأرزاقِ إلى ميكائيلَ ونسخةُ الحروبِ إلى جبريلَ وكذا الزلازلُ والخسفُ والصواعقُ ،
লাওহে মাহফুজ হতে (যা ৫০ হাজার বছর আগে নির্ধারিত) শবে বরাতে ঐ বছরের ভাগ্য লিখা শুর।
লেখক: হোছাইন মুহাম্মদ রমিজ রেজা
খতিব শাহ অলি উল্লাহ জামে মসজিদ
কাঞ্চনগর, চন্দনাইশ, চট্টগ্রাম।