25/09/2023
সূরাঃ আন নুর আয়াতঃ ৩১
(অনুবাদ)
বিশ্বাসী নারীদেরকে বল, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থান রক্ষা করে।[১] তারা যা সাধারণতঃ প্রকাশ থাকে তা ব্যতীত[২] তাদের সৌন্দর্য যেন প্রদর্শন না করে[৩] তারা তাদের বক্ষঃস্থল যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত রাখে।[৪] তারা যেন[৫] তাদের স্বামী,[৬] পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীর পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগিনী পুত্র,[৭] তাদের নারীগণ, [৮] নিজ অধিকারভুক্ত দাস,[৯] যৌনকামনা-রহিত পুরুষ[১০] অথবা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্বন্ধে অজ্ঞ বালক[১১] ব্যতীত কারও নিকট তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। আর তারা যেন এমন সজোরে পদক্ষেপ না করে, যাতে তাদের গোপন আভরণ প্রকাশ পেয়ে যায়।[১২] হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা সকলে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। [১৩]
(তাফসীর)
[১] যদিও মহিলারা দৃষ্টি সংযত রাখা ও গুপ্তাঙ্গের হিফাযত করার প্রথম আদেশেই শামিল, যা ব্যাপকভাবে সকল মু'মিনদেরকে দেওয়া হয়েছে; যেহেতু মু'মিন মহিলারাও ব্যাপকার্থে মু'মিনদেরই অন্তর্ভুক্ত। তবুও এখানে বিষয়টির গুরুত্বের প্রতি লক্ষ্য রেখে বিশেষভাবে মহিলাদেরকেও দ্বিতীয়বার সেই একই আদেশ দেওয়া হচ্ছে। যার উদ্দেশ্য হল তাকীদ ও গুরুত্ব আরোপ। এখান হতে কিছু উলামাগণ দলীল গ্রহণ করে বলেছেন যে, যেরূপ পুরুষদের জন্য বেগানা মহিলাদেরকে তাকিয়ে দেখা নিষিদ্ধ, অনুরূপ মহিলাদের জন্যও বেগানা পুরুষদেরকে তাকিয়ে দেখা ব্যাপকভাবে নিষিদ্ধ। পক্ষান্তরে অন্য কিছু উলামা সেই হাদীস থেকে দলীল গ্রহণ করে মহিলাদের জন্য পুরুষদেরকে নিষ্কাম দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখা বৈধ বলেছেন, যে হাদীসে আয়েশা (রাঃ)-এর হাবশীদের খেলা দেখার বর্ণনা রয়েছে। (বুখারীঃ নামায অধ্যায়)
[২] 'যা সাধারণতঃ প্রকাশ থাকে' বলতে এমন সৌন্দর্য (বাহ্যিক আভরণ) বা দেহের অংশকে বুঝানো হয়েছে যা পর্দা বা গোপন করা অসম্ভব। যেমন কোন জিনিস নিতে বা দিতে গিয়ে হাতের করতল, অথবা কিছু দেখতে গিয়ে চোখ গোপন করা সহজ নয়। অনুরূপভাবে হাতের মেহেন্দী, আঙ্গুলের আংটি, চোখের সুর্মা, কাজল, অথবা পরিহিত সৌন্দর্যময় পোশাককে ঢাকার জন্য যে বোরকা বা চাদর ব্যবহার করা হয়, তাও এক প্রকার সৌন্দর্যের অন্তর্ভুক্ত; যা গোপন করা অসম্ভব। অতএব এই সব আভরণের প্রকাশ প্রয়োজন মত দরকার সময়ে বৈধ। [৩] সৌন্দর্য বলতে এমন পোশাক ও অলংকার বোঝায় যা মহিলারা নিজেদের রূপ-সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য ব্যবহার করে থাকে। যে সৌন্দর্য একমাত্র স্বামীদের জন্য ব্যবহার করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। সুতরাং নারীর পোশাক ও অলংকারের সৌন্দর্য প্রকাশ যদি অন্য পুরুষের সামনে নিষিদ্ধ হয়, তাহলে দেহের কোন অংশ খুলে প্রদর্শন করা ইসলামে কেমন করে অনুমতি থাকতে পারে? এ তো অধিকরূপে হারাম তথা নিষিদ্ধ হবে। [৪] যাতে মাথা ঘাড়, গলা ও বুকের পর্দা হয়ে যায়। কারণ এ সমস্ত অঙ্গ খুলে রাখার অনুমতি নেই। [৫] এখানে সেই সৌন্দর্য বা প্রসাধন এগানা পুরুষদের সামনে প্রকাশ করা বৈধ বলা হচ্ছে, যা ইতিপূর্বে বেগানা পুরুষদের সামনে প্রকাশ করা নিষিদ্ধ বলা হয়েছে। অর্থাৎ, পোশাক, অলংকার ও প্রসাধন ইত্যাদির সৌন্দর্য যা চাদর বা বোরকার নিচে গুপ্ত থাকে। এখানে এ মর্মে ব্যতিক্রমধর্মী বর্ণনা এসেছে যে, অমুক অমুক ব্যক্তির সামনে প্রকাশ করা বৈধ হবে। [৬] এদের মধ্যে সবার শীর্ষে হল স্বামী। সেই জন্য স্বামীকে সবার আগে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ স্ত্রীর সকল শোভা- সৌন্দর্য একমাত্র স্বামীর জন্যই নির্দিষ্ট। আর স্বামীর জন্য স্ত্রীর সারা দেহ (দেখা ও ছোঁয়া) বৈধ। (যেহেতু স্বামী-স্ত্রী একে অপরের লেবাস।) এ ছাড়া মাহরাম (এগানা; যাদের সঙ্গে চিরতরে বিবাহ হারাম) অথবা ঘরে যাদের আসা-যাওয়া সব সময় হয়ে থাকে এবং নৈকট্য বা আত্মীয়তার কারণে বা অন্য কোন প্রাকৃতিক কারণে নারীর প্রতি তাদের সকাম এমন আকর্ষণ সৃষ্টি হয় না, যার ফলে কোন ফিতনা (বা অঘটন) ঘটার আশঙ্কা থাকে, শরীয়তে সেই সমস্ত লোকদের সামনে এবং এগানা পুরুষদের সামনে সৌন্দর্য প্রদর্শনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তবে এখানে মামা ও চাচার কথা উল্লেখ হয়নি। অধিকাংশ উলামাগণের নিকট এরাও মাহরাম বা এগানার অন্তর্ভুক্ত। এদের সামনেও সৌন্দর্য প্রদর্শন মহিলার জন্য বৈধ। পক্ষান্তরে কিছু উলামার নিকট এরা মাহরামের অন্তর্ভুক্ত নয়। (ফাতহুল কাদীর) [৭] পিতা বলতে বাপ, দাদা, দাদার বাপ এবং তার ঊর্ধ্বে, নানা ও নানার বাপ এবং তার ঊর্ধ্বের সবাই এর অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপ শ্বশুর বলতে শ্বশুরের বাপ, দাদা এবং তার ঊর্ধ্বে সকলেই শামিল। পুত্র বলতে বেটা, পোতা, পোতার বেটা, নাতী নাতীর বেটা এবং এদের নিম্নের সকলেই শামিল। স্বামীর পুত্র বলতেও তার (অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত) বেটা, পোতা এবং তার নিম্নের সকলেই শামিল। ভ্রাতা বলতে সহোদর, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় তিন প্রকারের ভাইকেই বুঝানো হয়েছে। ভ্রাতুষ্পুত্র বলতে ভাইপো বা ভাতিজা ও তাদের নিম্নের সকল পুরুষকে এবং ভগিনী পুত্র বলতে সহোদর, বৈমাত্রেয় ও বৈপিত্রেয় তিন প্রকার বোনের বেটা (ভাগ্নে) ও তাদের নিম্নের সকল পুরুষকে বুঝানো হয়েছে। [৮] 'তাদের নারীগণ' বলতে মুসলিম মহিলাদেরকে বুঝানো হয়েছে, যাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে যে, তারা যেন কোন মহিলার শোভা-সৌন্দর্য, রূপ-লাবণ্য, দৈহিক আকার-আকৃতি নিজেদের স্বামীর কাছে বর্ণনা না করে। এ ছাড়া যে কোন কাফের মহিলার সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করা নিষেধ। এই অভিমত ব্যক্ত করেছেন উমার, আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ), মুজাহিদ এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ)। কেউ কেউ বলেন, এখানে 'তাদের নারীগণ' বলতে বিশেষ ধরনের নারীদেরকে বুঝানো হয়েছে, যারা খিদমত ইত্যাদির জন্য সর্বদা কাছে থাকে, আর তার মধ্যে বাঁদী-দাসীও শামিল। (এদের সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ করায় দোষ নেই।) [৯] مَا ملَكَتْ أِيمَانُهُنَّ (তাদের ডান হাত যাদের মালিক হয়েছে) বলতে কেউ কেউ শুধু ক্রীতদাসী এবং কেউ কেউ শুধুমাত্র ক্রীতদাস অর্থ নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ উভয়কেই বুঝিয়েছেন। হাদীসেও পরিষ্কার এসেছে যে, ক্রীতদাসদের সামনে পর্দার প্রয়োজন নেই। (আবু দাউদঃ পরিচ্ছদ অধ্যায়) অনুরূপভাবে কেউ কেউ তার ব্যাপক অর্থ নিয়ে বলেছেন, তাতে মু'মিন ও কাফের উভয় প্রকার ক্রীতদাস শামিল। [১০] কেউ কেউ এ থেকে এমন সব পুরুষ অর্থ নিয়েছেন, যাদের ঘরে থেকে খাওয়া-পান করা ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য থাকে না। আবার কেউ নির্বোধ, কেউ হিজড়া, খাসি করা বা ধ্বজভঙ্গ, কেউ অতিবৃদ্ধ অর্থ নিয়েছেন। ইমাম শাওকানী (রঃ) বলেন, যাদের মধ্যে কুরআনে বর্ণিত গুণ পাওয়া যাবে, তারা এর পর্যায়ভুক্ত এবং অন্যেরা বহির্ভূত হবে। [১১] এ থেকে এমন সব বালককে বুঝানো হয়েছে যারা সাবালক বা সাবালকত্বের নিকটবর্তী নয়। কারণ এরা মেয়েদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অভিজ্ঞ নয়। [১২] গোপন আভরণ বা অলঙ্কার প্রকাশ পেয়ে অর্থাৎ, পায়ের নূপুরের শব্দে পুরুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়। হাই-হিল বা এমন শক্ত জুতা-চপ্পলও এই নির্দেশের শামিল। যেহেতু মহিলারা যখন এসব পরিধান করে চলা-ফিরা করে, তখন তাতে এক ধরনের এমন শব্দ সৃষ্টি হয়, যা আকর্ষণে নূপুরের শব্দের তুলনায় কম নয়। অনুরূপ হাদীসে এসেছে যে, সুগন্ধি মেখে ঘর থেকে বের হওয়া মহিলার জন্য বৈধ নয়। যে এ রকম করে, সে ব্যভিচারিণী। (তিরমিযীঃ অনুমতি অধ্যায়, আবু দাউদঃ চুল আঁচড়ানো অধ্যায়।) [১৩] এখানে পর্দার আদেশের পরপর তওবার আদেশ দেওয়ার মধ্যে যুক্তি হল যে, অজ্ঞতার যুগে এই সমস্ত আদেশের যে বিরোধিতা তোমরা করতে তা যেহেতু ইসলাম আসার পূর্বের কথা, সেহেতু তোমরা যদি সত্য অন্তরে তওবা করে নাও এবং উক্ত আদেশের সঠিক বাস্তবায়ন কর, তাহলে সফলতা, ইহ ও পরকালের সৌভাগ্য একমাত্র তোমাদের।
সূরাঃ আন নুর , আয়াতঃ ৩১