31/08/2023
টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমন!!!
গত বছর (2022) সেপ্টেম্বরের ছয় তারিখে স্কুল বন্ধু জিয়া ও কলিগ ফরহাদ এর সাথে রওনা হই সুনামগঞ্জের উদ্দেশ্যে। আমরা কল্যানপুর বাসষ্ট্যান্ড হতে বিআরটিসি এসি বাস যোগে রাত দশটায় রওনা দিই। সকাল সাতটার দিকে পৌঁছে যাই সুনামগঞ্জ বাসষ্ট্যান্ড। এখানে নামকরা পানসী রেস্তোরাঁয় নাস্তা করে রিক্সা যোগে পৌঁছে যাই হাছনরাজা মিউজিয়াম সংলগ্ন সাহেব বাড়ী ঘাটে।
আমরা আগে থেকেই নোঙ্গর নামের একটি প্রিমিয়াম বোটে আমাদের তিনজনের জন্য জনপ্রতি সাড়ে চার হাজার টাকায় প্যাকেজ বুক করেছিলাম। ঘাটে গিয়ে দেখি প্রিমিয়াম ও সাধারণ মিলে প্রায় বিশটির মত বোট বাঁধা। বোটে যেতেই এই বোটের হোস্ট তথা ওনার (পরে শুনেছিলাম এই বোটের তিন জন মালিক আর দুইজন আমাদের সাথে হোস্ট হিসেবে ছিলেন) আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান। এরপর আমাদেরকে রুম বুঝিয়ে দেন। এই বোটে ঢুকতে প্রথমেই একটুকরো জায়গা যেখান থেকে ছাদে উঠার সিঁড়ি ও একপাশে একটি জেনারেটর। এরপর সুন্দর করে সাজানো একটি ছোট্ট লবি। এরপর দুপাশে দুটি আনলকড কেবিন। তবে পর্দা দিয়ে প্রাইভেসি মেইনটেইন করা। প্রতিটি কেবিনে তিনজন শোয়ার ব্যবস্থা। এরপর তিনটি তিনটি করে মোট ছয়টি ডোরসহ কেবিন। তারপর দুটি টয়লেট। একটি হাইকোমড অন্যটি লো কমোড। এরপর স্টাফরুম ও রান্নাঘর। রুমে লাগেজ রেখেই আমরা ঘাটের দোকান থেকে কিছু শুকনো খাবার কিনি। ইতিমধ্যে বোটের অন্য গেস্টরা চেকইন করে।
প্রায় নয়টার দিকে সুরমা নদী হয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। একটু পরেই সামনের লবি অংশে সকালের নাস্তা সরবরাহ করা হয়। মেনু হিসেবে খিচুড়ি, ডিম ও মুরগির মাংস দেওয়া হয়। আমরা কখনওবা রুমের জানালা অথবা সামনের লবি অথবা ছাদে উঠে আশপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে একসময় বিশাল হাওরে প্রবেশ করি। দূরে মেঘালয়ের পাহাড়গুলো দেখা যায়। তখন চারদিকে শুধুই পানি আর পানি। সে এক অপার সৌন্দর্য।
প্রায় দেড়টার দিকে নৌকা নোঙ্গর করে একটি জলাবনের কাছে। গাছগুলোর কান্ডের বেশ অংশ পানির নীচে আর ডালপালা উপরে যা দেখতে খুবই সুন্দর লাগছিল। নৌকা ভিড়তে অনেকগুলো ছোট নৌকা ভিড় করল ভাড়া দেওয়ার জন্য; যার অধিকাংশ চালকই ছোট ছোট বাচ্চারা। আমরা রবারের একটি নৌকা দুইশত টাকায় ঠিক করে উঠে পড়ি। এগুলো চালানো যত সহজ মনে করেছিলাম বস্তুত ততটাই কঠিন। ছোট্ট ছেলেটি জলাবনের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ চালিয়ে নেয়। এরপর একজায়গায় আমরা নেমে পরি আবগাহনে। পানি বেশ পরিস্কারই ছিল। এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার আছে। আমরা সেই ওয়াচ টাওয়ারে উঠে চারদিকটা পরখ করে নেমে আসি। এইস্থানে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় করে ড্রাইফুড ও চা বিক্রি করে। আমরা পানিতে দাঁড়িয়ে চা এর স্বাদ নিই। এরপর নৌকায় ফিরে ফ্রেস হই। নৌকা এবার যাত্রা শুরু করে টেকেরহাটের উদ্দেশ্যে। নৌকায় বসে উঁচু উঁচু পাহাড়গুলো আরও স্পষ্ট হতে থাকে। সে এক মায়াজালে ভরা সৌন্দর্য। এবার ডাক পরে দুপরের খাবারের। মেনুতে ছিল হাওরের বোয়াল মাছ, ছোট মাছের ভাজি, মুরগির মাংস, ডাল ও সবজী। খাবার শেষ করে রুমে বসে জানালা খুলে হাওরের পানির মাঝ দিয়ে নৌকার বয়ে চলা উপভোগ করতে থাকি। সামনে উঁচু পাহাড় আর নীচে বিস্তৃত জলরাশি সে এক অন্য রকম অনুভূতি।
নৌকা প্রায় সাড়ে চারটার দিকে নিলাদ্রী লেক সংলগ্ন টেকেরহাট ঘাটে ভেড়ে। কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে নেমে পড়ি নৌকা থেকে। অন্যান্য ট্যুর অপারটরের নৌকাগুলো এক এক করে এখানে নোঙ্গর করতে শুরু করে। ঘাটের খুব কাছেই একটি হাসপাতাল আছে যার কার্যক্রম তখন ছিল না। এরপর রেলের কিছু পরিতক্ত লাইন ও পাশাপাশি অবস্থিত দুটি বিশাল ক্রেন আছে যা মাইনিং এর কাজে ব্যবহৃত হইত। এরপর এখানকার বিখ্যাত নিলাদ্রী লেক যা চুনাপাথর মাইনিং এর ফলে তৈরি । লেকটি বেশ গভীর বলেই মনে হলো। লেকটি পাহাড়ের গোড়া পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে দুটি ঘাট দেখলাম কায়াকিং ও ছোট বোট রাইডিংয়ের এর জন্য। ঘাট এবং লেকের মাঝের অংশটি খুবই সুন্দর যেন শিল্পীর আঁকা কোন সবুজ প্রান্তর ও টিলা। এর একটু দূরেই টেকেরহাট বাজার ও স্থানীয় জনবসতি। আমরা লেকের পাশে বসে বসে অনেকখানি সময় অতিবাহিত করি। সন্ধ্যার বেশ খানিকক্ষণ পরে নৌকায় ফিরে নাস্তা সেরে নিই। নাস্তায় ছিল ছোলা-চানাচুর দিয়ে মুড়ি মাখা ও চা। আবার নৌকা থেকে নেমে আশপাশে ঘুরে বেড়াই। ইতমধ্যে সব বোটগুলো আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়ে উঠে। কয়েকটি বোটে দেখলাম গেস্টরা স্ব-উদ্দোগ্যে গানের আসর বসিয়েছিল। রাতের খাবারের পর নৌকা ঘাট থেকে একটু সরিয়ে পানির মধ্যে নোঙ্গর করে রাখে নিরাপত্তাজনিত কারনে। রাতের চাঁদের আলোতে পুরা এলাকাটি খুবই মোহনীয় হয়ে উঠে। আমরা সহ বোটের সকলে ছাদে উঠে গল্পগুজব করে অনেক রাত অবধি কেটে দিই।
সকালে বোট আবার ঘাটে ফেরত আনে। আমরা হালকা নাস্তা করে নীচে নেমে পড়ি। ঘাটের পাশেই বেশ কিছু স্থানীয় ছেলে মোটর সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রাইডের জন্য। একজনের সাথে কথা বলে আসা-যাওয়া একশত টাকা ঠিক করি যদিওবা আসার পর ছেলেটি কথা উল্টিয়ে ফেলে আমাদের কাছ থেকে ডবল টাকা নেয়!!! যাই হোক আমি ও বন্ধু জিয়া লাকমাছড়া পৌছে দেখি আমরা ছাড়া আর কেউ নেই। এমন শান্ত পরিবেশ। তবে ছড়ার পানি প্রবাহের শব্দ ছিল অন্যরকম। খুব কাছে কোন বড় ঝরনা দেখি নাই কিন্তু পানি প্রবাহের শব্দ ছিল বেশ। মনে হচ্ছিল যেন এক শব্দঝংকারের সংগীত। এখানে বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা বোটে ফিরে আসি।
এবার বোট নোঙ্গর তোলে যাদুকাটা নদী ও বারিক্কাটিলার উদ্দেশ্যে। চলতি পথেই পরিবেশন করা হয় সকালের নাস্তা। এমন পরিবেশে ছাদে বসে নাস্তা করতে খুবই ভাল লাগছিল। আমাদের বোট যাদুকাটা নদী হয়ে বারিক্কাটিলার দিকে যেতে থাকে। এপথে ভীষন কর্মব্যস্ততা ও প্রচুর বালু ও পাথর বোঝাই নৌকা দেখা যায়। এরপর নৌকা যাদুকাটা নদীর বাংলাদেশের শেষ অংশের কাছাকাছি একজায়গায় নোঙ্গর করে। এখান থেকে আনেকটা খাড়া পথ বেয়ে আমরা বারিক্কাটিলার চূড়ায় উঠি। ওঠার রাস্তাটি কংক্রিটের তৈরী। বারিক্কাটিলার চূড়াটি বেশ প্রসস্ত ও পুরা সবুজ ঘাসে ঢাকা। এর বিস্তৃর্ণ অংশের কিছু অংশ ভারতের মধ্যে পরেছে। টিলার চূড়াতে যাদুকাটা নদীর বাংলাদেশের অংশে শতশত নৌকা আর হাজারও মানুষ বালি, পাথর অথবা কয়লা সংগ্রহে ব্যস্ত। উপর থেকে দেখতে সে এক অন্যরকম লাগছিল। ভারতের অংশে বড় বড় পাহাড় আর দূরে সাদা ঝরনাও দেখা যাচ্ছিল। এখানে ঘোরা শেষ হলে নৌকা আবার আমাদেরকে শিমুল বাগানের কাছে নিয়ে যায়। বিশাল এলাকা নিয়ে অবস্থিত শিমুল বাগান ব্যক্তিগত প্রপার্টি। এখানে ঢুকতে তিরিশ টাকা টিকেট নিতে হয়েছে। এখানে বেশ কিছু ঘোড়া আছে যাতে উঠে ছবি তোলা যায় বা বাগানের ভিতরে ঘোরা যায়। এসময় পুরো বাগানটি ছিল সবুজে পরিপূর্ণ। শিমুল বাগানের পাশ্বে রয়েছে বাঁশ বাগান। এখান থেকে ফেরার পর নৌকা আমাদেরকে গোসলের জন্য একটা সুবিধাজনক স্থানে নেমে দেয়। সবাই লাইফ জ্যাকেট নিয়ে নেমে পড়ে। অনেক দিন পরে এমন এক পরিবেশ গোসল করতে খুবই ভালো লাগছিল। বোটের সবাই এই নদীতে ভেজা ও সাঁতার কাটা খুবই উপভোগ করেছিল। এরপর নৌকা এবার সুনামগঞ্জের দিকে ফিরতে শুরু করে। সবাই একসাথে বসে ছাদে দুপুরের খাবার খাই ও যে যার যার মত রুমে গিয়ে রেস্ট নেই। সন্ধ্যায় নৌকা আবার সাহেব বাড়ী ঘাটে ভেড়ে। আমরা বাসষ্ট্যান্ড থেকে ফিরতি বাসের টিকেট কেটে নৌকায় রেস্ট নিই। রাত দশটার দিকে নৌকা ত্যাগ করি এবং বিআরটিসি বাস যোগে ঢাকা ফিরি।
Masud Haider Jiaur Rahman Farhad Uddin