13/04/2024
"শ্রীরামচরিত"
☘️নমস্কার সকল অমৃতের সন্তানগণ।
▪️ধরিত্রীর মাঝে বহু মানবের আগমন ঘটেছে। তাদের কৃতিত্ব আমাদেরকে করেছে অনুপ্রাণিত, করেছে উদ্যমী সত্যের দিকে যাত্রা করার, উত্তম চরিত্র গঠন করার। কিন্তু সে সকল শ্রেষ্ঠদের মাঝে কিছু ব্যক্তিত্ব অমর, অজয় হয়ে তাহাদের কীর্তি যুগযুগান্তর ধরে সাধারণের কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হয়ে থাকে। তাদের আদর্শ সকলকে পরিচালিত করে সুচরিত্র গঠন অভিমুখে।
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম সে সকল কীর্তিমানের মাঝে শ্রেষ্ঠতম। আদর্শিক যুগ পুরুষ, অমৃতের শ্রেষ্ঠ সন্তান, ধরিত্রী বুকে জন্ম নেওয়া শ্রেষ্ঠ শাসক। আজ শুভ রাম নবমী। সময়ের এই শুভলগ্নে আবির্ভাব হয়েছিল সকল গুণে গুণান্বিত যুগশ্রেষ্ঠ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম। দশরথ পুত্র, কৌশল্যা নন্দন হয়েও তিনি ছিলেন মাতা কৈকেয়ী ও সুমিত্রার অধিক প্রিয় পুত্র এবং ভরত, লক্ষ্মণ ও শত্রুগ্নের শ্রদ্ধেয় ভ্রাতা। প্রজাদের জন্য ছিলেন পিতৃতুল্য শাসক। তার চরিত্র বর্ণন করতে গিয়ে রাজা দশরথ বলেন,
🌱"ক্ষমা যস্মিং স্তপস্ত্যাগঃ সত্যং ধর্ম কৃতজ্ঞতা।
অপ্যহিংসা চ ভূতানাং তমৃতে কা গতিমম" ।। 🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ১২/৩৩
দশরথ বললেন – হে কৈকেয়ী ! যে রামের মধ্যে ক্ষমা, তপ, ত্যাগ, ধর্ম ও কৃতজ্ঞতা এবং সর্বপ্রাণীদের জন্য দয়া বর্তমান সেই রাম সত্য, ব্যতিরেকে আমার কী গতি হবে ?☘️
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর জন্ম জয়ন্তী উপলক্ষে তাহার চরিত্র, আদর্শ ও গুণের আলোচনা উপস্থাপন করা হলো:
🔸রামচরিতকথা:-
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম সর্বদা ছিলেন সত্যের ধারক ও বিনয়ী। তিনি কখনো ধর্মের বিরুদ্ধাচরণ করতেন না। তিনি যেমন বেদজ্ঞ ছিলেন, তেমনি ছিলেন পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার উদারতা ও বিনয়ী আচরণ ছিলো অতুলনীয়। বহুলাংশে ভরতের চরিত্র রামের মতোই সৌন্দর্যপূর্ণ আদর্শিক হলেও শ্রীরাম ছিলেন অনেক ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ।
শ্রীরামের বেদজ্ঞান: মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম ছিলেন
বেদ জ্ঞানী। তিনি বৈদিক জ্ঞান অর্জন করে হয়ে ছিলেন সর্ববিদ্যাব্রতস্নাতক।
🌱"বেদবেদাঙ্গতত্বঙ্গঃ"🌱
- বাল্মিকী রামায়ণ বাল্যকাণ্ড ০১/১৪📖🌼
✍️অর্থাৎ, রাম বেদবেদাঙ্গ তত্ত্ববেত্তা ছিলেন।☘️
🌱"সর্ববিদ্যাব্রতস্নাতো যথাবৎ সাঙ্গবেদবিৎ"🌱
- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ১/২০📖🌼
✍️অর্থাৎ, রাম সর্ববিদ্যাব্রতস্নাতক তথা যথাবৎ বেদাঙ্গ জ্ঞাতা ছিলেন।☘️
🔸শ্রীরামের বিনম্রতা:-
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম শুধু বেদজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিনয়ী, নির্লোভ, নিরহংকারী।
🌱"প্রীতির্বহুমানশ্চ ময়্যযোধ্যানিবাসিনাম্ ।
মৎপ্রিয়ার্থং বিশেষেন ভরতে সা বিধীয়তে"।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ৪৩/৭📖🌼
✍️বনবাস গমন করার সময় রাম বললেন- হে অযোধ্যানিবাসীগণ! আপনারা আমার সঙ্গমে প্রীতি ও বহুমান্যতা বজায় রেখেছেন, আমাকে প্রসন্ন করার জন্য ভরতের সঙ্গেও সেইরূপ করবেন।🌱
বিভিন্ন সময়ে আমরা এক ভ্রাতার সাথে অন্য ভ্রাতার দ্বন্দ্ব দেখতে পাই৷ রাজ্য প্রাপ্তির মোহে এক ভ্রাতা অন্য ভ্রাতা গর্দান কেটে তা পিতার সম্মুখে উপস্থাপন করার ইতিহাসও রয়েছে মুঘল আমলে। কিন্তু শ্রীরাম ভিন্ন সবার থেকে। তিনি যে শ্রেষ্ঠ। তাই তিনি প্রজা বৎসল শাসকের মতো ভরতের প্রতি তাদের প্রীতি ভালোবাসা কামনা করেছেন।
🔸শ্রীরামের পিতা মাতার প্রতি শ্রদ্ধা:-
পিতা ও মাতা আমাদের জন্য শ্রদ্ধা শ্রেষ্ঠতম স্থানে অবস্থান করেন। কিন্তু আমরা কতটুকু নিজ মাতা পিতার প্রতির শ্রদ্ধাশীল ও নম্র হতে পেরেছি। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এক্ষেত্রেও তৈরি করেছেন এক দৃষ্টান্ত। শুধু নিজ জন্মধাত্রী মাতার প্রতিই নয় বরং সে কৈকেয়ী মাতার প্রতিও তার শ্রদ্ধা ও সম্মান ছিল অবিচল।
🔸পিতার আজ্ঞাপালনশীলতা:-
পিতা বটবৃক্ষের ন্যায়। সে পিতার প্রতি আজ আমরা অজ্ঞতাবশত বিভিন্ন অযাচিত আচরণ করি। যা সত্যি অপরাধ ও অমার্জনীয়। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম ছিলেন পিতৃভক্তির শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। তিনি পিতৃসত্য পালনে বনবাসে যেতেও দ্বিধাবোধ করেননি। সেজন্য তিনি বলেন,
🌱"এতাভ্যাং ধর্মশালাভ্যাং বনং গচ্ছেতি রাঘব।
মাতাপিতৃভ্যাসুক্তো্যহং কথমন্যৎ সমাচরে"।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ১০১/২২📖🌼
✍️অর্থাৎ, রাম বললেন, এই ধর্মশীল মাতাপিতা আমাকে বনবাসে যাওয়ার আজ্ঞা প্রদান করলেন আমি তা কী করে উল্লঙ্ঘন করতে পারি।☘️
🌱"লক্ষীশ্চন্দ্রাদপেযাদ্বা হিমবাণ্ বা হিমং ত্যজেত্। অতিযতসাগরো বেলাং না প্রতিজ্ঞামহং পিতুঃ।।"🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ৭৯/১৩📖🌼
✍️অর্থাৎ, চন্দ্রমা যদিও চন্দ্র কে ছেড়ে দেয়, হিমালয় হিমকে ছেড়ে দেয়, হতে পারে সমুদ্র নিজের মর্যাদাকে ছেড়ে সীমায় আটকে যায় কিন্তু আমি পিতার কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা ছাড়তে পারবো না।☘️
পিতার প্রতি এমন শ্রদ্ধা আর কোথায় দেখতে পাওয়া যায় বলতে পারেন। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম ছিলেন এমনই। পিতৃসত্য পালনে নিজের সকল সুখ শান্তি বিসর্জন দেওয়ার মতো অদম্য মনোভাবের অধিকারী।
🔸শ্রীরামের মাতার প্রতি ভালোবাসা: -
মাতা কৈকেয়ী শ্রীরামকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। যার ফলে তিনি শ্রীরাম ও ভরতের মাঝে কোনো পার্থক্য দেখতেন না।
🌱"ধর্মজ্ঞো গুণবান দান্তঃ কৃতজ্ঞঃ সত্যবান শুচিঃ।
রামো রাজসুতো জ্যৈষ্ঠৌ যৌবরাজ্যমতোৎইতি।।
কিমিদং পরিতপ্যসে। যথাবৈ ভরতো মান্যস্তথা ভূয়্যোপি রাঘবঃ"🌱
✅-বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ৮/১৪-১৮📖🌼
✍️অর্থাৎ, হে মন্থরা! রাম ধর্মজ্ঞ, গুণবান, জিতেন্দ্রিয়, কৃতজ্ঞ, সত্যবাদী ও পবিত্র। রাম রাজার জ্যৈষ্ঠ পুত্র সুতরাং সে যৌবরাজ্য প্রাপ্ত করার অধিকারী। তুই বৃথা কেন দুঃখী হচ্ছিস। ভরত অপেক্ষা রাম আমার কাছে বেশি মান্য কেননা ভরতের চেয়ে রাম আমায় বেশি সেবাশুশ্রূষা করে।☘️
এখানে স্পষ্ট যে মাতা কৈকেয়ী কখনোই রাম বিদ্বেষী ছিলেন না। তিনি ভরত ও রাম উভয়কেই স্নেহ করতেন এবং রামের রাজ্যাভিষেক এ তিনি আনন্দিত হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ষড়যন্ত্রকারী মন্থরার কুমন্ত্রণায় মাতা কৈকেয়ী দিকভ্রষ্ট হন। কিন্তু একবারের জন্যও, মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম মাতা কৈকেয়ী এবং মন্থরার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করেননি। বরং ভরত যখন মাতা কৈকেয়ী ও মন্থরাকে ভর্ৎসনা করেছিলেন তখন রাম বললেন,
🌱"ন দোষং ত্বয়ি পশ্যামি সূক্ষ্মমপ্যরিসূদন।
ন চাপি জননীং বাল্যাত্বং বিগর্হিতুমর্হসি"।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ১০১/১৭📖🌼
✍️অর্থাৎ, রাম বললেন - হে ভরত! আমি তোমার দোষ দেখিনা, এবং তুমি মাতা কৈকেয়ীর কালোচিত স্বভাবের জন্য তার নিন্দা করতে পারো না।☘️
🔸শ্রীরামের স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব ও ভালোবাসা:-
🌱"অহং বদামি নৈত্ত্বং সভায়ামহ ত্বং বদ।
মমদেসস্ত্বং কেবলো নান্যাসদং কীর্তায়াশ্চন"।।🌱
✍️অর্থাৎ, এই সভামধ্যে প্রতিজ্ঞা করছি তুমি শুধু আমার হবে,অন্য দ্বিতীয় কারো কথা বলা তো দূরে থাক চিন্তাও করবেনা।☘️
✅-অথর্ববেদ ৭/৩৮/৪📖🌼
পবিত্র বেদ এর এই সুমহান মন্ত্র যেন ধ্বনিত হয়েছে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম ও মাতা সীতার মাঝে। তারা যেন ছিলেন একই বৃত্তে আবদ্ধ। মাতা সীতার প্রতি অফুরন্ত ভালোবাসা ছিল বলেই তাকে ফিরে পাওয়ার জন্য রাবণের বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ লড়াই করেছেন।
▫️শ্রীরাম মাতা সীতাকে হারানোর পর তিনি প্রচন্ড মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এবং বলেন,
🌱"মোষং হি ধর্মশ্চরিতো ময়ায়ং তথৈকপত্নীত্বমিদং নিরর্থকম্"🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ সুন্দরকান্ড ২৮/১৩ 📖🌼
✍️অর্থাৎ, রাম সীতার অপহরণের পর দুঃখের সহিত বললেন, আমি ব্যর্থ ধর্মাচরণ করলাম এবং এক পত্নীব্রতও নিরর্থক হয়ে গেলো। এখানে স্পষ্ট যে শুধু স্ত্রী পতিব্রতা নয় স্বামীরও পত্নীব্রত পালন করতে হয়।☘️
মাতা সীতাও ছিলেন সতী সাবিত্রী। তার চরিত্র সকল নারীদের নিকট অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। মাতা সীতা নিজ স্বামীর প্রতি ছিলেন একনিষ্ঠ শ্রদ্ধাবান। যখন রাবণ মাতা সীতাকে অপহরণ করে প্রাপ্ত করার চেষ্টা করেন তখন মাতা সীতা বলেছিলেন,
🌱"তথাহং ধর্মনিত্যস্য ধর্মপত্নী দৃঢ়ব্রতা।
ত্বয়া স্প্রষ্টুং ন শক্যাহং রক্ষসা ধর্মপাপিনা।।"🌱
✅ - বাল্মীকি রামায়ণ অরণ্যকান্ড ৫৬|১৯ 🪷
✍️অর্থাৎ, আমি সর্বদা ধর্মপরায়ণ রামের দৃঢ়ব্রতসম্পন্ন ধর্মপত্নী , তুমি রাক্ষস, অধম, আমাকে তুমি স্পর্শ করতে পারবেনা। ☘️
বনবাসে যাত্রাকালে শ্রীরাম মাতা সীতাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেন রাজমহলে থাকার জন্য। কিন্তু মাতা সীতা তার সদুত্তরে বলেছিলেন,
🌱যদি ত্বং প্রস্তিতো দুর্গং বনমদ্যৈব রাঘব।
অগ্রতস্তে গমিষ্যামি মৃজন্তী কুশকিস্ত কান্।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ২৭/৭📖🌼
✍️অর্থাৎ, হে রাম! যদি তুমি অদ্যই দুর্গম বনে প্রস্থান করো তাহলে আমি তোমার অগ্রে পথের কুশকন্টক পদদলিত করে চলবো।☘️
বনবাস ছিল সত্যি ভয়ংকর। কন্টকাকীর্ণ পথ, হিংস্র জানোয়ার এর ভয়। এ সত্ত্বেও মাতা সীতা ছিলেন অনড়।
🌱কুশক্রাশশরেষীকা যে চ কন্টকাকিনো দ্রুক্ষা।
তুলাজিন সমস্পর্শা মার্গে মম সহ ত্বয়া।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ৩০/১৩📖🌼
✍️অর্থাৎ, হে রাম! কুশ, কাশ, শর, শলাকা ও অন্যান্য কন্টকযুক্ত ঝোপঝাড়গুলি তোমার গমনপথে আমার নিকট তুলাও অজিনসম স্পর্শদায়ক হবে। অতএব, আমি তোমার সঙ্গে অবশ্যই বনে গমন করবো।☘️
সত্যি মাতা সীতা ও শ্রীরাম ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। তাহাদের প্রেমকাব্য যেন সকল স্বামী স্ত্রীর জন্য এক অনন্য উদাহরণ।
🔸শ্রীরামের ভ্রাতৃপ্রেম :-
ইতিহাসের বহু কালোধ্যায় রয়েছে যেখানে রাজ্য প্রাপ্তির জন্য ভাই ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ভাইকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে, প্রয়োজনে পিতাকে কারাবন্দী করেছে বহু শাসক। কিন্তু শ্রীরাম ছিলেন ব্যতিক্রম। তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা যখন ভরত ও তার সঙ্গীদের বধ করার কথা উল্লেখ করেন তখন শ্রীরাম চন্দ্র বলেন,
🌱"পিতুঃ সত্যং প্রতিশ্রুত্য হত্বা ভরতমাহবে।
কিং করিষ্যামি রাজ্যেন সাপবাদেন লক্ষ্মণ।। কথং নু পুত্রাঃ পিতরং হন্যুঃ কস্যাংচিদাপদি।
ভ্রতো বা ভাতরং হন্যাৎসৌমিত্রে প্রাণমাত্মনঃ"।। 🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অযোধ্যাকান্ড ৯৭/৩-১৬📖🌼
✍️অর্থাৎ, হে লক্ষ্মণ! পিতৃসত্য পালনার্থ যুদ্ধে ভরতকে হত্যা করে অপবাদগ্রস্ত রাজ্যের আমি কি করবো? কোনো অবস্থাতেই পুত্র দ্বারা পিতা ও প্রাণসদৃশ ভ্রাতার হনন কি করে সম্ভব?☘️
🌱"য়ৈথব মাং বনং যান্তমনুযাতো মহাদ্যুতিঃ।
অহমপ্যনুযাস্যমি তথৈবৈনং যবক্ষয়ং"।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধকান্ড ৪৯/১৮📖🌼
✍️অর্থাৎ, হে লক্ষ্মণ! বনযাত্রার সময় তুমি যেমন আমার সঙ্গে চলেছিলে, আমিও যমলোকে যাওয়ার সময় তোমার সঙ্গী হবো।☘️
অনুজের প্রতি বড় ভ্রাতার প্রেম এর এক অনন্য শ্রীরাম ও লক্ষ্মণ। লক্ষ্মণ যেমন রামের প্রতি ছিলেন অনুগত তেমনি শ্রীরাম ছিলেন লক্ষ্মণের প্রতি স্নেহশীল এবং প্রাণপ্রিয়।
শুধু শ্রীরাম এবং লক্ষ্মণ এর মধ্যে নয়। ভরত নিজেও রামের প্রতি ছিলেন শ্রদ্ধাশীল এবং ভালোবাসাপূর্ণ।
তাই যখন তাকে অযোধ্যার রাজা করার প্রচেষ্টা করা হয় তখন তিনি বলেছিলেন,
🌱"চরিতব্রহ্মচর্যস্য বিদ্যাস্নাতস্য ধীমতঃ।
ধর্মে প্রয়তমানস্য কো রাজ্যং মদ্বিধোহরেৎ"।।🌱
✍️অর্থাৎ, ভরত বললেন যে, ব্রহ্মচর্যব্রতে পূর্ণ বিদ্যাস্নাতক বুদ্ধিমান ও ধর্মাচরণে যত্নশীল রামের রাজ্যকে কে আমার মতো হরণ করতে পারে?☘️
🔸শরণাগতকে অভয়দান:-
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম যেমন উত্তম যোদ্ধা ছিলেন তেমনি দূর্বলকে এবং যে তার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করতো তাকেও শরণ দেওয়া ছিলো তার উত্তমগুণ। যার উল্লেখ আমরা রামায়ণের যুদ্ধকান্ডে উল্লেখ পাই, যখন বিভীষণ মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামের শরণাপন্ন হন।
🌱"সকৃদেব প্রপন্নায় তবাস্মীতি চ যাচতে ।
অভয়ং সর্বভূতেভ্যো দদাম্যেতদ ব্রতং মম ।। আনয়ৈনং হরিশ্রেষ্ঠ দত্তমস্যা ভয়ং ময়া।
বিভীষিনো বা সুগ্রীব বা যদি বী রাবণঃ স্বয়ম্"।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধকান্ড ১৮/৩৪📖🌼
✍️অর্থাৎ, যখন বিভীষণ রামের শরণাগত হন তখন সুগ্রীবাদি তাঁকে হত্যা করতে চাইলেন। রাম বললেন- আমি শরণাগত সকল প্রাণীকে অভয় দান দিয়ে থাকি। এইজন্য বিভীষণকে হত্যা না করে আমার নিকটে নিয়ে এসো। আমি তাঁকে অভয় দান দিয়েছি। বিভীষণ কেন, যদি রাবণও স্বয়ং উপস্থিত হন, তাঁকে বধ না করে নিয়ে এসো।☘️
🔸শ্রীরামের রণশ্রেষ্ঠত্ব:-
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম যেমন বিনয়ী, সহমর্মি স্বভাবের এবং প্রজা রক্ষক ছিলেন তেমনি রাজ্য ও প্রজাদের রক্ষার্থে ও দুষ্টের দমনে ছিলেন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। তিনি ব্রহ্মচর্য শেষ করে যখন রাজগৃহে ফিরে আসেন তারপর তিনি বহু যুদ্ধ অংশগ্রহণ করেন এবং অসুর ও রাক্ষসদের পরাস্ত করেন সু নিপুণ ভাবে।
🌱"বুদ্ধিমান্ নীতিমান্ বাগ্মী শ্ৰীমাঞ্ছক্রনিবর্হণঃ।
বিপুলাংসো মহাবাহুঃ কম্বুগ্ৰীৰো মহাহনুঃ" ৷৷ 🌱
✅- বাল্মীকি রামায়ণ বালকাণ্ড ১/৯ 📖🌼
✍️অর্থাৎ, শ্রীরামচন্দ্র সুবুদ্ধিমান, নীতিজ্ঞ, বাগ্মী, শ্রীমান, শত্রুসংহারক, তাঁর স্কন্ধদেশ সুদৃঢ়, বাহুযুগল দীর্ঘ, শঙ্খের ন্যায় তাঁর গ্রীবাদেশ এবং গণ্ডস্থলের ঊর্ধ্বদিক সুপুষ্ট।☘️
▫️মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম ছিলেন একজন আদর্শ শাসক। তিনি অযোধ্যাকে এক শ্রেষ্ঠ ও সুখী রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার রাজ্য এতই সুখময় ও শান্তিপূর্ণ ছিলো যে বর্তমানেও তাকে এবং তার রাম রাজ্যকে আদর্শ মেনে দেশ পরিচালনা করেন বহু শাসক। শুধু ভারতবর্ষে নয় বরং ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া এবং থাইল্যান্ডে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এক আদর্শ এবং তার রাজ্যকে আদর্শ হিসেবে দেশ পরিচালিত হয়। তাহলে কেমন ছিলো সে রাম রাজ্য?
🌱"ন পর্যদেবেন বিধবা ন চ ব্যালকৃতং ভয়ম৷
ন ব্যধিজং ভয়ং চাসীদ্ রামে রাজ্যং প্রশাসতি"।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধকান্ড ১২৮/৯৮ 📖🌿
✍️অর্থাৎ, রামের শাসনকালে বিধবাদের ক্রন্দন শোনা যেত না, হিংস্র প্রাণীর ভয় ছিলো না, ব্যাধি থেকে উৎপন্ন ভয়ও ছিলো না অর্থাৎ রোগ কাউকে কষ্ট দিতো না।☘️
🌱নির্দস্যুরভবল্লোকো নানর্থং কশ্চিদস্পৃশৎ ।
ন চ স্ম বৃদ্ধা বালানাং প্রেতকার্যানি কুৰ্বতে।। 🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধকান্ড ১২৮/৯৯ 📖🌿
✍️অর্থাৎ, প্রজাগণ চোর-ডাকাতের ভয় থেকে রহিত, কেউ কারো প্রতি অনর্থ বা পাপ করতো না। বৃদ্ধদের সম্মুখে শিশুদের মৃত্যু হতো না।☘️
🌱সর্ব মুদিতমেবাসীৎ সর্বো ধর্মপরো্যভবৎ।
রামমেবানুপশ্যন্তো নাভ্যহিংসন্ পরস্পরম্।। 🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধকান্ড ১২৮/১০০ 📖🌿
✍️অর্থাৎ, সকলেই সন্তুষ্ট ছিলো, সকলেই ধর্মপরায়ণ ছিলো, রামকে স্মরণে রেখে পরস্পর হিংসা করতো না। ☘️
🌱"আসন্ বর্ষসহস্রানি ততা পুত্র সহশ্রিনঃ"🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধকান্ড ১২৮/১০১📖🌿
✍️অর্থাৎ, অনেক পুত্র-পৌত্র যুক্ত বংশ সহস্র বর্ষ পর্যন্ত চলত। ☘️
🔸রাম কেন শ্রেষ্ঠতর রাবণ অপেক্ষা:-
রাম এবং রাবণের মধ্যে তুলনা করা কার্যত অযৌক্তিক। কারণ শ্রীরাম ছিলেন শ্রেষ্ঠ চরিত্রের এবং আর্যশ্রেষ্ঠ। কিন্তু রাবণেরও কিছু গুণগত বৈশিষ্ট্য ছিল। রাম যেখানে সর্বগুণে গুণান্বিত সেখানে রাবণও বহু গুণের অধিকারী ছিলো। যেমন,
▫️বাল্মিকী রামায়ণ এর সুন্দর কান্ডে ৯২/৬২ শ্লোকে উল্লেখ রয়েছে যে রাবণ বেদবিশারদ ছিলেন,
🌱হে রাবণ! তুমি বেদবিদ্যাব্রজস্নাতক, স্বকর্মপরায়ণ হয়েও সীতার বধ কেন করতে চাও?🌱
▪️রাবণের মর্যাদাবোধ,
🌱"এবং চৈতদকামাং ত্বাং ন চ স্প্রক্ষ্যামি মৈথিলি"।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ সুন্দরকান্ড ২০/৬📖🌼
✍️অর্থাৎ, রাবণ সীতাকে বললেন, হে সীতা। তুমি যদি আমার প্রতি কামভাব পোষণ না করো আমি তোমাকে স্পর্শ করতে পারি না। ☘️
এরুপ মন্তব্যের পর রাবণ মাতা সীতাকে একবছর সময়ের অনুরোধ গ্রহণ করে। কিন্তু রাবণ এর সকল গুণগত বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলেও রামের একটি গুণের নিকট সব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আর সে গুণ বা আদর্শ হলো চরিত্র। মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর চরিত্র ছিলো তুলনাহীন। তিনি ছিলেন ধার্মিক ও একজন প্রকৃত বৈদিক জীবন নির্বাহকারী। রাবণ পাপী ও দুরাচারী ছিল না হলে তিনি ছিলেন অন্যন্য।
এমনকি রাবণের ব্যক্তিত্ব ও সৌন্দর্য দেখে শ্রীরাম উল্লেখ করেন,
🌱"অহোরুপমহো ধৈর্যমহো কান্তিরহো দ্যুতিঃ
অহো রাক্ষসরাজস্য সর্বলক্ষণযুক্ততা
যদ্যধর্মো ন বলবান স্যাদয়ং রাক্ষসেশ্বরঃ
স্যাদয়ং সুরলোকস্য সশত্রুস্যাপি রক্ষিতাঃ"🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ সুন্দরকান্ড ৪৯/১৮📖🌼
✍️অর্থাৎ, অহো রাবণের রূপসৌন্দর্য, আহো কান্তি, সর্বলক্ষ্মণযুক্ত দেহ! যদি এর মধ্যে অধর্ম বলবান না হতো তাহলে রাবণ ইন্দ্রসহ দেব লোকের অধীশ্বর হয়ে যেত। ☘️
▫️রাবণ অত্যন্ত অহংকারী, অত্যাচারী ছিলো সেজন্য অধার্মিক হওয়ায় তার পতন হয়। রাবণের পাপের বর্ণনা তার স্ত্রী মন্দোদরী উল্লেখ করেন,
🌱"নৈকযজ্ঞবিলোপ্তারং, ধর্মব্যবস্থাভেত্তারং।
দেবাসুর নু কন্যা নামহির্তারং ততস্তত"।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ যুদ্ধকান্ড ১১১/৫১📖🌼
✍️অর্থাৎ, অনেক যজ্ঞের বিলুপ্তকারী, ধর্মব্যবস্থা লঙ্ঘনকারী, দেব অসুর ও মানব কন্যাদের যত্রতত্র হরণকারী। আর তুমি তোমার এইসব পাপ কর্মের কারণে হত হয়েছো। ☘️
🌱"মম্ত্রেরভিষ্টুতং পুণ্যমধ্যরেষু দ্বিজাতিভিঃ৷৷ ১৯
হবিধানেষু যঃ সোমমুপম্তি মহাবলঃ"। 🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ অরণ্যকান্ড ৩১/১৯📖🌼
✍️অর্থাৎ, যজ্ঞের সময় ব্রাহ্মণগণ যজ্ঞস্থলে সোমদ্রব্যাধারে মন্ত্রপূত পবিত্র সোমরস দান করলে মহাবলী রাবণ তা নষ্ট করে দেয়।☘️
🌱"প্রাপ্তযজ্ঞহরং দুষ্টং ব্রহ্মঘ্নং ক্ররকারিণম্। কর্কশ নিরনুক্রোশং প্রজানামহিতে রতম্"।🌱
✅ বাল্মিকী রামায়ণ অরণ্যকান্ড ৩১/২০📖🌼
✍️অর্থাৎ, রাবণ ছিলেন যজ্ঞসমাপ্তিকালে সেই যজ্ঞ নষ্টকারী, দুষ্ট, ব্রাহ্মণহন্তা, নিষ্ঠুরকর্মা, রুক্ষ, নির্দয় প্রজাদের অহিতকারী।☘️
🔸রাবণ ধর্ষণকারী: -
বাল্মিকী রামায়ণ সুন্দরকান্ডে বর্ণনা পাওয়া যায় রাবণের অসৎ চরিত্র সম্পর্কে,
🌱"এবমুক্ত্বব্রিবীদ্রম্ভা বেপমানা কৃতাঞ্জলিঃ।
প্রসীদ নার্হসে বক্তুমীদৃশং ত্বং হি মে গুরুঃ" ৷৷🌱
✍️অর্থাৎ, রাবণ এই কথা বলায় রম্ভা কেঁপে উঠে হাত জোড় করে বললেন- 'প্রভু! প্ৰসন্ন হোন—আমাকে কৃপা করুন। এরূপ কথা আপনার মুখ থেকে বার হওয়া উচিত নয়। কারণ আপনি আমার গুরুজন- পিতার তুল্য।☘️
▫️কিন্তু রাবণ তার বিনীত অনুরোধ শুনেনি।
🌱"এবমুক্তা স তাং রক্ষো নিবেশ্য চ শিলাতলে।
কামভোগাভিসংরক্তো মৈথুনায়োপচক্রমে"।।🌱
✍️অর্থাৎ, এই কথা বলে সেই রাক্ষস রম্ভাকে বলপূর্বক শিলায় বসিয়ে, কামভোগে আসক্ত হয়ে তার সঙ্গে সমাগম করেন।☘️
▫️রাবণের এরুপ পাপ ও অত্যাচার দেখে সে সূর্পণখাও বলে,
🌱"প্রমম্তঃ কামভোগেষু স্বৈরবৃত্তো নিরঙ্কুশঃ।
সমুৎপন্নং ভয়ং ঘোরং বোদ্ধব্যং নাববুধ্যমে"। 🌱
✍️অর্থাৎ, হে রাক্ষসরাজ! স্বেচ্ছাচারিতাহেতু অবাধে কামভোগাসক্ত হয়ে জ্ঞাতব্য আসন্ন ভয়ঙ্কর বিপদ তুমি বুঝতে পারছ না।☘️
🔸কিন্তু বিপরীতে মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরাম এর বর্ণনা হলো:-
🌱আনৃশংস্যম্ অনুক্রোশ: শ্রুতম্ শীলম্ দমঃ শমঃ |
রাঘভম্ শোভ্যন্তি এতে ষড়্ গুণাঃ পুরুষ উত্তমম্।।🌱
✅বাল্মিকী রামায়ণ, অযোধ্যাকাণ্ড ৩৩/১২📖🌼
✍️অর্থাৎ, অহিংস স্বভাব, সমবেদনা, পাণ্ডিত্য, উত্তম আচরণ, আত্মনিয়ন্ত্রণ, প্রশান্তি- এই ছয়টি গুণ রামচন্দ্রের চরিত্রকে সজ্জিত করেছে, তাই তিনি পুরুষোত্তম।☘️
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম যেখানে তার গুণের জন্য ছিলেন সকলের প্রাণপুরুষ ও জগতবিখ্যাত এবং সকল প্রজার প্রিয়। সেখানে রাবণ ছিলো ধর্ষণকারী, অধার্মিক এসকল পাপের কারণে সে অধম হয়েছে।
মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর সাথে রাবণের তুলনা কখনো সম্ভব নয়। শ্রীরাম একজনই তিনি শ্রেষ্ঠ তার চরিত্র ও ব্যক্তিত্ববলে।
🌱"য়াবৎ স্থাস্যন্তি গিরয়ঃ সরিতশ্চ মহীতলে।
তাবদ্ রামায়ণকথা লোকেষু প্রচরিষ্যতি"।।🌱
✅- বাল্মিকী রামায়ণ আদিকান্ড ২/৩৬
✍️অর্থাৎ, যতকাল এই ধরণীতলে পর্বত দাড়িয়ে থাকবে আর নদীর ধারা প্রবাহমান থাকবে, ততকাল শ্রী রামের রামায়ণকথা এই জগতে লোকমুখে প্রচারিত হবে।☘️
▪️রামায়ণের এ উক্তির যর্থাততা বর্তমানেও বিদ্যমান। আমরা সকলে প্রচেষ্টা করবো মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর চরিত্রকে আদর্শ হিসেবে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করা। শ্রীরামের মতো দায়িত্ববান, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়া। সকলে সমভাবে ভালোবাসা। তবে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরাম এর যথাযোগ্য মর্যাদা আমরা করতে পারবো।
জয় শ্রীরাম - জয় সনাতন 🚩