13/09/2024
ইতিহাস ও আত্মপরিচয়
আত্মপরিচয় নির্মাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান হলো ইতিহাস। এই অধ্যায়ে আমরা আত্মপরিচয়ের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব।
মানুষের যেকোনো আত্মপরিচয়কে সঠিকভাবে এবং শক্তিশালীভাবে আবিষ্কারের জন্য সে আত্মপরিচয়ের ইতিহাস সম্পর্কে জানা জরুরি। আমরা লক্ষ করলেই দেখব, বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের আকৃতিবিশিষ্ট বা ভাস্কর্য নির্মাণ করে। এসব ব্যক্তির সাথে ওই রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক সম্পর্ক থাকে। কখনো কোনো রাষ্ট্রপ্রধান, আবার কখনো কোনো সৈনিক, আবার কখনো কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রতীকি আকৃতি বিভিন্ন দেশই নির্মাণ করে থাকে। আর দেখা যাবে তারা সকলেই ওই রাষ্ট্রের ইতিহাসের অংশ। আবার দেশে দেশে বিচিত্র ধরনের স্মৃতিসৌধও তৈরি করা হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যখন সেগুলো নিয়ে আলোচনা করে, তখন এর ইতিহাস টেনে নিয়ে আসে। কারণ ইতিহাস জাতির আত্মপরিচয় নির্মাণ করে। এজন্য প্রত্যেক জাতিই তাদের ইতিহাসের স্বীকৃতি দেয়, গুরুত্ব দেয় এবং এর সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করে।
কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, জাতি হিসেবে বর্তমান মুসলিম জাতি এই জায়গায় খুবই দুর্বল ও উদাসীন। আমাদের পূর্বসূরি মনীষীদের হাতে নির্মিত ইতিহাসশাস্ত্রের সমৃদ্ধ এক ভান্ডার আছে আমাদের। আছে আমাদের বিজয়, শাসন, সভ্যতা, সংস্কৃতি নির্মাণকারী গৌরবময় সুদীর্ঘ ইতিহাসের ধারা। কিন্তু আমরা সে ইতিহাস থেকে পরিপূর্ণ বিমুখ হয়ে পড়েছি।
আমরা যদি ইউরোপের দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখব যে, তারা কেবল তাদের ইতিহাসই নয়, বরং মুসলিমদের জ্ঞানশাস্ত্র ও ইতিহাস নিয়ে বিভিন্ন শাস্ত্র গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো প্রাচ্যবাদ। আর ইসলামি ইতিহাস ও শাস্ত্র সম্পর্কে জানার জন্য আধুনিক সময় মুসলিম তরুণদের কাছে সেগুলোই উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য তারা ইসলামি ইতিহাস ও ইসলামের বিভিন্ন শাস্ত্র নিয়ে ইউরোপীয় বা সেকুলার প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছে। উদ্দেশ্যমূলক কিংবা বিভ্রান্তিমূলক এই ইতিহাস পাঠ করে তারা হয়তো নিজেদের ইতিহাস সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পাচ্ছে অথবা নিজেদের ইতিহাসের শিক্ষাকে পশ্চিমা সভ্যতা ও সংস্কৃতির পেটে দাফন করে দিচ্ছে। অথচ ইউরোপীয়রা নিজেদের ইতিহাস নিয়ে গর্ব করে। আর আমরা আমাদের ইতিহাস নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভুগি! আরও পরিতাপের বিষয় হলো, পশ্চিমাদের নিক্ষেপিত ইতিহাসকে মানদণ্ড বানিয়ে অনেক মুসলিম নিজেদের ঐতিহাসিক বিভিন্ন ব্যক্তিত্বকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখছে। এজন্য আমরা দেখি, কোনো কোনো মুসলমান এ কথাও বলছে যে, আমাদের ইতিহাস গৌরবোজ্জ্বল নয়; মূলত ইসলামি বিজয়গুলো ছিল একধরনের উপনিবেশ, নাউজুবিল্লাহ। এগুলো মূলত পশ্চিমা প্রাচ্যবিদ কিংবা সেকুলারদের নিক্ষেপিত ইতিহাসের প্রভাব।
ভূখণ্ড হিসেবে আমাদের বাংলাদেশের মুসলিমদের আরেকটি সংকট হলো—এই অঞ্চলে ইসলাম ও মুসলিমদের ইতিহাস সম্পর্কে তাদের অজ্ঞতা। এখানে আমাদের ইতিহাসকে বিগত ৫০ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ভূখণ্ডে ইসলাম ও মুসলিমদের বসবাস ১২শ বছরেরও বেশি সময় যাবৎ। বাঙালি ইতিহাসের হিন্দুত্ববাদী ও সেকুলারীয় যে বয়ান এখানে আরোপিতভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে, এটি এই অঞ্চলের মুসলিমদের জন্য হুমকিস্বরূপ। যাই হোক, এখানে আমরা সে ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করব না। সামনের কোনো মলাটে আমরা এ নিয়ে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
আমরা এখানে এটাই বোঝাতে চাচ্ছি যে, মানুষের আত্মপরিচয় গঠনে ইতিহাসের ভূমিকা স্বীকৃত ও বাস্তব বিষয়। কিন্তু মুসলিমরা আজ তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য থেকে উদাসীন। যতটুকু ইতিহাসের বয়ান তারা গ্রহণ করছে সেটাও নিজেদের ভান্ডার থেকে নয়; বরং শত্রু ও অন্যদের রচিত ঐতিহাসিক বয়ান তারা গিলছে, যা তাদের আত্মপরিচয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
আমরা এখন একটা অবস্থা কল্পনা করি। ধরুন, রাসুলের সিরাত, নবিদের বিভিন্ন ঘটনা, আবু বকর, উমর, উসমান, আলি, খালিদ বিন ওয়ালিদ, সালাহুদ্দিন আইয়ুবি, খাদিজা, আয়েশাসহ ইতিহাসের সকল ঘটনাপ্রবাহ ও ব্যক্তিত্বকে চিন্তা থেকে ফেলে দিতে চাইলাম। এ সকল ঘটনা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইলাম। এখন ভাবুন তো, যারা এ সকল ব্যক্তিত্ব ও ঘটনা সম্পর্কে জানে, তারা কি কখনো নিজেদের এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে। তারা যতই চেষ্টা করে যাক, সে কল্পনা তারা করতে পারবে না। কারণ এগুলো তাদের আত্মপরিচয়ের মৌলিক উপাদান, যেখান থেকে তারা কখনোই বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না। হ্যাঁ, একজন তখনই এগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারবে, যখন সে এগুলো সম্পর্কে অজ্ঞ হবে, এগুলোর কোনো জ্ঞানই তার থাকবে না।
এজন্য আমাদের মুসলিমদের অতীত ইতিহাস জানতে হবে। ভ্রমণ করতে হবে ইতিহাসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের বীরদের জীবনচরিতে। কদম ফেলতে হবে ইতিহাসের পাতার বিশাল অংশ জুড়ে থাকা আমাদের শাসনব্যবস্থা, সভ্যতা, সংস্কৃতি আর বিজয়নগরে। তখন আমরা নিজেদের চিনতে পারব, আবিষ্কার করতে পারব আমাদের আত্মপরিচয়। কারণ ইতিহাস মানুষকে নির্মাণ করে।
বই : আত্মপরিচয়ের সংকট -১
লেখক : ইফতেখার সিফাত
মুদ্রিত মূল্য : ২৫০৳