05/08/2024
#অপ্রিয়কথা
লেখাটা প্রথমে শুরু করেছিলাম "৫ আগস্ট ২০২৪ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের মধ্যে দিয়ে আশা করি দেশে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো" এই লাইন দিয়ে! কিন্তু এর মাঝেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িটাকে দাউদাউ আগুনে জ্বলতে দেখে মনে হচ্ছে, দেশ আসলে স্বাধীন না, দোযখের মালিকানাটা হয়তো এক হাত থেকে অন্য হাতে হস্তান্তরিত হয়েছে মাত্র! প্রচন্ড দুঃখ, হতাশা আর ব্যার্থতা নিয়ে বলতে হচ্ছে আমরা দেশের জনগনরা আসলে এমনই! প্রতিহিংসাপরায়ণ! সুযোগের অভাবে সবাই ভালো আর সহজ সরল! সুযোগ পেলে প্রত্যেকে এক একজন রাবণ! কি ভীষন হিংস্রতা আর ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মানসিকতা আমরা নিজেদের ভেতর ধারন করি তা ভাবলেও আমি শিউরে উঠি!
সত্যি কথা বলতে দেশের স্বাধীনতার জন্য যারা লড়েছে, যারা প্রান দিয়েছে, ৭১ কি ২৪, সেই স্বাধীনতা আমরা এতো বছরেও পাইনি। সামনেও পাওয়ার আশা আছে কিনা জানি না। আজকে কোনভাবে আওয়ামীলিগ জিতে গেলে যা করতো, সাধারণ জনগনও ঠিক একি কাজটাই করছে! ধ্বংসযজ্ঞ, হানাহানী আর প্রতিশোধপরায়নতার উদযাপন! তাই হয়তো স্বাধীনতার দাবীতে অন্য সবার মতো অতি আবেগের আতিশয্যে স্রোতে গা ভাসাতে পারিনি। যুক্তিবোধটাই বেশী কাজ করেছে!
নাহ, শেখ হাসিনার বিকল্প নাই বা দেশ কে চালাবে এই ভাবনার চেয়েও শংকিত হচ্ছিলাম দেশের পলিটিক্যাল ট্র্যাকরেকর্ড চিন্তা করে। বিএনপি জামাত জেতার পর ২০০১ এ প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপানো হিন্দুদের পুড়ে ছাই হওয়া বাড়িঘরের ধ্বংসস্তুপ আর ঘরপোড়া মানুষের আর্তনাদ আমি ভুলতে পারিনা! আর আওয়ামীলিগ ক্ষমতায় আসার পর ক্যাঙারু কোর্টে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ত্বকী হত্যা, সাগর, রুনী হত্যা, গুম খুনের সংস্কৃতি আর সর্বশেষ সাধারন ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ, এসবই বা আমি কিভাবে ভুলবো! এইসব ক্ষত প্রতিটা মানুষের মনে এখনো তরতাজা!
গণজাগরন মঞ্চের সময় আওয়ামীলিগের সৃষ্ট যে ডিভাইড আর রুল কালচার তা আমাদের নেক্সট কত জেনারেশন ধরে বহন করতে হবে কে জানে!
লীগের বিপক্ষে কথা বলা মানেই যেমন রাজাকার ট্যাগ দেয়া হতো, আজকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের সাথে সাথে বিজয়ী জনগন, 'লীগের দালালদের' লিস্ট করা শুরু করেছে! অর্থাৎ লীগের পক্ষে কেউ কিছু বললে সেও এখন 'বিপক্ষ দল' হয়ে যাবে! কেউ কোথাও ভারসাম্য রাখতে পারবে না! আর এই পক্ষপাতিত্বের রাজনীতিতে জয়ী হয় শুধু ক্ষমতাবান আর তাদের পক্ষ! এর বাইরে আমরা আর কিছু বুঝিনা! বুঝতে চাইও না। কারন ক্ষমতাইতো দিনশেষে আমাদের 'যাদুর কাঠি'!
আমরা বাঙালীরা আবেগী জাতি, যেই আবেগ দিয়ে ৭১ এ পূর্বপুরুষরা দেশ স্বাধীন করেছিলো, ঠিক একিই রকম স্পৃহা আর আবেগ দিয়ে আমাদের কিশোর তরুনরা ২০২৪ এ এসেও দেশকে স্বৈরাচারমুক্ত করেছে। কিন্তু তারপর! যারা শহীদ হয়েছে, তারাতো আর ফিরে আসবেনা, কিন্তু যারা বেঁচে আছি তাদের দায়িত্বতো আকাশসম! কিন্তু ইতিহাস বলে সেই দায়িত্ব পালনে আমরা আসলে খুব একটা সফল না। আমরা বিজয় উদযাপন করি হিংস্রতার মাধ্যমে। আজ যদি আওয়ামীলীগের বিজয় হতো তাহলে সাধারণ জনগন আর ছাত্রদের যা দশা হতো, এখন হয়তো লীগের সাধারণ নেতাকর্মী আর সাপোর্টারদের সেই একি দশাই হবে! এই লেখা লিখতে লিখতে ইতিমধ্যেই ভাংচুরের খবর দেখছিলাম সোশাল মিডিয়াতে! গণভবন লুটপাট, সংসদ ভবনের চেয়ারে বসে সিগারেট টানা, হিন্দু বাড়িতে ভাংচুর, মন্দিরে আগুন, ভয় দেখানো!
আচ্ছা এতে করে কি স্বাধীনতার স্বাদ নেয়া হচ্ছে আপনাদের! খুব মিষ্টি লাগছে এই স্বাধীনতা! ১৫/১৬ বছর যারা লীগের লুটপাট, হত্যা, গুম সহ্য করেছে তাদের অনেকেই এখন চাইবে যেভাবেই হোক তার প্রতিশোধ নিতে! কিন্তু কে বোঝাবে এই জাতিকে এই প্রতিশোধপরায়ন মানসিকতার পরিবর্তন না হলে, দেশ যতবারই স্বাধীন হোক না কেন, যতজনই শহীদ হোক না কেনো, সেই স্বাধীনতার সম্মান বা অস্তিত্ব বেশীদিন টেকেনা! যদি টিকতো তাহলে জনগনের ভয়ে 'শেখের বেটি'র লেজ গুটায় এইভাবে পালানো লাগতো না!
নেক্সট দেশ কে চালাবে, কি পরিকল্পনা, কি ভাবে কি হবে, কে যাবে, কে থাকবে আমি জানিনা। কিন্তু এইটুকু বুঝতে পারি আবেগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করা গেলেও, দেশ চালানো যায়না! আর এটাও সত্য যে এতোদিন ধরে প্রশাসন চালানো আওয়ামী মনোভাবাপন্ন যারা তারা খুব সহজে নতুন প্রধানমন্ত্রীকে বরন করে নেবে বা নিশিন্তে দেশ পরিচালনা করতে দেবে সেটাও আমি ভাবিনা। কিন্তু খুব করে চাই দেশের সত্যিকার অর্থে ভালো চাওয়া তরুন আর প্রজ্ঞাবানরা মানুষেরা এক হয়ে দেশের জন্য মঙ্গলময় পরিবর্তনগুলোই আনুক!
দেশ যেমন কারো বাপের না, দেশকে তেমন নতুন করে অন্য কারও বাপেরও হতে দেয়া যাবেনা! দেশ আমাদের সবার-আমার মতের পক্ষে যারা অথবা বিপক্ষে! তারমানে এই না যে দেশের ক্ষতি করা বা দেশের সম্পদ নষ্ট করার অধিকার আমাদের কারো আছে!
পরিবারে বাবা, মা, ভাইবোনের সাথে অমত হলেও যেমন আমরা তাদেরকে চিরশত্রু ভাবা শুরু করিনা। দেশটাও তেমনি। আপনি, আমি, পক্ষ, বিপক্ষ সবাই মিলেই আমাদের দেশ। এক দল জনগনকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দিতে চায় তো আর এক দল ভারত! তাদের সাহস কি করে হয় যে তারা দেশের মানুষের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে যায় কে কোন দেশে যাবে! অতীতের রাজনৈতিক ট্র্যাকরেকর্ড দেখলে উপলব্ধি করা যায় আমাদের পূর্বসুরীরা না অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছে, না তারা হিংসা, বিদ্বেষ উপেক্ষা করে জনগনের ভালোর জন্য দেশকে দৃঢ়ভাবে পরিচালিত করতে পেরেছে! তাই এই ২০২৪ এ এসে আমরা কি এবার আশা করতে পারিনা আমাদের নতুন প্রজন্ম অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আর প্রতিহিংসার রাজনীতিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, প্রত্যেকের জন্য সমান অধিকারের বাংলাদেশ গড়ে তুলবে!
©মুনলীন
(অস্থির সময়ের অগোছালো কিছু ভাবনা)