17/09/2024
পাঠ পরবর্তী প্রতিক্রিয়া লিখেছেন মানসী মণ্ডল
ভাদ্র মাস মানেই অগস্ত্যের মাস। সেই অগ্যস্তকে নিয়েই লেখা বই :
অগস্ত্য ও শাঁখা— ইতিহাস, পুরাণ আর বর্তমানের মিসিং লিংক
'গতকালই ঘরের গম ফুরিয়ে গিয়েছে। বাণিজ্যে যাওয়ার আগে পলিত যেটুকু কিনে দিয়ে গিয়েছিল তাতে ভালোভাবেই দুই চাঁদ অবধি চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু দুই চাঁদ পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যে পলিত ফিরবে না তা উস্না কখনও ভাবেনি। এই হারিপা শহরে আসার পর থেকে তার কেমন যেন সব অচেনা লাগে। মেলুহার মধ্যে হলেও এখানকার আদবকায়দা, কথা বলার ঢং সবই তাদের বারাকে বসতির থেকে অনেকটাই আলাদা। সবে তিন মাস হল উস্না এখানে এসেছে পলিতের সঙ্গে, যদিও আসার ইচ্ছে তার ছিল না। পলিত হারিপার মানুষ হলেও তার নিয়মিত আসাযাওয়া লেগেই থাকত বারাকেতে। আর হবে নাই বা কেন, মেলুহাতে শঙ্খের কারবার করতে হলে তাকে বারাকেতে আসতেই হবে, নয়তো শঙ্খ সে পাবে কোথায়।.....'
একটা কাল্পনিক গল্পের শুরুর অংশ।
এরকম একটা গল্প দিয়েই শুরু এই আশ্চর্য বইখানা। কিন্তু না, গল্পের বই এটা নয়। এটা একটা ইতিহাসের বই যেটাকে আষ্টেপৃষ্টে, পরতে পরতে জড়িয়ে রেখেছে এই কাল্পনিক গল্পখানা। গল্প সে কোন সুদূরের, কোন পুরা কালের। আমরা তাকে চিনি কিন্তু ভারি আবছা আর অস্পষ্ট। । 'হারিপা' শব্দটা কেমন যেন চেনা চেনা ঠেকছে তাই না? ঠিক ধরেছেন, হরপ্পা শহর, যার কথা ইতিহাসের বইয়ে পড়েছি এ সেই হরপ্পা। এই শহরেই পলিতের বাড়ি, সে শাঁখার ব্যবসা করে। মেসোপটেমিয়া সভ্যতায় হরপ্পাসভ্যতাকে বলা হত মেলুহা। এই শাঁখার ব্যবসা করতে পলিতকে যেতে হতো বারাকে । কারণ হারিপার সবচেয়ে কাছের সমুদ্রতীরের অঞ্চল ছিল 'বারাকে '।ছোট ছোট সব সম্মিলিত দ্বীপপুঞ্জ।বেট দ্বারকা, দ্বারকা, নাগেশ্বর। সেখানেই পাওয়া যেত শাঁখ। স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রতীরের অঞ্চলে শাঁখ থেকে অলঙ্কার তৈরি হতেই পারে। কিন্তু আমাদের আশ্চর্য হতে হয় হরপ্পাসভ্যতার পরিণত পর্যায়ের পাঁচ - ছয় হাজার বছর আগেই বৃহত্তর হরপ্পাসভ্যতার প্রথম পর্যায়ে মেহেরগড়ে সমাধি খনন করে অনেক অলঙ্কারের সন্ধান পাওয়া গেছে।এদের মধ্যে ছিল শাঁখের তৈরি গয়না। মেহেরগড়ের সবচেয়ে কাছের সমুদ্রতট ছিল মাকরানা উপকূল, দূরত্ব প্রায় পাঁচশো কিলোমিটার। এতদূর থেকে কীভাবে এল শাঁখা?
শাঁখা বললেই বাঙালি সধবা নারীর হাতদুখানি মনে পড়ে। শুধু বাঙালি নারীরা নন বাঙালি দেবীরাও তাঁদের হাতে শাঁখাকে স্থান দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব বর্ধমান জেলার ক্ষীরগ্রামে মা যোগাদ্যা স্বয়ং বাঙালি কন্যে সেজে শাঁখারির হাত থেকে শাঁখা পরেন। এই নিয়ে কবি তরু দত্ত তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'Jogadhya Uma' লেখেন।তবে এই শাঁখা শুধু বাঙালির নয় তামিলকাব্য মাদুরিকাঞ্চিতেও এক ডুবুরি জাতির উল্লেখ আছে যারা ডুব দিয়ে শাঁখা তুলে আনত। মধ্যপ্রদেশের নিমার জেলায় নর্মদা নদীর তীরে মহেশ্বর যা প্রাচীন নগরী মাহিষ্মতী সেখানে খনন করে শাঁখা পাওয়া গেছে। মহারাষ্ট্রের পৈথান যেখানে একসময় সাতবাহন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। তখন এর নাম ছিল প্রতিষ্ঠান। সেখানে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে থেকে পাওয়া প্রত্ন বস্তুর মধ্যে অন্যতম হল শাঁখা। তামিলনাড়ুরও বেশ কিছু জায়গায় প্রত্নবস্তু হিসেবে শাঁখা পাওয়া গেছে। যদিও বর্তমানে দক্ষিণ ভারতে শাঁখার প্রচলন নেই কিন্তু একসময় যে প্রচলন ছিল প্রত্নবস্তুই তার প্রমাণ। সূদুর উত্তর- পশ্চিমে সুপ্রাচীন সিন্ধুসভ্যতা থেকে দাক্ষিণাত্য, দাক্ষিণাত্য থেকে বঙ্গদেশ সবখানেই গুরুত্বপূর্ণ অলঙ্কার ছিল শাঁখা। তাহলে এদের মধ্যে কি কোনো যোগসূত্র আছে? কী সেই যোগসূত্র?
আবার ফিরে আসি গল্পে। ".... বিপদের দিনে কাজে লাগবে বলেই হারিপায় নিয়ম আছে যে প্রত্যেককে একটি কলসে কিছুটা করে শস্য জমিয়ে রাখতে হয়, যে যেমন পারে। যেদিন পুরো চাঁদ ওঠে, সেই দিন মন্দিরে গিয়ে পুরোহিত রাজার খাজাঞ্চির কাছে নিজের বাড়ির মোহর দেখিয়ে শস্য ভর্তি সেই কুম্ভ দিয়ে আসতে হয়।... কলস ভর্তি শস্য নিয়ে গেলে তখন খাজাঞ্চির লোক প্রত্যেকের মোহর দেখে লিখে নেয় আর শস্য জমা হয়ে যায় শস্যাগারে। হারিপার সে শস্যাগার দেখার মতো, বিরাট ইটের চাতালের উপরে সরু রাস্তা যার এক এক দিকে ছয়খানা করে বিরাট ঘর।.... হারিপায় পলিতের মত প্রচুর মানুষ আছে, যাদের চাষের জমিজমা নেই আর ঘুরে ঘুরে বাণিজ্য করার নেশা লেগে গেলে তাদের দিয়ে জমি চষা, কাপড় বোনা কিংবা তামা গলানো যায় না। তাই এই কুম্ভের নিয়ম। "
কুম্ভ বা ঘড়ার চিহ্ন ছিল সিন্ধুসভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ লিপি। যদিও এই বোবা সভ্যতার অনেক কিছুই আমাদের আকারে ইঙ্গিতে বুঝতে হয়েছে। সেখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে প্রত্নবস্তু, বিভিন্ন রঙের পোড়া মাটির পাত্র। মাটির পাত্রের রং বলে দেয় সে সিন্ধুসভ্যতার, না বৈদিক সভ্যতার না রামায়ণ বা মহাভারতের কালে। এইসব পোড়া মাটির পাত্রই প্রাচীন এইসব সভ্যতাকে চিনিয়েছে, কিন্তু কীভাবে?
সিন্ধুসভ্যতার লিপিগুলো শেষ হয়েছে এই কুম্ভচিহ্ন দিয়ে। এই চিহ্ন বারবার লিপিতে ঘুরে ফিরে এসেছে।যেটুকু জানা গেছে সিন্ধুসভ্যতার এক এক প্রশাসক বংশের নাম ছিল কুম্ভবংশ। এই কুম্ভবংশের সঙ্গেই যোগসূত্র ছিল অগস্ত্যের । আবার অগস্ত্যই সেই বিখ্যাত ঋষি যাঁর আদেশে বিন্ধ্যপর্বত মাথা ঝুঁকিয়ে ছিল।এই অগ্যস্ত মুনির নাম রামায়ণ, মহাভারত, স্কন্দপুরাণে উল্লেখ আছে।রামায়ণে আছে সুগ্রীব পরামর্শ দেন সীতাকে খুঁজতে যাওয়ার আগে অগস্ত্যের আশ্রমে গিয়ে তাঁর আশীর্বাদ নিতে। ওদিকে মহাভারতে আছে যযাতির পিতা নহুষকে অগস্ত্য সাপ হওয়ার শাপ দেন।
যযাতি ছিলেন যদু বংশ এবং কুরুবংশের পূর্বপুরুষ।
হচ্ছিল কথাটা সিন্ধুসভ্যতার চলে এল রামায়ণ, মহাভারত। আরো একটা তথ্য দিই, পশ্চিমবঙ্গে যেসব শাঁখারি আছেন তাঁদের উপাস্য দেবতা এই অগ্যস্ত ।
দাঁড়ান মশাই, সিন্ধুসভ্যতা, রামায়ণ, মহাভারত, স্কন্দপুরাণ আর বাঙালি, হয়ে গেল অগস্ত্য!
কেমন মাথাটা গুলিয়ে গেল তো?এ যেন অনেকটা সেই সুকুমার রায়ের 'হযবরল' গল্পের মত।
'বেড়ালটা খুশি হয়ে বলল, "হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে --চন্দ্রবিন্দুর ' চ', বেড়ালের তালব্য ' শ', রুমালের ' মা ' - হলো চশমা। কেমন, হলো তো?"
ওদিকে আবার দক্ষিণের সঙ্গম সাহিত্য বলছে অগস্ত্য বিন্ধ্যপর্বত পেরিয়ে দক্ষিণে এসেছিলেন দ্বারকা থেকে।তাঁর সঙ্গে তামিল দেশে এসেছিল আঠেরোজন। এরা নাকি আবার যদুবংশের। এরাই ভেলির রাজা নামে নামে খ্যাত। সঙ্গমসাহিত্য অনুসারে এই সব ভেলির রাজার পূর্বপুরুষের জন্ম কুম্ভ থেকে হয়েছিল। অর্থাৎ তাঁরা কুম্ভবংশ বা কুম্ভ গোষ্ঠীর মানুষ। ওদিকে যযাতির পুত্র যদুর বংশে জন্ম নেন কৃষ্ণ। এই লেখার শুরুতে যে বারাকে অঞ্চলের কথা বলা তার সঙ্গে কৃষ্ণের যোগসূত্র ছিল। কী সেই যোগসূত্র?
কেন অগস্ত্য এবং কৃষ্ণের পূর্বপুরুষ যদু বংশের মানুষরা চলে এলেন দ্বারকা ছেড়ে? পুরাণে অগস্ত্যের বিন্ধ্যপর্বত পেরোনো নিয়ে মজাদার কাহিনী আছে। ওদিকে সঙ্গমসাহিত্য বলছে সমস্ত দেবতারা মেরুপর্বতে চলে গেলে পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষার জন্য অগস্ত্যকে দক্ষিণে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করা হয়। কারা এই দেবতারা? অগস্ত্যকেই বা চলে যেতে হল কেন? আবার এই অগস্ত্যই হয়ে উঠলেন বাঙালি শাঁখারিদের দেবতা। কীভাবে? ইতিহাস কী বলে?
ভাদ্র মাসের আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র অগস্ত্য। শাঁখারিরা অগস্ত্যপুজো করেন ভাদ্রমাসেই। আবার ১লা ভাদ্র অগস্ত্যযাত্রা।
অগস্ত্য আর বাঙালি রমণীর শাঁখা যেন মিসিং লিংক যা জুড়ে দেয় সিন্ধুসভ্যতা, বৈদিক সভ্যতা এবং রামায়ণ - মহাভারতের কালকে।
সত্যিই এক আশ্চর্য বই এই 'সিন্ধু সভ্যতায় শাঁখা ও অগস্ত্যযাত্রা' ।লেখক দীপান ভট্টাচার্য তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে বিস্তারিতভাবে ব্যখ্যা করেছেন বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য। এ বই ভীষণ সহজ সরল করে লেখা যাতে পাঠককে কোথাও হোঁচট খেতে না হয় । যতরকমের তথ্য দেওয়া যায় তাঁর বক্তব্যকে সমর্থনে সব তিনি উত্থাপন করেছেন। কার্পণ্য করেননি এতটুকু। ভীষণরকম অধ্যবসায় আর অক্লান্ত পরিশ্রম এই বইটিকে মানুষের প্রিয় করে তুলবে। যাঁরা ইতিহাস ভালবাসেন না তাঁরাও ভালবাসবেন। আমরা ইতিহাস বইয়ে পড়েছিলাম সিন্ধুসভ্যতার কথা। কিন্তু কীভাবে এই সভ্যতা ধ্বংস হয়েছিল সেই নিয়ে কোনও সঠিক সিদ্ধান্ত জানতে পারিনি। বইয়ের পাতায় কিছু সম্ভাব্য কারণের তালিকা দেওয়া ছিল। এ প্রশ্ন মনে থেকেই গেছিল, আর তার উত্তর পেলাম এই বইয়ে। আবার এই বইটিকে অগস্ত্যপিডিয়া বললেও খুব একটা ভুল হবে না।
সবশেষে কয়েকটা ধাঁধা আর সেই কাল্পনিক গল্পের একটু অংশ দিয়ে শেষ করব। আচ্ছা, বলুন তো কৃষ্ণের শঙ্খের নাম কী?তিনি কীভাবে পেলেন এই শঙ্খ?বিষ্ণুর হাতেও থাকে এক শঙ্খ। দুটোই কি এক? শালগ্রাম শিলাতো স্বয়ং নারায়ণস্বরূপ ওদিকে আবার দ্বারকা শিলাও তাই।বিষ্ণু আর কৃষ্ণ কি একই?
'পরের মরসুমে পলিত আসতেই সে আর থাকতে পারে নি, পলিতেরও যে ইচ্ছে ছিল প্রথম থেকেই তা সে জানতে পেরেছিল বিয়ের রাত্রে। দুজনের মনের ইচ্ছা জানতে পেরে উস্নার বাবা খবর পাঠিয়েছিল সমুদ্রদেবতার পুরোহিতের কাছে।... অনুষ্ঠানে সমুদ্রদেবতার মন্দিরে রাখা পঞ্চজনের পবিত্র বিরাট শঙ্খ বাজিয়ে যখন অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল তখন তো উস্নার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল।.... আজ সকালে উঠে, উস্না স্নান করে সে সমুদ্রদেবতার পুজো সেরে নিয়েছে। হারিপায় সমুদ্রদেবতার পুজো হয় না। এটা শিংওয়ালা দেবতার রাজ্য, কিন্তু উস্না আসার সময় একটা সমুদ্রদেবতার পাথর নিয়ে এসেছে বারাকে থেকে। বারাকের মানুষদের বিশ্বাস ঢেউয়ের ওপরে হাজারখানা ফণার মতো সমুদ্রদেবতার হাজারখানা মাথা। সহস্রশীর্ষ সেই সমুদ্রদেবতার হাজার হাজার চোখ ফুটে থাকে সেই পাথরে। '
লেখকমশাই যেভাবে সাজিয়েছেন তাঁর বইয়ের সূচি :
*শুরুর কথা
*সিন্ধু সভ্যতা ভ্রমণ
*সিন্ধু সভ্যতায় শাঁখা বানাবার পদ্ধতি
*সিন্ধুসভ্যতায় শাঁখার ব্যবহার
*বাংলার শাঁখার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
*শাঁখারিদের দেবতা অগস্ত্যের সন্ধানে
*অগস্ত্যের রাজনৈতিক পরিচয়
*পুরাণ ও তার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য
*দ্বারকার খনন ও নিষ্পত্তি
*দক্ষিণের আকাশে অগস্ত্য নক্ষত্রের উপস্থিতি
এছাড়া পরিশিষ্ট ও পরিভাষা তো আছেই।
সিন্ধুসভ্যতায় শাঁখা ও অগস্ত্যযাত্রা
লেখক: Dipan Bhattacharya
প্রকাশক : শব্দ প্রকাশন
মুদ্রিত মূল্য : ৫৫০ টাকা।
বই আলোচনাটি সায়ন্তন পাবলিকেশনের কারুকৃতি গণিত সংখ্যায় প্রকাশিত।
___________________________________________________
অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। ভালো থাকুন, পাঠে থাকুন...
শব্দ প্রকাশন