27/09/2022
#মহিষাসুরমর্দিনী হল আকাশবাণী থেকে সম্প্রচারিত একটি জনপ্রিয় বাংলা বেতার অনুষ্ঠান।
১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে আজও সম্প্রচারিত হওয়া দীর্ঘতম অনুষ্ঠান। প্রথমে সরাসরি সম্প্রচার করা হত মহিষাসুরমর্দিনী। কিন্তু ১৯৭২ সালের পর তা আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই ১৯৬৬ সালের সংগৃহীত রেকর্ডটাই এখন বাজানো হয়। এত বছরেরও অনুষ্ঠানটি বিন্দুমাত্র মর্যাদা হারায়নি।
আসুন স্মৃতির সরণি বেয়ে স্মরণ করি মহিষাসুরমর্দিনীর সেই তিন প্রধান রূপকারকে - বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বানীকুমার এবং পঙ্কজকুমার মল্লিক !! আর জেনে নেই মহিষাসুরমর্দিনী সম্পর্কিত বেশ কিছু অজানা কাহিনী -----
১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ২৬ আগস্ট মুম্বই-এর ইন্ডিয়ান ব্রডকাস্টিং কোম্পানি নামে একটি বেসরকারি সংস্থা ১নং গার্স্টিন প্লেসে একটি ভাড়া বাড়িতে রেডিও স্টেশন স্থাপন করে। সংস্থার অধিকর্তা ছিলেন এক ব্রিটিশ কর্মকর্তা - নাম স্টেপলটন । প্রতিভার সমাবেশ ঘটেছিল শুরুর দিন থেকেই। পরিকল্পনা হয় ‘ভারতীয়’ ও ‘ইউরোপিয়ান’ এই দুই ভাগে হবে অনুষ্ঠান। ভারতীয় প্রোগ্রামের ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব নিলেন নৃপেন্দ্রনাথ মজুমদার। কিছু দিনের মধ্যেই এলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র ও বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য (বাণীকুমার)। যোগ দিলেন রাইচাঁদ বড়াল, হীরেন বসু। ঘোষক ও সংবাদ-পাঠক হিসেবে মোহনবাগানের ১৯১১ সালের ঐতিহাসিক শিল্ডজয়ী দলের হাফব্যাক রাজেন সেনগুপ্ত আগেই এসেছিলেন। ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গেলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। বেতারকেন্দ্র থেকে একটি নিজস্ব মুখপত্র প্রকাশিত হবে, সম্পাদনার জন্য এলেন প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। ‘বেতার জগৎ’ প্রথম প্রকাশিত হল ১৯২৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে।
প্রেমাঙ্কুর আতর্থী একদিন বললেন, যা যা অনুষ্ঠান চলছে, তার পাশাপাশি কিছু অভিনবত্ব আনাও দরকার। লেখালেখির জন্য বাণী রয়েছে, রাই সুর দিক, বীরেন শ্লোক আওড়াক্…ভোরবেলায় লাগিয়ে দাও, লোকজন ভালোই নেবে। কথাটা নৃপেন মজুমদারের মনে ধরল। বাণীকুমার ভাবতে বসে গেলেন। একমাস বাদে দুর্গাপুজো। বীরেন ভদ্র বললেন, যদি পুজোকে কেন্দ্র করেই কিছু করা হয় তাতে চণ্ডীপাঠ অবশ্যই থাকবে। কেবল একটা ব্যাপারে একটু কিন্তু রয়ে গেল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ তো কায়স্থ, তিনি চণ্ডীপাঠ করলে, সবাই মেনে নেবেন তো? সেই সময় এই দ্বিধাগ্রস্ততা অস্বাভাবিক নয়। নৃপেনবাবু বললেন, একটা প্রোগ্রাম হবে তার আবার বামুন কায়েত কি? আমরা কি হিন্দুর মন্দিরে গিয়ে পুজো করছি? এই প্রোগ্রামে যারা বাজাবে তারা তো অর্ধেক মুসলমান, খুশী মহম্মদ, আলি, মুনশি – সবাই তো বাজাবে, তা হলে তাদের বাদ দিয়ে ব্রাহ্মণদের ডেকে আনতে হয়। বাণীকুমার তখন হেসে উঠে বলেছিলেন যে, যাই হোক না কেন, তিনি বীরেনবাবু ছাড়া আর কাউকে এ কাজের জন্যে ভাববেনই না। বীরেনবাবু বাংলার সঙ্গে সংস্কৃত ভাষ্যকেও সুর বলে বাজনার সুরের সঙ্গে মিলিয়ে দিলেন। এক অন্য রূপ পেল স্তোত্রপাঠ, যা আমরা আজও শুনি। উস্তাদি যন্ত্রসঙ্গীতের সুরের সঙ্গে মিলে গেল চণ্ডীপাঠের সুর – এক অপূর্ব ধর্মীয় মেলবন্ধন।
গীতিআলেখ্য ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ প্রথম প্রচারিত হয় ১৯৩২ সালে ষষ্ঠীর দিন। তবে তার আগের বছর, বাণীকুমার (বৈদ্যনাথ ভট্টাচার্য) ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’-র বিষয়বস্তু নিয়ে ‘বসন্তেশ্বরী’ নামে একটি কাব্য রচনা করেছিলেন। সে বছরই চৈত্র মাসে বাসন্তীপুজোর সময়ে ‘বসন্তেশ্বরী’ প্রচারিত হয়। তাতে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী। অংশ নিয়েছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ও বাণীকুমারও। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। এমনই এক সময় সকলে মিলে ঠিক করলেন দুর্গাপুজোর ষষ্ঠীর সকালে এমন একটা অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়? সেই শুরু। ১৯৩২ সালে প্রথম প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বাণীকুমার এই রচনায় সহায়তা পেয়েছিলেন পণ্ডিত অশোকনাথ শাস্ত্রীর। কয়েকটি গানে সুর দিয়েছিলেন পণ্ডিত হরিশচন্দ্র বালী ও রাইচাঁদ বড়াল। তবে বেশির ভাগ গানে সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক।
১৯৩২ সালে মহাষষ্ঠীর সকালে ‘প্রত্যুষ প্রোগ্রাম’ শিরোনামে এই অনুষ্ঠান প্রথম সম্প্রচারিত হয়। পরের বছর হয় ‘প্রভাতী অনুষ্ঠান’ নামে, ১৯৩৬-এ ‘মহিষাসুর বধ’, ১৯৩৭ সালে শিরোনাম হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তবে প্রথম দু’বছর মানে ১৯৩২ ও ১৯৩৩ সালে অনুষ্ঠানটি মহাষষ্ঠীর ভোরে সম্প্রচারিত হয়ে, ১৯৩৪ সাল থেকে মহালয়া-র ভোরে সম্প্রচারিত হতে থাকে। মাঝে কয়েক বার আবার অদলবদল হলেও অবশেষে মহালয়ার ভোরেই সম্প্রচার স্থায়ী হয়।
প্রথম কয়েক বছর সঙ্গীত পরিচালনায় পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে ছিলেন রাইচাঁদ বড়াল। এ ছাড়াও ছিলেন পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, সাগির খাঁ প্রমুখ। যদিও অধিকাংশ গানের সুরারোপ পঙ্কজবাবুর। যেমন ‘বিমানে বিমানে আলোকের গানে…’ পণ্ডিত হরিশ্চন্দ্র বালী, ‘শান্তি দিলে ভরি…’ উস্তাদ সাগির খাঁ এবং ‘নিখিল আজি সকল ভোলে …’ গানটিতে রাইচাঁদ বড়াল প্রমুখ সুর প্রয়োগ করেন। প্রথম দিকে এক ঘণ্টার হিসেবে অনুষ্ঠান শুরু হলেও কোনো কোনো বছর দু’ ঘণ্টা পর্যন্ত চলেছে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। পরে দেড় ঘণ্টায় স্থায়ী হয়। ১৯৭২ সালে স্থায়ী ভাবে রেকর্ড হওয়ার আগে পর্যন্ত এই অনুষ্ঠানের রূপকল্পের ক্ষেত্রে বহু পরিবর্তন ঘটেছে। এমনকি ১৯৪৪ ও ১৯৪৫ বছর দু’টিতে সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গে বেতার-কর্তৃপক্ষের মনোমালিন্য হওয়ায় তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। সে বার সঙ্গীত পরিচালনার কাজ সামলেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তিনি অবশ্য গানের সুর এক রেখেছিলেন। কিন্তু ১৯৪৫ সালে সম্পূর্ণ নতুন একটি অনুষ্ঠান হয়। সেটির যৌথ সঙ্গীতপরিচালক ছিলেন বিজনবালা ঘোষদস্তিদার ও শচীন দাশ মতিলাল। কিন্তু সেই অনুষ্ঠান একেবারেই জনপ্রিয় হয়নি। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ ও পঙ্কজকুমার মল্লিক-এর একই সঙ্গে প্রত্যাবর্তন ঘটে ১৯৪৬ সালে, একই সঙ্গে ১৯৩২ থেকে যে লাইভ সম্প্রচার চলছিল তা প্রথম বারের মতো ছেদ পড়ে কারণ, ওই বছর ১৬ অগস্ট থেকে কলকাতায় ভয়াবহ দাঙ্গা শুরু হয়, বেতার কর্তৃপক্ষ অত রাতে শিল্পীদের নিয়ে আসার ঝুঁকি নেননি ৷ ওই একটি বছর বাদ দিলে লাইভ সম্প্রচার একটানা চলে ১৯৬২ অবধি। এর পর রেকর্ডিং করা অনুষ্ঠান শোনানো হলেও, রেকর্ডারের অনুন্নত মানের জন্য ২-৩ বছর অন্তর নতুন করে রিহার্সাল দিয়ে রেকর্ডিং করা হত, তবে শেষবার স্থায়ী রেকর্ডিং হয় ১৯৭২ সালে। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭২ এই কয়েকবছরের মধ্যে ৬ বার মোট রেকর্ডিং করা হয়, এবং ১৯৬৬ সালের রেকর্ডিং HMV কে দেওয়া হয়, যেটা আমরা বিভিন্ন জায়গায় শুনতে পাই |
প্রসঙ্গত, ১৯৭৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, দেশে তখন জরুরি অবস্থা চলছে, মহালয়ার ভোরবেলা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে বেজে উঠল না চিরাচরিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। তার জায়গায় নতুন অনুষ্ঠান ‘দেবীং দুর্গতিহারিণীম্’। বাণীকুমার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজ কুমার মল্লিক সবাই বাদ। পরিবর্তে ধ্যানেশনারায়ণ চক্রবর্তীর লেখা আলেখ্য, শ্যামল গুপ্ত-র লেখা গান, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সুর আর প্রধান ভাষ্যপাঠক উত্তমকুমার। কিন্তু পত্র-পত্রিকায় সমালোচনার ঝড়, জনরোষ, চার পাশের প্রবল চাপে জনসাধারণের চাহিদাকে মর্যাদা দিতে সেই বছরই ষষ্ঠীর দিনই সম্প্রচারিত হয় ‘মহিষাসুরমর্দিনী’।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’ শুরু থেকে স্থায়ী ভাবে রেকর্ড করে রাখার আগে পর্যন্ত বহু খ্যাতনামা শিল্পীরা গান গেয়েছিলেন, যেমন জগন্ময় মিত্র, রাধারানি দেবী, সাবিত্রী ঘোষ, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, পান্নালাল ভট্টাচার্য, শচীন গুন্ত, বাঁশরী লাহিড়ি, শৈলেন মুখোপাধ্যায়, কল্যাণী মজুমদার, অখিলবন্ধু ঘোষ প্রমুখ। ‘মহিষাসুরমর্দিনী’-তে প্রতিভাবান যন্ত্রশিল্পী-সমাবেশও ঘটেছিল। বাজাতেন মুনশি (সারেঙ্গি), আলি (চেলো), খুশী মহম্মদ (হারমোনিয়াম), তারকনাথ দে (বেহালা), সুরেন পাল (ম্যান্ডোলিন), সুজিত নাথ (গিটার), দক্ষিণামোহন ঠাকুর (এসরাজ), শান্তি ঘোষ (ডবল বাস্), অবনী মুখোপাধ্যায় (বেহালা), রাইচাঁদ বড়াল (পিয়ানো)। সঙ্গীত-আয়োজনের কাজ করেছেন সুরেন্দ্রলাল দাসের পরিচালিত ‘যন্ত্রীসংঘ’, পরবর্তীকালে দায়িত্ব সামলেছেন ভি. বালসারা।
আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের এখনও পর্যন্ত সর্বাধিক জনপ্রিয় কালজয়ী গীতিআলেখ্য এই ‘মহিষাসুরমর্দিনী’,যা যুগে যুগে শ্রোতাদের প্রশংসা ধন্য ।