03/08/2021
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) ও তাঁর আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা বিচার
প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান
প্রাক্তন চেয়ারম্যান - দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
________________________________________
সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (র.) উত্তর ভারতের রায়বেরেলীর একটি বিখ্যাত হাসানী সাইয়্যিদ পরিবারে ১৭৮৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৩১ সালের ৬ই মে পাঞ্জাবের হাযারা জেলার বালাকোট প্রান্তরে শহীদ হন। তাঁর শাহাদাতের পর ১৭৯বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে তাঁর জীবন ও আদর্শের উপর ইংরেজীসহ বেশ কয়েকটি ভাষায় অনেক গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচিত হয়েছে। প্রধানতঃ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এসব রচনায় একদিকে যেমন তাঁকে স্বাধীনতার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সিপাহসালার এবং সত্যিকার ইসলামের একজন প্রকৃত ধারক ও বাহকরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে, তেমনি আবার কারো কারো পক্ষ থেকে তাঁকে সাম্প্রদায়িক ও ওয়াহাবী বলেও চিত্রিত করার অপচেষ্টা করা হয়েছে। আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে আমরা তাঁর সঠিক পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা করবো এবং সে সাথে সমকালে তাঁর আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা বিচার করবো।
প্রথম কথা হলো,★ সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) ওয়াহাবী ছিলেন না। ★
এর অনেক কারণের একটি হলো- ওয়াহাবীরা যেখানে তাসাউফ অস্বীকার করে, সেখানে তিনি হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর সুযোগ্য সাহেবজাদা ও খলীফা শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.)-এর বিখ্যাত খলীফা ছিলেন। তিনি আমাদের ভারতবর্ষের সুপরিচিত চার তরীকা- চিশতিয়া, কাদিরীয়া, নকশবন্দিয়া ও মুজাদ্দিদিয়া তরীকায় খিলাফতপ্রাপ্ত ছিলেন এবং তাসাউফে এমন উন্নতি ও পারদর্শিতা অর্জন করেন যে তিনি পরবর্তীতে ‘তরীকায়ে মুহাম্মদিয়া’ নামে একটি শিরক ও বিদআতমুক্ত সমন্বিত সূফী তরীকা প্রবর্তন করেন।
দ্বিতীয়ত, ওয়াহাবীরা সবখানে ওলীআল্লাহ, নবী-রাসুল এমন কি হযরত রাসূলে আকরাম (সাঃ) কেও মৃত মনে করে, সেখানে তিনি প্রিয়তম রাসূল (সা.) কে জিন্দা নবী হিসেবে বিশ্বাস করেন। অসংখ্য বার তিনি স্বপ্নে রাসূল (সা.) এর দীদার লাভ করেন ও তাঁর কাছ থেকে নির্দেশ ও হিদায়াত লাভ করেন।
তৃতীয়ত, অবিভক্ত বাংলা ও আসামে যে সব সূফী তরীকা তথা দরবার প্রধান যথা- ফুরফুরা, জৌনপুর, শর্ষিনা, ধামতী, ফুলতলী ইত্যাদি এগুলোর সিলসিলা এক পর্যায়ে সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভীতে যেয়ে মিলিত হয়েছে। সুতরাং তাকে ওয়াহাবী বলা মানে এমন সূফী তরীকাকেও ওয়াহাবী বলে সাব্যস্ত করার শামিল।
সুতরাং যেসব বক্তা ও লেখক সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভীকে ওয়াহাবী বলে চিহ্নিত করেন তাঁরা তথ্য সংকটের শিকার। তবে তাঁকে যে ওয়াহাবী বলে অপবাদ দেওয়া হয় তার একটি কারণ আছে। আর তা হচ্ছে ইংরেজরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী আলিমদের আরবের মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব নজদীর অনুসারী বলে চিত্রিত করার অপচেষ্টা করেছিল। উইলিয়াম হান্টারসহ অনেক লেখকই এ ধারার অপতৎপরতার সাথে যুক্ত। ইতিহাস স্বাক্ষী দেয় যে, ভারতে বিশেষ করে উত্তর ও পূর্ব ভারতে ইসলাম প্রচারিত হয়েছিল সূফীগণের মাধ্যমে। তাই এখানে যে ইসলাম জনগণের হৃদয়ের গভীরে শেকড় গেড়েছে সেটি সূফী আদলের ইসলাম। তাই যদি কোনভাবে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দানকারী আলিমদের সূফীবাদ বিরোধী তথা ওয়াহাবী বলে চিত্রিত করা সম্ভব হয়, তাহলে জনমনে তাঁদের যে উচ্চ স্থান আছে সেটা চলে যাবে এবং জনসাধারণ তাঁদের অনুবর্তী হবে না।
এই গভীর মনোসামাজিক ধর্মীয় কারণে সায়্যিদ আহমদসহ সেইসব সর্বত্যাগী সাহসী আলিমদের বিরুদ্ধে ওয়াহাবিয়াতের অভিযোগ উত্থাপন করার অপচেষ্টা করা হয়।
দ্বিতীয় অভিযোগ যে, সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভী পরিচালিত সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক ছিলো। এ কথাটিও কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। ধর্মীয় বিবেচনা ছাড়াও সাধারণ নৈতিকতা ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গি এ অভিযোগ সমর্থন করে না। প্রথমে আমরা এ অভিযোগটি সাধারণ নৈতিক যুক্তি আলোকে বিচার করবো। অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত। এটি সাধারণ্যে গৃহীত একটি কর্মনীতি। জাতিসংঘ স্বীকৃত সার্বজনীন মানবাধিকারের প্রথম প্রস্তাবটিই হলো মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার। প্রতিটি মানুষের সম্মান ও মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। জাতিসংঘ স্বীকৃত সার্বজনীন মানবাধিকারের অপর একটি অনুচ্ছেদের মর্মকথা হলো মানুষের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন ও প্রচার করার অধিকার আছে। তাছাড়া যুদ্ধ সংক্রান্ত নৈতিকতায় বলা হয়েছে যে, সব যুদ্ধ এক পর্যায়ের নয়। কিছু যুদ্ধ আছে অন্যায় যুদ্ধ, কিছু যুদ্ধ আছে ন্যায় যুদ্ধ, অন্য কথায় সব যুদ্ধই অন্যায় নয়। তা যদি হতো তাহলে দেশের মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার আন্দোলন অনৈতিক হতো। তা তো নয়ই বরং মুক্তিযুদ্ধ একটি ন্যায় যুদ্ধ, জাতির অস্তিত্বের লড়াই। সাইয়িদ আহমাদ বেরলভী (র.) কর্তৃক শিখদের বিরুদ্ধে পরিচালিত যুদ্ধ সম্বন্ধেও একই কথা প্রযোজ্য। এরই ক্রমধারায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সব সংগ্রামই ন্যায়সঙ্গত। স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বধর্মের অস্তিত্ব সংরক্ষণ ও বিকাশের লক্ষ্যে পরিচালিত লড়াই তাই নৈতিক লড়াই। এই ন্যায় যুদ্ধের একজন নির্ভীক সেনাপতি ছিলেন হযরত সাইয়িদ আহমদ বেরলভী (র.)। অবশ্য ন্যায় যুদ্ধ ততক্ষণ পর্যন্ত বৈধ যতক্ষণ এর প্রয়োজন থাকে এবং সে ক্ষেত্রেও কতগুলো নৈতিক সীমা ও শর্ত মেনে চলতে হয়। তা না হলে যুদ্ধ তো ন্যায় যুদ্ধ হবে কিন্তু সীমা অতিক্রমকারীর আচরণ নৈতিক হবে না। আমরা যদি সায়্যিদ আহমদ বেরলভীর সময়ের পশ্চিম ভারতের দিকে তাকাই তাহলে দেখবো যে, সত্যিই সেখানে মুসলমানগণ ছিল চরমভাবে নির্যাতিত। যুদ্ধাংদেহী শিখ নেতারা নির্বিচারে মুসলমানদের উপর সীমাহীন নির্যাতন করে যাচ্ছিল। এসব নির্যাতিত মুসলমানদের জানমাল ও সম্মান রক্ষা করার সংগ্রাম সাম্প্রদায়িক হতে পারে না বরং এটি শক্তিমান সাহসী মানুষের জন্য অবশ্য পালনীয় একটি মানবিক কর্ম এবং অবশ্যই নৈতিকও বটে। এবার আমরা দেখবো এ ব্যাপারে ইসলাম কী নির্দেশনা দেয়। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে নিপীড়িত মানবতার সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার জন্য অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে। কিছু সংখ্যক মানুষ মুসলমান বলে তারা সাধারণ মানবসুলভ আচরণও পাবে না এমন মনোভাব তো চরম জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর নামান্তর। এখন আমরা পবিত্র কুরআন থেকে একটি আয়াত ও রাসূল (সা.) এর অসংখ্য হাদীস থেকে একটি প্রাসঙ্গিক হাদীস উদ্ধৃত করবো। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে- “তোমাদের কী হয়েছে যে তোমরা আল্লাহর পথে সে সব অসহায় নর-নারী ও শিশুদের জন্য লড়াই কর না যারা ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের প্রতিপালক! যালিমদের এ জনপদ থেকে বের করে আমাদের অন্য কোথাও নিয়ে যাও, তুমি আমাদের জন্য তোমার কাছ থেকে একজন অভিভাবক নিযুক্ত কর এবং আমাদের জন্য একজন সাহায্যকারী পাঠাও” (৪:৭৫)। পবিত্র হাদীসে বলা হয়েছে যে, যে ব্যক্তি কোন নাজায়িয কাজ দেখে ক্ষমতা থাকলে সে যেন তা হাত দ্বারা তথা শক্তি প্রয়োগে বন্ধ করে দেয়। যদি তার ততটা ক্ষমতা না থাকে তাহলে সে যেন যবান দ্বারা খারাপ কাজের প্রতিবাদ করে। যদি এতটা ক্ষমতাও তার না থাকে তাহলে যেন সে অন্তর দ্বারা এ ধরনের কাজকে ঘৃণা করে, আর এটাই ঈমানের সর্বনিম্ন স্তর।” (মুসলিম)
সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.)এর জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায় তিনি প্রথম জীবনে গতানুগতিক কিতাবী লেখাপড়ায় তেমন মনোযোগী ছিলেন না। জন্মগতভাবে তিনি সুঠাম ও শক্ত গঠনের অধিকারী ছিলেন। বিভিন্ন ধরনের শরীর গঠনমূলক খেলাধুলা ও ব্যায়ামে তিনি ব্যস্ত থাকতেন। তিনি পরোপকারী ও সেবাপরায়ন ছিলেন। বিপদগ্রস্থ মানুষের সাহায্যে তিনি ছুটে যেতেন। সামরিক শিক্ষা গ্রহণের জন্য তিনি যৌবনে মধ্য ভারতের টংক-এর নবাবের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং একজন দক্ষ সৈনিক ও পরবর্তী সময়ে কৌশলী সেনাপতি হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন। বলা বাহুল্য, এমন একজন মানুষের পক্ষে স্বজাতি ও স্বদেশের দুংখের দিনে নীরব দর্শকের ভূমিকায় বা কেবল ওয়াজ নসীহত করে সন্তুষ্ট হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই কুদরতই অলক্ষ্যে তাঁকে গড়ে তুলেছিল আগামী দিনে অধঃপতিত ও নির্যাতিত মুসলিম জাতি ও ভারতবাসীকে মুক্ত করার জন্য, স্বদেশীয় অত্যাচারী শিখ ও বিদেশী ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলা, এ সংগ্রামকে সংহত করা ও নেতৃত্ব দানের জন্য। একজন লেখক অবশ্য অন্য কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন যে, সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) পরিচালিত আন্দোলন নবুওয়াতের অনুসরণে পরিচালিত ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠার আন্দোলনই ছিল এবং তা সফল হতো যদি তিনি সূফীবাদের দিকে ঝুঁকে না পড়তেন। তাঁর মতে সূফীবাদ থেকে সত্যিকার সফলতাকামী ইসলামী প্রচেষ্টাকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। উল্টোভাবে এ কথা থেকে প্রমাণিত হয়,
এক- তিনি ওয়াহাবী ছিলেন না; দুই- সূফীবাদ অংশটুকু বাদ দিলে তার আন্দোলন সঠিক ইসলামী আন্দোলন ছিল।
এবার আমরা সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) এর একটি চিঠি থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দেব যে চিঠিতে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন যে কোন পার্থিব বা জাগতিক কারণে তিনি সংগ্রাম করছেন না। কোনরূপ উচ্চাভিলাষ পুরণ বা সুনাম অর্জন করাও তাঁর লক্ষ্য নয় বরং সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা, অন্যায়ের প্রতিরোধ এবং মানবাধিকার রক্ষা করাই তাঁর সব কর্মপ্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য। “...কেউ কেউ ধনৈশ্বর্য ও রাজ্য দখলের জন্য, আবার কেউ কেউ নিজের বীরত্ব ও বাহাদুরী প্রদর্শনের জন্য, আবার কেউ কেউ শাহাদাতের গৌরব অর্জনের জন্য যুদ্ধ করে থাকে। কিন্তু এ যদ্ধে আমার উদ্দেশ্য ভিন্নতর। আমার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে মহান রবের নির্দেশ পালন করা, যিনি একমাত্র মালিক ও নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। মহা গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত আল্লাহ এ কথার সাক্ষী যে, এ যুদ্ধ বিগ্রহ দ্বারা তাঁর হুকুম পালন করা ব্যতীত আমার অন্য কোন উদ্দেশ্য নেই। এতে ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের কোন স্পৃহা না আমার মুখে কখনও উচ্চারিত হয়েছে, আর না কখনো অন্তরে উদিত হয়েছে।... সারকথা, আমার না আছে বীরত্ব প্রদর্শনের কোন হীন উদ্দেশ্য, আর না আছে রাজত্ব হাসিলের কোন স্বার্থ। এর জ্বলন্ত প্রমাণ এই যে, যদি কোন সম্মানিত শাসক ও শীর্ষস্থানীয় সরদার ইসলাম কবুল করেন তাহলে আমি তাঁর বীরত্ব শতমুখে অকপটে স্বীকার করে নেব, হাজার প্রাণের বিনিময়ে হলেও তার সাম্রাজ্যের উন্নতি করবো এবং তাঁর সরকারের শ্রীবৃদ্ধির জন্য সীমাহীন প্রচেষ্টাও চালিয়ে যাব।” (সীরাতে সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ, পৃ. ৪৫৪-৪৫৫ ।
কেবল আল্লাহপাকের সন্তুষ্টির লক্ষ্যে তিনি সত্য ন্যায় বিচর প্রতিষ্ঠার জন্য সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন। এটি মানুষের মাঝে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। সুদুর বাংলাদেশ থেকে শুরু করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান তাঁর সংগ্রামী কাফেলায় যোগদান করে। ভারতের সীমা অতিক্রম করে আফগানিস্তান থেকেও অনেক লোক তাঁর সাথে শরীক হয়। অনেক হিন্দু ও শিখ মুসলমান হয়ে তাঁর সাথী হয়। কিন্তু গোত্রবাদের সংকীর্ণতা, কিছু সীমান্ত সরদারদের ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তা ও কঠোর হৃদয়ের কিছু সংখ্যক শিখদের নিষ্ঠুরতা (নির্বিচারে নারী ও শিশুদের হত্যা, ঘরবাড়ী, ফসলের ক্ষেত জ্বালিয়ে দেওয়া ইত্যাদি) মুক্তিকামী মানুষের এ অগ্রযাত্রাকে মাঝপথে থামিয়ে দেয়। এক অসম সম্মুখ সমরে সিংহ পুরুষ ও মর্দে মু’মিন ও সাচ্চা মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন। আর সে সাথে রাসূলের আদর্শে একটি ন্যায় বিচারপূর্ণ মানবিক সমাজ নির্মাণের আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থেকে যায়।
এখন আমরা অতি সংক্ষেপে বর্তমান সময়ে সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) এর আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে মাত্র দু’টি কথা বলবো। প্রথম কথা হলো ঃ তাঁর আদর্শ হলো সূফীবাদী ইসলাম, তবে তাঁর সূফীবাদ নিষ্ক্রিয়, বিদআতমিশ্রিত সূফীবাদ নয়। এটি জীবনমুখী, সাহসী, অন্যায়ের প্রতিবাদকারী, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য জীবন বাজী রাখা সূফীবাদ। সূফীবাদ হলো ইসলামের প্রাণ। প্রাণহীন দেহ দুর্গন্ধ ছড়ায়। মহান আল্লাহর সঠিক পরিচয় ও প্রিয়নবী (সাঃ) এর প্রতি সীমাহীন ভালবাসা ও তাঁর আদর্শের পূর্ণ অনুকরন ব্যতীত সত্যিকার ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। প্রকৃত সূফী চেতনাহীন ইসলাম পরিশেষে জাগতিক সুবিধাবাদিতা বা ভেদবুদ্ধির রাজনৈতিক ফায়দা লুটার কৌশলে পরিণতি লাভ করে। মুসলমানদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ইতিহাস এ কথার সত্যতা বহন করে। অপরদিকে পবিত্র কুরআন, হাদিস, সাহাবায়ে কিরাম ও আহলে বায়তের অনুসরণ ও অনুবর্তিতাহীন সূফী সাধনা নাফসানিয়াতের কানাগলিতে পথ হারিয়ে ফেলে। স্বার্থবাদী নফস পূজারী ভন্ড সূফীদের জীবন কর্ম দেখলে যে কোন চোখ-কান খোলা মানুষের কাছে এ ধারার সূফী পথের বিভ্রান্তি ধরা পড়বে। আজকের মুসলিম দুনিয়ার দিকে তাকালেও আমরা প্রকৃত সূফী চেতনাহীন ইসলামী প্রয়াস ও ভন্ড সূফী নামধারীদের ধর্মের নামে ব্যবসা পরিচালনা লক্ষ্য করলে জাগতিক প্রয়াসের মধ্যে প্রকৃত সূফী জীবনবোধ যুক্ত করার অপরিহার্যতা স্বীকার করতে বাধ্য। সায়্যিদ আহমদ বেরলভ (র.) এর জীবনাদর্শ আমাদের পূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠার এ সঠিক রাজপথের দিকে নিরন্তর আহবান জানায়।
সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.) এর দ্বিতীয় আদর্শ হলো অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে, মানবিক অধিকার ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে নিঃস্বার্থভাবে লড়াই করে যাওয়া। ইসলাম সাম্প্রদায়িক কোন ধর্ম নয়। ইসলাম হলো একটি সর্বমানবিক, সর্বকল্যাণ সমৃদ্ধ জীবনমুখী আদর্শ। ইসলামে আল্লাহর যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে তাতে তিনি সমস্ত বিশ্বের কেবল স্রষ্টা নন, তিনি করুণাময় প্রতিপালক, পরম ন্যায় বিচারক ও সব শুভ ও কল্যাণের সংরক্ষক। ঠিক একইভাবে রাসূল (সাঃ) কেবল আরববাসী বা মুসলমানদের জন্য পথ প্রদর্শক নন। তিনি সব সৃষ্টির জন্য মহান আল্লাহর করুণার মূর্ত প্রতীক। ইসলামী জীবন পদ্ধতি জন্মগত নয়, সত্য-উপলব্ধি-জাত। সেজন্য ইসলামে কেবল জন্মগত কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই। শ্রেষ্ঠত্ব সঠিক বিশ্বাস ও সৎকর্ম নির্ভর। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে; ‘তোমাদের মধ্যে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে সম্মানিত, যে সর্বাধিক মুত্তাকী’।
রাসুল (সা.) বলেছেন, যার কর্ম তাকে পিছনে টানে, তার বংশ পরিচয় তাকে আগে বাড়াতে পারে না।
আমরা যদি এখন বিশ্ব পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তাহলে দেখবো নয়া উপনিশাসক বিশ্বায়নের নামে ক্ষুদ্র ও দুর্বল জাতিসত্তাকে গ্রাস করতে সর্বশক্তি নিয়োজিত করছে, শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে তারা আংশিক তথ্য দিয়ে বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করছে, একটা কৃত্রিম সংস্কৃতি নির্মাণ করতে প্রয়াসী হচ্ছে, অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল জিনিসপত্র তৈরী করে সেগুলো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অশুভ ব্যবহার করে যুব সমাজকে বিপথে পরিচালিত করছে। অর্থ ও বিভিন্ন অনৈতিক পদ্ধতি দ্বারা প্রলুদ্ধ করে মেধাবীদের নিজ স্বার্থ সিদ্ধির জন্য ব্যবহার করছে অথবা নিষ্ক্রিয় করে রাখছে অথবা ভোগবাদী করে তুলছে। এসব কারণে ধনী আরও ধনী হচ্ছে। গরীব আরও গরীব হচ্ছে এবং গরীবের সংখ্যা বাড়ছেই। এভাবে এক অশুভ কর্মতৎপরতায় অনেক মানুষের জীবন বাধা পড়ছে। এর বিরুদ্ধে কি শুভ বুদ্ধির অধিকারী বিবেকবান মানুষের কিছুই করণীয় নেই? সায়্যিদ আহমদ বেরলভী (র.)-এর মহৎ ও সাহসী, ত্যাগী ও তৎপর জীবন এ দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে আলোর দিশা হিসেবে কাজ করে। তাঁর আহবান মানবতার কল্যাণকামী সব মানুষের জন্য, এখানে কোন ধর্ম ও জাতির প্রশ্ন নেই। তাঁর এ ডাক পরিবর্তনকামী তথা শোষণমুক্ত সমাজ নির্মাণের সব কর্মীদের জন্য। সে কারণে তাঁর আদর্শ সমকালীন দেশীয় ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে খুবই প্রাসঙ্গিক। মহান আল্লাহ আমাদের সঠিক পথে চলার তাওফীক দিন, আমীন।