18/11/2024
কক্সবাজারের টেকনাফ থানাধীন বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়ার পাহাড়ের চূড়ায় অভিযান পরিচালনা করে মানব পাচারকারীদের গোপন আস্তানা হতে ৩১ জন ভিকটিম র্যাব-১৫ কর্তৃক উদ্ধার; মানব পাচারকারী চক্রের ০২ জন গ্রেফতার
১। র্যাব-১৫, কক্সবাজার দায়িত্বপূর্ণ এলাকার অপরাধ নির্মূলে প্রতিনিয়ত অবদান রেখে চলেছে। দায়িত্বাধীন এলাকা কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলায় হত্যা, ধর্ষণ, জঙ্গী, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, জলদস্যু, ডাকাত, চুরি-ছিনতাই, সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, মাদক, অপহরণ ও দেশে বিরাজমান নানাবিধ অপরাধ দমনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
২। কক্সবাজারে মরণ নেশা ইয়াবার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাগরপথে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানব পাচারকারী চক্র। যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিনিয়নই প্রকাশিত হচ্ছে। এই চক্রের সঙ্গে উখিয়া-টেকনাফের বেশির ভাগ পাচারকারী জড়িত বলে জানা যায়। স্থানীয়দের পাশাপাশি তারা বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে শিশু, নারী ও পুরুষ পাচারের জন্য সংগ্রহ করে তাদের দুর্গম পাহাড়ী আস্তানায় আটক রাখে। আটককৃতদের সুযোগ বুঝে পাচারের উদ্দেশ্যে ট্রলারে তুলে দেওয়া হয়। এর মধ্যে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, পাচারকারীরা তাদের পরিবার থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করে মর্মে তথ্য পায় র্যাব-১৫।
৩। র্যাব-১৫, কক্সবাজার এর আভিযানিক দল জানতে পারে যে, গত ১২ নভেম্বর ২০২৪ তারিখে কক্সবাজার জেলার উখিয়ার মোছার খোলা এলাকার একলাছ মিয়া ও তার চাচাতো ভাই এবং ২/৩ জন বন্ধু কচ্ছপিয়া মেরিন ড্রাইভ এলাকায় ঘুরতে গিয়ে মানবপাচারকারী কর্তৃক অপহরণের শিকার হয়। ঘটনার দিন অনুমান ১৭.০০ ঘটিকায় ঘুরাঘুরি একপর্যায়ে তারা ছবি তোলার সময় অজ্ঞাত কয়েকজন ব্যক্তি তাদের নিকট আসে। এ সময় তাদের নাম-ঠিকানা জানতে চেয়ে হঠাৎ অজ্ঞাত ব্যক্তিরা জোরপূর্বক ভিকটিমদের চোখ বেঁধে ফেলে এবং সেখান থেকে পাহাড়ের চূড়ায় একটি অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ভিকটিম একলাছ মিয়া সেখানে একটা ছোট খুপড়ি ঘরে ৪০-৫০ জন নারী-পুরুষ, শিশু দেখতে পায়। অতঃপর মানব পাচারকারীরা তাকে নির্যাতন করে ২,০০,০০০/- (দুই লক্ষ) টাকা মুক্তিপণ দাবী এবং মুক্তিপণের টাকা না দিলে মালয়েশিয়ায় পাচার করে দিবে বলে হুমকি দেয়। একপর্যায়ে ভিকটিম একলাছ মিয়ার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেও মুক্তিপনের টাকা না পাওয়ায় গত ১৬ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ অনুমান ২০.১৫ ঘটিকায় তাকে’সহ ১৫-২০ জনকে ট্রলারযোগে মালয়েশিয়ায় পাচারের উদ্দেশ্যে পাহাড়ের চূড়ার খুপড়ি ঘর থেকে বের করে সাগর পাড়ে ট্রলারের নিকট নিয়ে যাওয়ার সময়ে কৌশলে সে পালিয়ে আসে। কিন্তু তার সাথে থাকা চাচাতো ভাইসহ অন্যান্যরা পাচারকারীদের হেফাজতে থাকায় তাদের উদ্ধারের জন্য র্যাবের সহায়তা কামনা করেন।
৪। এরই ধারাবাহিকতায়, ভিকটিমদের উদ্ধারসহ মানবপাচারকারীদের গ্রেফতারের লক্ষ্যে র্যাব গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ভিকটিম একলাছ মিয়ার নিকট হতে প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা যাচাই করতঃ অদ্য ১৮ নভেম্বর ২০২৪ তারিখ রাত অনুমান ০২.৩০ ঘটিকার সময় র্যাব-১৫ এর সিপিসি-২, হোয়াইক্যং ক্যাম্পের আভিযানিক দল কক্সবাজার জেলার টেকনাফ থানাধীন বাহারছড়া ইউনিয়নের ৮নং ওয়ার্ডের কচ্ছপিয়া এলাকাস্থ জনৈক নুর হোসেনের বাড়ীর পিছনে পাহাড়ের চূড়ায় একটি গোপন আস্তানায় অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় মানব পাচারকারীদের হেফাজত হতে ০৫ বাংলাদেশী (পুরুষ-০৩, নারী-০১, শিশু-০১) ও ২৬ রোহিঙ্গা নাগরিক (পুরুষ-০২, নারী-০২ ও শিশু-২২) সহ সর্বমোট ৩১ জন ভিকটিমকে উদ্ধার এবং পাচার চক্রের ০২ জনকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র্যাবের আভিযানিক দল।
৫। উদ্ধারকৃত ভিকটিমদের বিস্তারিত পরিচয়-
১) আতিকুর রহমান (৩২), পিতা-আবুল কালাম, সাং-মকশেট আজম, দোলহাজারা ইউনিয়ন, থানা-চকরিয়া, জেলা-কক্সবাজার।
২) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম (২৭), পিতা-আব্দুল কাদের, সাং-কায়কাবাদ, শাপলাপুর ইউনিয়ন, থানা-মহেশখালী, জেলা-কক্সবাজার।
৩) মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন (২২), পিতা-ফরিদ, সাং-সাদেকের কাটা, শাপলাপুর ইউনিয়ন, থানা-মহেশখালী, জেলা-কক্সবাজার।
৪) মোহাম্মদ শহিদ (১৭), পিতা-নজির আহমেদ, সাং-কায়কাবাদ, শাপলাপুর ইউনিয়ন, থানা-মহেশখালী, জেলা-কক্সবাজার।
৫) হাসনা বেগম (১৮), পিতা-সাব্বির, সাং-শাপলাপুর, বাহারছড়া ইউনিয়ন, থানা-টেকনাফ, জেলা-কক্সবাজার।
৬) মোহাম্মদ নূর (১২), পিতা-মনজুর রহমান, সাং-ক্যাম্প-১২, ব্লক-জি-১৭।
৭) নূর কামাল (৩৫), পিতা-নূর মোহাম্মদ, সাং-ক্যাম্প-০৩, ব্লক-এইচ-৩৬।
৮) শরীয়ত উল্লাহ (১৭), পিতা-আজিমুল্লাহ, সাং-ক্যাম্প-১৭, ব্লক-এইচ-১০০।
৯) মোহাম্মদ আরাফাত (১৪), পিতা-সৈয়দ নুর, সাং-ক্যাম্প-০৫, ব্লক-ই-১।
১০) নাইমুল হাসান (২০), পিতা-হাফেজ আহমেদ, সাং-ক্যাম্প-১৯, ব্লক-ডি-১২।
১১) আয়াতুল্লাহ (১২), পিতা-জালাল আহমেদ, সাং-ক্যাম্প-০৩, ব্লক-ই-৫৪।
১২) সালমান (১৭) পিতা-অলি আহমদ, সাং-ক্যাম্প-১৩, ব্লক-জি-০৩।
১৩) মোহাম্মদ নূর (১৭), পিতা-কোভির আহমেদ, সাং-ক্যাম্প-১৩, ব্লক-এফ-১।
১৪) সেনোয়ারা (২৫), পিতা-আব্দুল মোতালেব, স্বামী-মহিবুল্লাহ, সাং-ক্যাম্প-০৩, ব্লক-ডি-৪০।
১৫) খুইললে বানু (১৮), পিতা-অলি আহমদ, সাং-ক্যাম্প-১৭, ব্লক-এ-১০০।
১৬) সুফাইরা (১৭), পিতা-অলি আহমেদ, সাং-ক্যাম্প-১৩, ব্লক-জি-৩।
১৭) তশমিনা আরা (১৭), পিতা-আলী জোহার, সাং-ক্যাম্প-০৩, ব্লক-সি-৪১।
১৮) জোহরা আক্তার (১৭), পিতা-সৈয়দ সালাম, সাং-ক্যাম্প-০৩, ব্লক-সি-৩৯।
১৯) হামিদা (১৭), পিতা-দিল মোহাম্দ, সাং-ক্যাম্প-০৪, ব্লক-ডি-০৪।
২০) বিবি আছিয়া (২৪), পিতা-শামসুল হক, সাং-ক্যাম্প-১২, ব্লক-এইচ-১৩।
২১) চকুতারা (১৮), পিতা-মুসা আলি, সাং-ক্যাম্প-০৩, ব্লক-বি-৪০।
২২) তসলিমা (১৮), পিতা-নূর হোসেন, সাং-ক্যাম্প-০৩, ব্লক-ডি-৪০।
২৩) জান্নাত আর (১৫), পিতা-কাশেম, সাং-ক্যাম্প-১০, ব্লক-এ-৩৬।
২৪) দিল কায়াস (১৬), পিতা-কাশেম, সাং-ক্যাম্প-১০, ব্লক-এ-৩৬।
২৫) আরজিনা (১৮), পিতা-নুর আলম, সাং-ক্যাম্প-০৩, ব্লক-ই-০৬।
২৬) রুমিয়াছ (০৭), পিতা-নুর আলম, সাং-ক্যাম্প-১৭, ব্লক-এ-১০০।
২৭) দিলারা (১৪), পিতা-নূর মোহাম্মদ, সাং-ক্যাম্প-১৫, ব্লক-বি-০৩।
২৮) হামিদা (১৫), পিতা-শামসুল আলম, সাং-ক্যাম্প-১১, ব্লক-ডি-০৫।
২৯) নুরুল আমিন (০৮), পিতা-মহিবুল্লাহ, সাং-ক্যাম্প-১০, ব্লক-এইচ-৩৬।
৩০) নুর হাফেজ (০৬), পিতা-মহিবুল্লাহ, সাং-ক্যাম্প-১০, ব্লক-এইচ-৩৬।
৩১) নুর সাহারা (০৩), পিতা-মহিবুল্লাহ, সাং-ক্যাম্প-১০, ব্লক-এইচ-৩৬, ক্রমিক ৬-৩১ পর্যন্ত সর্বথানা-উখিয়া, জেলা-কক্সবাজার।
৬। গ্রেফতারকৃত মানব পাচারকারীদ্বয়ের বিস্তারিত পরিচয়-
১) মোঃ আনোয়ার (৪৪), পিতা-মৃত অছিউর রহমান, সাং-পানখালী ৪নং ওয়ার্ড, ইউনিয়ন-হ্নীলা এবং
২) মোহাম্মদ আইয়ুব (৩৬), পিতা-মৃত মোঃ রফিক, সাং-উত্তর লম্বরী, ২নং ওয়ার্ড, ইউনিয়ন-সদর ইউনিয়ন, উভয় থানা- টেকনাফ, জেলা-কক্সবাজার
৭। উদ্ধারকৃত ভিকটিমদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভিকটিমদের মালয়েশিয়ায় নেয়ার কথা বলে কচ্ছপিয়ার পাহাড়ের চূড়ায় আস্তানায় আটকে রাখে মানব পাচারকারীরা। সেখানে থাকা অবস্থায় বার্মায় আছে বলে ভিকটিমদের পরিবারের নিকট ফোন করে টাকা দাবী করা হতো। এভাবে করে অনেকের নিকট হতে জনপ্রতি এক লক্ষ করে টাকা আদায় করে পাচারকারীরা। উদ্ধারকৃত এক ভিকটিমের ভাষ্যমতে তাকে আট দিন ধরে পাহাড়ী ঐ আস্তানায় আটকে রাখা হয়। অপর এক ভিকটিমকে আটকে রাখা হয় তের দিনের অধিক সময়। উদ্ধারকৃত এ সকল ভিকটিমদের ঠিকমত দেয়া হতো না খাবার। করা হতো বিভিন্নভাবে নিযার্তন।
৮। গ্রেফতারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ এবং তাদের চক্রের মূলহোতাসহ আরো ৫-৭ জন কৌশলে পাহাড়ের অপর পাশ দিয়ে পালিয়ে যায় মর্মে জানায়। জিজ্ঞাসাবাদে আরো জানা যায়, ভিকটিমদের আর্থ-সামাজিক অনগ্রসরতা ও পরিবেশগত অসহায়ত্বকে পুঁজি করে মানব পাচারকারী চক্র উন্নত জীবন-যাপন, অধিক বেতনে চাকুরী ও অবিবাহিত নারীদেরকে বিবাহের মিথ্যা প্রলোভনের মাধ্যমে ছল-চাতুরীর আশ্রয় নিয়ে যৌন নিপীড়ন, প্রতারণামূলক বিবাহ ও জবর-দস্তিমূলক শ্রম সেবা আদায় এর অভিপ্রায়ে পাহাড়ী আস্তানায় একত্রিত করে মালয়েশিয়া পাচারের জন্য জোরপূর্বক আটক রাখা হয়। মূলহোতাসহ সংঘবদ্ধ মানব পাচার চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারের র্যাবের অভিযান চলমান রয়েছে।
৯। উদ্ধারকৃত ৩১ জন ভিকটিম এবং গ্রেফতারকৃত পাচারকারীদ্বয়ের বিরুদ্ধে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণার্থে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ মডেল থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।