04/08/2023
পুরনো জাহাজের তার বিক্রি প্রতিদিন কোটি টাকার
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাটের একজন ভ্রাম্যমাণ কেবল ব্যবসায়ী। কোনো শিপব্রেকিং ইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি হলে সেখান থেকে কেবল সংগ্রহ করতে ছুটে যান তিনি। তারপর জাহাজে উঠে কেবল ভালো করে দেখেন। তারপর তা কেনার প্রস্তাব দেন জাহাজের মালিক বা তাঁর প্রতিনিধিকে।
কখনো সরাসরিই এগুলো কিনে নেওয়ার সুযোগ পান, আবারও কখনো প্রতিযোগিতা করে নিলাম থেকে কেবলগুলো কেনেন। তবে তিনি কোনো খুচরা দোকানে বিক্রি না করে কিছু লাভ রেখে ছেড়ে দেন পাইকারি ব্যবসায়ীদের হাতে। তাঁদের হাত থেকে কেবল চলে আসে স্থানীয় বাজারে। এভাবে স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে কেবল সংগ্রহ করে বিক্রি করেন এমন ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ী রয়েছেন সহস্রাধিক।
আবার স্থানীয় দোকানগুলো থেকে এসব কেবল কিনে দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে গিয়ে ব্যবসা করেন অসংখ্য ব্যবসায়ী। এ ব্যবসায়ই প্রতিদিন কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে সীতাকুণ্ডে, যা দেশের অর্থনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সমুদ্র উপকূলে বর্তমানে ৬০ থেকে ৭০ টা শিপব্রেকিং ইয়ার্ড রয়েছে। তবে এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ টির মতো ইয়ার্ড সচল রয়েছে।
এসব ইয়ার্ডের মালিকরা নিয়মিত স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে তা ভেঙে ব্যবসা করেন। আর এসব জাহাজে রয়েছে বিচিত্র সব সরঞ্জাম। মূল্যবান ধাতব তামা, পিতল, কেবল, ফার্নিচার, ফ্রিজ, পাখা, কালো তেল, নাট-বল্টু, লোহার প্লেট থেকে শুরু করে স্ক্র্যাপ লোহা পর্যন্ত সব সরঞ্জামেরই বিশাল বাজার রয়েছে বাংলাদেশে। তামা-পিতলের মতো কিছু কিছু সরঞ্জাম আবার এখান থেকে বিদেশেও চলে যায়। ফলে এসব প্রতিটি সরঞ্জামেরই দোকান গড়ে উঠেছে এখানে।
একইভাবে গড়ে উঠেছে জাহাজ থেকে পাওয়া কেবল বা বৈদ্যুতিক তারের দোকানও।
সরেজমিনে গিয়ে ঘুরে এসব ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এখানে শুধু কেবলের দোকানই রয়েছে ৫ শতাধিক। উপজেলার কুমিরা, বারোআউলিয়া, কদমরসুল, মাদামবিবিরহাট, ভাটিয়ারী, ফৌজদারহাট, সলিমপুর প্রভৃতি এলাকায় এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাদামবিবিরহাটে আল মদিনা স্টিল ও এমএ এন্টারপ্রাইজের ম্যানেজার মো. নাদিম জানান, তিনি বিগত ১৮ বছর ধরে এই কেবলের ব্যবসা করে আসছেন। এখানে প্রায় ২০ রকমের কেবল তার বিক্রি করা হয়। এর মধ্যে ফ্লেক্সিবল কেবল, পাওয়ার কেবল, স্কিন কেবল, এইচটি কেবল, আরজি কেবল, আর সেট কেবল, এলটি কেবল ইত্যাদি প্রকারের তার বেশি বিক্রি হয়। স্ক্র্যাপ জাহাজ থেকে কেবলগুলো এনে দোকানে সাজানোর পর সেগুলো ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান।
মাদামবিবিরহাটের অপর ব্যবসায়ী মেসার্স একে করপোরেশনের ম্যানেজার মো. সেলিম জানান, জাহাজ থেকে কেবলগুলো আনার পরও সেগুলোকে প্রক্রিয়া করতে হয়। অনেকগুলোর ওপরের কাভার খুলে ফেলে ভেতরের তার বের করে বিক্রি করতে হয়। এ কাজেও লাখ লাখ টাকা ব্যয় হয় অনেক ক্ষেত্রে। প্রচুর কেবল কেনার পর ওপরের প্লাস্টিক কভার ছাড়াতে অনেক সময় ঠিকাদারদের শরণাপন্ন হন ব্যবসায়ীরা। সে ক্ষেত্রে প্রতি টন তারে খরচ হয় দুই হাজার ২০০ থেকে তিন হাজার টাকা। সেলিম বলেন, যাঁরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, ধোলাইখাল প্রভৃতি এলাকা থেকে এখানে এসে কেবল কিনে নিয়ে যান, তাঁরা সব রেডিমেড নিয়ে যান। কিন্তু এর আগে আমাদের জাহাজ থেকে কিনে, দীর্ঘ সময় নিয়ে সেগুলো ছাড়ানোসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়া করতে হয়। সব মিলিয়ে এসব ব্যবসা। তবে এই দুই দোকানিই জানিয়েছেন, প্রতিদিনই বেশি কেবল বিক্রি হয় না। আবার কোনো কোনো দিন একদিনেই টনে টনে কেবল বিক্রি হয়। যার মূল্য হয় কখনো ৫-১০ লাখ বা তারও বেশি। আর খুচরা দৈনিক কয়েক লাখ টাকার কেবল বিক্রি হয় দোকানগুলোতে। সব মিলিয়ে যেসব দোকান আছে তাতে দৈনিক কয়েক কোটি টাকার কেবল বিক্রি হয়। আর বছর শেষে এখানের কেবল ব্যবসা শত শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। কোনো কোনো ব্যবসায়ী বছরে কয়েক কোটি টাকাও লাভ করেন। ব্যবসায়ীরা চান যে জাহাজ ভাঙা শিল্প থেকে এসব কেবল তাঁরা পাচ্ছেন সে শিল্পটি যেন টিকে থাকে। এ শিল্পের বিরুদ্ধে দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র চলছে দাবি করে তাঁরা বলেন, শিল্পটি বন্ধ হয়ে গেলে শুধু যে তাঁদের মতো কেবল ব্যবসায়ী ও তাঁদের পরিবারে দুঃসময় নেমে আসবে তা-ই নয়, জাহাজ ভাঙা শিল্পের ওপর নির্ভর করা লাখ মানুষের জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে। স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি করে বিক্রি করছি। এই জাহাজ থেকে শত শত রকম সরঞ্জাম পাওয়া যায়। তারই একটি এই কেবল। তাই জাহাজ ভাঙা শিল্পকে টিকিয়ে রাখলে সব শিল্পই বেঁচে থাকবে। আর নচেত্ এ রকমই বহু ব্যবসা ও তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকা কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়বে।