20/08/2023
দশ মাস পর দেশে ফিরেছে তানভীর। পিএইচডি কমপ্লিট করতে আরো এক বছর লাগবে। বাসায় এসে রীতিমত লজ্জায় পড়ে গেছে সে। নতুন বাবা হয়েছে। ছেলের জন্য হাবিজাবি কিনে এনেছে। আর কারো জন্য কেনাকাটা করার সময় হয়ে ওঠেনি। সময় থেকেও বড় প্রবলেম হচ্ছে আর্থিক সংকট। এখন বড় আপা, ভাবী আর দুলাভাই ওকে মাস্ট খেপাবে। পার্টটাইম জব করে নিজের খরচ থেকে বাঁচিয়ে দেশে পাঠানো খুব একটা সম্ভব হয় না তার।
তানভীরের স্ত্রী ইরা, একটা স্কুলে চাকরি করে নিজের খরচটা মেটায়। তানভীর মাঝে মাঝেই ইরাকে ফোনে বলে, ❝পুরোপুরি এস্টাবিলিশড না হয়ে হুট করে বিয়ে করাটা বোকামি হয়ে গেছে। সুন্দরী বৌ, গা ভর্তি গয়না থাকবে। কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আপাতত ফকিরি দশায় আছি দেখে দিতে পারছি না। ভবিষ্যতে দেখে নিও সব ইচ্ছে একসাথে পূরণ করবো।❞
ইরা খিলখিল করে হাসে স্বামীর কথা শুনে। হাসির শব্দ তানভীরের বুকে এসে বাজে খুব। ফোনের ও প্রান্তে থাকা মেয়েটার হাসি স্বচক্ষে দেখতে ইচ্ছে করে খুব। আলতো হাতে গালটা ছুতে ইচ্ছে করে। আর বলতে ইচ্ছে করে, তোমার গা ভর্তি গয়নার দরকার নেই। বুকে রিনঝিন কাঁপন তোলা হাসিটাই তোমার অলংকার।
বৌ ছেলের সাথে এখনো দেখা হয় নি তানভীরের। ড্রয়িং রুমে বসে ঘামছে সে। আর ভীষন লজ্জা লাগছে। এমনিতে ছোটবেলা থেকে মুখচোরা। এখন বাবা হয়ে গেছে, এই লজ্জায় বাবার সামনে বসে মাথা তুলে কথা বলতে পারছে না। কথা বলতে গেলেই জড়িয়ে যাচ্ছে লজ্জায়।
সে নিজে কারো বাবা হয়ে গেছে, আনবিলিভেবল! কি ভীষন লজ্জার ব্যাপার! পাশের রুম থেকে বিড়াল ডাকার শব্দ ভেসে আসছে। মহাকৌতুহলে রুমের পর্দার ফাঁক ফোকঁর দিয়ে কাউকে দেখা যায় কি না দেখার চেষ্টা করল তানভীর। কত কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছে। ইচ্ছে করছে এক ছুটে গিয়ে ছেলেটাকে দেখে আসে। বিশ্বাস করতে পারছে না এখনো, আস্ত একটা ছেলের বাপ হয়ে গেছে ও!
তানভীরের বাবা গম্ভীর মুখে পেপার পড়তে পড়তে চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। মাঝে একটা দুইটা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে ছেলের উদ্দেশ্যে। তার এই ছেলেটা ভীষন ভয় পায়। এটা বুঝে যেন আরো রাশভারি আচরন করেন ছেলের সামনে।
যেমন, এই মুহুর্তে ওনার ইচ্ছে করছে ছেলেকে ছোটবেলার মত কোলে বসিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু তিনি পারছেন না। ভেতরে ভেতরে কষ্ট হচ্ছে। তবুও মুখ থেকে গাম্ভীর্য সরিয়ে ঝলমলে হাসিতে বলতে পারছেন না, তানভীর বাবা একটু বুকে আয়।
ছেলে বাসায় ঢোকার পর মহাখুশিতে ভেতরটা ধুকপুক করা সত্ত্বেও ভাবলেশহীন কন্ঠে বলেছেন, এলে তুমি? ভালো করেছো, বসো।
যেন পাশের বাসা থেকে কেউ বেড়াতে আসায় অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। বুঝতে দিলেন না এতক্ষন ধরে ছেলের অপেক্ষায়, ছেলেকে দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে, এ ঘর ও ঘর করেছেন।
ওনার আশা ছিল, ছেলে হয়ত মনের ভাবটা বুঝবে। বুঝে তার বুকটাতে মাথা গুজবে, ভেতরের উল্লাস, আর্তনাদ কান পেতে শুনবে। কিন্তু সম্পর্কের বরফ গলিয়ে ছেলে তো কাছেইয়ে এলো না।
তানভীর উশখুশ করছিল। সে বলে উঠল, বাবা আমি ভেতরের ঘর থেকে আসি, আপনি বসেন।
তানভীরের বাবার ভেতরটা একটু দমে গেল। দীর্ঘক্ষন ছেলের মুখে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ঠিক আছে যাও।
ইরার ঠোঁটের কোণে হাসির আভা।
- তারপর এতক্ষনে বৌ-বাচ্চার কথা মনে পড়ল।
- কি করব, তোমার শ্বশুরের সামনে থেকে উঠা যায়। তো এইটা কে?
লাল টুকটুকে আধহাত সমান পিচ্চিকে দেখে মহাবিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে ফেলেছে তানভীর!
- আমার কপাল! নিজের ছেলেকে দেখে চিনতে পারছো না!
- এইটা আমার ছেলে! এত ছোট!
- (রাগ করে) তুমি কি ভেবেছিলে তোমার বৌ একশ কেজি ওজনের ছেলে জন্ম দিবে?
- (হেসে) এই ব্যাটা তুই ও কি তোর আম্মুর মত বদরাগী হবি না কি?
- ইরা, এইটা আমার ছেলে! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না বাবা হয়েছি!
- (হেসে) কি পাগল! কোলে নিবা?
- কোলে? নেব? ইয়ে মানে যদি পড়ে যায়?
- পড়বে না।
ইরা হাসি চেপে রেখেছে। তানভীর মহাচিন্তিত ভঙ্গিতে ভাবছে কোন এঙ্গেলে কোলে নিলে ছোটখাট পিচ্চিটা কোল থেকে পড়ে যাবে না। ইরা সাবধানে ছেলেকে বাবার কোলে তুলে দিল।
তানভীর টের পায় ভেতরে অন্যরকম একটা অনুভূতির জন্ম হচ্ছে। ছেলেকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। সারাজীবন বুকের ভেতরে আগলে রাখার আকুলতায় ভেতরটা ছটফট করছে। আরো একটা কিসের তৃষ্ণা যেন জেগে উঠছে ভেতরে। কিসের সেটা ঠিক বুঝতে পারছে না সে।
তানভীরের বাবা মন খারাপ করে ছাদে উঠে এসেছেন। কবুতরগুলোকে খাওয়াচ্ছেন। মন খারাপ হলেই স্ত্রীর কথা মনে পড়ে ওনার। সে সময় মন খারাপ হলে ওনার স্ত্রী কাছে এসে আবোল তাবোল বকত। মন ভাল করে দেয়ার চেষ্টা চালাত হাস্যকর ভাবে। ব্যথায় টনটন করছে বুকের ভেতরটা। কি হতো ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরলে, একদিনই তো। এতো বাধা ঠেকে কেনো ছেলের সামনে! নিজেরই তো ছেলে।
পিছনে কে যেন এসে দাড়িয়েছে। তিনি ঝাপসা চোখে পেছন ফিরলেন। আর তানভীর সাথে সাথে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আকস্মিক ঘটনায় তিনি হতবিহ্বল হয়ে গেছেন।
অতঃপর টের পেলেন চোখের পানিতে শার্ট ভিজে যাচ্ছে। বোকা ছেলেটা কাঁদছে, কাঁদুক। আদরের ছেলে আমার। ছেলেকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে ওনার।
কবুতরের দল ঝাঁক বেঁধে উড়ে গেল। অদ্ভুত নীল আকাশটায় মেঘের সাথে মিলে মিশে একাকার ওরা। আর সেই নীল আকাশটার ঠিক নিচে পুরনো বিল্ডিংটার ছাদে এক বাবা-ছেলের দূরুত্বের গল্পের সমাপ্তি হচ্ছে।।
————————————————————★
❣️❣️ সমাপ্ত ❣️❣️
————————————————————★
©️ সমাপ্তির গল্প
তানভীর আহমেদ