16/09/2022
আপনি আসলে কে?
পৃথিবীতে আজ অবধি যারা মানুষের কাছে শান্তির বার্তা পৌঁছায় দিসে, সে অবতার হোক বা কোনো কবি, সাহিত্যিক বা আর্টিস্ট - সবার শিক্ষার মধ্যে একটা কথা কমন। এই কথায় সবাই জোর দিসে। তারা বলে গেসে know thyself। নিজেকে জানো। এই কথা নতুন না। অনেকেই অনেকখানে শুনসেন। কিন্তু এই কথার প্রকৃত অর্থ আসলে কী?
'নো ম্যানস ল্যান্ড' হচ্ছে দুইটা দেশের বর্ডারের মধ্যবর্তী একটা জায়গা। যে জায়গার উপর কোনো দেশেরই অধিকার নাই। এই জায়গার কোনো পরিচয় নাই। নাম নাই। বাংলায় যারে বলে অনিকেত প্রান্তর। মানুষ হিসেবে আমরা এক একজনের কাছে এক একরকম। সত্যি বলতে দ্বিধা নাই, আমাদের সবার আলাদা আলাদা মুখোশ আছে। পরিবারের কাছে আপনি একরকম। বন্ধুদের কাছে আপনি এক রকম। প্রেমিক/প্রেমিকার কাছে একরকম। বৌ/জামাইয়ের কাছে একরকম। সমাজের কাছে একরকম। দিনশেষে আপনি আপনার ঘরে এসে সব মুখোশ খুলে যখন বিছানায় শোন বা বসেন, যখন আপনার আশে-পাশে আর কেউ থাকে না, তখন আপনি হয়ে উঠেন আপনি। এই আপনি তখন হয়ে যান অনিকেত প্রান্তর, বা নো ম্যানস ল্যান্ড। এখানে আপনার কোনো মুখোশ পড়ার প্রয়োজন হয় না। কারণ এখানে জাজমেন্টের ভয়নাই। এখানে আপনাকে অপছন্দ করার কেউ নাই। তাই অভিনয় বা মুখোশ পড়ারও কোনো প্রয়োজন নাই।
মানুষ প্রচন্ড স্বার্থপর একটা প্রাণী। সে সবকিছু করে নিজের জন্য। প্রিয়জনের মৃত্যুতে আপনার যখন বুক ভেঙে কান্না আসে, কেনো আসে? কারণ এই মানুষের অনুপস্থিতিতে আপনার বাঁচতে কষ্ট হবে। সে মারা গেছে, কষ্টের প্রধাণ কারণ কিন্তু এটা থাকে না। আপনি তাকে মিস করবেন। তার অস্তিত্বের যে অভ্যস্ততা আপনার মাঝে তৈরি হয়েছে, সেই অভ্যস্ততা কাটতে সময় লাগবে। প্রেমিক প্রেমিকার 'তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবোনাও' অনেকটা এমন। এখানে আপনার অপার ভালোবাসা নেই। আছে অভ্যস্ততা। সে বিহীন বাস্তবতায় অভ্যস্ত হতে আপনার সময় লাগবে দেখেই আপনার কষ্ট হয় তাকে ছাড়তে। ঠিক এই কারণেই মানুষ একলা বাঁচতে পারে না। তার সঙ্গ লাগে। পরিবার লাগে। বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য লাগে।
পৃথিবীর বুকে এই 'মানুষ' অনেক বড় একটা নাম। মানুষের একইসাথে ভালো এবং শয়তান হওয়ার ক্ষমতা আছে। মানুষ চাইলেই পৃথিবীকে সুন্দর করতে পারে। আবার চাইলেই ধ্বংস করে দিতে পারে। অনেকে এখানে বলতে পারেন আমার বেঁচে থাকার উদ্দেশ্য আমার পরিবার, আমার সন্তান। আপনার পরিবারকে ভালো রাখা, সন্তানকে ভালো রাখা অবশ্যই একটা উদ্দেশ্য। কিন্তু ওই যে বললাম, মানুষ স্বার্থপর প্রাণী; ঠিক এ কারণেই মানুষের বাঁচতে হলে তার একান্তই নিজস্ব কিছু লাগে। দিনশেষে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে আপনি যখন আপনার অনিকেত প্রান্তরে, যেখানে আপনার পরিবার, বন্ধু, সন্তান বা সমাজের সামনে কোনো মুখোশ পড়ার প্রয়োজন পড়ে না, ঠিক সে সময় আপনি কে? আপনার পরিচয় কী? সেখানে আপনার একান্ত নিজস্ব কিছুটা কী?
ঠিক এখানেই বুঝতে পারা যায় মহামানবদের মহান বানী নিজেকে জানো'র সংজ্ঞা। এসময় কারও পরিচয়, সে একজন আর্টিস্ট, পলিটিশিয়ান, ড্রিমার, মিউজিশিয়ান, লেখক বা হয়তো খুব সিম্পল একজন সাধারণ মানুষ। ধরা যাক, আপনার পরিবার আর নাই। সন্তান নাই। কিচ্ছু নাই। সব জাগতিক অবলম্বন শেষ, তখন আপনার বাঁচার উদ্দেশ্য তাহলে কি থাকবে?
আমার উদ্দেশ্য থাকবে তখন লেখা। আমি জীবনে বেশ কয়েকবার সিলিং ফ্যানের সাথে ফাঁস টাঙায় ফিরে আসছি। কারণ মনে হইসে, আমার অনেক গল্প লেখার আছে। আমি চাই আমার লেখা দিয়ে পৃথিবীতে ভালোবাসা নেমে আসুক। এই পৃথিবী সুন্দর হয়ে যাক। আমার এই এতটুকু গুণের শক্তি কিন্তু উপেক্ষা করার মতো না। আমার বন্ধু রাফসানের এই অনিকেত প্রান্তরের পরিচয় ছিলো মানুষকে হাসানো। সে লোকজনকে হাসানোর এক অদ্ভুত ক্ষমতা নিয়ে আসছিলো। আমার বন্ধু রাব্বির ছিলো সে কুত্তা পছন্দ করে। ওর মনে হইসে ও মরে গেলে এই কুকুরগুলারে দেখার কেউ থাকবে না। এই কথা বলার কারণ এইটাই যে আপনি মানুষকে হাসাতে পারেন বা কুত্তারে খাওয়ান, এটাও আপনার বাঁচার একটা অবলম্বন হইতে পারে।
"মানুষ মূলত একা " কথাটা এতো হালকা না। মানুষের আসলেই কেউ নাই। আমরা প্রচন্ড ইন্ডিভিজুয়াল প্রাণী। আপনার কি করতে ভালো লাগে, কোন জিনিসটা একান্তই আপনার, বেঁচে থাকার জন্য এটা খুঁজে বের করার আসলেই খুব দরকার।
শুনতে হয়তো কঠিন মনে হবে। কিন্তু বিষয়টা এতো কঠিনও না। একদিন হুট করে বাসা থেকে বের হয়ে যান। নিরুদ্দেশের পথে হাঁটা দেন। কমলাপুরে গিয়ে একটা র্যান্ডম ট্রেনে উঠে পড়েন। কিংবা বাসস্ট্যান্ডে উঠে কোনো বাসে। আপনার ভিতরে কি আছে একটু খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন।
দেখবেন, জীবনের অন্যরকম একটা মানে খুঁজে পাবেন।