25/12/2021
~| মন খারাপের দিনে |~
•লেখক:- মুহাম্মাদ নুরুল ইসলাম
আজ সকাল থেকে মনটা খুব খারাপ। কোন কাজেই মন বসছেনা। কিছুদিন আগে বাবার ব্যবসার লস তচনচ করে দিয়েছে সবকিছু। পারিবারিক চাপ, বাবার ব্যবসায় লস, বাবার ঋণের বোঝা সবকিছু মিলিয়ে বলতে গেলে মানসিক অস্তিরতার দিন পার করছি। অস্বচ্ছল, আর্থিকভাবে নিদারুণ কষ্টে আছি। বাবার ব্যবসায় লস হওয়ায় নিয়মিত করা হচ্ছেনা ঘরের বাজার পত্র, কেনা হচ্ছেনা নিয়মিত মায়ের ঔষধপত্র, বড় অংকের ঋণের বোঝা মাথায়।
বাবাকে বলেছিলাম পার্টটাইম একটি জব করার জন্য। বাবা কিছুতেই রাজি ছিলো না। বাবা বলতেন, ‘আগে ভালোকরে পড়াশোনা করো। পড়াশোনা করে যোগ্যতা অর্জন করো। তখন না হয় ভালো কোন চাকরি করবে।
বাবার একার উপার্জনের উপর আমাদের ঘর চলে। আমাদের দিন সুখেই চলছিলো। হঠাৎ ব্যবসায় নামে ধস! সবকিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেলো। ঘরে অশান্তি থাকলে কী আর কিছু ভালো লাগে?
যোহরের নামায পড়লাম মসজিদে। নামায পড়েছিলাম ঠিকই; কী পড়ছি নিজেই জানিনা। ইমাম সাহেব তাকবির বলতেন, আমি শুনে শুধু ওঠা-বসা করেছি। এককথায় তন(শরীর) ছিলো মন ছিলোনা। যোহরের নামায পড়ে বের হলাম ডান পা দিয়ে। বের হয়ে জুতা পড়লাম বাম পা দিয়ে। কারো সাথে কোন কথা না বলে চলে যাচ্ছিলাম। প্রতিদিন আদিব আর আমি একসাথে মসজিদে যেতাম, একসাথে মসজিদ থেকে আসতাম। পিছন থেকে আদিব ডাক দিয়ে বলল, ‘বল, পার্থিব জীবনের কোন এমন জিনিস, যেটা আল্লাহর কথা ভুলিয়ে দিয়েছে, বিরত রেখেছে নবীর সুন্নাহ আদায়ে?
তার এই কথা শুনে হকচকিয়ে গেলাম। আদিবকে বললাম, ‘বুঝলাম না ঠিক তোর কথা।
–তোর আজ কী হলো? তোর মতিগতিও সন্দেহজনক। কখন থেকে দেখছি তোর বিষন্ন মলিন চেহারা। কী হয়েছে আজ তোর? মসজিদ থেকে বের হলি ডান পা দিয়ে, জুতা পড়লি বাম পা দিয়ে। কবর জিয়ারত না করেই চলে যাচ্ছিস। অন্যমনস্ক হয়ে আছিস। কখনো তোকে আমি এরকম দেখিনি।
– না তেমন কিছু হয়নি।
– আজ তোকে এমন বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন? নিশ্চয় কিছু একটা হয়েছে! কী হয়েছে আমাকে বল। কোন একটা সমাধান বের হবে ইন শা আল্লাহ!
জোর করে নিয়ে মসজিদের পাশের পুকুরের ঘাটে নিয়ে বসালো। মসজিদের পাশে একটি বড় পুকুর আছে। পুকুরে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ আছে। মাছ বিক্রি করে মসজিদ কমিটি মসজিদের খাতে ব্যয় করে। একটি বড় পুকুর ঘাট আছে। মসজিদের মুসল্লিরা নামাযের পর কিছু সময় পুকুর ঘাটে বসে গল্পসল্প করে। যখন আদিব জোর করলো, তখন আমার আর কিছু করার নেই। অবুঝ শিশুর মতো আমাকে হুকুম তামিল করতেই হবে। কারণ, সেই আমার একমাত্র বেষ্টু, যে সুখে-দুঃখে সবসময় আমার পাশে থেকেছে। আদিবও আমার পাশে বসলো। বল এবার, তোর কী হয়েছে?
– জানিনা কী হয়েছে! আজ সকাল থেকে মন খারাপ। আমাদের পরিবারের কথা তো জানিস-ই। তার সাথে বাবার ব্যবসার লস । সবকিছু মিলিয়ে বলতে গেলে মানসিকভাবে বিপর্যয়গ্রস্ত।
– তো অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলি কই?
– জানিনা।
– গন্তব্যহীন পথচলাতো মু’মিনের আদত নয়! মু’মিনরা কখনো ভেঙে পড়েনা। কারণ, মু’মিনের সাথে রয়েছে আল্লাহ। মু’মিনের জন্য আল্লাহই যতেষ্ট। সুখে-দুঃখে একমাত্র আল্লাহর উপরই ভরসা করবি। কেননা, যে আল্লাহর উপর ভরসা করে তার জন্য আল্লাহই যতেষ্ট। আল্লাহ তার কার্যকলাপ সহজ করে দিবেন।[১]
আমি কিছু বলছিনা। নিচের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। কিচ্ছু ভালো লাগছিলনা। হয়তো এই ব্যাপারটা খেয়াল করলো আদিব। কিন্তু, কিচ্ছু বলেনি। অন্যসময় হলে ধমকাতো। কারণ, আদিব কথা বলার সময় তার দিকেই চেয়ে থাকতে হয়।
- এই আমার দিকে তাকা। আচ্ছা, আল্লাহ তাআলা দুনিয়া সৃষ্টি করেছেন, আমাদের সৃষ্টি করে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন, আমাদের জন্ম ও মৃত্যু দিয়েছেন এগুলো কী এমনি এমনি? না এমনি এমনি না। আমাদেরকে পরিক্ষা করার জন্য। [২]
এই পরীক্ষা খাতা-কলমে নয়। পরীক্ষার হলে আসলাম, খাতায় লিখলাম, চলে গেলাম তেমন নয়। এই পরীক্ষা ভিন্ন ও কঠিনতর। এই পরীক্ষা যেমন কঠিন তার পুরুষ্কারও তেমন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ ফরমান,
অবশ্যই আমি তোমাদিগকে পরীক্ষা করব কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, মাল ও জানের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও সবরকারীদের।[৩]
এটা তো তোর জন্য পরীক্ষা। ভেঙে পড়লে যে চলবেনা। কারণ, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে অকল্পনীয় কিছু পাবি— যা তুই কখনো কল্পনাও করিসনি। এই মুহুর্তে তোর কাজ হলো সবর করা, ধৈর্য ধরা। জানিস, ধৈর্যের বৃক্ষ কাঁটাযুক্ত হলেও তার ফল কিন্তু মিষ্ট হয়। আল্লাহ তাআলা এরশাদ ফরমান, হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর। নিশ্চিই আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে রয়েছেন।[৪] বল, ঐ ব্যাক্তির চেয়ে ভাগ্যবান আর কে হতে পারে যার সাথে রয়েছেন আল্লাহ?
– এখন কী করবো বল? কোন একটা পরামর্শ দে। আমি কী করবো বুঝতেছিনা।
– তুই এই সিচুয়েশনে কী করবি আমি বলবোনা স্বয়ং আল্লাহ বলে দিচ্ছেন। ধৈর্য্যর সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে।[৫] কারণ, আল্লাহ ব্যতীত তোর কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই।[৬]
আদিবের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করছিলাম। তাঁর কথাগুলো শুনে যেন আমি আমার মনোবল ফিরে পাচ্ছি। পাচ্ছি উঠে দাঁড়ানোর শক্তি। সত্যিইতো মু’মিনরাতো কখনো হতাশ হয়না। এই দুর্যোগ মুহূর্তে একমাত্র আদিবই আমার আশা জোগালো। এই জন্যই বলি, এই মুসাফির সফরে একজন প্রকৃত বন্ধু অতিব জরুরি। যে সুখে-দুঃখে পাশে থাকবে, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিবে। ছোটকালে আমরা কোন বিপদেআপদে পতিত হলে মা-বাবা ছিলো পাশে। কিন্তু বড় হলে কেউ থাকেনা একমাত্র প্রকৃত বন্ধু ছাড়া। চায়লে এই মুহূর্তে আদিব আমাকে নিয়ে ট্রল করতে পারতো, মজা উড়াতে পারত— এমনটা না করে দিয়েছে সান্ত্বনা, শুনিয়েছে সান্ত্বনার বানী, জুগিয়েছে আশা।
আমাদের আশেপাশে অনেক বন্ধু; কিন্তু প্রকৃত বন্ধু নয়। প্রত্যেকের কোন না কোন স্বার্থ আছে। সার্থসিদ্ধি হলে আর কোন খবর থাকেনা। কিন্তু একজন প্রকৃত বন্ধু হয় লিল্লাহ ( আল্লাহর ওয়াস্তে)। একমাত্র আল্লাহর জন্যই ভালোবাসা, আল্লাহর জন্য ঘৃণা করা। আর এমন সম্পর্ক নিছক কোন সম্পর্ক নয়; বরং একটি ইবাদত।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর আদিব বলল, ‘আচ্ছা আমাদের সৃষ্টিকর্তা কে?
– আল্লাহ।
– রহমান, রহীম, রাজ্জাক, খালিক, ইত্যাদি কে?
– আল্লাহ।
– আমাদের প্রয়োজন, হাযত চাইবো কার কাছে।
– আল্লাহর কাছে।
– তাহলে আল্লাহর কাছে না চেয়ে চলে যাচ্ছিলি যে? ভান্ডার তো রবের কাছে। রব দিতে সর্বদা প্রস্তুত। শুধু আমাদের চেয়ে নিতে হচ্ছে। হুযায়ফা রাদিআল্লাহু আনহু বলেন— রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন কোন সংকটে পড়তেন, তখন সালাতে রত হতেন।[৭] এখনি গিয়ে দুই রাকাত সালাতুল হাযত নামায পড়ে রবকে তোর মনে যত ক্ষোভ-আক্রোস, সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়া সব বলে মনকে হালকা কর। দেখবি রব তোর ডাকে সাড়া দিচ্ছে। তোর ও ভালো লাগবে। আমি বাইরে দাড়াচ্ছি।
আমি আদিবের কথামতো গিয়ে সালাতুল হাযত নামায পড়লাম। নামায শেষে দীর্ঘ মোনাজাতে নিজের সব কথা রবকে বললাম। চেয়ে নিলাম অনেককিছু। এখন কিছুটা ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ঘাড় থেকে কয়েক মনের বোঝা নামানো হয়েছে। কিছুটা স্বস্তিবোধ করছি। দাঁড়িয়ে দীর্ঘ একটি শ্বাস ফেললাম। বের হয়ে দেখি আদিব বাইরে আমার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমি গিয়ে বললাম, ‘নামায পড়েছি, চল।
- কোথায়? কবর যিয়ারত করে তারপর যাবি। জানিস, এই অন্ধকার কবরে শায়িত আছে কারো না কারোর আদরের মাতা-পিতা, দাদা-দাদি। জানিনা কবরবাসীরা কে কোন অবস্থায় আছে? একসময় রাজপথ কাঁপানো ব্যক্তিটিও এই অন্ধকার কবরে শায়িত। যার ভয়ে মানুষ পালিয়ে বেড়াতো, তেমন ক্ষমতাধর ব্যক্তিটিও আজ অসহায়। অন্ততপক্ষে সূরা এখলাসটুকু পড়।
আদিব কখনো কবর জিয়ারত না করে যায় না। যার নিমিত্তে আজ আমারো আদত হয়ে গেলো। কোন একদিন বলেছিলো সূরা এখলাসের ফযীলতের কথা, আমার এখনো মনে আছে। সূরা এখলাসকে কুরআনের এক তৃতীয়াংশ বলা হয়।[৮]
( হে পাঠকগণ! যখনই কোন কবরের পাশ দিয়ে যাবেন করব যিয়ারত করতে ভুল করবেন না।)
দাড়িয়ে দুজনে কবর যিয়ারত করলাম। সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা ‘ওহে পথিক! যাচ্ছ যখন যাও। যাওয়ার সময় একটু নাহয় দাঁড়াও।’
আদিব বলল, ‘চল, কোথাও থেকে একটু হেঁটে আসি। ভালো লাগবে।
বাদাম ওয়ালা থেকে দু’জন বাদাম কিনে হাঁটতে লাগলাম। জানিস নূর, যখন আমরা কোন বিপদে পরি তখন আমরা আল্লাহকে বেমালুম ভুলে যায়। ছুটে চলি দিগ্বিদিক। যেখানে আসার সেখানে আসিনা। নামায, জিকির কোনকিছুই যেন তখন ভালো লাগেনা। অথচ আল্লাহ বলছেন, তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ করবো।[৯]আল্লাহ কতই-না দয়াবান!
আমি কিছু না বলে হাঁটছি আর আল্লাহর সৃজিত মনোরম প্রকৃতিকে উপভোগ করছি।
রেফারেন্স :
১. সূরা তালাক - ০৩
২. আল্লাহ তাআলা এরশাদ ফরমান — যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন-কে তোমাদের মধ্যে কর্মে শ্রেষ্ঠ? তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাময়। সূরা মূলক - ০২
৩. সূরা বাকারাহ - ১৫৫
৪. সূরা বাকারাহ - ১৫৩
৫. সূরা বাকারাহ - ৪৫
৬. আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা এরশাদ ফরমান— তুমি কি জান না যে, আল্লাহর জন্যই নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের আধিপত্য? আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু ও সাহায্যকারী নেই। সূরা বাকারাহ- ১০৭
৭. আবু দাউদঃ ১৩১৯
৮. সহিহুল বুখারি - ৬৬৪৩
৯. সূরা বাকারাহ- ১৫২
[ উক্ত গল্পটি ❝ অভিযাত্রী ❞ কর্তৃক প্রতিযোগিতায় ১ম স্থান অধিকার করে পুরস্কৃত হয়]