11/10/2022
আজ আধ্যাত্মিক দরবার মাইজভান্ডার শরীফে বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহুল আযিয)’র স্মরণ” ৩৪তম মহান ২৬ আশ্বিন উরস শরিফ,
==========================================
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
৩৪তম মহান ২৬ আশ্বিন উরস শরিফ (২০২২) উপলক্ষেঃ
বাংলাদেশে প্রবর্তিত একমাত্র ত্বরিকা, বিশ্বসমাদৃত ত্বরিকা-ই-মাইজভাণ্ডারীয়ার উজ্জ্বল নক্ষত্র "মারাজাল বাহরাইন বিশ্বঅলি শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহুল আযিয)’র স্মরণ”
🌸 “বিবর্তিত জীবনের মানচিত্র” 🌸
[জীবনী গ্রন্থ “শাহানশাহ্ হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (কাদ্দাসাল্লাহু সিররাহুল আযিয)” হতে]
জীবন যেহেতু শরীর নির্ভর, তাই মহাপুরুষদের শরীরের বিবরণী জানাও গুরুত্বপূর্ণ। শৈশব হতে তাঁর শরীর ছিল হালকা পাতলা ও নাতিদীর্ঘ, গায়ের রং উদয়কালীন পূর্ণিমা চাঁদের মত তামাটে। মাথা গোলাকার, চুল ঘনকাল নরম, কপাল প্রশস্ত, দীর্ঘ টিকালো নাক, চোখ ও কান স্বাভাবিক আকৃতি, দু’চোখের ভ্রু আলাদা, মাঝারি সাইজের সাদা দাঁত, মুখমন্ডল লম্বাটে, দাড়ি পাতলা। আজানু লম্বিত বাহু, নরম হাতে সুস্পষ্ট রেখা, সরু কলমি আঙ্গুল, চওড়া ঘাড় ও বুক। কেশহীন বুকের মধ্যখানে গর্ত, মেদহীন পেট। মসৃণ পিঠ, শিড়দাঁড়া বরাবর একটু ভাঁজ, সমতল কোমরের গ্রন্থি সন্ধিতে টোল। নাতিপুরুষ্ট নিতম্ব ও দুই উরু। লম্বা পাতলা পায়ের পাতা, আঙ্গুল সরু। শরীরের উপরাংশের চেয়ে কোমর হতে নীচের অংশ দীর্ঘ। খাওয়া ঘুম পরিমিত ও গোসল ছিল নিয়মিত।
কলেজ জীবন পর্যন্ত কাপড় চোপড় চালচলন ছিল শৌখিন। তিনি প্যান্ট শার্ট জুতা স্যান্ডেল কখনো কখনো স্যুট হ্যাট ধুতি পাঞ্জাবীও পরিধান করতেন। তিনি ছিলেন বন্ধু বৎসল, আমুদে ও খেলাধুলা প্রিয়। স্বভাব শান্ত, আচরণ বিনয়ী, কণ্ঠস্বর মধুর এবং কথাবার্তা ছিল যুক্তিপূর্ণ। ধৈর্য ও সহনশীলতা ছিল স্বভাবজাত।
আধ্যাত্মিক সাধনার সূচনাকাল হতে দ্রুত বদলে যায় তাঁর জীবনচিত্র। খাওয়া ঘুম গোসল সবকিছু অনিয়মিত হয়ে যায়। মাসাধিককালের গোসলহীন শরীরে কোন দুর্গন্ধ নয় বরং এক প্রকার স্নিগ্ধ সুগন্ধ ছিল। মেজাজ কখনো জজবা-গরম হাল, কখনো আনমনা আত্মভোলা। আবার কখনো ভীষণ ব্যস্ত থাকতেন এমন সব কাজে সাধারণ মানুষের চোখে যেগুলোর কোন গুরুত্বই ছিল না। নিপীড়িত লাঞ্ছিত ও দুঃখী মানুষের প্রতি তিনি ছিলেন সহানুভূতিশীল। অত্যাচারী মানুষ দেখলে বজ্রের মত কঠোর আচরণ করতেন। স্বাভাবিক অবস্থায় তাঁর আতিথেয়তা ছিল অতুলনীয়। মনে হতো তিনি অত্যধিক ধূমপায়ী ছিলেন। সিগারেটে আগুন লাগিয়ে ধোঁয়া টেনে তা মুখের অগ্রভাগ থেকে বাইরে ফুঁ দিয়ে ছেড়ে দিতেন। কোন সময় দেখা যেত সিগারেট মুখে বার বার ম্যাচ জ্বালালেন কিন্তু সিগারেট জ্বললো না। যে ব্র্যান্ডের সিগারেট পান করতেন, তাঁর ওফাতের সাথেই সে ব্র্যান্ড উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ঘুরে বেড়াতেন দেশের শহর গ্রামের নানাস্থানে। তাঁর হাঁটা স্বাভাবিক মনে হলেও সঙ্গীদের দস্তুরমত দৌঁড়াতে হত।
রিয়াজত পরবর্তীকালে তিনি প্রায় লুঙ্গি পাঞ্জাবী পরিধান করতেন। কোন কোন সময় উদোম গায়ে অথবা শুধু গেঞ্জি পরে সর্বত্র ঘুরে বেড়াতেন। ১৮ দিন পর বন্ধ মুখ খুলতে যে দুটি দাঁত মরে গিয়েছিল বাকি সময় সেগুলো কালোই থেকে যায়। ওফাতের পূর্বে তাঁর ক’টি দাঁত পড়ে যায়। কখনো তাঁর গুরুতর কোন রোগ হতে দেখি নাই। শেষ দিকে চুল দাড়ি অধিকাংশ পেকে যায়। ১৯৮০ সালের দিকে পিতার ওফাতের পূর্বে তাঁর শরীরে কাঠামোগত উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। পীরে ত্বরিকত পিতার কাছ হতে পাওয়া এত্বেহাদী ফয়েজ (সার্বিক অনুগ্রহ) এর ফলে তাঁর শরীরের কোমর হতে উপরাংশ একটু বেঁটে, মুখে ও পিঠে জরুল জাতীয় দাগগুলো ভেসে উঠে যে রকম তাঁর পিতা ও গাউসুল আযম মাইজভাণ্ডারীর ছিল। এ সময় শরীরও একটুখানি স্থূল হয়ে পড়ে। জগত বিখ্যাত দার্শনিক ও ধর্মতত্ত্ববিদ ইসলামের গৌরব হযরত ইমাম গাজ্জালী এক দরবেশকে উপদেশ দিতে বললেন, ‘‘আমি একটানা চল্লিশ বৎসর আল্লাহ’র ইবাদত বন্দেগীতে রত ছিলাম। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে আমার মধ্যে আল্লাহ’র নূর কিংবা কোন উন্নতি না দেখে হতাশ হয়ে পড়ি। অতঃপর কম খাওয়া, কম কথা বলা, কম নিদ্রা ও লোকের সাথে কম মেলামেশার ব্রত গ্রহণ করি। এর পর আমি আকাশের দিকে তাকালে আল্লাহ’র আরশ পর্যন্ত দেখতে পাই। কোন কিছুই আমার দৃষ্টি পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আবার যখন মাটির দিকে দৃষ্টিপাত করি তখন সাত তল জমিনের মধ্যে যা কিছু আছে সবই আমি দেখতে পাই’’। শাহানশাহ্ মাইজভাণ্ডারী সাধনাকাল হতে চারটি বিষয়কে চরিত্রগত করে নিয়েছিলেন: (১) অল্প আহার (২) স্বল্প কথা (৩) রাত্রি জাগরণ এবং (৪) লোকালয়ে বাস করেও নির্জনতা অবলম্বন। ফলে তাঁর দৃষ্টিতেও সমগ্র সৃষ্টি জগত সমুদ্ভাসিত হওয়ার দৃষ্টান্ত লক্ষ্যণীয়।
একবার সৈয়দ নুরুল বখতেয়ার শাহ্কে তিনি নিজেই বলেন ‘‘মামু সাহেব, ছয়মাসে একবার ঘর হতে বারান্দায় বের হই; কাজের জন্য একেবারে সময় পাই না’’। ওফাতের বছর খানেক পূর্বে নিত্য সফরসঙ্গী মৌলবী কুদ্দুছ বাবাজানকে তাঁর বয়স কত জিজ্ঞাসা করলে বলেন, পাঁচ বছর। মৌলবী সাহেব হিসাব কষে বয়স ষাট বছর বলে তাঁর সম্মতি আশা করলেও তিনি চুপ থাকেন। জীবন সায়াহ্নে ইমামে আযম হযরত আবু হানিফাকে (র:) বয়স কত জিজ্ঞাসা করলে বলেন, দুই বছর। উপস্থিত লোকেরা আশ্চর্য হলে বলেন, ‘আওলাদে রাসূল (দ:) হযরত ইমাম জাফর সাদেক রাদিয়াল্লাহ্ এর সোহবতে তরিকার সবক গ্রহণ করে সত্যিকার আমলের দুই বছরই আমার মৌলিক বয়স’। অনুরূপভাবে গাউসুল আযম হযরত আবদুল কাদের জিলানী (ক:) তাঁর বয়স পাঁচ বছর বলে মন্তব্য করেছিলেন।
বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসের প্রচন্ড গরমে কয়েকটা কম্বল মুড়ে শুয়ে থাকতেন আবার পৌষ-মাঘের কনকনে শীতে আপন হুজরা শরীফে কয়েকটা পাখা চালিয়ে বসে থাকতেন। যেহেতু তিনি ছিলেন বিশ্বঅলি আল্লাহ’র সমগ্র জাহানে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ, আমরা যদিও গরমের মধ্যে কম্বল মুড়ে বা শীতের সময় পাখা ছেড়ে শুয়ে থাকতে দেখেছি কিন্তু এর হাকিকত হল তিনি যখন গরমে কম্বল মুড়ে শুয়েছিলেন তখন তিনি এমন কোন জায়গায় অবস্থান করেছিলেন বা এমন কোন দেশে অবস্থান করছিলেন যেখানে তখন ছিল শীতকাল। আর তিনি যখন শীতে পাখা ছেড়ে বসেছিলেন তখন এমন কোন জায়গায় অবস্থান করছিলেন যেখানে তখন ছিল গ্রীষ্মকাল। এখানে একটা ঘটনা প্রণিধানযোগ্য; একদা রাসূলে পাক (দ:) বাইরে থেকে নিজ ঘরে প্রবেশ করলে বিবি হযরত আয়েশা (রাদিঃ) নবীজির শরীর, দাড়ি ও টুপি মোবারকে পানি দেখে জিজ্ঞেস করেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ্ (দ:) আপনার শরীর মোবারকে পানি কেন? রাসূল (দ:) প্রতিউত্তরে বলেন: বৃষ্টির পানি। বিবি আয়েশা (রাদিঃ) বলেন আরব দেশে বেশ কিছুদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে না। অথচ আপনি বৃষ্টিতে ভিজে আসলেন। রাসূল (দ:) বলেন, ‘‘হে আয়েশা আমি শুধু আরবের নবী নই, আল্লাহ্ যতটুকুর জন্য রাব্বুল আলামীন আমি ততটুকুর জন্য রহমতুল্লিল আলামিন। আমি এখন এমন এক দেশ থেকে আসছি যেখানে এখন বৃষ্টি হচ্ছে’’। আর শাহানশাহ্ বাবাজানের কালাম, ‘‘রহমতুল্লিল আলামিন রাসূলের রহমতের সীমা জুড়ে আমার বেলায়তি কর্মক্ষমতা’’। কবি দার্শনিক ডক্টর আল্লামা ইকবাল বলেন,
‘‘এমন পাখির ‘হাল’ ও ‘মকান’ কিছুই কি এরা (মানুষ) জানে
উড়ে চলে যে নিঃসীম আকাশে প্রতিপলে প্রতিক্ষণে!’’