12/03/2024
কলেজ বেলায় নটডেমের কয়েকজন বন্ধু ছিল আমার। ভিকি হিসেবে ডেমিয়ান বন্ধু না থাকাটাই অস্বাভাবিক ছিল। আর সেই “ইটস নট আ রিলেশন, ইটস আ ট্র্যাডিশন” ব্যাপারটা তো ছিলই।
প্রতিদিন সকালে আমি বাপির সাথে মোটরসাইকেলে চেপে কলেজে যেতাম। যাওয়ার পথে পড়ত নটরডেমের ক্যাম্পাস। ক্রিম শার্টের ছেলেগুলোর হুড়োহুড়ি ছোটাছুটি চোখে পড়ত প্রতিদিনই। কিন্তু এত ক্রিম শার্টের মধ্যে একজন আমার বড্ড চেনা ছিল। আমি যখন প্রতিদিন নটরডেমের ক্যাম্পাস পেরিয়ে কলেজ যেতাম, ছেলেটা কলেজের সামনে টং-এর দোকানে চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকত, বা তাদের পেছনদিকের ভবনটার তিনতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত। অতটা দূর থেকেও প্রতিদিনই সে আমাকে ঠিক খুঁজে পেত বাপির সাথে মোটরসাইকেলের পেছনে। অতদূর থেকে চেহারাটা স্পষ্ট না দেখলেও আমি জানতাম মানুষটা কে। হাত নাড়তাম দুজন দুজনকে।
কলেজ পেরিয়ে যখন আমরা জীবনের পরবর্তী ধাপের জন্য প্রস্তুত হচ্ছি, ভীষণ ভুল বোঝাবুঝি হল দুজনের। যাকে রোজ কলেজ যাওয়ার পথে দেখে অভ্যস্ত ছিলাম, তার সাথে কথা পর্যন্ত বন্ধ। নটরডেমের ক্যাম্পাস পেরিয়ে কোথাও যেতে গেলে বুকের ভেতর কী একটা পাথর চেপে বসত। ততদিনে নটরডেমের নতুন ভবনের ইট-পাথরগুলো আড়াল করে ফেলেছে সেই পুরোনো ভবনের বারান্দাটা। আমার কেমন যেন মনে হত, নতুন ভবনটা না থাকলে আমি ঠিকই দেখতাম ঐ বারান্দাটায় ক্রিম শার্ট পরা একটা অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে।
বড্ড কঠিন ছিল দিনগুলো। সেই দিনগুলোতে সারাক্ষণ আমার সাথে ফোন ধরে বসে থাকত আমার আরেকটা নটরডেমিয়ান বন্ধু। বেচারা বুয়েটের কোচিং করছিল। কোচিং-এ যাওয়ার পথে, আসার পথে সে ফোনটা ধরেই থাকত। আমি কাঁদতাম। সেই বন্ধুর বাড়ানো হাত ধরে আমি সেই শূন্যতার সমুদ্র থেকে উঠে এসে ফিরে এসেছিলাম আমার স্বপ্নপূরণের পথে।
তার পরের বছর আমি ইউএসএ-এর একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফুল স্কলারশিপসহ অ্যাডমিশন অফার পাই, সাথে ফিনল্যান্ডের আল্টো ইউনিভার্সিটির কোয়ান্টাম টেকনোলজি প্রোগ্রাম এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রোগ্রামে আন্ডারগ্র্যাড এবং মাস্টার্সের জন্য একসাথে ফুল স্কলারশিপ। নানা বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত গেটিসবার্গে আসার সিদ্ধান্ত নিই। তখন কোভিড তুঙ্গে। প্রথম সেমিস্টার অনলাইনে করে পরের ২০২১-এর জানুয়ারির এক সকালে বিমানে চড়ে উড়াল দিই স্বপ্নের পেছনে ছুটতে।
তো যাই হোক। ততদিনে সেই চায়ের টং-এ দাঁড়িয়ে থাকা ক্রিম শার্টের বন্ধুটার স্মৃতিগুলো আর অত জ্বালায় না। এক সময় ভুলে যাই তার প্রিয় রং, প্রিয় খাবার, এমনকি তার চোখ দুটোও।
বছরখানেক আগে হঠাৎ মনে হল, এক সময় যে অতটা প্রিয় ছিল- যার সাথে অত ভালো স্মৃতিগুলো ছিল- কলেজ জীবনের সেই মানুষটাকে এইভাবে হারিয়ে যেতে দেয়া হয়তো উচিত না। হ্যাঁ, সে মানুষটাই বলেছিল আমাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ থাকবে না। কিন্তু আমার হঠাৎ মনে হল, মানুষের জীবন কতটুকু? এইটুকু জীবনে যদি এক সময়ের প্রিয় কেউ এতটাই অচেনা হয়ে ওঠে যে তাকে দেখলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে অচেনা মানুষের মতো চলে যেতে হয়- তবে সেটা খুবই খারাপ একটা ব্যাপার। ভাবলাম, সে না হয় বাচ্চা রয়ে গেছে। আজও আমার খোঁজ নেয়নি। কিন্তু তা বলে আমিও বাচ্চা থেকে গেলে হয়?
মনের সাথে পরামর্শ করলাম। জানতে চাইলাম, সব ব্যথা ভুলেছ তুমি? তার সাথে কথা বলতে গেলে নতুন করে কষ্টগুলো ফিরে আসবে না তো? তাকে প্রশ্ন করবে না তো, কেন চলে গেছিলি ওভাবে?
মন অনেক ভেবে বলল, সেই ঘরটা ঝেড়েমুছে পরিষ্কার করেছি ঠিকই, কিন্তু এখনও কিছুটা কষ্ট, কিছুটা চাপা অভিমান রয়ে গেছে। হয়তো তাকে প্রশ্নটা করতেও পারি- কেন চলে গেছিলি?
আমি বললাম, তবে এখনও সময় আসেনি তার মুখোমুখি হওয়ার। সময় হবে সেদিন, যেদিন মন তুমি তাকে ক্ষমা করে দেবে, আমাকে ক্ষমা করে দেবে, সেই সময়টাকে, সেই অনুভূতিগুলোকে ক্ষমা করে দেবে। যেদিন তুমি তার সাথে দেখা হলে দেখবে এক ওল্ড কমরেডকে, যার সাথে তুমি অনেক যুদ্ধ একসাথে করেছিলে, হাতে হাত রেখে। আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেলেও সেই ভালো স্মৃতিগুলো রেখে অভিমানগুলো, রাগ, দুঃখগুলো যেদিন তুমি আকাশের নীলে ভাসিয়ে দিতে পারবে, সেইদিন আমি তার সাথে কথা বলব।
এরপর সেই বন্ধুটার কথা আবার ভুলে গিয়েছিলাম। এই কিছুদিন আগে হঠাৎ মনে হলো। মনকে প্রশ্নটা আবার করলাম। সে বলল, আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। ক্ষমা করে দিয়েছি তাকেও, আর তোমাদের কলেজ বেলার ছেলেমানুষি ভুলগুলো, মন কষাকষিটুকু।
আমি সেই বন্ধুকে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুঁজে বের করে নক করলাম। বললাম, আমি বন্ধুত্ব চাইছি না। শুধু চাইছি যেন কোনোদিন আমাদের দেখা হলে আমরা মুখ ফিরিয়ে চলে না যাই। চাইছি যেন আমরা সেইদিন কোনো এক ক্যাফেতে বসে এক কাপ কফি হাতে গল্প করতে পারি।
আমি বন্ধুটাকে মেসেজ পাঠিয়েছি শুনে আমার বাকি বন্ধুরা দারুণ রেগে গেল। বলল, যে মানুষটা তোকে ভেঙ্গেচুরে টুকরো টুকরো করে রেখে হারিয়ে গেল, কোনোদিন স্যরি পর্যন্ত বলল না, তুই তার সাথে কথা বলতে গেলি?
আমি হাসলাম শুধু। হ্যাঁ, আমাকে সেইদিন সে ভেঙে চুরমার করে দিয়ে চলে গিয়েছিল। But that’s what made me realize how strong I was. That’s what made me see the part of myself I never knew- a warrior. That’s what transitioned me from being a girl to an independent, strong woman. A woman on fire. And while I never forgot how hurt I was that time, it only made me stronger. It only showed me what I was capable of. Do I really need him to apologize for hurting me? Do I not know how terrible it felt to be hurt like that? Do I really need him to validate my feelings?
উত্তরটা ছিল, না।
যাই হোক, পরদিন সকালে উঠে দেখি সেই বন্ধুটার উত্তর। সেই কলেজ বেলার মতো একটা ঝাড়ি দিয়ে লিখেছে- এতদিন পর মেসেজ দিচ্ছিস তাও আবার ফর্মাল ইংলিশে? এই সমস্যা কী রে তোর?
হাসলাম আমি।
সে বলল, আমি কক্ষনো তোকে কষ্ট দিতে চাইনি রে। আমি কক্ষনো কোথাও চলে যাইনি। আমি যে স্টেশনে ছিলাম, আজও সেখানেই বসে আছি। শুধু তোর জন্য একটু চা আনতে গিয়েছিলাম। তুই ভেবেছিলি আমি চলে গেছি। তাই তুই পরের ট্রেনটা ধরে চলে গেলি। আমি এসে দেখি, তুই নেই। কিন্তু আমি এখনও সেখানেই আছি, আজ তিন বছর এগারো মাস পর তুই সেই স্টেশনে ফিরে এসে দেখলি আমি ঠিক আগের জায়গাতেই বসে আছি।
আবার স্মিত হাসলাম আমি।
আমি কোনো পালটা যুক্তি দিলাম না। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, কখনো কখনো হেরে আসতে হয়। ছেড়ে আসতে হয়। Some things are not worth fighting for. আমি হেরে এলাম। ছেড়ে এলাম। আমার কোনো রাগ নেই সেই পুরনো বন্ধুর উপর। নেই সেই কিশোরী নিজের উপরেও। দুজনকেই আমি ক্ষমা করে দিয়েছি।
সেই সদ্য কলেজ পেরুনো বেলায় তার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল ১২ই অক্টোবর, ২০১৯।
তারিখটা আমি মনে রাখতে পারিনি, সে রেখেছে। ঠিক যেমন সে মনে রেখেছে আমার প্রিয় রং সাদা, আমার জন্মদিন জানুয়ারির ৬, আমার মেয়ের নাম আমি ঠিক করে রেখেছি আলিশা, মনে রেখেছে আমার প্রিয় গানগুলোর নাম।
আজ ১২ অক্টোবর। আমাদের সেই কথা বন্ধের ঠিক চার বছর।
গত চার বছরে আমার জীবনে যা যা হয়েছে, তার সবটাই সে জানে। কীভাবে- তা আমি জানি না।
পরশু রাতে যখন আমরা ফোনে কথা বলছিলাম, সে হঠাৎ-ই তার সময়ের রাত সাড়ে তিনটের দিকে বারান্দায় কনকনে শীতে দাঁড়িয়ে গাইতে শুরু করল-
“তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার,
যত দূরে সরে যাও রবে আমার…
… আলো আলো আমি কখনো খুঁজে পাব না
চাঁদের আলো তুমি কখনো আমার হবে না…”
আমার তখন রাত সাড়ে ন’টা। আমি জানালার পাশে আমার বই পড়ার ছোট্ট আরাম আরাম জায়গাটায় একটা বিন ব্যাগে আধশোয়া হয়ে আছি। থার্মোস্ট্যাটের উষ্ণতার সাথে মিশেছে আমার ঘরজুড়ে ফেয়ারি লাইটের উষ্ণতা। হঠাৎ আমার মনে হলো, এই গানটা আসলে তাহসানের লেখা বা গাওয়ার কথা ছিল না। এই গানটা আমার বন্ধুটারই লেখার কথা ছিল, এই গানটা লেখার কথা ছিল আমার জন্য।
আমি তার কাছে জানতে চেয়েছি, এই যে এত বছর পর আমরা কথা বলছি, এখান থেকে তুই কোথায় যেতে চাস?
সে বলেছে, আমি শুধু তোকে আর হারাতে চাই না। তুই যেদিন নোবেল পাবি, সেইদিন আমি পত্রিকা হাতে সারা শহর ছুটে বেড়িয়ে চিৎকার করে বলতে চাই- This woman- Meem- this Nobel laureate- she is my best friend!
জীবন বড় অদ্ভুত জানেন তো? জীবন একটা উপন্যাস। সেই উপন্যাসের কিছু অধ্যায়ে একটা চরিত্র থাকতে পারে, আবার পরের অনেকগুলো অধ্যায়ে সে হয়তো একদমই থাকল না। তাই বলে কিন্তু এমন না যে ১৮ থেকে ২১ অধ্যায় পর্যন্ত সেই চরিত্র ছিল না বলে সে ২২তম অধ্যায়ে ফিরে আসবে না। উপন্যাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রই কিন্তু কিছু অধ্যায়ে হারিয়ে যায়, কিন্তু তাই বলে তারা সবসময়ের জন্য হারিয়ে যায় না। আবার কোনো এক অধ্যায়ে তাদের আবার আগমন হয়।
Don’t close any doors forever shut. Don’t forget the people who were once important to you. Reach out to that person you left three years ago, and that person who left you four years ago. Don’t wait for them to reach out. Don’t wait for them to apologize. You don’t need their apologies to validate your feelings. You know what you went through when they left. You don’t need them to tell you that. Whether you were the one who left or the one who was left, don’t fear to reach out. Let go of your grudges. Maybe these people will become a vital character of your story again. And even if they don’t return in your story, your heart will be able to let go of the heavy sigh it has been hiding.