08/10/2024
এ যুগের মুজতাহিদ- ইমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম?
[লেখাটি না পড়ে মন্তব্য করবেন না]
একটা রাষ্ট্রকাঠামো দাঁড় করাতে হলে যত ধরনের আইন কানুন বিধি-ব্যবস্থা লাগে তা কিন্তু পবিত্র কোর’আনে নাই। আপনি যদি গভীর মনোযোগ দিয়ে কোর’আন পড়েন তাহলে দেখতে পাবেন- কোর’আনে কিন্তু খুব বেশি আইন কানুন আল্লাহ দেননি। শুধু প্রধান প্রধান কয়েকটি অপরাধের সর্বোচ্চ দণ্ডবিধি ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন- চুরি, ডাকাতি ও ব্যাভিচারের শাস্তি। বলা বাহুল্য, এতটুকু আইন-বিধান-দণ্ডবিধি দিয়ে কিন্তু রাষ্ট্র চলে না। একটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য আরও হাজার হাজার আইন, কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি প্রয়োজন হয়। প্রয়োজন যে হয়- তা আমাদের চাইতে সর্বজ্ঞানী আল্লাহ আরও ভালোভাবে জানেন। তবু তিনি এই মৌলিক কিছু বিষয় ছাড়া অন্যান্য বিষয়ে কোর’আনে কিছুই বলেননি। প্রশ্ন হলো, কেন বলেননি?
কেন বলেননি- তা জানতে হলে আমাদেরকে আগে বুঝতে হবে পবিত্র কোর’আনটা আসলে কী। আসলে কোর’আন কোনো আইনের বই নয়, বা দণ্ডবিধির বই নয়। কোর’আন হলো আল্লাহর দেওয়া সীমারেখা। কীভাবে? ব্যাখ্যা করছি।
ধরেন আপনি একটা মহল্লায় বসবাস করেন। দীর্ঘদিন যাবৎ সেখানে বসবাস করার কারণে ঐ মহল্লার আশেপাশের পরিবেশ, পরিস্থিতি সবই আপনার জানা। ঐ মহল্লার উত্তরপ্রান্তে আরেকটা মহল্লা আছে- যেখানে প্রতিনিয়ত চুরি ডাকাতি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। তাছাড়া ওখানে সবসময়ই মারামারি, গণ্ডগোল, রক্তপাত লেগেই থাকে। হঠাৎ একদিন আপনার ছোট ভাই আপনার বাড়িতে আসলো। আপনি তাকে বললেন- শোনো, ঐ যে রাস্তাটা দেখছো, ওখান পর্যন্ত তোমার সীমারেখা। পরিস্থিতি যাই হোক তুমি ওই রাস্তা পেরিয়ে পার্শ্ববর্তী মহল্লার ভেতরে ঢুকবে না। ঢুকলে কিন্তু বিপদ হবে। অন্য যে কোনো স্থানে তুমি যেতে পারো, ঘুরতে পারো, বেড়াতে পারো, কোনো অসুবিধা নাই।
এই যে আপনি আপনার ছোট ভাইকে তার সীমারেখাটা বুঝিয়ে দিলেন- এভাবেই আল্লাহ পবিত্র কোর’আনে তাঁর মো’মেন বান্দাদেরকে সীমারেখা বর্ণনা করে দিয়েছেন, যার বাইরে গেলেই বিপদ। কিন্তু এই সীমারেখার ভেতরে মো’মেনরা স্বাধীন। মানুষ কী পোশাক পরবে তা আল্লাহ নির্ধারণ করে দেননি, শুধু সীমারেখা বলে দিয়েছেন- লজ্জাস্থান ঢাকতে হবে। কী দিয়ে ঢাকবে তা যার যার সংস্কৃতি অনুযায়ী, রুচি অনুযায়ী, অভ্যাস অনুযায়ী, পরিবেশ অনুযায়ী নির্ধারিত হবে। ওখানে আল্লাহর কোনো হস্তক্ষেপ নাই। মো’মেনরা কী খাবার খাবে তা বলেননি শুধু বলেছেন শুকর, রক্ত ইত্যাদি খেতে পারবে না। মো’মেনরা কী গান গাইবে, কী ছবি আঁকবে, কী সিনেমা বানাবে, কী ভাস্কর্য বানাবে, কী সাহিত্য লিখবে তা নিয়ে আল্লাহর কোনো আদেশ বা নিষেধ কোনোটাই নাই, শুধু সীমারেখা বলে দিয়েছেন অশ্লীলতা করা যাবে না, মিথ্যা প্রচার করা যাবে না। সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়- ব্যক্তিগত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে, খাদ্য নিয়ে, পোশাক নিয়ে, সংস্কৃতি নিয়ে কিংবা অন্যান্য ছোটখাটো বিষয় নিয়ে আল্লাহ যদি কোর’আনে হাজার হাজার বিধান দিতেন তাহলে মানুষের জন্য তা দমবন্ধ পরিবেশ তৈরি করত। একবার ভাবুন তো- মেরু এলাকার মানুষ যে পোশাক পরে, যে খাদ্য খায়, যে সংস্কৃতি চর্চা করে, মরু এলাকার মানুষ কি তা পারবে? কখনই না। আবার চিন্তা করে দেখুন- আমাদের দেশের মানুষ এখন থেকে এক হাজার বছর আগে যে আইন কানুন মেনে জীবনযাপন করেছে, এখন কি আমাদের পক্ষে হুবহু সেটা মেনে চলা সম্ভব হচ্ছে? আমাদের শাসকরা কি চাইলেও সুলতানী যুগের আইন দিয়ে বর্তমান যুগের বাংলাদেশ শাসন করতে পারবেন? পারবেন না, কারণ যুগের সাথে আমাদের জীবনে হাজারও নতুন উপাদান যুক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও কতকিছু যুক্ত হবে, কতকিছু বাতিল হয়ে যাবে। তাই আল্লাহ ছোটখাটো সকল বিষয়ে কোর’আনে বিধান দিয়ে মানুষকে একটা গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চাননি। তিনি শুধু চূড়ান্ত সীমারেখা নির্ধারণ করে দিয়ে বাকি সবকিছু মানুষের উপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষকে স্বাধীনতা দিয়েছেন বাকিটুকু নিজেদের মতো পরিবেশ পরিস্থিতি ও স্থান-কাল-পাত্র বুঝে নির্ধারণ করে নিতে।
অর্থাৎ আল্লাহর চাওয়া হলো- “আমার এই সীমারেখার মধ্যে থেকে তোমরা তোমাদের স্থান কাল পাত্র বুঝে নিজেদের সিস্টেম ডেভেলপ করে নাও। তারপর সময়ের প্রয়োজনে সেটাকে আপডেট করো, সংস্কার করো, মেরামত করো, কিংবা ঢেলে সাজাও। সেটা তোমাদের ইজতেহাদের ব্যাপার। ওখানে আমি হস্তক্ষেপ করতে যাব না। যাওয়ার দরকারও নাই- কারণ যতক্ষণ তোমরা আমার সীমারেখার মধ্যে থাকবে ততক্ষণ তোমাদের কোনো বিপদ হবে না, তোমরা শান্তিতেই থাকবে, তোমাদের মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকবে। কিন্তু আমার নির্ধারণ করে দেওয়া চৌহদ্দির বাইরে চলে গেলে, অর্থাৎ সীমালঙ্ঘন করলে তোমরা বিপদে পড়বে, তোমরা ইবলিশের আক্রমণের শিকার হবে, তোমাদের জান-মালের নিরাপত্তা থাকবে না, তোমরা অন্যায় অবিচার ও যুদ্ধ রক্তপাতে জড়িয়ে পড়বে।
এখানে আরেকটা কথা না বললেই নয়, আমাদের সমাজে একটা ভুল ধারণা বদ্ধমূল হয়ে আছে যে, “ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যত আইন কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি প্রয়োজন তা হাজার বছর আগের মুজতাহিদরাই লিখে দিয়ে গেছেন। সুতরাং, এখন আর ইজতিহাদের যুগ নয়। এখন তাকলীদের যুগ। ইসলামী রাষ্ট্রের মুফতীরা আগেকার যুগের ফকিহদের লেখা আইন কানুনগুলো পড়ে মুখস্থ করে রাখবেন, আর যখন যেটা প্রয়োজন হবে ফতোয়া দিয়ে দিবেন- ব্যাস! ইসলামী রাষ্ট্র দিব্যি চলতে থাকবে!”
তাদেরকে হতাশ করার জন্য দুঃখিত- কেননা তাদের ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। যদি কেউ হাজার বছর আগে লেখা ফিকাহর কিতাবগুলোকে ইসলামী শরিয়াহর নামে যুগের পর যুগ ধরে প্রয়োগ করতে চান এবং লোকজনকে জোর করে সেই আইন মানাতে চান, তারা ভুল করবেন। আমি আগেই বলে এসেছি- ১০০০ বছর আগের ইজতেহাদ দিয়ে যদি আজকের যুগের সমস্যার সমাধান হতো, তাহলে তো আল্লাহ কোর’আনেই হাজার হাজার আইন কানুন দিয়ে দিতে পারতেন। আল্লাহ কোর’আনে এত আইন কানুন উল্লেখ করেননি এই জন্য যে, মো’মেনরা যেন আল্লাহর দেওয়া সীমারেখার ভেতরে থেকে কেয়ামত পর্যন্ত যখন যেই আইন কানুন, বিধি-বিধান ও সিস্টেম প্রয়োজন হবে তা ইজতিহাদ করে নির্ধারণ করতে পারে। কারণ মানবসমাজ নিত্য পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নতি মানুষের জীবনের হেন দিক নেই যাকে প্রভাবিত করেনি। উটের যুগ শেষ হয়ে মার্সিডিজের যুগ চলে এসেছে। ঢাল তলোয়ার ফেলে দিয়ে মানুষ এখন পরমাণবিক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই যুগটা তো হাজার বছর আগের মুজতাহিদরা দেখেন নাই। তারা শেয়ার বাজার দেখেন নাই, পারমাণবিক বোমা দেখেন নাই, ডিজিটাল ডিভাইস হ্যাকিং দেখেন নাই, সাইবার যুদ্ধ দেখেন নাই, ক্যাসিনো দেখেন নাই, ক্রিপ্টো কারেন্সি দেখেন নাই, ডার্ক ওয়েব দেখেন নাই। কাজেই একবিংশ শতাব্দীর সঙ্কটের সমাধান হাজার বছর আগের শরিয়াহর কেতাবে পাওয়া যাবে না। তাহলে উপায়? উপায় হলো এই যুগে মো’মেনদের যিনি ইমাম হবেন, তাকেই এই যুগের উপযোগী ইজতেহাদ করতে হবে। আল্লাহর কোর’আনের সীমারেখার মধ্যে থেকে ও রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ মোতাবেক তাকে এমন রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তুলতে হবে- যা হবে ইতিহাসের সবচাইতে আধুনিক, যুগোপযোগী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থা। সেই রাষ্ট্রব্যবস্থার আইন কানুন, দণ্ডবিধি ইত্যাদি হুবহু হাজার বছর আগের ফিকাহর কিতাবের সাথে না-ও মিলতে পারে। আবার এই যুগে যে ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে- ভবিষ্যতে সেটাও সংস্কার করা লাগতে পারে। যদিও সবই করতে হবে আল্লাহর দেওয়া সীমারেখার ভেতর থেকে বা কোর’আনের মানদণ্ডকে স্থির রেখে।
আমাদের জন্য আনন্দের খবর এই যে, ইতোমধ্যেই এই যুগের মুজতাহিদ, ইমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম নতুন রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপরেখা তুলে ধরেছেন। পশ্চিমা বিশ্বের ব্যর্থ প্রমাণিত হওয়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও নয়, আবার হাজার বছর আগে লেখা শরিয়াহ আইনের উপর ভিত্তি করা মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্রও নয়, তার প্রস্তাবিত রাষ্ট্রকাঠামো হলো একক ও অনন্য। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্যের লিংক কমেন্টবক্সে দেওয়া হলো। পাঠকদের কাছে সবিনয় অনুরোধ- আপনারা ইমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিমের বক্তব্য শুনুন, মতামত দিন। কোনো বিষয়ে দ্বিমত থাকলে সেটাও উল্লেখ করুন। আমরা আর কড়াই থেকে চুলোয় পড়তে চাই না। পশ্চিমাদের তৈরি বিধান বারবার ব্যর্থ হবার পরও পুনরায় সেই বিধানে শান্তি খোঁজার বৃথা চেষ্টা করতে চাই না। আসুন এবার আল্লাহর বিধান নিয়ে সিরিয়াস হই। কথা বলি। আলোচনা করি। সত্যিকারের রাষ্ট্রসংস্কার করতে উদ্যোগী হই।
***বিশেষ দ্রষ্টব্য: অনেকে ইসলামের রাষ্ট্রব্যবস্থা বলতে বোঝেন মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। অথচ ইসলামে মোল্লাতন্ত্র বা পুরোহিততন্ত্রের কোনো স্থানই নাই। মোল্লাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোর ধারণাটি মূলত ইউরোপের খ্রিস্টান পোপদের মতবাদ।