15/06/2024
কিছুদিন আগে আমি বাইরে থেকে বাসায় ফিরি। শরীফ তখন বাসায়ই ছিল। এসে দেখি, সে আমার জন্য এসি ছেড়ে রুম ঠান্ডা করে রেখেছে। আমি অবাক হই! ছেলেটা এত যত্ন কই থেকে শিখলো!!?
পরক্ষণেই মনে পড়ে, সে তার বাবার থেকে শিখেছে। সপ্তাহে তিন দিন আমার শাশুড়ি ডায়ালাইসিস করাতে যায়। সেই তিনদিন যখন তার বাড়ি ফেরার সময় হয় এবং আমার শ্বশুর ফোনে যখনই জানতে পারে যে আম্মু গাড়িতে উঠেছে, আমার শ্বশুর ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে সাদরে গ্রহণ করতে।
প্রথমে সে নিশ্চিত করে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর রুম শতভাগ পরিচ্ছন্ন আছে কিনা! বিছানার চাদর একদম টানটান আছে কিনা! স্ত্রীর প্রয়োজনীয় সবকিছু খাটের পাশের টেবিলে রাখা আছে কিনা! তারপর সে নিজ হাতে এসি ছেড়ে রুমের দরজা বন্ধ করে রাখে। রুমকে ঠান্ডা হতে দেয়। যেন প্রিয়তমা রুমে ঢোকার সাথে সাথে শীতল স্পর্শ পায়। এ যেন প্রিয় স্ত্রীর সারা দিনের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেওয়ার অতি সামান্য প্রচেষ্টা।
আম্মু যখন ডায়ালিসিসের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে রওনা দেয়, বাড়ির দরজা দিয়ে বের হওয়া থেকে নিচে গিয়ে গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত পুরোটা সময় আব্বু বারান্দার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকে। আম্মু নিচে গিয়ে উপর দিকে তাকিয়ে আব্বুর উদ্দেশ্যে হাত নারে, আব্বুও শিশু বাচ্চার মত তার স্ত্রীকে টাটা দেয়। আম্মু গাড়িতে উঠে। গাড়ি ছাড়ে। আব্বু তখনও দাঁড়িয়ে। যতদূর পর্যন্ত গাড়ি দেখা যায় আব্বু এক চুলও সেখান থেকে নড়ে না।হয়তো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে তার প্রিয়তমার প্রতিরক্ষার জন্য নিরবে সৃষ্টিকর্তার নিকট দোয়া করে।
সপ্তাহে তিন দিন আম্মু বাসায় থাকে না বেশ লম্বা সময়ের জন্য। এই সময়টা আব্বুর সামনে যে কোন খাবার উপস্থাপন করলেই আব্বুর প্রশ্ন থাকে একটাই, "তোমার আম্মুর জন্য রাখসো?"
আব্বু জানে আমি রাখবো। তবুও যেন নিজে নিশ্চিত হয়ে নেয় তার অনুপস্থিত প্রিয়তমা ভুলেও যেন কিছু মিস না করে ফেলে।
যখন আম্মুর ফেরার সময় হয়। আম্মুর গাড়ি এসে থামতে থামতে, আব্বু বাড়ির সদর দরজা খুলে চেয়ার নিয়ে সেখানে বসে থাকে, যতক্ষণ না আম্মু উপরে উঠে আসে। আম্মু ঘরে ঢুকার সাথে সাথে, আব্বু তাকে নিয়ে যায় তার যত্নে ঠান্ডা করা রুমে। আম্মুর মাথায় হাত দিয়ে আদর করে। তারপর ধীরে ধীরে শুরু করে তার সারাদিনের জমানো যত কথা। বাচ্চারা স্কুল থেকে ফিরে সারাদিনের কথাগুলো যেভাবে তার মাকে বলে, আব্বু ঠিক তেমনি চোখ ভরা উৎসাহ নিয়ে তার সারাদিনের গল্পগুলো বলে তার প্রিয় স্ত্রীকে।
আম্মুর প্রিয় খাবার হলো ফল। আব্বু বাইরে যায় আর ফল ছাড়া বাড়ি ফিরে এমন খুব কম দেখেছি। প্রিয়তমা স্ত্রীর খাটের নিচে যেন সর্বদা থালি ভর্তি ফল থাকে, তা নিশ্চিত করে তার এই চমৎকার স্বামী।
বাইরে থেকে ফেরার সময় আব্বু তার নাতি নাতনিদের জন্য সব সময় চকলেট, আইসক্রিম, জুস কিংবা চিপস নিয়ে ফিরে। কিন্তু এগুলো কখনো নিজে নাতি নাতনিদের হাতে তুলে দেয় না। তুলে দেয় প্রিয়তমা স্ত্রীর হাতে। তারপর স্ত্রী যখন এগুলো তার নাতিদের মাঝে বিলি করে, মুগ্ধ হয়ে আব্বু সেই দৃশ্য দেখে। এভাবেই যুগ যুগ ধরে হয়তো বাবারা তাদের কিনে আনা সুখ মায়েদের হাতে করে আমাদের মাঝে বিলিয়ে দেয়।
বিয়ের পর থেকেই আমি বারবার অনুভব করেছি শরীফ খুব চমৎকার, যত্নশীল একজন স্বামী। শরিফের যত্নে আমি বারবার অবাক হতাম আর ভাবতাম এত যত্নশীল একটা মানুষ কিভাবে হয়?
কিন্তু, আমি এখন এর উত্তর জানি। একজন চমৎকার স্বামীই জন্ম দেয় আরেক জন চমৎকার স্বামীর। ছোটকাল থেকেই হয়তো সে দেখেছে, তার বাবা তার মাকে কিভাবে ভালোবাসে! সে থেকেই তার শিশু মন শিখে নিয়েছে স্ত্রীকে ভালোবাসার ১০১ টি কৌশল।
আমি সবসময় মুগ্ধ হয়ে আমার শ্বশুরকে আমার শাশুড়ির যত্ন করতে দেখি, সেই দৃশ্যগুলো আমার খুব প্রিয়। আমার মনে হয়, একজন পুরুষ তার শখের নারীকে যত্ন করছে, এর চেয়ে মধুর দৃশ্য আর হতে পারে না!
©হাফসা জারিস