14/02/2024
‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ : আন্তর্জাতিক নির্লজ্জতা দিবস
প্রতি বছর ১৪-ই ফেব্রুয়ারি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঘটা করে পালিত হয় ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’। এ দিনটিতে নানা শ্রেণির মানুষ নিজের প্রিয়জনকে শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করে এবং প্রতিটি প্রেমিক জুটি পরস্পরের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। বিশেষত অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের মাঝে এ দিবস উপলক্ষ্যে আনন্দ-উল্লাসের মাত্রাটা অন্যদের তুলনায় অনেক বেশিই থাকে। যুবক-যুবতীদের পাশাপাশি প্রেম নিবেদনের জন্য অনেক কিশোর-কিশোরীও এ দিবসের অপেক্ষায় চাতক পাখির ন্যায় চেয়ে থাকে। এমনকি বর্তমান সময়ে অনেক শিশুও কৈশোরে পা দেওয়ার আগেই এ দিবসের ভয়ানক ফাঁদে পড়ে যাচ্ছে। এভাবেই এ দিনটিতে বিভিন্ন বয়সের শিশু থেকে শুরু করে অনেক বৃদ্ধ পর্যন্ত ভালোবাসার রঙে নিজেকে সজ্জিত করার চেষ্টা করে। অসংখ্য কুমারী মেয়ে এদিন নিজের মহামূল্যবান ইজ্জতের সওদা করার চুক্তি করে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বখাটেদের জন্য এ দিবসটি যেন ঈদ-উৎসব কিংবা তার চেয়েও অধিক আনন্দের দিন। কিন্তু অবলা নারী জাতি বুঝে কিংবা না বুঝে এ পথে পা বাড়িয়ে নিজের চরিত্র, দ্বীন ও জীবন ধ্বংস করে থাকে।
এ দিবসটির সাথে ইসলামের কোনোই সম্পর্ক নেই; এমনকি আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির সাথেও এর দূরতম কোনো সংযোগ নেই। বরং ইসলামের সাথে রয়েছে এর সুস্পষ্ট বৈরিতা ও শত্রুতা। শরিয়তের সাথে রয়েছে এর সরাসরি বিরোধ ও সংঘর্ষ। কোনো বিবেকবান মুসলিম ও জ্ঞানবান মুমিন কখনও এ দিবস পালন করতে পারে না। সে নিজে যেমন এ দিবসের সকল নোংরামি-অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকে; তেমনই সে নিজের সন্তানসন্ততি, ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনকেও এ থেকে নিবৃত্ত রাখে। কেননা, এ দিবসে যেমন নোংরামি-অশ্লীলতার সয়লাব ও কাফিরদের সাদৃশ্যের ব্যাপার রয়েছে, তেমনই এর ইতিহাস-উৎপত্তির সাথে রোমান পৌত্তলিকদের বিভিন্ন কুসংস্কৃতি ও দেব-দেবীর সম্পৃক্ততাও বিদ্যমান রয়েছে। তাই কোনো মুসলিম এগুলো জানার পর এ দিবসের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখতে পারে না; বরং নির্দ্বিধায় সে এর সাথে নিজের দায়মুক্তি ও সব ধরনের সম্পর্কহীনতার ঘোষণা দেয়। পাঠকদের উপকারার্থে আমরা নিম্নে সংক্ষিপ্তাকারে ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ এর ইতিহাস, এর বর্তমান রূপরেখা ও এর শারয়ি বিধান নিয়ে আলোচনা করছি।
‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ এর উৎপত্তি ও ইতিহাস :
এ দিবসটির উৎপত্তি কবে এবং কীভাবে এর সূচনা ও নামকরণ হয়েছে, সে ব্যাপারে ইতিহাসবিদদের একাধিক মত রয়েছে। একদল গবেষকের মতে, প্রাচীন কালে রোমের পৌত্তলিকরা ১৪-ই ফেব্রুয়ারি ‘লুপারকালিয়া’ নামে একটি উৎসব পালন করত। এ উৎসব পালিত হতো মূলত তাদের জমির উর্বরতার লক্ষ্যে। আর তাই এ উৎসবকে উৎসর্গ করা হতো তাদের কৃষির দেবতা ‘ফাউনাস’ এর প্রতি। সাধারণ মানুষ পবিত্রতা লাভের জন্য এ উৎসবের সময় কুকুর, শূকর; এমনকি নারীদেরকেও বলি দিত। তাদের আয়োজিত এ উৎসবের অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি ছিল যুবতীদের নামে লটারি ইস্যু করা। তৎকালীন রোমের মেয়েরা একটি স্থানে একত্র হতো এবং তাদের নাম লিখে একটা স্থানে জমা দিত। অতঃপর শহরের অবিবাহিত ছেলেরা এসে লটারির মাধ্যমে সেখান থেকে একেকজন মেয়েকে পেয়ে যেত এবং বিয়ে ছাড়াই তার সাথে এক বছর পর্যন্ত লিভ টুগেদার করত। অতঃপর রোমে খ্রিষ্টধর্মের আগমন ঘটলে খ্রিষ্টান পাদ্রীরা এটাকে পৌত্তলিক কুসংস্কার হিসেবে আখ্যায়িত করে তা নিষিদ্ধ করার চেষ্টা করে। তাদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলে শেষ পর্যন্ত তারা এ দিবসকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করে। তাই তারা দেবতার নামের পরিবর্তে পাদ্রীর নামে এ অনুষ্ঠান চালু করে ঘোষণা করল যে, ‘লুপারকালিয়া’ উৎসবের দিন ১৪-ই ফেব্রুয়ারি লটারিতে যেসব যুবকের নাম আসবে, তাদেকে এক বছর পাদ্রীর সাহচর্যে থেকে আত্মশুদ্ধি অর্জন করতে হবে। অতঃপর ৪৭৬ খ্রিষ্টাব্দে পোপ জোলিয়াস তাদের বিখ্যাত যাজক ভ্যালেন্টাইনের সম্মানে এ দিবসের নাম পরিবর্তন করে ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ রাখে।
আরেকদল গবেষকের মতে, প্রাচীন রোমে সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াসের আমলে ‘ভ্যালেন্টাইন’ নামে একজন চিকিৎসক ছিল। সে খ্রিষ্টধর্মের বাণী ও তার সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মূর্তিপূজক থেকে খ্রিষ্টান হয়ে যায়। তৎকালীন রোমে খ্রিষ্টধর্ম নিষিদ্ধ ধর্ম হিসেবে বিবেচিত হতো। এ ধর্মে বিশ্বাসীদের কঠিন শাস্তি দেওয়া হতো। অতঃপর ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে ১৪-ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রীয় বিধান লঙ্ঘনের অভিযোগে সম্রাট তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে। অন্য বর্ণনা মতে, সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস নিজ সাম্রাজ্যের যুবক-যুবতীর মাঝে বিবাহকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কারণ, তার ধারণা অনুসারে অবিবাহিত সৈন্যরা যুদ্ধের ময়দানে তুমুল লড়াই করলেও বিবাহিত সৈন্যরা স্ত্রী-সন্তানের মায়ায় সেভাবে যুদ্ধ করতে পারে না। এজন্য সে বিবাহ নিষিদ্ধ করে নিজের সৈন্যদের শক্তি বাড়ানোর প্রতি মনোযোগ দেয়। তার এ অমানবিক সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াটা সবার পক্ষে কঠিন হলেও রাজশাস্তির ভয়ে কেউ তার বিরোধিতা করতে সাহস পেল না। তখন ভ্যালেন্টাইন নামে জনৈক পাদ্রী সম্রাটের জারিকৃত এ নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করে গোপনে তার গির্জায় বিবাহপ্রথা বহাল রাখল। কিছুদিনের মধ্যেই এ বিষয়টি প্রকাশ পেলে তাকে জেলে বন্দী করা হলো। অতঃপর একদিন জেলপ্রধান তার অন্ধ মেয়েকে নিয়ে তার কাছে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আসল। সে তার চিকিৎসা করতে শুরু করল এবং একপর্যায়ে তার প্রেমে পড়ে গেল। অতঃপর ২৬৯ খ্রিষ্টাব্দে বা কারও মতে ২৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১৪-ই ফেব্রুয়ারি রাষ্টদ্রোহ মামলায় সম্রাট তার মৃত্যদণ্ড কার্যকর করার আদেশ দিলে সে মেয়েটির উদ্দেশ্যে একটি গোপন চিরকুট লিখে রাখল। পরে জেলপ্রধান সে চিরকুটটি পেয়ে তার মেয়ের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, From your Valentine বা ‘ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন’। ভালোবাসার এমন কীর্তির জন্য ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পোপ জেলাসিয়ুস তার মৃত্যুদিবস ১৪-ই ফেব্রুয়ারিকে ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ বলে ঘোষণা করে। সেই থেকে এ দিবসটিকে মানুষ ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ হিসেবে পালন করে আসছে।
এ দুটি মত ছাড়াও এ দিবসটিকে ঘিরে আরও বেশ কয়েকটি মতের উল্লেখ পাওয়া যায়। কারও মতে, ভ্যালেন্টাইন নামক এক পাদ্রীকে রোমানদের দেবতা ‘আতারিত’ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রোমানদের বিশ্বাস অনুসারে যে ছিল তাদের ব্যবসা, সাহিত্য, পরিকল্পনা ও দস্যুদের প্রভু। অনুরূপ তাকে ‘জুয়াইবেতা’ সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রোমানদের বিশ্বাস অনুসারে যে ছিল তাদের সবচেয়ে বড় প্রভু। তখন সে উত্তরে বলেছিল, এগুলো সব মানবরচিত ও কল্পিত প্রভু। প্রকৃত প্রভু হচ্ছেন ইসা মাসিহ আলাইহিস সালাম। (বস্তুত তাদের উভয় পক্ষের বিশ্বাসেই ছিল মারাত্মক বিচ্যুতি ও ভয়ংকর ভুল। রোমানদের দেবতা বা খ্রিষ্টধর্মের ভ্রান্ত বিশ্বাস অনুযায়ী ইসা আলাইস সালাম কেউই প্রভু নয়। প্রকৃত প্রভু হলেন একমাত্র আল্লাহ তাআলা, যা ইহুদিধর্ম, খ্রিষ্টধর্ম ও ইসলামধর্ম-সহ সকল আসমানি ধর্মের অবিকৃত বিশ্বাস। এতে কারও কোনো মতবিরোধ নেই।) প্রথাবিরোধী তার এমন উত্তর শুনে সম্রাট অত্যন্ত রাগান্বিত হয়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করে এবং ১৪-ই ফেব্রুয়ারি তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। পরবর্তী সময়ে তার স্মরণার্থে এ দিনটিকে ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ নামে নামকরণ করা হয়। আবার কারও মতে, প্রাচীনকালে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪-ই ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের বিয়ের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়তে বসে। আবার কারও মতে, মধ্যযুগের শেষদিকে একদল মানুষ বিশ্বাস করত, ১৪-ই ফেব্রুয়ারি থেকে পাখিদের মিলন-ঋতু শুরু হয়। এ দিন থেকে পাখিরা তাদের সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি তাই মানুষও তার সঙ্গী নির্বাচন করে এ দিনে। এ দিবসকে ঘিরে বিভিন্ন সূত্রে এ ধরনের আরও কিছু মিথ বর্ণিত হয়েছে। তবে প্রথম দুটি মতই সবচেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ।
‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ এর বর্তমান রূপরেখা :
‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ এর উৎপত্তির ইতিহাস হাজার বছরের পুরোনো হলেও প্রথম দিকে এটা বিশ্বব্যাপী তেমন বেশি প্রচার-প্রসার লাভ করেনি। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে এটার কদর বৃদ্ধি পেলেও অধুনা কালে এসেই এটার পরিধি সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে এ দিবসটি পুরো বিশ্বেই পরিচিতি লাভ করেছে। পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে এ উৎসব মহাসমারোহে উদযাপন করা হয়। তাদের অনুকরণে প্রাচ্যের অনেক দেশেও এ দিবস পালন শুরু হয়েছে। ইউরোপ-আমেরিকা এই দিবস উপলক্ষে কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে থাকে। এ দিনটিতে লোকেরা ভালোবাসার কার্ড, বাহারি ফুল, সুস্বাদু চকলেট ও অন্যান্য দামী উপহারসামগ্রী ক্রয় করে। যুক্তরাষ্ট্রে এ দিবসে প্রায় আনুমানিক তিন কোটি শুভেচ্ছাকার্ড আদান-প্রদান করা হয়। মোটকথা, অতীতের ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ থেকে বর্তমানের ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ পরিচালিত হচ্ছে ভিন্ন গতিধারায়। এক কথায় বলা যায়, কেবল প্রেমিক জুটিদের জন্যই এ ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ বা ভালোবাসা দিবস; বিশেষত অবিবাহিত তরুণ-তরুণীদের জন্য। কিন্তু যারা সিঙ্গেল, অনেক চেষ্টা করেও যারা মনমতো জুটি জোগাতে পারেনি, তাদের জন্য এ দিনটি বেশ হতাশারই বলা যায়।
পাশ্চাত্য সভ্যতা জাগতিক বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে অনেক উন্নতি সাধন করতে পারলেও পারিবারিক বন্ধন ও আত্মিক প্রশান্তি অর্জনের ক্ষেত্রে তারা অনেক পিছিয়ে। তারা নারী স্বাধীনতার নামে তাদেরকে উলঙ্গ করে রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে, যুগ যুগ ধরে চলমান সুন্দর পরিবারব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে এখন নিজেরাই অশান্তির আগুনে জ্বলছে। তাদের মধ্যে বিয়েশাদি উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে। যতটুকুও বা আছে, সেটাও শত ঝগড়া-বিবাদ আর নানারকম মামলা-হামলার ঝুঁকিতে কোনোমতে টিকে আছে। আর এজন্যই তারা একটুখানি মানসিক প্রশান্তির আশায় নিজেদের জন্য বেছে নিয়েছে জঘন্য আরেকটি পথ। এখন তারা লিভ টুগেদার ও নানা নোংরামি-অশ্লীলতার আবরণে নিজেদের প্রাণহীন দেহসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখঅর চেষ্টা করছে। তাদের কাছে নিষ্ঠাপূর্ণ অকৃত্তিম ভালোবাসা বিরল এক জিনিসের নাম। যেহেতু তারা দীর্ঘদিন ধরে সত্যিকারের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত, তাই তারা হাজার বছরের পুরোনো সংস্কৃতি ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ মডিফাই করে, এতে নানা রং চড়িয়ে এ দিবসটিকে তাদের ভালোবাসার তৃষ্ণা মেটানোর দিন হিসেবে নির্ধারণ করেছে। এটাই হলো পশ্চিমাদের ‘ভালোবাসা দিবস’ পালনের বাস্তবতা।
কিন্তু আফসোসের বিষয় যে, পশ্চিমাদের মতো এখন মুসলিম দেশগুলোতেও এ অপসংস্কৃতির ঢেউ লেগেছে। এসব দেশে বিবাহের মতো পবিত্র বন্ধন ও প্রকৃত ভালোবাসার অস্তিত্ব থাকা সত্ত্বেও পশ্চিমাদের অন্ধ অনুকরণে কিছু মানুষ নিজেদের দেশে এ হারাম সংস্কৃতি আমদানি করেছে। এ দিনটিতে অনেক মুসলিম এতটাই অশ্লীলতায় ডুবে থাকে যে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা পশ্চিমাদেরকেও হার মানায়। শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রেমিক জুটি একত্র হয়। অনেকে হোটেল ভাড়া নেয়। এরপর তারা বাধাহীন আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠে। বিশেষ করে কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া মেয়েরা এক্ষেত্রে বেশি এগিয়ে থাকে। গার্মেন্টসকর্মীরাও একেবারে পিছিয়ে থাকে না। ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ উদযাপন উপলক্ষ্যে বিভিন্ন হোটেলের হলরুমে বসে তারুণ্যের মিলনমেলা। নাচ-গান ও নানা অশ্লীল আয়োজনে এ দিবসটিকে তারা রঙিন করে তোলে। এ দিবসকে স্বাগত জানাতে হোটেল কর্তৃপক্ষ হলরুমকে সাজায় বর্ণাঢ্য সাজে। পার্ক, রেস্তোরাঁ, ভার্সিটির করিডোর, টিএসসি, ওয়াটার ফ্রন্ট, চারুকলার বকুলতলা, বোটানিক্যাল গার্ডেনসহ বিভিন্ন স্থানে থাকে প্রেমিক-প্রেমিকাদের প্রচণ্ড ভিড়। কেউ নির্জনে, আর কেউ প্রকাশ্যেই একান্ত প্রেম নিবেদন করে।
নতুন প্রেমিক জুটি এ দিবসটির অপেক্ষায় থাকে। বখাটে প্রেমিকরা এ দিনটিকে তাদের মনের খাহেশ মেটানোর জন্য বেছে নেয়। এরা সরল টাইপের মেয়েদের টার্গেট করে এবং নানা কৌশলে নির্জনবাসের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। অতঃপর মেয়েরা তাদের মিথ্যা আশ্বাসে সরল মনে নিজেদের সতীত্ব বিলিয়ে অপবিত্র ও ক্লান্ত দেহে বাসায় ফেরে। যারা নির্জন স্থানে যাওয়ার সুযোগ পায় না, তারা বিভিন্ন অশালীন স্পর্শ ও চুম্বনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিছু জুটি পরস্পরে অধিক সময় পর্যন্ত চুম্বনাবদ্ধ হয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এগুলো একসময় নির্জনে করা হলেও বর্তমানে সব প্রকাশ্যেই করা হয়। এ রাতে অনেক জুটি মাদক গ্রহণ করে। অতঃপর নেশাগ্রস্থ হয়ে তারা পরস্পরের এত কাছাকাছি চলে আসে যে, একে অপরের মধ্যে তারা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায়। শয়তান তাদের অন্য জগতে নিয়ে যায়। মোটকথা, বর্তমানে এ দিবসটিতে তরুণ-তরুণীদের অবাধ মেলামেশায় কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি থাকে না। প্রত্যেকে তার ইচ্ছেমতো স্বাধীনতা ভোগ করে এ দিবসটির যথাযথ হক আদায় করে। আর এভাবেই ভালোবাসা দিবসের নামে এ দিনটি এখন বেহায়া ও অশ্লীলতা দিবসে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে এ দিবসটি উদযাপনের জন্য এক সপ্তাহ পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়। এ সাতদিনকে বলা হয় ভ্যালেন্টাইন উইক, যা ৭-ই ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয়ে ১৪-ই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলে। ভ্যালেন্টাইন উইকের প্রতিটি দিনের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে। যেমন, ৭-ই ফেব্রুয়ারি হলো রোজ-ডে (গোলাপ দিবস)। এদিন পছন্দের মানুষকে ফুল দিয়ে নিজের ভালোলাগার কথা জানানো হয়। ৮-ই ফেব্রুয়ারি হলো প্রোপোজ-ডে (প্রেম-নিবেদন দিবস)। এদিন মনের মানুষের কাছে নিজের ভালোবাসার কথা প্রকাশ করা হয়। ৯-ই ফেব্রুয়ারি হলো চকোলেট-ডে (চকোলেট দিবস)। এদিন প্রেমাষ্পদকে চকোলেট উপহার দেওয়া হয়। ১০-ই ফেব্রুয়ারি হলো টেডি-ডে (টেডি দিবস)। এদিন প্রেমাষ্পদকে টেডি উপহার দেওয়া হয়। ১১-ই ফেব্রুয়ারি হলো প্রমিস-ডে (প্রতিজ্ঞা দিবস)। এদিন পার্টনারের সাথে আজীবন থাকার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। ১২-ই ফেব্রুয়ারি হলো হাগ-ডে (আলিঙ্গন দিবস)। এদিন প্রিয় মানুষকে জড়িয়ে নিজের মনের কথা বলা হয়। ১৩-ই ফেব্রুয়ারি হলো কিস-ডে (চুম্বন দিবস)। এদিন পার্টনারের বিভিন্ন অঙ্গে চুম্বন করে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হয়। ১৪-ই ফেব্রুয়ারি হলো ভ্যালেন্টাইনস-ডে (ভালোবাসা দিবস)। এদিন প্রিয় মানুষটির সঙ্গে একান্তে সময় কাটানো হয় এবং সম্ভাব্য সকল উপায়ে ভালোবাসার দাবি পূরণ করা হয়।
‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ পালনের শারয়ি বিধান :
নিঃসন্দেহে ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ পালন শরিয়তের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয়, নিষিদ্ধ ও হারাম। এ দিবসটির অশ্লীলতা সম্পর্কে যার সামান্য ধারণা আছে, সে কখনও এ দিবস পালনকে বৈধ বলতে পারে না। এ দিবসটির অতীত-উৎপত্তির সাথে পৌত্তলিকতার সম্পর্ক, অবৈধ প্রেমের বিষয়, কুসংস্কারে বিশ্বাস ও বিধর্মীদের সাদৃশ্য, পাশাপাশি বর্তমানের নোংরামি ও অশ্লীলতার দিকে তাকালে নির্দ্বিধায় বুঝা যায় যে, এটা কোনো মুসলিমের পালনীয় দিবস হতে পারে না। না সে নিজে তা পালন করতে পারে, আর না সে অধীনস্ত কাউকে পালনের অনুমতি দিতে পারে। কেননা, এটা একজন সত্যিকারের মুমিনের স্বভাববিরুদ্ধ কাজ। কুরআন-সুন্নাহর অসংখ্য জায়গায় অশ্লীলতার বিরুদ্ধে, অশ্লীলতার প্রসার কামনার বিরুদ্ধে, নারীদের খোলামেলা চলার বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট বাণী রয়েছে। পাশাপাশি জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে লজ্জা ও শালীনতা অবলম্বন করতে আদেশ করা হয়েছে, কাফিরদের সংস্কৃতি ও তাদের রীতিনীতির বিরোধিতা করতে বলা হয়েছে। সেজেগুজে বেপর্দার সহিত মেয়েদের বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারেও হাদিসে ভয়ংকর সতর্কবার্তা এসেছে। আমরা এখানে এসংক্রান্ত কুরআন-সুন্নাহর কিছু প্রমাণ উল্লেখ করছি।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تَقْرَبُوا الزِّنَا إِنَّهُ كَانَ فَاحِشَةً وَسَاءَ سَبِيلًا
‘আর তোমরা ব্যভিচারের ধারে-কাছেও যেও না। নিশ্চয়ই তা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পথ।’ [সুরা আল-ইসরা : ৩২]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
إِنَّ الَّذِينَ يُحِبُّونَ أَنْ تَشِيعَ الْفَاحِشَةُ فِي الَّذِينَ آمَنُوا لَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ
‘নিশ্চয়ই যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে, তাদের জন্য রয়েছে দুনিয়া ও আখিরাতে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ [সুরা আন-নুর : ১৯]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন :
قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللَّهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ. وَقُلْ لِلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَلْيَضْرِبْنَ بِخُمُرِهِنَّ عَلَى جُيُوبِهِنَّ.
‘আপনি মুমিন পুরুষদেরকে বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফাযত করে। এটাই তাদের জন্য অধিক পবিত্র। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের বিষয়ে সম্যক অবহিত। আর মুমিন নারীদেরকে বলুন, তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফাযত করে। আর তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশমান তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ না করে।’ [সুরা আন-নুর : ৩০-৩১]
হুযাইফা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ
‘যে ব্যক্তি বিজাতির সঙ্গে সাদৃশ্যতা অবলম্বন করে, সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’ [সুনানু আবি দাউদ : ৪০৩১]
আমর বিন শুআইব রাহিমাহুল্লাহ থেকে তাঁর বাবার সূত্রে দাদা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَشَبَّهَ بِغَيْرِنَا، لَا تَشَبَّهُوا بِاليَهُودِ وَلَا بِالنَّصَارَى
‘ওই ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে (মুসলিমদের বাদ দিয়ে) বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে। তোমরা ইহুদি-খ্রিষ্টানদের সাথে সাদৃশ্য অবলম্বন করো না।’ [সুনানুত তিরমিজি : ২৬৯৫]
আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
صِنْفَانِ مِنْ أَهْلِ النَّارِ لَمْ أَرَهُمَا، قَوْمٌ مَعَهُمْ سِيَاطٌ كَأَذْنَابِ الْبَقَرِ يَضْرِبُونَ بِهَا النَّاسَ، وَنِسَاءٌ كَاسِيَاتٌ عَارِيَاتٌ مُمِيلَاتٌ مَائِلَاتٌ، رُءُوسُهُنَّ كَأَسْنِمَةِ الْبُخْتِ الْمَائِلَةِ، لَا يَدْخُلْنَ الْجَنَّةَ، وَلَا يَجِدْنَ رِيحَهَا، وَإِنَّ رِيحَهَا لَيُوجَدُ مِنْ مَسِيرَةِ كَذَا وَكَذَا
‘জাহান্নামিদের দুটি শ্রেণিকে আমি (এখন পর্যন্ত) দেখিনি। একদল (পুরুষ) লোক, যাদের সঙ্গে গরুর লেজের মতো চাবুক থাকবে, তা দ্বারা তারা (সাধারণ) মানুষকে প্রহার করবে। আরেক দল নারী, যারা কাপড় পরিহিতা হয়েও বিবস্ত্র থাকবে। তারা (পাতলা পোশাক পরে পুরুষদেরকে) আকর্ষণকারিণী হবে এবং হেলে-দুলে চলবে। (চুলকে স্টাইলিশ করে বাঁধায়) তাদের মাথাগুলো (বড় কুঁজবিশিষ্ট) বুখতি উটের হেলে পড়া কুঁজের মতো হবে। ওরা জান্নাতে যেতে পারবে না, এমনকি তার সুগন্ধিও পাবে না; অথচ এত এত (অর্থাৎ অনেক) দূর হতেও তার সুঘ্ৰাণ পাওয়া যায়।’ [সহিহু মুসলিম : ২১২৮]
এসব সুস্পষ্ট আয়াত ও দ্ব্যর্থহীন হাদিস থেকে পরিষ্কারভাবে প্রমাণ হয় যে, অশ্লীলতায় লিপ্ত হওয়া, অশ্লীলতাকে সমর্থন করা, মুমিনদের মাঝে অশ্লীলতার প্রচার-প্রসার কামনা করা, বিজাতীয় অপসংস্কৃতি পালন করা, বিধর্মীদের উৎসবে শরিক হওয়া নিষিদ্ধ। এগুলো সুস্পষ্ট হারাম কাজ। আর কোনো সন্দেহ নেই যে, ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ হলো সম্পূর্ণরূপে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি এবং এটা জঘন্য সব নোংরামি-অশ্লীলতায় ভরপুর একটি আনন্দ-উৎসব। অতএব, যারা ‘ভ্যালেন্টাইনস-ডে’ কিংবা এ ধরনের বিজাতীয় কোনো আনন্দ-উৎসবে অংশগ্রহণ করবে, এটাকে সাপোর্ট বা সমর্থন করবে, এতে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করবে এবং নিজের অধীনস্ত লোকদের এতে অংশগ্রহণের অনুমতি দেবে, নিঃসন্দেহে তারা গর্হিত কাজে লিপ্ত বলে গণ্য হবে। পাশাপাশি হাদিসের ভাষ্যানুসারে তারা এ ব্যাপারে বিজাতির শ্রেণিভুক্ত বলে বিবেচিত হবে এবং এক শ্রেণির নারীর জন্য জান্নাত হারাম হয়ে যাবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকল ধরনের নোংরামি, অশ্লীলতা ও বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুসরণ থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের পরিবার, সন্তানসন্তুতি ও ভবিষ্যৎ-প্রজন্মকে এসব জঘন্য কাজ থেকে নিরাপদ রাখুুন।