30/11/2023
বাড়ির চারতলা বেয়ে নিচে নেমে তাঁর মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।
বারবার মানা করার পরও পুলিশের গানম্যান এসে হাজির হয়েছে। তাঁর ইচ্ছে হলো, কড়া একটা ধমক লাগানোর; কিন্তু তরুণ পুলিশ কর্মীটির দিকে তাকিয়ে মায়া হলো। তার তো কিছু করার নেই, সে আদেশ পালন করছে মাত্র।
তারপরও তিনি বললেন- যাও, বাড়ি যাও, আজ ছুটির দিন, ফ্যামিলিকে সময় দাও। কাল হোম সেক্রেটারির সাথে কথা বলে আমি ব্যাপারটা ফাইনাল করে নেবো।
তুমি নিশ্চিন্তে বাড়ি যাও। এজন্য কোনো সমস্যা হলে আমি দেখবো। কথা শেষ করেই তিনি হতভম্ব এসআইকে পেছনে রেখে রিকশার সন্ধানে বের হয়ে এলেন। তাঁকে বাস স্ট্যান্ডে যেতে হবে।
অনেক দিন পর তিনি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন। সময়ের অভাবে যাওয়া হয় না। তিনি যে বাসে উঠেছেন তাতে ঠাসবুনন ভিড়, কারণ এটা লোকাল বাস, থেমে থেমে যাত্রী নেয়, ভাড়াও তাই কম।
বেশ কিছুক্ষণ দম বন্ধ করা গরমে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি এক কোণায় বসার সুযোগ পেলেন। গাড়ি টিকটিক করে চলতে লাগলো, কখন গন্তব্যে পৌঁছাবে কে জানে?
তিনি যখন নিজের গ্রামে পৌঁছালেন তখন সূর্য বিকেলের দিকে হেলে পড়েছে। রোদের তেজ কমে এসেছে। বাস থেকে নামতেই তিনি চায়ের দোকানে বসা মতি মিয়াকে দেখতে পেলেন, তাঁকে ঘিরে তুমুল আড্ডা দিচ্ছেন আরো কয়েকজন। মতি মিয়াসহ এদের প্রায় সবাইকে তিনি চিনেন। এরা তাঁর বাল্য বন্ধু, একসাথে পড়াশুনা করেছেন। তাই তিনি প্রথমেই বাড়ি না গিয়ে সে দোকানের দিকে পা বাড়ালেন। বাড়ি যাওয়ার আগে ওদের সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়া যাক। অনেকদিন তাঁদের সাথে দেখা হয় না, কতদিন পর বাড়ি এলেন!
তিনি ঢুকতেই দোকানে আড্ডারত বন্ধুরা কেমন যেন সংকুচিত হয়ে গেলেন। তাঁকে তাঁরা এখানে আশা করেননি। এক সময় কত কাছের বন্ধু ছিলেন, কিন্তু এখন তাঁর সাথে কোনো তুলনাই চলে না। তিনি দেশের মস্ত কর্তাব্যক্তি, প্রায়ই টেলিভিশনে দেখা যায়, আর তাঁরা সে-ই গ্রামেই পড়ে আছেন, বেশির ভাগ স্কুলের দরজাই পেরুতে পারেননি, কেউ কৃষক, কেউ দরজি, কেউ চায়ের দোকানদার। কোথায় তিনি আর কোথায় তাঁরা!
তাঁর মধ্যে কিন্তু এসবের কোনো বিকার নেই, দোকানে ঢুকেই তিনি হাঁক দিলেন, এই হারামীরা তোরা কী করস? মইত্যা কড়া কইরা সবাইরে চা দে। দুধ-চিনি সব দিবি, আমি ডায়াবেটিসের গুষ্টি খিলাই। আর ভয় পাবি না, বাকি খাবো না, নগদ পেমেন্ট, হাহাহাহাহা----
তাঁর হাসির দমকে বাল্যবন্ধুদের কুণ্ঠা মুহূর্তে যেন ঝড়ো বাতাসে উড়ে গেলো। মতি মিয়া দ্রুত চা বানাতে লাগলেন, তাঁর সাথে হাত লাগালেন আবদুল কুদ্দুস, পাশেই তাঁর একটি ওষুধের দোকান আছে।
চায়ের কাপে কাপে জমে থাকা গল্প ঘুরতে লাগলো, ফুটে উঠলো অনেক আগে মিলিয়ে যাওয়া স্মৃতির রেখাগুলো। এভাবেই ঘণ্টাখানেক কেটে গেলো। তারপর তিনিই আড্ডা ভেঙে বললেন, যাইরে, বাড়ি যাওয়া দরকার, তারপর একটু দূরে বসা একজনকে ইঙ্গিত করে বললেন, মজিদ্দা তোর রিকশা আছেনি? আমারে বাড়ি দিয়া আসতে পারবি?
বন্ধুদের মধ্যে আবদুল মজিদের অবস্থাই সবচে খারাপ। তিনি রিকশা চালান। তাই গ্রামের অন্য অতি সাধারণ বন্ধুদের মাঝেও তিনি খুব কুণ্ঠিত থাকেন, কিন্তু তাঁদের জোড়াজুরিতে আড্ডায় না এসে পারেন না। এরমধ্যে হঠাৎ বিখ্যাত বন্ধুর রিকশায় বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তাব শুনে তিনি থরথর করে কেঁপে উঠলেন।
বাল্যবন্ধুকে রিকশায় বসিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়ার মতো লজ্জার আর কিছু নেই। তাঁর চোখে বিন্দু বিন্দু জল জমে উঠলো। ঢাকার ভদ্রলোক তা খেয়াল করলেন না, তিনি নির্বিকার ভঙিতে রিকশায় উঠে বসেছেন।
আবদুল মজিদ ময়লা গামছায় মুখ মোছার কায়দায় চোখ মুছে রিকশার প্যাডেলে পা রাখলেন।
রিকশা ধীরগতিতে চলছে। যাত্রীর আসনে বসা ভদ্রলোক রং চায়ের মতো লালচে গোধুলি মুগ্ধ নয়নে দেখছেন, বাল্যবন্ধু যে রিকশা চালাতে চালাতে বারবার গামছায় চোখ মুছছেন সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই!
অর্ধেক পথ আসার পর হঠাৎ তিনি হাঁক দিলেন, অ্যাই মজিদ্দা, রিকশা থামা!
আবদুল মজিদ সে ডাক শুনে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রিকশা থামিয়ে ফেললেন। তারপর পেছনে বসা ভদ্রলোক আসন থেকে নেমে এসে বললেন, এইবার তুই গিয়া সিটে বয়, বাকি পথ আমি রিকশা টানবো।
আবদুল মজিদের যেন মাথায় বাজ পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বললেন, এইটা আপনি কী কন?
তিনি প্রায় তেড়ে গিয়ে বললেন, এক ঘুসিতে দাঁত সব বরবাদ করে দেব হারামী, এত ভদ্র হইছস কবে থিকা? 'তুই' থাইকা একদম 'আপনি'! আরেকবার 'আপনি' কইলে খবর আছে, যা সিটে গিয়া বয়।
আবদুল মজিদ তারপরও দাঁড়িয়ে আছেন, এটা কীভাবে সম্ভব?! তিনি তাকে সিটে বসিয়ে রিকশা টানবেন?
তিনি আমতা আমতা করে কোনো রকমে তুমিতে উঠলেন, 'তুই'- এ নামা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তিনি বললেন, এইটা সম্ভব না, তুমি ক্যান রিকশা টানবা?!
ঢাকার ভদ্রলোক এবার খেঁকিয়ে উঠলেন, ক্যান সম্ভব না? আমরা সারাজীবন সব ভাগাভাগি কইরা বড়ো হইছি না? পেয়ারা চুরি করলে অর্ধেক তোর, অর্ধেক আমার, আম হাতাইলে তাও সমান দুই ভাগ। নরেন কাকার গাছ থাইক্যা ডাব নিয়া ভাগলে পানি খাওনের পর শাঁস ভাগাভাগি কইরা খাই নাই? তাইলে রিকশা ভাগাভাগি করলে সমস্যা কী? অর্ধেক পথ তুই চালাইছস, অর্ধেক আমি চালামু, যা ওঠ গিয়া, টাইট কইরা বয়, যা কইলাম-----
এরপর মজিদ মিয়াকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি অনভ্যস্থ হাতে রিকশার হ্যান্ডেলে হাত রাখলেন, পেছনে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছেন তাঁর বাল্যবন্ধু আবদুল মজিদ!
সামনে চালকের আসনে বসা বাংলাদেশ সরকারের এক জাঁদরেল শীর্ষ কর্মকর্তা রিকশার প্যাডেলে পা চালাচ্ছেন!
কী আশ্চর্য! অনভ্যস্ত হলেও রিকশা কিন্তু তিনি ঠিকভাবেই টেনে নিয়ে যাচ্ছেন।
যাত্রীর আসনে বসা আবদুল মজিদ এখনো ময়লা গামছায় চোখ মুছছেন।
তবে এবার তা মুছছেন অন্য কারণে।
আসলে শৈশব কখনো ভুলার নয়! যে যেখানেই থাকুক, যে অবস্থায়ই থাকুক শৈশব থাকে আজন্ম লালিত! আহারে শৈশব! মনে পড়ে খুব!🥹