12/04/2023
অসংখ্য ধর্মীয় বক্তা কিয়ামতের আলামতসংক্রান্ত হাদিসসমূহকে উপস্থাপন করে মানুষের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করে। সামাজিক অনাচার ও বিপর্যয়কে সংশোধনের আহ্বান না জানিয়ে তা থেকে পলায়নের পরামর্শ দেয়। ফলে সমাজের একটি বিশাল অংশ সমাজ সংশোধনের কাজ থেকে দূরে সরে গিয়ে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। তাদের আপনি যদি সামাজিক সংশোধনের দিকে আহ্বান করেন, তারা আপনার দিকে ফিতানসংক্রান্ত হাদিসসমূহকে ছুড়ে দেবে।
ফিতনাসংক্রান্ত হাদিসগুলোর মাধ্যমে রাসূল (সা.) কখনোই শত্রুর মোকাবিলায় পিছু হটার কথা বলেননি। সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে তাসবিহ নিয়ে দিনগুজার করতে বলেননি। সেগুলোর মাধ্যমে তিনি বরং মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বিশ্বের সকল সম্প্রদায়ের ষড়ন্ত্রকে প্রকাশ করতে চেয়েছেন। আমরা যেন সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে পারি। হাদিসগুলোর মাধ্যমে আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাসমূহকে দেখিয়ে দিয়েছেন। আমরা যেন সে দুর্বলতাসমূহকে কাটিয়ে পুনরায় শক্তিতে বলীয়ান হতে পারি। হাদিসগুলো থেকে আমরা যেন মুসলিম সমাজের রোগ নির্ণয় করতে পারি। আর রোগ নির্ণয় হচ্ছে কার্যকর চিকিৎসার প্রথম ধাপ।
আমাদের আলেমদের উচিত, হতাশাপূর্ণ ও অনুৎসাহমূলক বক্তব্যের বিপরীতে ইতিবাচক ও সুসংবাদপূর্ণ হাদিসগুলোকে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা। এতে করে আমাদের অন্তরসমূহ সজিব হবে। স্বপ্ন দেখতে শুরু করবে নতুন করে। আশা-আকাঙ্ক্ষা ও হিম্মতের সমন্বয়ে আমরা পুনরুজ্জীবিত হতে পারব।
নিম্নলিখিত হাদিসসমূহ মুসলিম উম্মাহকে আশাব্যঞ্জক এবং প্রেরণা জোগাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
এক. ইমাম ইবনে হিব্বান (রহ.) তাঁর সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, নবি করিম (সা.) বলেন—‘অবশ্যই এ দ্বীন একদিন পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে পৌঁছে যাবে। যেখানেই রাত-দিনের পরিক্রমা দেখা যাবে, সবখানেই। আল্লাহ প্রতিটি ঘরে ঘরে—সেটি মাটির হোক কিংবা অন্যান্য সাময়িক আবাস্থল হোক না কেন—তাঁর দ্বীনকে প্রবেশ করিয়ে দেবেন। এর মাধ্যমে একদলকে ইসলাম গ্রহণের কারণে সম্মানিত করবেন। আরেক দলকে কুফরির ওপর অটল থাকার কারণে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করবেন।’ (মুসনাদে আহমদ, মুসনাদুশ শামিয়্যিন : ১৬৯৫৭)
দুই. ইমাম আহমদ (রহ.), মুসলিম (রহ.), আবু দাউদ (রহ.), তিরমিজি (রহ.) এবং ইবনে মাজাহ (রহ.) ছাউবান (রা.) থেকে মারফু সনদে বর্ণনা করেন, নবি করিম (সা.) বলেন—
‘আল্লাহ তায়ালা এ বিশাল জমিনকে মুষ্টিবদ্ধ করে আমার সামনে উপস্থাপন করেছিলেন। আমি এর পূর্ব থেকে শুরু করে পশ্চিম পর্যন্ত সবকিছুই দেখেছি। আমি আমার উম্মতকে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে রাজত্ব করতে দেখেছি।’ (মুসলিম, কিতাবুল ফিতান ওয়া আশরাতিস সাআহ : ২৮৮৯ আবু দাউদ, আওয়ালু কিতাবিল ফিতানি ওয়াল মালাহিম : ৪২৫২, তিরমিজি, আবওয়াবুল ফিতানি আন রাসূলিল্লাহ : ২১৭৬ ইবনে মাজাহ, কিতাবুল ফিতান : ৩৯৫২ মুসনাদে আহমদ, মুসনাদুশ-শামিয়্যিন : ১৭১১৫)
তিন. হাদিসটি ইমাম আহমদ (রহ.), দারেমি (রহ.), ইবনু আবি শায়বা (রহ.) এবং হাকিম (রহ.) বর্ণনা করেছেন। মুহাদ্দিসগণ একে সহিহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। আবু কুবাইল (রহ.) বলেন—
‘আমরা একদা আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস (রা.)-এর মজলিশে উপস্থিত ছিলাম। আমাদের একজন তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, কনস্ট্যান্টিনোপল ও রোম—এ দুটি শহরের মধ্যে কোনটি সর্বপ্রথম ইসলামের পতাকাতলে আসবে? আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) তাঁর একটি বাক্সকে উপস্থিত করলেন, যা বন্ধ ছিল। এরপর সে বাক্স থেকে একটি বই বের করলেন এবং বললেন, আমরা একদিন নবিজির মজলিশে বসে লিখছিলাম। এক সাহাবি তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, কনস্ট্যান্টিনোপল ও রোমের মধ্যে কোন শহরটি আগে বিজিত হবে? তখন নবিজি বলেছিলেন, হিরাক্লিয়াসের শহর অর্থাৎ কনস্ট্যান্টিনোপল সর্বপ্রথম বিজিত হবে।’ (সুনানে দারেমি, আল-মুকাদ্দিমাহ : ৫০৩ মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে আবদুল্লাহ ইবনে আমর : ৬৬৪৫)
হাদিসে رُوْمِيَّةٍ দ্বারা ইতালির রাজধানী রোমকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে। বিখ্যাত গ্রন্থ মুজামুল বুলদান-এ শব্দটিকে এ অর্থেই নেওয়া হয়েছে। মুসলমানদের প্রথম বিজয়টি অর্জিত হয়েছে। কিন্তু রোম বিজয়ের সুসংবাদটি এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। আর বিশ্বনবির (সা.) ভবিষ্যদ্বাণী কখনোই মিথ্যা সাব্যস্ত হয় না।
চার. হাদিসটি ইমাম আবু দাউদ ও হাকিম (রহ.) বর্ণনা করেছেন। ইমাম হাকিম (রহ.) একে সহিহ হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন। এ ছাড়াও ইমাম বায়হাকি (রহ.) মারিফাতুস সুনান ওয়াল আসার গ্রন্থে আবু হুরায়রা (রা.) থেকে মারফু সনদে উল্লেখ করেছেন। রাসূল (সা.) বলেন—
‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক শতাব্দীর শুরুতে এই উম্মাহর কল্যাণের জন্য একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন; যিনি এসে দ্বীনকে পুনরায় সংস্কার করে থাকেন।’ (আবু দাউদ, আওওয়ালু কিতাবিল মালাহিম : ৪২৯১)
হাফিজ আল ইরাকি (রহ.)সহ অন্যরা হাদিসটির সনদকে সহিহ বলেছেন। ইমাম আল সুয়ুতি (রহ.) তাঁর আল জামিউস সগির গ্রন্থে একে সহিহ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
পাঁচ. হাদিসটি ইমাম আহমদ ও তিরমিজি (রহ.) আনাস (রা.) থেকে, ইমাম আহমদ (রহ.) আম্মার ইবনে ইয়াসির (রা.) থেকে, ইমাম আবদুর রাজ্জাক (রহ.) আলি (রা.) থেকে এবং ইমাম তাবরানি (রহ.) আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) থেকে মারফু সনদে বর্ণনা করেছেন। নবি করিম (সা.) বলেন—
‘আমার উম্মতের লোকেরা হচ্ছে বৃষ্টির মতো। কেউ জানে না তার প্রথমাংশে নাকি শেষাংশে কল্যাণ নিহিত রয়েছে।’ (তিরমিজি, আবওয়াবুল আমছালি আন রাসূলিল্লাহ : ২৮৬৯ মুসনাদে আহমদ, মুসনাদে আনাস ইবনে মালিক : ১২৩২৭)
হাদিসের মর্মার্থ হচ্ছে, বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা পানির মধ্যে যেমন জীবনীশক্তি নিহিত রয়েছে, মুসলিম উম্মাহর প্রতিটি প্রজন্মের মাঝে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যার মাধ্যমে তাঁরা সামাজিক পুনর্জাগরণের কাজ করে।
ছয়. হাদিসটি ইমাম আহমদ (রহ.) ও বাজ্জার (রহ.) হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান (রা.) হতে মারফু সনদে বর্ণনা করেছেন। নবি করিম (সা.) বলেন—‘তোমাদের মাঝে নবুয়তের এ শাসনব্যবস্থা আল্লাহর সিদ্ধান্ত যতদিন, ততদিন চলতে থাকবে। নবুয়তি শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটলে নবুয়তের আদলে খিলাফতব্যবস্থা কায়েম হবে। আল্লাহ যতদিন চাইবেন—
খিলাফতের শাসন চলবে। খেলাফতের পরিসমাপ্তি হলে জুলুমের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হবে। আল্লাহ যতদিন চাইবেন, জুলুমের এ রাজত্ব চলতে থাকবে। এ শাসনব্যবস্থার পতন ঘটলে জবরদস্তিমূলক শাসনব্যবস্থার আবির্ভাব হবে। আল্লাহ যতদিন চাইবেন, এ শাসন চলতে থাকবে। এ শাসনের পরিসমাপ্তির পর পুনরায় নবুয়তের আদলে খিলাফতব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। এরপর নবিজি চুপ থাকলেন।’ (মুসনাদ আহমদ, আওওয়ালু মুসনাদিল কুফিয়্যিন, হাদিস নং- ১৮৪০৬)
বিশ্বনবির (সা.) ভবিষ্যদ্বাণীর প্রথম তিনটি ধাপ অর্থাৎ খুলাফায়ে রাশেদা, জুলুমবাজ শাসন এবং জবরদস্তিমূলক শাসনব্যবস্থা অতিবাহিত হতে চলেছে। বহুল প্রত্যাশিত নবুয়তি মানহাজের ওপর প্রতিষ্ঠিত খিলাফতব্যবস্থা এখনও বাকি আছে, মুসলিম উম্মাহ অধীর আগ্রহে যার অপেক্ষমাণ রয়েছে। তবে খিলাফতের প্রতিষ্ঠা ও বাস্তবায়নের জন্য উম্মাহকে কাজ করে যেতে হবে। মুমিনদের প্রচেষ্টা ও শ্রমের বিনিময়েই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জাতির মধ্যে পরিবর্তন আনয়ন করেন।
এ ছাড়াও অসংখ্য হাদিস এ বিষয়টিকে সাব্যস্ত করে।
সাত. রাসূল (সা.) বলেন—‘আমার উম্মতের মধ্য হতে একটি দল সর্বাবস্থায় আল্লাহর দ্বীনের ওপর দণ্ডায়মান থাকবে। শত বাধা-বিপত্তি ও বিরোধিতা তাঁদের সত্যের পথযাত্রী হওয়া থেকে দমাতে পারবে না। অতঃপর আল্লাহর সিদ্ধান্তক্রমে একদিন তাঁরা সকলের ওপরে বিজয় লাভ করবে।’ (বুখারি, কিতাবুল মানাকিব : ৩৬৪১)
আট. রাসূল (সা.) বলেন—‘কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগ পর্যন্ত ইসলাম পৃথিবীর ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে। যার জন্য সর্বাবস্থায় মুসলমানদের মধ্য হতে একটি দল লড়াই করে যাবে।’ (মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ : ১৯২২)
নয়. রাসূল (সা.) বলেন—‘আমার উম্মতের মধ্য হতে একটি দল সর্বাবস্থায় সত্যের পথে সংগ্রাম করে যাবে। শত্রুর মোকাবিলায় তাঁরা জয়ী হবে এবং তাঁদের সর্বশেষ দলটি কিয়ামতের পূর্বক্ষণে দাজ্জালের বিরুদ্ধে লড়াই করবে।’ (আবু দাউদ, কিতাবুল জিহাদ : ২৪৮৪ )
দশ. রাসূল (সা.) সাহাবিদের উদ্দেশে বলেন—‘ঈসা (আ.) দুনিয়াতে এসে এমন কিছু সত্যনিষ্ঠ জনগোষ্ঠীকে পাবেন, যারা হবে ঠিক তোমাদের মতোই অথবা শ্রেষ্ঠ তিন প্রজন্মের মতো। আল্লাহ তায়ালা কখনোই এমন একটি উম্মাহকে লাঞ্ছিত করবেন না, যার শুরু হয়েছে আমাকে দিয়ে এবং পরিসমাপ্তি ঘটবে মাসিহ ঈসা (আ.)-এর মাধ্যমে।’ (হাদিসটি ইবনু আবি শাইবা (রহ.) বর্ণনা করেছেন)
এগারো. রাসূল (সা.) বলেন—‘আমার উম্মতকে দ্বীনের বিজয় এবং বিকাশতার, উচ্চ মর্যাদা এবং পৃথিবীকে নেতৃত্ব দানের ব্যাপারে সুসংবাদ দাও।’ (মুসনাদে আহমদ, মুসনাদুল আনসার : ২১২২০)
বারো. রাসূল (সা.) বলেন—‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না পৃথিবীতে সম্পদের প্রাচুর্যতা ঘটবে। এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, মানুষ জাকাতের সম্পদ নিয়ে ঘুরতে থাকবে, কিন্তু গ্রহণ করার মতো কাউকে খুঁজে পাবে না। এ ছাড়াও ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত হবে না, যতক্ষণ না আরবের মরু অঞ্চল পুনরায় সবুজ-শ্যামল এবং নদী-নালায় পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।’ (মুসলিম, কিতাবুজ জাকাত : ১৫৭)
তেরো. রাসূল (সা.) বলেন—‘ততক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ইহুদিদের সাথে তোমাদের এক চূড়ান্ত যুদ্ধ হবে। সে যুদ্ধে ইহুদিরা পলায়ন করে পাথরের আড়ালে লুকোতে চাইবে। তখন পাথর বলবে, ওহে আল্লাহর বান্দা বা ওহে মুসলিম! আমার আড়ালে ইহুদি লুকিয়ে আছে, তাকে হত্যা করো।’ (বুখারি, কিতাবুল জিহাদ ওয়াস সিয়ার : ২৯২৬)
চৌদ্দ. রাসূল (সা.) বলেন—‘দুনিয়ার সময়কালের মধ্য হতে একটি দিনও যদি অবশিষ্ট থাকে, সে দিনটিকে মহান আল্লাহ টেনে দীর্ঘায়িত করবেন। অতঃপর সে দিনটিতে আমার বংশের মধ্য হতে একজনকে পাঠানো হবে। তিনি পুরো পৃথিবীকে ন্যায়-নীতির মানদণ্ডে সাজিয়ে নেবেন, যেমনিভাবে পৃথিবীটা আজ জুলুম ও নিপীড়ন দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে আছে।’ (আবু দাউদ, কিতাবুল মাহদি : ৪২৮২)
প্রচেষ্টা ও কর্মতৎপরতার ওপর এত অধিক সংখ্যক হাদিস অধ্যয়নের পর কোনো ব্যক্তি দুয়েকটি বিশেষ প্রেক্ষাপটের হাদিসকে দলিল হিসেবে উপস্থাপন করে ঘরে বসে থাকতে পারে না।
আল্লামা ড. ইউসুফ আল কারজাভির ‘দাঈদের জ্ঞানচর্চ্চা’ বই থেকে...