23/07/2021
গরুর অন্ডকোষ/ বিচি বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি টাকা
আগে কোরবানির পশুর হাড়, শিংসহ, নাড়িভুড়ি বর্জ্য হিসেবে ফেলে দেওয়া হতো। তবে, এখন সেগুলো আর ফেলনা নয়। রাজধানীতে কোরবানির পশুর উচ্ছিষ্টাংশের (হাড়, শিং, অণ্ডকোষ, নাড়ি-ভুড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলি, চর্বি) রমরমা ব্যবসা চলছে। কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে এসব দ্রব্যের।
বৃহস্পতিবার (২২ জুালাই) হাজারীবাগ ঘুরে দেখা গেছে, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করা পশুর হাড়, শিং, নাড়ি-ভুড়ি বিক্রির জন্য নিয়ে আসছেন পথশিশু, কসাই, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ও ফেরিওয়ালারা। হাজারীবাগের হাড্ডিপট্টির বিভিন্ন দোকানে তা কেনাবেচনা হচ্ছে। ভেজা হাড়, মাথার হাড়, দাঁত বিক্রি হচ্ছে ৮-১৩ টাকা কেজি দরে। শুকনো হাড়ের কেজি ১৫ থেকে ২০ টাকা। প্রতি কেজি অণ্ডকোষ ২০ থেকে ৪২ টাকা, শিং ৪০ থেকে ৭০ টাকা, চর্বি ৩০ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, হাড় ওষুধের ক্যাপসুলের কাভার, সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সারা বছর ধরে বিভিন্ন বাজার থেকে এগুলো সংগ্রহ করা হলেও সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় কোরবানির ঈদে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কারখানাগুলোতে প্রথমে হাড় শুকিয়ে গুঁড়ো করা হয়। হাড়ের গুঁড়ো ক্যাপসুলের আবরণ তৈরির কাজে ব্যবহার হয়। পাশাপাশি হাড় ও হাড়ের গুঁড়ো বিদেশে রপ্তানি করা হয়। গরু, মহিষ ও ছাগলের শিং ভারতে রপ্তানি হয়। শিং দিয়ে চিরুনি, বোতাম, এক্স-রে ফিল্ম, ক্যামেরার ফিল্ম, ঘর সাজানোর দ্রব্যসহ বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি করা হয়। সাবান তৈরিতে ব্যবহার হয় চর্বি। রক্ত শুকিয়ে মুরগি ও পাখির খাবার তৈরি করা হয়। মাথার হাড় মেলামাইন তৈরিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়।
হাজারীবাগের হাড্ডিপট্টিতে পশুর বর্জ্য কেনার জন্য ২০ থেকে ২৫টি দোকান আছে। গরু-মহিষের হাড় ছাড়াও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকিকিনি চলে এখানে।
হাড্ডিপট্টির দোকানি আব্দুর রহিম শুকুর রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রতি টন হাড় ওষুধ কোম্পানির কাছে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হবে। দেশে প্রায় ৫০টি ওষুধ কোম্পানি ও হারবাল প্রতিষ্ঠান প্রতি মাসে ৩০ থেকে ৪০ কোটি ক্যাপসুলের কাভার তৈরি করে। বেশকিছু কোম্পানি গুঁড়া করা হাড় থেকে ক্যাপসুলের কাভার তৈরি করে। এতে প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ পশুর হাড় প্রয়োজন হয়। জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুলসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার পশুর অণ্ডকোষ দিয়ে তৈরি হয়। নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান তৈরি হয়। চট্টগ্রামসহ কয়েকটি জেলার ব্যবসায়ীরা অণ্ডকোষ কিনে বিদেশে রপ্তানি করেন।’
আরেক ব্যবসায়ী সবুজ হোসেন জানান, কোরবানির দিন তিনি হাড়, অণ্ডকোষ, রগ, শিং কিনেছেন আড়াই টন। এগুলো ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে যাবেন। তারা এগুলো চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে রপ্তানি করবেন।
তিনি আরও জানান, গরুর অণ্ডকোষ সংগ্রহের পর এগুলো রোদে শুকানো হয়। অনেকে সেসব হিমাগারে রাখে। সারা দেশ থেকেই বিক্রির জন্য এগুলো ঢাকায় আসবে। প্রতি মণ গরু ও মহিষের অণ্ডকোষ (শুকনো) ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, বরিশাল, রাজশাহীসহ বড় শহরগুলো থেকে এসব কিনে এনে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। প্রতিটি অণ্ডকোষের রপ্তানিমূল্য ৪ থেকে ৬ ডলার। একটি ভুড়ির দাম ১০ থেকে ১২ ডলার।
বৃহস্পতিবার রাজধানীর মিরপুর ও পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি ডাস্টবিন থেকে কয়েকজনকে হাড়, শিং ও নাড়ি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। তাদের মধ্যে একজন রবীন। তিনি ডিএসসিসির পরিচ্ছন্নতা কর্মী।
রবীন বলেন, ‘প্রতি বছরের মতো এবারও হাড়, মাথাসহ পশুর বর্জ্য সংগ্রহ করেছি। কেউ বিক্রি করলে তাও আমি কিনে নিই। পরে তা হাজারিবাগে বিক্রি করি।’
জানা গেছে, সারা দেশে হাড় গুঁড়ো করার ৩০-৩৫টি কারখানা আছে। রাজধানীর হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর ছাড়াও হাড় ভাঙার কারখানা আছে যাত্রাবাড়ী এলাকায়। চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে চারটি হাড়ের কারখানা। খুলনা মহানগরীর লবণচরা এলাকায় রূপসা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে তিনটি হাড় কারখানা। এছাড়া, সৈয়দপুর, বরিশাল, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও এখন হাড়ের কারখানা গড়ে উঠেছে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর দেশব্যপী ৯৪ লাখ ৫০ হাজার পশু কোরবানি হয়েছে। এর মধ্যে গরু প্রায় ৫৪ লাখ ৫০ হাজার। ছাগল, ভেড়া ও মহিষ প্রায় ৪০ লাখ। চলতি বছরেও প্রায় একই পরিমাণ পশু কোরবানি হবে। গরুপ্রতি গড়ে ১৫ কেজি করে হাড় হলে ৫০ লাখ গরু থেকে ৭ কোটি ৫০ লাখ কেজি হাড় হওয়ার কথা। ৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলে এসব হাড়ের দাম হয় ৬০ কোটি টাকা। যদিও সব গরুর হাড়ই যে বিক্রি করা হচ্ছে, তা নয়।
গরু–মহিষের হাড়, শিং দিয়ে বোতাম তৈরি করছে নীলফামারীর সৈয়দপুরের অ্যাগ্রো রিসোর্স কোম্পানি লিমিটেড। তারা জার্মানি, স্পেন, চীনে বছরে ২০ কোটি টাকার হাড় ও শিংয়ের বোতাম রপ্তানি করে। এসব বোতাম শার্ট, কোট, প্যান্ট, সাফারিসহ বিভিন্ন পোশাকে ব্যবহার করা হয়। ছোট পরিসরে শুরু করা কোম্পানিটির এখন তিনটি কারখানা। মোট ৩২ কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে তারা বছরে বোতাম রপ্তানি করে ২০ কোটি টাকার।
ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, ‘পশুর হাড়, শিং, চামড়া, ভুড়ি, অণ্ডকোষ, মূত্রথলি, চর্বি, রক্ত সবই রপ্তানিযোগ্য। অধিকাংশই রপ্তানি হয় চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে। হাড় ও শিং ফেলে না দিয়ে সেগুলো আড়তে বিক্রি করা যেতে পারে। এতে এসব অপ্রচলিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হবে।’