26/06/2020
পৃষ্ঠের গভীরতম বিন্দু কি?
মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, "ভূপৃষ্ঠের উচ্চতম বিন্দু কি?" তার ঝটিতি উত্তর, " মাউন্ট এভারেস্টের শৃঙ্গ, 8848m বা 29,028 ft"। পরের প্রশ্ন, "ভূপৃষ্ঠের গভীরতম বিন্দু কি?" এবার মাথা চুলকে জিজ্ঞাসা-চিহ্ন লাগিয়ে বললো,"মারিয়ানা ট্রেঞ্চ"?
হ্যাঁ, জাপান দেশের দক্ষিণ-পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরের নীচে এক গভীর সমুদ্র-খাদ "মারিয়ানা ট্রেঞ্চ"এর গভীরতম বিন্দু "The Challenger Deep" হ'ল ভূপৃষ্ঠের গভীরতম বিন্দু, সমুদ্র-পৃষ্ঠ থেকে যার গভীরতা 10,911 m বা 35,798 ft।
ইটালিতে এক সুইস প্রযুক্তিবিদ অগষ্ট পিকার্ড এক ডুবোজাহাজ বানিয়েছেন, সময়টা 1953 সালের আগস্ট মাস। (এ বছরেরই মে মাসে এডমন্ড হিলারি ভূপৃষ্ঠের উচ্চতম বিন্দু জয় করে সমস্ত পৃথিবী জুড়ে আলোড়ন ফেলে দিয়েছেন। ) এই ডুবোজাহাজটি অদ্ভুতদর্শন, একটি কোল-বালিশের মতো 59.5ft × 11.5ft × 18.5ft ট্যাঙ্ক যার তলায় ঝুলছে একটি ভারী ধাতব গোলক । পিকার্ডের দাবি, এই ছোট্ট জলযানটি সমুদ্রের গভীরতম বিন্দু স্পর্শ করতে সক্ষম। বাবার কাজে মোহিত ছিলেন প্রযুক্তিবিদ ও বিজ্ঞানী ছেলে জ্যাক পিকার্ড।
ভূপৃষ্ঠ বা সমুদ্রপৃষ্ঠে যদি বায়ুচাপ 1 atm (760mmHg) হয়, তা এভারেস্টের উপরে হবে 0.329 atm( 250mmHg); সমুদ্রের গভীরতম বিন্দু The Challenger Deep এ জলের চাপ হবে 1091.1 atm (829236 mmHg)। অর্থাৎ, আপনার উপর আঠারো হাজার হাতি চাপিয়ে দেওয়া হলো, বুঝুন এ'বার! এই চাপ সহ্য করতে পারবে পিকার্ডের তৈরী ডুবোজাহাজ "ট্রিয়েস্ট" (Trieste) ?
পাঁচ বছর ধরে প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর 1958 সালে মার্কিন নৌবাহিনী "ট্রিয়েস্ট" কিনে নেয়। শুরু হয় Project "Necton"; অর্থাৎ The Challenger Deep (যার অস্তিত্ব তখনো পর্যন্ত তাত্ত্বিক) এ মানুষ পাঠানোর প্রচেষ্টা।
1960 সালের 23শে জানুয়ারি। সুন্দর রৌদ্রজ্বল আবহাওয়ায় প্রশান্ত মহাসাগরের উপর ভেসে আছে মার্কিনী নৌজাহাজ USS Wandank। জলে নামানো হয়েছে "ট্রিয়েস্ট"। তার floater-tank এ ভরে দেওয়া হয়েছে গ্যাসোলিন (পেট্রোলিয়াম), যা সমুদ্রের জলের থেকে বেশি ঘন, ফলে বাইরে-ভিতরে চাপপার্থক্য কমবে। দু'টো ইঞ্জিনের সাহায্যে প্রপেলার ঘুরবে ও বিদ্যুত তৈরি হবে। বৈদ্যুতিক চুম্বকের সাহায্যে নীচে দু'টি আধারে ধরে রাখা হবে বেশ ওজনদার লোহার ballast , যা ট্রিয়েস্টকে ডুবতে সাহায্য করবে; আবার যান্ত্রিক ত্রুটি হ'লে (power failure) এ'গুলি খসে পরবে সমুদ্রে, ফলে ট্রিয়েস্ট নিজেই ভেসে উঠতে শুরু করবে। লৌহগোলকে প্রবেশ করলেন পিকার্ডের ছেলে জ্যাক পিকার্ড ও মার্কিন নৌ-অফিসার ডন ওয়াল্স। ছোট্ট গোলকে কোনো রকমে দু'টি মানুষের জায়গা হ'ল।
ট্রিয়েস্ট ডুবতে শুরু করলো, গতিবেগ ঘণ্টায় প্রায় তিন কিমি। একটি মোটা কাঁচের জানলা দিয়ে সতর্ক দুজোড়া চোখ সমুদ্র দেখে ও কন্ট্রোলপ্যানেলে তাকায়।
প্রথম দু'শো মিটার Surface-layer, কতো রকম সামুদ্রিক জীবের আনাগোনা, তিমিদের ওঠা-নামা, সামুদ্রিক কচ্ছপের ভেসে বেড়ানো, মাছের ঝাঁক; মানে, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিতে আমরা যা দেখি আর কি! তারপর আলোটা কেমন যেন কমে এলো, সন্ধ্যা হওয়ার মতো। (The twilight zone)। মাছেদের আনাগোনা কম। কিছু Eel, Lobster, Shark, Olive-ridley ঘুরে বেড়াচ্ছে। গোলকের বাইরের sensorএ তাপমাত্রা কমছে, জলের ঘনত্ব বাড়ছে। কিছু বড়ো আকারের স্কুইড ও হাঙর পাশকাটিয়ে যায়। গভীরতা বাড়তেই থাকে...600m, 800m, অন্ধকার ঘনিয়ে আসে। একটা Leather-back turtle ভেসে যায় জানলার সামনে দিয়ে। 900m, বাইরে মধ্যরাতের নিস্তব্ধতা। কেবল ইঞ্জিনের শব্দটাই শোনা যায়।
গভীরতা 1000m। আর কোনো আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। নিশ্ছিদ্র কালো অন্ধকার। তারই মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ তারার মতো জ্বলে উঠছে....ওগুলো কি? নিজের শরীরে আলো সৃষ্টিকারি সামুদ্রিক জীব। 1200m, তিন চার রকম আলোয় উজ্জ্বল এক কোরালের গাছ, কোনো এক প্রস্তরখণ্ডে লেগে আছে। 1400m, বীভৎস দর্শন ড্রাগন-ফিস, সার্চলাইটে দেখা গেলো। 1500m, 2000m....জীবনের সংখ্যা খুব কমে গেছে। অন্ধকার পাতালপুরি যেন মৃত্যু গহ্বর। জ্যাক আর ডনের যেন মাথায় ঘোর লাগে। কেবিনের ভেতরেও তাপমাত্রা বেশ কমছে।
প্যানেলের সিগন্যাল আলো জ্বলে ওঠে, গভীরতা 3680m, পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রের গড় গভীরতা। 3000--6000m কে বলা হয় The Abyssal Zone, বাইরের তাপমাত্রা 4°C ।
6000m এর ও তলায় নামতে থাকে ট্রিয়েস্ট। বাইরের তাপমাত্রা 1°C, জলের চাপ বেড়েই চলেছে। The Hadal Zone । ট্রিয়েস্ট ঢুকে পড়েছে মারিয়ানা ট্রেঞ্চ এর ভিতর, সমুদ্রতলের দেওয়াল দেখা যায় দূরে। দুই অসীম সাহসী মানুষ বিস্ময়ে ও উত্তেজনায় হতবাক। একটু বোধহয় অন্যমনস্ক! হঠাৎ একটা আওয়াজ, থরথর করে কেঁপে ওঠে ট্রিয়েস্ট। জ্যাক পিকার্ড কন্ট্রোল-প্যানেলের তথ্যে চোখ বোলায়, গভীরতা 9000m। খুঁজে দেখে জানালার একটি বাইরের দিকের plexiglass pane এ চির ধরেছে। অতিরিক্ত চাপে কেঁপে উঠেছে ট্রিয়েস্ট। ডন একবার জ্যাকের চোখে চোখ রাখে। জ্যাক পিকার্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। ট্রিয়েস্টের গতি একদম কমিয়ে সে আরো গভীরে নামতে থাকে। এই রকম মৃত্যুশীতল গভীরতাতেও ডনের চোখে পড়ে কিছু অদ্ভুত দর্শন সামুদ্রিক জীব। Hydrothermal vent অর্থাৎ আগ্নেয় উষ্ণ প্রস্রবণের স্রোত থেকে পাওয়া খনিজ যাদের খাদ্য। কিন্তু হায়, জ্যাক বা ডন, কেউই জীববিদ্যায় পারদর্শি নন। ফলে এই জীবকুলের বৈজ্ঞানিক বিবরণ তাঁরা দিতে পারেন নি।
অবশেষে আর নীচে যাওয়ার পথ মেলে না, চার ঘন্টা সাতচল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত। কন্ট্রোলপ্যানেলে গভীরতা দেখাচ্ছে 10,924 m( যান্ত্রিক ত্রুটি বাদ দিয়ে এটি হবে 10,911m)। অর্থাৎ এভারেস্ট জয়ের সাত বছর পর মানুষ The Challenger Deep পৌঁছে আর এক ইতিহাস রচনা করেছে। বিশেষ hydrophone voice communication system এর মাধ্যমে উপরে ভাসমান জাহাজের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে তাঁরা সফল হন। বাতাসে শব্দের গতির পাঁচগুণ দ্রুততায় মাত্র সাত সেকেন্ডে এই বার্তা উপরে পৌঁছায় ও আরো সাত সেকেন্ডে অভিনন্দন বার্তা ফেরে। কেবিনের ভিতরে তাপমাত্রা তখন 7°C।
এই গভীরতায় কুড়ি মিনিট ট্রিয়েস্টকে স্থির রেখে, তারপর Iron ballast release করে ডন ও জ্যাক ধীর গতিতে উপরে উঠতে থাকেন এবং তিন ঘন্টা পনেরো মিনিটে তাঁরা নিরাপদে ভেসে ওঠেন।
এর পর 1995 সালে জাপানের রোবট এবং 2009 সালে মানুষহীন-যান Nereus, The Challenger Deep এ নামে ও বৈজ্ঞানিক তথ্য সংগ্রহ করে। 2012 সালের মার্চ মাসে "টাইটানিক" খ্যাত হলিউডি চিত্রপরিচালক জেমস ক্যামেরন একটি অত্যাধুনিক ক্যাপসুলে চেপে পুনরায় The Challenger Deep স্পর্শ করেন।
2020র জুন মাস (till date) পর্যন্ত ধরে, এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছেন 5780 জন (একাধিকবার আরোহণ, বিশেষতঃ শেরপাদের, বাদ দিয়ে)। আর এ পর্যন্ত The Challenger Deep স্পর্শ করেছেন মাত্র তিনটি মানুষ।
ট্রিয়েস্ট যানটি মার্কিন নৌবাহিনীর জাদুঘরে এখনো প্রদর্শিত আছে।
Writer: Dr Sagnik, Abu Dhabi
Bengali Translation: Hindol Roy