10/09/2022
বরিশাল পুলিশে তোলপাড়!
নিজস্ব প্রতিবেদক, বরিশাল টাইমস::- মাদক উদ্ধার অভিযানের নামে তল্লাশি করে নিরাপরাধ এক যুবকের বাসা থেকে লক্ষাধিক টাকা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে বরিশাল মেট্রোপলিটন কাউনিয়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) এবং সহকারি উপ-পরিদর্শক (এএসআই) পদমর্যাদার বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এসআই সাইদুল হক সরদারের নেতৃত্বে ৭ সেপ্টেম্বর শহরের পুরানপাড়া থেকে মহিউদ্দিন ওরফে রাইফেল মহিউদ্দিন নামের এক যুবককে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার এবং পরবর্তীতে তার দেওয়া তথ্যমতে ওই দিন দুপুরে ইমরান হোসেন নামের আরেক যুবককে ধরতে কাউনিয়া বিসিক গলিতে হানা দেয়। তবে এই যুবককে না পেয়ে তার বাসায় মাদক উদ্ধারে নাটকীয় অভিযান চালায় এবং তল্লাশির একপর্যায়ে ওয়ারড্রব থেকে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা নিয়ে যায়। ওই সময় যুবকের বাবা-মা বিষয়টির প্রতিবাদ করলে তাদের ভয়ভীতি দেখানোসহ ছেলে ইমরানকে মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বিষয়টি জানাজানি হলে ঘটনার দিন রাতে ৪০ হাজার এবং একদিন বাদে ৮ সেপ্টেম্বর আরও ৫০ হাজার টাকা ফেরত দেয়। পাশাপাশি যুবক ইমরানকে মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে এই বিষয়টি নিয়ে বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে ভেতরে তোলপাড় চললেও দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তা মিডিয়ার কাছে মুখ খুলছেন না।
পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে- পুরো ঘটনা বিশেষ কোনো মাধ্যম বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মো. সাইফুল ইসলাম নিশ্চিত হয়েছেন এবং তার নির্দেশে অভিযোগসমূহের তদন্তও ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। ফলে বিষয়টি নিয়ে পুলিশের দায়িত্বশীল মহল আপাতত সংবাদমাধ্যমে কিছু বলতে চাইছে না।
একাধিক সূত্র জানায়- কাউনিয়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) সাইদুল হক সরদারের নেতৃত্বে এসআই রাহাতুল ইসলাম, এএসআই কামরুল আহসান, এএসআই শফিক, এএসআই হান্নান এবং এএসআই জাহিদ গত ৭ সেপ্টেম্বর পুরানপাড়া এলাকায় অভিযান করে এবং মহিউদ্দিন ওরফে রাইফেল মহিউদ্দিন নামের যুবককে সাত পিস ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করে। পরবর্তীতে তাকে নিয়ে থানা পুলিশের এই টিমটি কাউনিয়া বিসিক গলিতে আবুল হোসেন নামের জনৈক ব্যক্তির ছেলে ইমরান হোসেনকে ধরতে তার বাসায় যায়। কিন্তু সেখানে ইমরানকে না পাওয়া গেলে তার বাসায় ঢুকে পুলিশ কর্মকর্তারা মাদক উদ্ধারের নামে তল্লাশি করে। একপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তারা ইমরানের বাবা-মায়ের উপস্থিতিতে বাসার ওয়ারড্রব থেকে ১ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। এবং বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে ছেলে ইমরানকে মাদক মামলায় মহিউদ্দিনের সহযোগী হিসেবে জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়।
যুবক ইমরানের পরিবারের অভিযোগ, কোনো ধরনের মাদক না পেলেও পুলিশ কর্মকর্তারা সমুদ্বয় টাকাসহ বাসা থেকে বেড়িয়ে দাবি করে ঘরের অভ্যন্তরে ইয়াবা সেবনের উপকরণ পাওয়া গেছে। এবং এই ঘটনায় স্থানীয় যুবকদ্বয় আল আমিন এবং মেহেদীকে সাক্ষী করতে মুঠোফোনে তাদের বক্তব্য রেকর্ড করে। এরই মধ্যে ইমরানের ফুফা বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আউয়াল মোল্লা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছে নাটকীয় তল্লাশি অভিযানসহ ঘরে রাখা টাকা নেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু এসআই সাইদুলসহ অভিযানিক টিমের সদস্যরা সেখানে কোনো প্রকার উত্তর না দিয়ে এই জনপ্রতিধিকে পরবর্তীতে থানায় যোগাযোগ করতে বলেন।
কিন্তু থানায় পৌছানোর আগেই পুলিশ কর্মকর্তারা আরও একটি বিতর্কিত ঘটনার জন্ম দেন। ইমরান ভেবে তারা পথিমধ্যে ফয়সাল নামে স্থানীয় এক যুবককে আটক করে মারধর শুরু করেন। একপর্যায়ে ওই যুবককে গাড়িতে উঠিয়ে মহিউদ্দিনের সাথে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। থানা পুলিশের ভেতরকার একটি সূত্রে জানা গেছে- এই যুবককে সাধারণ ধারায় আদালতে পাঠানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার পরিবারের কাছ থেকে ওইদিন রাতে ২০ হাজার টাকা ঘুস নেন এসআই সাইদুল। সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী যুবককে পরদিন ৮১ ধারায় আদালতে চালান দেওয়া হয়।
এসব অভিযোগসমূহ অভিযানিক টিম প্রধান এসআই সাইদুল হক সরদার এবং এসআই রাহাতুল ইসলাম অসত্য দাবি করলেও ইমরানের ফুফা আউয়াল মোল্লা বলছেন- এই দুই কর্মকর্তাই বাসায় বসে টাকা গুণে নিয়ে যান। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় থানায় গেলে তারা বলেন- সমুদ্বয় টাকার বিনিময়ে ইমরানকে মাদক মামলায় থেকে বাদ দেওয়া হবে। কিন্তু এর আগেই তল্লাশির নামে বাসা থেকে টাকা দেওয়ার বিষয়টি পুলিশের শীর্ষমহলে জানাজানি হয়। পরে অনেকটা চাপের মুখে সেখান থেকে ৪০ হাজার টাকা ফেরত দেন এসআই সাইদুল। এবং ক্ষোভে ইমরানকে মহিউদ্দিনের সহযোগী হিসেবে মাদক মামলায় জড়িয়ে দিয়ে পলাতক দেখান।
ইমরানের পরিবার জানায়- টাকা নেওয়ার পরেও কেন নিরাপরাধ ইমরানকে মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হল এই বিষয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তারা সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা ৮ সেপ্টেম্বর সকালে আরও ৫০ হাজার টাকা ফেরত দেন। পাশাপাশি ইমরানকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠানোসহ আরও কয়েকটি মাদক মামলায় জড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেন। এবং গত দুদিন ধরে ইমরানকে ধরতে তারা এলাকায় অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। ফলে যুবকের পরিবার অনেকটা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। পাশাপাশি সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হয়েছেন, হচ্ছেন দাবি করেছেন ইমরানের বাবা আবুল হোসেন।
কাউনিয়া থানা পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তার নাটকীয় এই মাদক উদ্ধার অভিযানের খবর চাউর হয়ে যাওয়ায় স্থানীয় সুশীলমহলে ক্ষোভের তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত পরবর্তী অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি রাখা হয়।
এই ঘটনায় বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ভেতরে তোলপাড় চললেও দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা প্রাসঙ্গিক বিষয়টিতে মুখ খুলতে চাইছেন না।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে উপ-পুলিশ কমিশনার (উত্তর) জাকির হোসেন মজুমদারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য না করলেও শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা মো. সাইফুল ইসলাম বলছেন- এই ঘটনায় তদন্ত চলছে। অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগের সত্যতা মিললে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সেক্ষেত্রে ধারণা করা হচ্ছেÑ উত্থ্যাপিত এই অভিযোগের সত্যতা মিললে অভিযুক্তদের ভবিষ্যত বিষিয়ে উঠতে পারে। এমতাবস্থায় কারও কারও অভিমত তাদের বরখাস্ত করাসহ বিভাগীয় মামলাও হতে পারে। কারণ স্বচ্ছ-সৎ পরিচ্ছন্ন মানসিকতার শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম অপরাধ বা অপরাধীদের সাথে কখনই আপস করেননি, সুতরাং এই ইস্যুতেও কাউকে ছাড় দেওয়ার সম্ভবনা খুবই কম। যার প্রমাণ বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার থাকাকালীন দেখিয়েছে বলে উদাহরণ টানা হচ্ছে। অপরাধে জড়িয়ে পড়া মাঠপর্যায়ের এই পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন সেটাই এখন দেখার বিষয়।’