08/06/2022
প্রতিটি পরিবেশ দিবসে কীসের অঙ্গীকার করি? গাছ যে লাগাচ্ছি তার বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেছি তো? স্থানাভাব আমাদের আছে, তা বলে বড় বড় গাছ কেটে, পুকুর বুজিয়ে ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটে স্নেক প্ল্যান্ট লাগিয়ে অক্সিজেনের ঘাটতি মেটাতে পারব তো? পাড়ার মুদীর দোকান ধুকছে, অন্যদিকে প্রতিটি শহরের শোভা বনর্ধনকারী শপিংমলগুলির ছাড়া বিষ বাতাসে পৃথিবী টলমল। এযুগের ভরসা এসেছে ধোঁয়া উড়িয়ে বিজয়রথে। 'হোম ডেলিভারি'। খাওয়ার ওষুধ থেকে চাল, চিনি, তেল, গম, কোল্ডপ্রেস তেল, মিলেট। নামে 'অর্গ্যানিক' কিনছি আসলে সেই পেট্রোল, তাঁরাও বাজার দখলের লিপ্সায় চলে আসছেন ভোঁ করে, ডাকলেই, বাড়িয়ে চলেছি কার্বন ফুট প্রিন্ট। এই সব আমরা ভেবেছি কখনও? বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে মেরু অঞ্চলে প্রতিদিন বরফ গলে যাচ্ছে। ফলে মেরুভালুকের মূল খাবার সীলমাছ, সেই ভাণ্ডারে টান পড়ায় ভাল্লুকেরা মানবজমিনে ঘুরেটুরে বেড়াচ্ছে খাবারের আশায়, এবং অপ্রতুল খাদ্য আর খাদ্যের ঘাটতিতে মরণোন্মুখ দশায় পৌঁছে যাচ্ছে।
ঠিক দশবছর আগে লুইস পিউ ভৌগলিক উত্তরমেরুতে সাঁতরে চমকে দিয়েছিলেন বিশ্বকে। আবেদন রেখেছিলেন তাবড় তাবড় বিশ্বনেতাদের কাছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে সঠিক পদক্ষেপের। দশ বছর চলে গেলেও পৃথিবী সাবধান হয়নি কিছুই। ডোনাল্ড ট্রাম্পের পছন্দের টপ এনভায়রনমেন্টাল অ্যাডভাইসার নমিনি ক্যাথলিন হার্নেট হোয়াইট জানেনই না বিশ্ব উষ্ণায়ণ বলে কোনও বিষয় এই পৃথিবীতে আছে।
আমরা যে পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে ছেড়েছি, যে হারে গাছ কেটেছি, যে পরিমাণ বর্জ্য ও বিষ মাটিতে আর জলে দিয়েছি সারা পৃথিবীর প্রকৃতি সে ক্ষতি এ বছরে আর পূরণ করতে পারবে না। ভয়ের বিষয় হচ্ছে প্রতিবছর এই আর্থস ওভারশুট ডে এগিয়ে আসছে। তার আগে অবধি আমরা গাছ কেটে রাস্তা চওড়া করে ভাববো উন্নয়ন হচ্ছে। সুন্দরবন উজাড় করে কয়লাচালিত তাপবিদ্যুতকেন্দ্র বানিয়ে ভাবব উন্নয়ন হচ্ছে। উত্তর মেরুতে অয়েল ড্রিলিং করব এ কথা ভুলে গিয়ে অসুস্থ, ছিন্নভিন্ন এই প্রকৃতিকে নিয়ে আমাদের সতর্ক হবার কথা ছিল। তা হইনি বলে কোনও তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নয় বিষযুদ্ধে এই পৃথিবী উজাড় হয়ে যাবে।প্রকৃতির উপর অধিকার জাহির করতে গিয়ে আস্তে আস্তে যে বিপদের সামনে দাঁরিয়েছি আমরা নিজেরাই তার গভীরতা আন্দাজ করতে পারছি না। ইতিমধ্যে দূষিত বাতাসদীর্ণ দিল্লির পর কলকাতাতে শুরু হয়েছে (সোসাল মিডিয়ায়) বিশুদ্ধ বাতাসের জন্যে নাগরিক সচেতনতা। আমরা বুঝবো তো?
চল্লিশ বছর ধরে সন্দেশ পত্রিকায় বেরিয়েছে প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর। সত্যজিৎ রায়, সত্যেন বসু প্রমুখের প্রণোদনায় জীবন সর্দার ছদ্মনামে সুনীল বন্দোপাধ্যায় একটানা লিখে গেছেন আমাদের বাড়ির চারপাশের আরশিনগরের কথা। পাখি, পোকা, প্রজাপতি গাছপালা আর জীবজন্তুর আজব জগতের কথা। এম্প্যাথি তৈরি করতে চেয়েছেন শিশুর মনে এই প্রতিবেশীদের জন্যে। বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রকৃতির উপর এই যথেচ্ছাচারের ফল ভাল হবার কথা নয়। লিখছেন হাওয়াতে যদি বিষের ধোঁয়া মেশে আমরা তখন তখনই তার কুফল কতটুকু বুঝি!প্রাণী আর উদ্ভিদের শরীরে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায় তার পরিণাম। কিন্তু মহাকাশ থেকে তোলাছবি দেখে বোঝা গ্যাছে পৃথিবীর হাওয়ার ভাল গুণ হারিয়েছে। যদি এ সব সত্যি হয়, তবে, পৃথিবী দূর থেকে সুন্দর হলেও কাছে থাকার মতো নয়। অথচ পৃথিবীটাকে, মানে প্রকৃতিকে আগামীর মানুষের জন্যে নির্মল বিশুদ্ধ রাখতে হবে। পৃথিবীর রূপগুণের কারণ প্রকৃতি। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সম্প্ররক যে কত নিবিড় সেই খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। মানুষ প্রকৃতির একটি অংশ মাত্র, প্রকৃতির প্রভু নয়- এ কথাটি এত কাল কেউ মানতে না চাইলেও আজ বুঝি সেই সময় এসেছে।
প্রকৃতি নিজেই একটি রাজনীতি। রাষ্ট্রের সঙ্গে বহুজাতিকের অশুভ আঁতাত বাধ্য করছে গ্রিন পলিটিক্স সম্পর্কে সচেতন হতে। তাই উরাল হ্রদের চেয়ে সোভিয়েত সেচ কিংবা সুন্দরবন ও তার প্রাণীসম্পদের চেয়ে তাপবিদ্যুত কেন্দ্র গুরুত্বপূর্ণ এমন মনে করতেই পারেন ওয়াকিফহাল মহল। সুন্দরলাল বহুগুনার সেই স্লোগান “ecology is permanent economy”—অমোঘ মনে হয়। শেষ নদীটি মজে যাবার পর, শেষ গাছটি কেটে ফেলার পর, শেষ মাছটি মরে যাবার পরে মানুষ জানবে শুধু টাকা খেলে বাঁচা যায় না।
সুতরাং এ লড়াই একান্ত আমাদের। আমাদের ঠিক করতে হবে কোন পৃথিবীতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রেখে যাব আমরা। আমাদের ঠিক করতে হবে পৃথিবী নামের এই আশ্চর্য সবুজ গ্রহটাকে বাঁচাবার জন্যে একটা চমৎকার প্রতিবাদের শুরু আমরাই করব কিনা। আমাদের বেঁচে থাকবার জন্যে একটা জমি না ছাড়া লড়াই লড়বো কিনা। আর সেই লড়াইয়ের হাতিয়ার করে সন্তানের হাতে তুলে দেব কি না প্রকৃতি চেনার, প্রকৃতিকে ভালবাসবার এই সহজপাঠ।
গত চল্লিশ বছর ধরে চলা সন্দেশের পাতা থেকে উদ্ধ্বার করা হয়েছে এই সব লেখা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের চেষ্টায়। তাকে সম্পাদনা করে, সাজিয়ে, সময়ানুগ করে তুলেছেন ৯ঋকাল বুকস, এঁকেছেন অভিজ্ঞ শিল্পী যুধাজিৎ সেনগুপ্ত।
প্রকৃতি পড়ুয়ার দপ্তর
জীবন সর্দার
শিল্প- সত্যজিৎ রায়, যুধাজিৎ সেনগুপ্ত
দাম ৬০০ টাকা
#৯ঋকালবুকস