11/06/2021
"গপ্পো: লকডাউন"
--বাবু
পর্ব ১ :-
ওরলির রানওয়ে ছেড়ে প্লেনটা ভারতের আকাশ পথ ধরলো। এর কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে ঋক সিটবেল্ট খুলে ল্যাপটপটা খুলে বসলো। ককপিট থেকে পাইলট তখন নিজের ও কো-পাইলটের পরিচয় দিয়ে প্যারিসের আবহাওয়ার বর্ননা করছে এবং সবশেষে গন্তব্যস্থল ভারতের পরিচয় দিয়ে ঘোষণা শেষ করলো। দীর্ঘ চার বছর পর ঋক আবার দেশে ফিরছে।এই কয় বছরে দেশের সাথে বাড়ির সাথে সম্পর্ক বলতে ছিলো বোন আর লতাপিসির ফোন। মা-বাবা যেন ওকে এক রকম ভুলেই গেছে। অবশ্য ওদেরও দোষ দেওয়া যায়না, ও তো এই মানুষ দুজনকে কম দুঃখ দেয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ও ল্যাপটপে চলা সিনেমাটায় মন দিলো।
কয়দিন ধরেই ও শুনছিল করোনা ভাইরাস কিভাবে চীন থেকে ক্রমশ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, কব্জা করে নিচ্ছে গোটা পৃথিবীকে। বাঁচার একমাত্র উপায় মানুষে মানুষে ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা। তাই প্রত্যেকটি দেশ পূর্ণ লকডাউন ঘোষণা করেছে।প্যারিসেও আর কয়েক দিনের মধ্যে লকডাউন শুরু হয়ে যাবে।এই দেশে ওর একমাত্র বাঙালি বন্ধু ছিল দিব্য। ওই বলেছিলো সময় থাকতে দেশে ফেরার কথা। কিন্তু ঋক এদেশে থাকাই স্থির করেছিলো। এরপর হঠাৎই বোনের ফোন আসে, সবাই ওর জন্য টেনশন করছে।এ কথা সে কথার পর বোন ওকে বলেছিলো–’দাদা এইবার বাড়ি আয়রে। মানুষ দুটো বুড়ো হয়েছে,ওরা আর আগের মতো নেই।সব ভুলে এইবার বাড়ি ফিরে আয়’। বোনের কথাটা ও আর ফেলতে পারেনি।
এই প্লেনে আজ দুজন বিখ্যাত ব্যক্তি সফর করছে তারই ঘোষণা চলছে।এদের মধ্যে একজন জনপ্রিয় বলিউড তারকা এবং ওপরজন পৃথিবী বিখ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার ঋকরাজ চ্যাটার্জী অর্থাৎ ও নিজে।ঋক উঠে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে সবাইকে নমস্কার করলো।ওর ক্লদিং লাইন ‘দ্য আউট লুক’ আজ পৃথিবীর নামজাদা ব্র্যান্ডগুলোর সাথে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। টাকা-পয়সা, সাফল্য সবই আজ ওর হাতে ধরা দিয়েছে। কিন্তু এতো কিছুর পরেও ওর মনে শান্তি নেই।ওর নিজেকে স্বার্থপর মনেহয়।ওর নিজের পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ও মা-বাবার কথা মনেই রাখেনি। তাই আজ এতো সাফল্য সন্মান পাওয়ার পরও ওর নিজেকে খুব ছোট মনে হয়। হঠাৎ এই করোনা মহামারী,লকডাউন না আসলে আজও ও এদেশেই থেকে যেত। দীর্ঘ সময় যেন কয়েকটা যুগ বয়ে গেছে ওর জীবনে। সামনের ল্যাপটপের স্ক্রিনে চলা সিনেমা ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে, তার বদলে একটু একটু করে ফুটে ওঠে ওর ফেলে আসা অতীত।
পর্ব ২ :-
ঋকরা থাকতো মধ্য কলকাতায়। জ্যাঠতুতো খুড়তুতো মিলে ওদের জমজমাট একান্নবর্তী পরিবার ছিলো। পেশায় সরকারি কর্মী বাবা ছিলেন এই পরিবারের চতুর্থ ভাই। আর মা ইংরেজির প্রফেসর, নামকরা কলেজে পড়াতেন। ওরা দুই ভাইবোন মা-বাবাকে প্রায় পেতোই না। ঋকরা বড়ো হয়েছে লতাপিসির কাছে। পিসি বাবাদের দূর সম্পর্কের বোন হয়। এই সংসারে পিসির আপন বলতে ছিলো ওরাই। বাড়ির ছোটদের সব দায়িত্ব ছিলো পিসির ওপর,আর সেই দায়িত্ব পিসি হাসিমুখেই সামলাতো।
ঋক ছোট থেকেই মুখচোরা শান্ত প্রকৃতির ছেলে। বাকি ভাইবোনদের সাথে খেলাধুলা বা হইচই করার থেকে গল্পেরবই পড়তে বা ছবি আঁকতে ও বেশি ভালোবাসতো। এর জন্য ওকে বাবা প্রায় বকুনি দিয়ে বলতেন–’ছেলে হয়েছিস কোথায় দাপিয়ে খেলাধুলা করবি, তা না মেয়েদের মতো ঘরে বসে থাকিস’।আর বোনকে বকা খেতে হতো ঠিক এর উল্টো কারণে। মেয়েদের নাকি ওতো হট্টোগোল করা উচিৎ নয়, সংসারে অলক্ষ্মী আসে। ও বুঝে পেতনা শুধু ছেলে বলেই কেন ওকে খেলতে হবে আর মেয়ে বলে বোনকে শান্ত হতে হবে। ঋকের খুব ভালো লাগতো পিসির পাশে বসে সেলাই-ফোড়াই বা উলবোনা দেখতে। ও পিসির কাছে বায়না করতো ওকেও শিখিয়ে দেওয়ার জন্য। পিসি ওকে অল্প বকুনি দিয়ে বলতো–’ধুর, বোকা ছেলে তুই কি শেষে মেয়ে মানুষের মতো ঘরে বসে সেলাই ফোড়াই করবি’। কিন্তু ঋকের নাছোড় বায়নার কাছে তাকে শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হতো। আর ও যখন পিসির কাছে সেলাই অথবা উলকাঁটার কাজ শিখতো ,তখন ওর বোন রুমি ওদের বাড়ির পাশের মাঠে পাড়ার বাকি ছেলেদের সাথে ব্যাটে বলে ছক্কা মারতো। অবশ্য পিসি জানতো রুমি ঘুমিয়ে আছে।
সব ঠিক চলছিলো গোল বাঁধলো ওর জয়েন্টের ফল বেরানোর পর। ঋকের বাবার বরাবরের ইচ্ছা ছিলো ছেলেকে ডাক্তার বানানোর। বাবার চাপে ও সায়েন্স নিয়ে পড়াও চালিয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু তারপরই ও এন.আই.এফ.টির ফ্যাশান কোর্সের কথা জানতে পারে।ওর ইচ্ছা এই কোর্স করার।ও বড়ো ফ্যাশান ডিজাইনার হতে চায়। ও ভেবেছিলো ডাক্তারীতে ওর নাম উঠবেই না, কিন্তু ওকে ভুল প্রমান করে নামটা লিস্টে উঠে গেছিলো।ওই দিকে ফ্যাশন কোর্সের এ্যডমিশান টেস্টটা ও লুকিয়েই দিয়েছিলো, সেই লিস্টের প্রথম নামটাই ছিলো ওর। প্রথম কয়দিন ও কি করে বাড়িতে ওর ইচ্ছার কথাটা বলবে বুঝতে পারছিলো না। তারপর একদিন সাহস করে রাতে খাওয়ার টেবিলে ওর মনের কথাটা বলে ফেল্ল। প্রথমে সবাই ওর কথায় হতোভম্ব হয়ে গেছিলো, ভাবছিলো ও মজা করছে। কিন্তু যখন ভুল ভাঙ্গলো তখন বাবা রাগে ফেটে পড়েছিল। রাগের বশে ওকে সেদিন ওনেক কথা শুনতে হয়েছিলো। কথাগুলি আজও ঋকের মনে পড়ে। বাবা বলেছিলো —’চ্যাটার্জী বংশের কলঙ্ক তুই।তোর বাকি ভাইবোনরা যখন সন্মানের সাথে রোজগার করবে বিদেশে পাড়ি দেবে তুই তখন দর্জির দোকান খুলে বসবি। পুরুষ মানুষ হয়ে কুলাঙ্গারের মতো মেয়েদের কাপড়ের মাপ নিবি আর মেয়েলীপনা করে বেরাবি’ ইত্যাদি। ও মুখ নীচু করে সেদিন সব শুনেছিলো, শুধু দাঁত চেপে নিজের জেদ বজায় রাখতে।
অনেক রাতে মা ওর ঘরে এসে বলেছিলো— ‘বাবার ওপর রাগ করিস না। আসলে ওর মতে ওর নিজের ছেলে ডাক্তারীতে চান্স পেয়েও শেষে দর্জি হতে চায়। এটা মানতেই পারছে না। তুই তো জানিস ওর স্বপ্ন ছিলো তোকে বড়ো ডাক্তার বানানোর’।ঋক চোখের জল মুছে শুধু্ ওর মাকে বলেছিলো—’এই দর্জি হওয়াটাই আমার স্বপ্ন। তাতে আমায় পাড়ার মোড়ে দোকান দিতে হলে তাই দেবো’। এরপর হয়তো মাই বাবাকে বুঝিয়ে ছিলো। যাইহোক ও শেষমেশ ফ্যাশন ইনস্টিটিউট এ ভর্তি হয়ে গেছিলো। শুধু ভর্তির ফর্মে অভিভাবকের জায়গায় বাবার বদলে মার সাইন ছিলো। এরপর থেকে বাবা ওর সাথে কথা বলাও অনেক কমিয়ে দেয়। ঋক মনে মনে দুঃখ পেলেও ওর লক্ষ্য তখন নামকরা ডিজাইনার হওয়ার। তাই সব ভুলে ও ওর কেরিয়ারে মন দিয়েছিলো।
পর্ব ৩ :-
‘এক্সকিউস মি স্যার, ডু ইউ নিড এনিথিং?’ অতীতের স্মৃতি চারণ করতে করতে ঋকের চোখটা লেগে গেছিলো। এয়ারহোস্টেস গলার আওয়াজে ও চোখ খুলে ‘নো থ্যা্ংস’বলে উত্তর দিলো। হোস্টেস মেয়েটি অল্প হেসে চলে গেলে ও আবার চোখ বুজলো।
মনে আছে, ওর তখন ফ্যাশন কোর্সের সেকেন্ড ইয়ার চলছে। একদিন হঠাৎ ক্লাস অফ্ হয়ে যাওয়ায় ও প্রায় দুপুর দুপুর বাড়ি ফিরছিলো।এমন সময় অজিতদা পিছন থেকে ডেকে ওকে দাঁড়াতে বলে,ওর সাথে খুব জরুরি কথা আছে। অজিতদা হলো ওদের পাড়ার তরুণ দল ক্লাবের ক্রিকেট কোচ, আগে স্টেট লেভেলে খেলতো। কিন্তু পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে যাওয়ার পর খেলা বন্ধ হয়ে যায়। এখন ওর একটাই কাজ খুদে ক্রিকেট প্রতিভাদের বড়ো করে তোলা।
অজিতদা এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রেখে বলেছিলো ‘তোদের ঘরে প্রতিভাবান ক্রিকেটার আছে, আমার ওকে চাই, তুই ব্যবস্থা করে দে।’ ঋক কথাটা শুনে প্রথমে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো কার কথা বলছো। উত্তরে অজিতদাই বলেছিলো রুমির মধ্যে নামকরা ক্রিকেটার হওয়ার সম্ভাবনা আছে। ও শুনেই না করে দিয়েছিলো।ওর এই ফ্যাশন কোর্সের জন্য বাড়িতে কত ঝামেলা হয়েছে। তারপর ওদের বাড়ির মেয়ে হয়ে রুমি মাঠে খেলতে নামবে এতো অসম্ভব কথা। সেদিন অজিতদাই ওকে বুঝিয়ে বলেছিলো— ‘দ্যাখ মেয়েরা এখন ওনেক এগিয়ে গেছে। আমাদের জাতীয় মহিলা দলের মেয়েরাও তো কারোর ঘরের মেয়ে। আমাদের যেমন সৌরভ গাঙ্গুলি আছে তেমনি ঝুলন গোস্বামীও তো আছে। আমারতো ক্রিকেটটা হলো না আমি রুমির মধ্যে দিয়ে আমার স্বপ্নটা পূরণ করতে চাই। শুধু মেয়ে বলে ওর প্রতিভাটা নষ্ট হতে দিস না’। ঋক সেদিন দেখছি বলে বাড়ি চলে এসেছিলো। রাতে ও রুমিকে জিজ্ঞেস করেছিলো —’তুই যে ক্রিকেট নিয়ে এতোদূর এগিয়ে গেছিস, জানাসনি কেন?’। ও উত্তরে বলেছিলো—’ভয় পেয়েছি রে, চোখের সামনে তোর ফ্যাশন নিয়ে পড়ার জন্য ঝামেলা হতে দেখে আর বলতে পারি নি। তার উপর আমি মেয়ে বলে হয়তো খেলাটাই বন্ধ হয়ে যেতো।’ ঋক বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো — ‘সামনে কিন্তু অনেক বাধা আসবে, তুই পারবি তো সব সামলাতে?’। রুমি মাথা দুলিয়ে শুধু হ্যাঁ বলেছিলো। এরপর থেকে রুমি কি করে সব সামলে খেলা চালিয়ে গেছে তা শুধু ও জানে।আজ মহিলা ক্রিকেটে জগতে রম্যানী চ্যাটার্জী উজ্জ্বল নাম।
ঋক চাকরি নিয়ে মুম্বাই আসার এক বছরের মধ্যে ছাপার অক্ষরে ক্রীড়া জগতে উঠতি প্রতিভা রম্যানী চ্যাটার্জীর নাম ও ছবি ছাপার অক্ষরে সবার সামনে চলে আসে। বোনকে নিয়ে ফের নতুন করে ঝামেলা শুরু হয়,ও তখন মুম্বাই এ।রোজ রাতে লতাপিসি ওকে ফোনে জানাতো রুমি কি কি সহ্য করছে। এমনই এক দিন হঠাৎ রুমি ওকে ফোনে বলে—’দাদা, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে কিন্তু আর কয়দিন পর আমার জাতীয় দলের সিলেকশন টেস্ট। এইবারটা তুই আমায় বাঁচাতে পারবি?’। ও সেদিনই কলকাতায় রওনা দেয়। ওর বাবা-মা,জ্যাঠা-কাকা থেকে শুরু করে জ্যাঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে ও পাত্র পক্ষকে জানিয়ে ছিলো পাত্রীর এই বিয়েতে মত নেই। চলে আসার আগে ওর মা ওকে বলেছিলো-‘তুই নিজে যা হতে চেয়েছিলি আমি তাতে কখনোই বাধা দিই নি। কিন্তু রুমি মেয়ে হয়ে ঘরের মান সম্মান জলাঞ্জলি দিয়ে মাঠে ঘাটে খেলে বেড়াবে আর তুই দাদা হয়ে ওকে প্রশ্রয় দিবি এমনটা আশা করিনি। তোর বাবা ঠিকই বলে, তুই এই বংশের কুলাঙ্গার অপদার্থ ছেলে। তোর এ বাড়িতে থাকারও যোগ্যতা নেই।’ মার বলা কথা কটা ওকে বড়ো আঘাত করেছিলো। এরপর ও আর কখনো বাড়ি যায়নি।
আজ প্রায় দশ বছর হলো ঋকদের একান্নবর্তী পরিবারটা ভেঙ্গে গেছে।সবাই যে যার মতো অন্যত্র উঠে গেছে। ওর বাবা সল্টলেকে বাড়ি বানিয়ে চলে এসেছে। লতা পিসি ওদের সঙ্গেই থাকে। রুমি এখন জাতীয় মহিলা দলের নামকরা খেলোয়াড়। মা বাবা শেষ পর্যন্ত ওর খেলাটা মেনে নিয়েছে। ঋক এই ভেবে শান্তি পায় যে ও না হোক অন্তত ওর বোনটা মা বাবার কাছে থাকে।
পর্ব ৪:-
দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বেড়াতে ওর প্রায় রাত নটা বেজে গেলো। বাইরে এসে ও রুমিকে দেখতে পায়। দাদাকে দেখে রুমি ছুটে জড়িয়ে ধরতে আসলে ও মনে করিয়ে দেয় করোনার ফলে এখন চোদ্দো দিনের জন্যে ওর ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলতে হবে সবাইকে।
ঋক গাড়ির জানালা দিয়ে ফেলে যাওয়া শহরটা দেখছিলো।কত বদলে গেছে ওর শহরটা, যেন কোনো নতুন শহরে চলে এসেছে ও। রুমি গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিলো বাড়ির সবাই ওর জন্য কতটা চিন্তিত ছিলো সেই সব কথা ।ঋক ওকে জিজ্ঞাসা করেছিলো- ‘হ্যাঁরে করোনা না এলে কি মা বাবা আজও আমার কথা চিন্তা করতো না?’ রুমি ওর প্রশ্নটা এড়িয়ে শুধু বলেছিলো-‘দাদা সব মান অভিমান একদিন শেষ হয়, এইবার হয়তো আমাদেরটাও হবে।’
বাড়ি পৌছাতে পৌছাতে ওদের প্রায় দশটা বেজে গেলো। এতদিন এই বাড়িটার ছবিই দেখেছে ও। প্রথমে ওর কেমন বাঁধো বাঁধো লাগছিলো। কিন্তু দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা মা আর লতা পিসিকে দেখে ওর সব দ্বিধা দ্বন্দ কেটে চোখ ছাপিয়ে জল চলে এলো। ইচ্ছা হলো ছুটে গিয়ে মা আর পিসিকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পরক্ষনে ও ইচ্ছাটা সংবরন করে নেয়, এই মুহূর্তে ও যে কারোকে স্পর্শ করতে পারবে না। তাই দূর থেকেই ও মা আর লতা পিসিকে প্রণাম করে। মা-ই ওকে বাবার কাছে নিয়ে যায়। আজ দুই বছর হলো ওর বাবা রিটায়ার্ড করেছে। ঋক দেখে সেই ঝকঝকে লম্বা মানুষটার ওপর কেমন যেন বার্ধক্যের ছাপ পড়েছে। ও বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ওর বাবা খাটে আধশোয়া হয়ে পেপার পড়ছিল ওকে দেখে উঠে বসে। ঋক কিছুটা ইতস্তত করে অল্প দূরত্ব রেখে বাবাকে প্রণাম জানায়, বাবাও হাতটা তুলে ওকে আশীর্বাদ করে। ওর খুব ইচ্ছা করে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে কিন্তু ও আজ নিরূপায়।
রাতে খাওয়ার টেবিলে অনেক দিন পর ঋক সবার সাথে খেতে বসলো।সব ওর পছন্দের খাবার, মা আর পিসি মিলে রেঁধেছে। খেতে খেতে সবটা ওর কাছে স্বপ্ন মনে হচ্ছিল।
সকালে ফোনের আওয়াজে ঋকের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। কলকাতার জনপ্রিয় পত্রিকা থেকে ওদের দুই ভাইবোনসহ পুরো পরিবারের এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ চায়। ও প্রথমে না-ই বলে দিয়েছিলো। কিন্তু উল্টোপ্রান্ত থেকে মহিলা রিপোর্টারের নাছোড় অনুরোধে শেষে বাধ্য হয়েই রাজি হতে হলো। ঠিক হলো তিনটের সময় রিপোর্টার আসবে। ফোনটা রেখে ও রুমিকে ইন্টারভিউয়ের কথা জানালে ও বলে ওর কাছে আগেই ফোনটা এসেছে। ঋক রুমিকে জিজ্ঞেস করে মা বাবা কি ইন্টারভিউয়ের জন্য রাজি হবে। রুমি মুচকি হেসে উত্তর দেয়-‘হুমম্ হবে, বলেছিলাম তো ওরা আর আগের মতো নেই।ও নিয়ে চিন্তা করিস না, আমি ম্যানেজ করে নিয়েছি। তুই শুধু টাইমে তৈরি হয়ে নিস’।
পর্ব ৫:—
তিনটের একটু আগেই সেই রিপোর্টার ও তার সাথে এক ফটোগ্রাফার চলে এলো। প্রথমেই ওদের সকলের একপ্রস্থ ফটোশুট হলো। তারপর কাঁটায় কাঁটায় তিনটের সময় চা আর স্ন্যাকস নিয়ে সকলে ড্রইং রুমে এসে বসলো। রিপোর্টার মেয়েটির নাম সৃজা মিত্র। ঋক রুমির কাছে আগেই শুনেছে রিপোর্টার হিসেবে এর বেশ নামডাক আছে।
সৃজা চায়ের কাপে ছোট্ট করে চুমুক দিয়ে টেপ রেকর্ডারটা চালিয়ে দিলো। তারপর ঋকের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো–’আচ্ছা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়ে এমন পেশায় আসতে কোনো বাধা পাননি ?’।ঋক একটু চুপ করে থেকে উত্তর দিলো-‘না পাইনি।আমি আমার পরিবারকে সাপোর্টারের মতো সবসময় পাশে পেয়েছি।’ আচ্ছা তাহলে তো আপনি খুবই ভাগ্যবান, সৃজার কথায় ঋক সায় দিয়ে হ্যাঁ বলল। পরের প্রশ্ন রম্যানীকে -‘আজ আপনি ক্রিকেট জগতের একজন জনপ্রিয় নাম। কিন্তু শুরুর সময়ে মেয়ে বলে কোনো বাধা আসেনি,মাঠ বা মাঠের বাইরে ?’ রুমি প্রশ্নটা শুনে প্রথমে ওর বাবার দিকে তাকিয়ে দেখলো, বাবার মুখটা থমথম করছে। ও ঋকের সাথে একবার চোখাচুখি করে উত্তর দিলো-‘না, আমিও এই দিক দিয়ে ভাগ্যবান’। সৃজা বললো সত্যিই তাই, না হলে ছেলে বা মেয়ে বলে বাঁধাধরা নিয়মের বাইরে গিয়ে এমন পেশায় সফল হওয়া, পরিবারকে সবসময় পাশে পাওয়া, আজও এতো আধুনিক হয়েও কয়জন মা বাবা তাদের সন্তানদের এতটা সাপোর্ট করতে পারে। আপনারা কিন্তু এই দিক দিয়ে উজ্জ্বল ব্যাতিক্রম।
হঠাৎ ওদের বাবা গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন -‘ওদের কথায় সত্যি নেই, সত্যিটা হলো ওরা আজ যে নাম সাফল্য পেয়েছে তার সবটাই ওদের চেষ্টায়। আমরা বিশেষ করে আমি ওদের পছন্দ অপছন্দকে কখনোই বুঝতে চাইনি।’ ঋক ওর বাবাকে থামাতে গেলে তিনি ওকে মৃদু ধমক দিয়ে বললেন -‘আমাক বলতে দাও, আমি চাই না,আমি যে ভুল তোমাদের সাথে করেছি, অন্তত অন্য মা-বাবারা সেই ভুল আর না করেন।’ এই বলে তিনি অতীতের সব কথা বলতে শুরু করলেন। সবশেষে তিনি বললেন-‘আমাদের সব থেকে বড়ো ভুল আমরা গতেবাধা ধারণার বাইরে আর কিছু ভাবতেই পারি না, আমরা ভাবি মেয়ে মানে ও সাজগোজ করবে, রান্না করবে আর বয়স হলে বিয়ে দিতে হবে।আর ছেলে মানে ওকে ভালো চাকরি করতেই হবে, ক্রিকেট ফুটবল নিয়ে মেতে থাকতে হবে। এর বাইরে কিছু দেখতে আমরা অভ্যস্থ নই, আর কিছু নতুন দেখলে আমরা তার বিরুদ্ধে চলে যাই।আজ আমি সবাইকে এইটুকু বলতে চাই শুধু ছেলে বা মেয়ে বলে সন্তানদের পছন্দ অপছন্দের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবেন না। ওদের নিজেদের মতো করে বড়ো হতে দিন, সেটাই আপনার সবচে বড়ো কতর্ব্য’। এই বলে তিনি একটু থামলেন। তারপর ধরা গলায় ঋক রুমির দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন-‘আমি তোদের অপরাধী বাবা তোরা আমায় ক্ষমা করে দে।’ ওদের দুই ভাইবোনের চোখ থেকে তখন জলের ধারা বইছে।
অনেক দিন পর রাতে খাওয়া দাওয়ার শেষে সকলে মিলে আড্ডা দিতে বসলো ঋকদের পরিবারে পাথরের মতো চেপে বসে থাকা রাগ দুঃখ অভিমান গুলো আজ সব গলে জল হয়ে গেছে। হাসি ঠাট্টার মাঝেই ওদের মা গান ধরলেন। ওদের বাবা ফিসফিস করে ওদের বললেন -‘তোদের মার সংসারটা আবার আজ জোড়া লেগে গেছে দ্যাখ কেমন গলায় গান এসেছে, আজ আমি বড়ো শান্তি পেয়েছি রে।’
পুনশ্চ :-
ওদের গান গল্পের মাঝেই রুমির ফোনটা বেজে উঠলো। ও পাশের ঘরে উঠে গিয়ে কলটা ধরলো।ও প্রান্ত থেকে সৃজার গলা ভেসে এলো-‘হ্যাঁরে তোর ঘরের কি অবস্থা?’। রুমি উত্তর দিলো-‘সব ঠিক হয়ে গেছে।সবাই পাশের ঘরে বসে গল্প করছে। তুই বল তোর কাজ হলো?’। সৃজা খুশিতে উৎফুল্ল হয়ে উত্তর দিলো-‘কাজ হলো কিরে, বস্ তো অলরেডি হেব্বি খুশি ইন্টারভিউটা শুনে।বলেছে এক্সক্লুসিভ কভারেজ হবে’। রুমি একটু হেসে বললো-‘হ্যাঁ,এতটা যে হতে পারে তা আমিও ভাবিনি। যাক সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেছে।এখন রাখলাম রে, পরে কথা বলছি।’ এই বলে ও ফোনটা কেটে দিলো।
আজ অনেক দিন পর রুমিও শান্তিতে ঘুমাবে। ওর সবসময় নিজেকে অপরাধী মনে হতো এই ভেবে যে ওদের পরিবারটা এই ভাবে ভেঙ্গে যাওয়া, দাদার এতোটা দূরে চলে যাওয়া সব কিছুর জন্যে দায়ী ও নিজে। আজ ওর মনের সেই অপরাধবোধের অবসান হলো। লক ডাউনের এই কঠিন সময়ে ওদের পরিবারটা আবার এক হয়ে গেছে। সব খারাপেরই কিছু হয়তো ভালো দিক থাকে, লক ডাউনটারও নিশ্চয় আছে।
bongqthemagazine.wordpress.com/2021/01/06/%e0%a6%97%e0%a6%aa%e0%a7%8d%e0%a6%aa%e0%a7%8b-%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6
লকডাউন পর্ব ১ :- ওরলির রানওয়ে ছেড়ে প্লেনটা ভারতের আকাশ পথ ধরলো। এর কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে ঋক সিটবেল্ট খুলে ল্যাপটপটা ...