27/11/2020
ছাদ / --------- প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়
আমার মেসোমশায় যামিনী দেবনাথ ছিলেন একজন নামকরা আয়ুর্বেদাচার্য্য।তাঁর বসার ঘরের সামনে একটা লম্বা বারান্দায় দড়ির একটা দোলনায় তিনি বসে থাকতেন।একটা প্রকাণ্ড স্ট্যান্ডফ্যানের হাওয়ায় তাঁর কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলগুলো ফুরফুর করে উড়ত,রোগীর নাড়ি টিপে চোখ বুজে তিনি মৃদু মৃদু হাসতেন,আর তারপরই বজ্রগর্ভে হাঁক দিতেন,"প্যাংলা,বেরজো,
তোরা গেলি কোথায়?"প্যাংলা অর্থাৎ প্রলয়দেব এবং বেরজো অর্থাৎ ব্রজ ছিল মেসোমশায়ের শিক্ষানবীশ।তারা যে যেখানে থাকতো সেখান থেকেই দৌড়ে আসত।মেশোমশায় তাদের নির্দেশ দিতেন কোন রোগীকে কি কি ওষুধ দিতে হবে ।তাদের রোগ তো সারতই কিন্তু বিপদ হয়েছিল মেশোমশায়ের। রোগীর সংখ্যা যেহারে বেড়ে যাচ্ছিল তাতে নাওয়াখাওয়া বন্ধ হওয়ার যোগাড় হয়েছিল ।
মেসোমশায়ের একমাত্র ছেলে স্বপন ছিল একেবারে অন্যরকম।হয়তো আমরা সবাই মেসোমশায়ের কাছে বসে গল্প করছি। সবাই রয়েছে কিন্তু স্বপন কোথায়?কোথাও স্বপনকে পাওয়া যাচ্ছেনা।আমি অবশ্য জানতাম ওর গোপন ডেরাগুলো।সোজা হাজির হতাম ওদের বাড়ির পেছনে পুকুরপাড়ে,কিংবা পুকুরের ধার দিয়ে সরুপথটা ধরে হেঁটে গেলে যেখানে জলাজঙ্গল মতো একটা জায়গা আছে,সেখানে।প্রায় প্রত্যেকবারই অপরিবর্তিতভাবে আবিষ্কার করতাম স্বপন বসে আছে নিবিষ্ট হয়ে।তার স্বপ্নময় চোখদুটি গাছগুলির বাতাসে শিরশির করা পাতাগুলির দিকে স্থির নিবদ্ধ।মুখে একটা করুণভাব ফুটে উঠেছে।দুতিনবার ডেকেও যখন সাড়া পেতাম না তখন ঝাঁকি দিতাম,আর তখনি যেন সে ঘুম থেকে জেগে উঠত।কিছু ক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে যেন সম্বিত ফিরে পেয়ে বলত,"বলতো কী দেখছিলাম?"আমি বলতাম,"সেটাই তো জিজ্ঞাসা করছি। কী এতো ভাবছিলি যে এতবার ডেকেও সাড়া পাচ্ছিলাম না?"ও বলত,"ঐযেএকফালি রোদ দেখা যাচ্ছে,ও পাতাগুলোকে বলছিল ওর সাথে খেলতে,কিন্তু পাতাগুলো রাজি হচ্ছিলনা।তারা মাথা নেড়ে বলছিল ,না না,এখন আমাদের রান্নাকরার সময়,আমাদের গাছমাকে খাওয়াতে হবে,তোমার সঙ্গে পরে খেলব।"এই সময় ওকে আমার ভীষণ ভাল লাগত।মনে হ'ত যেন কোন স্বপ্নপুরীর রাজকুমার এইমাত্র বাস্তব পৃথিবীতে নেমেছে।একটু পরেই ডাক পড়ত আমাদের দুজনারই।মেসোমশায়ের রোগী দেখা শেষ হয়েছে;মাসিমা আমাদের সকলের জন্য থালায় সাজিয়ে রেখেছেন সাদা সাদা ময়দার লুচি,কাই কাই আলুরদম আর ভুরভুরে গন্ধ সুজির হালুয়া।এর কিছুক্ষণ পরেই জানি আসবে সরু চালের ফুরফুরে ভাতের সঙ্গে মাসিমার হাতের অপূর্ব রান্না কচি পাঁঠার মাংস । গুরুগম্ভীর গলায় মেসোমশায় জিজ্ঞাসা করতেন,"কি দীপুবাবু,কোথায় গিয়েছিলে?"মিথ্যে বলতে গিয়েও বলতে পারতামনা,এতো ব্যক্তিত্বের সামনে ।বলেই ফেলতাম এতক্ষণ কোথায় ছিলাম । মেসোমসায় বলতেন,"ঠিক আছে,যেখানে খুসি যেতে পার,শুধু ছাদে যেওনা।"মেসোমশায় এত রাশভারি মানুষ যে জিজ্ঞাসা করার সাহস হ'তনা কেন ছাদে যাওয়া যাবেনা।মসিমাকে জিজ্ঞাসা করেছি,স্বপনকেও,কিন্তু কেউই বলতে পারেনি।
কী আছে ছাদে যে সেখানে যাওয়া যাবেনা?ছাদে যাবার দরোজায় বিরাট এক তালা। চাবি থাকে মেসোমশায়ের কাছে। ঠিক করলাম,নকল চাবি তৈরী করাব। স্বপন আপত্তি করেছিল,কিন্তু আমি খুব জোর দিয়ে বলেছিলাম , "আরে আমরা তো চুরি করতে যাচ্ছিনা,শুধু দেখতে চাই কি এমন আছে যার জন্যে আমরা ছাদে যেতে পারবনা?"
যাইহোক অঘোর চাবিওয়ালাকে দিয়ে চাবি করান হল।দুপুরবেলা । এখন স্কুলে গরমের ছুটি চলছে।মেসোমশায় বাড়িতে নেই,মাসিমা রেডিও শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছেন । এই সুযোগ,চুপিচুপি সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদের দরজাটা নকল চাবি দিয়ে খুলে ফেললাম। কিন্তু এ কি দেখছি!!!ছাদে একটা নিচু ছাউনি,তার তলায় মনের সুখে চোখ বুজে জাবর কাটছে একটা বিশাল গরু। ভগবতীর শাবকটি মাঝে মাঝে ঢুঁ মারছে তার মাকে।ছাদের ওপর মেসোমশায় গরু পুষেছেন?কি আশ্চর্য!তবে আশ্চর্যের কিছু নেই । নিশ্চয় গড়ানে কোন তক্তা পেতে তার ওপর দিয়ে বাইরে থেকে গরু ও বাছুরকে তোলা হয়েছে ।মহান চিকিৎসক জানেন যে কবিরাজি ওষুধ তৈরী করতে অনেক গাছগাছড়ার সাথে মাঝে মাঝে গরুর খাঁটি দুধ দরকার হয়,যা গোয়ালার জল মেশান দুধে পাওয়া যায় না।তাই রোগীদের স্বার্থে পৌরসভার খাটাল উচ্ছেদ আইন বাঁচিয়ে এরকম একটা ঝুঁকি নিয়েছেন।