11/02/2023
‘রানী মুদিনীর গলির কথা’
একদা পুরানো কলকাতার যে গলিটির নাম ছিল ‘রানী মুদিনীর গলি’, পরবর্তীকালে সেটারই নাম হয়েছিল ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রীট’, আর সেটারই বর্তমান নাম হল ‘সিরাজুদ্দৌল্লা সরণি’। কলকাতার কিছু রাস্তার নাম অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পরিবর্তন হলেও, অতীতের কিছু নাম আজও ইতিহাস অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিদের মনে জিজ্ঞাসার ছাপ রেখে যায়। খুব বেশি দিন আগে নয়, ১৯৭০-এর দশকের কলকাতাতেও রাইটার্স বিল্ডিংয়ের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ‘সেইন্ট এন্ড্রুজ’ নামের স্কচ গির্জার মাথার ঘড়িটি ঘন্টা বাজিয়ে সময় জানান দিত। ওই ঘড়িটিই তখন ডালহৌসি স্কোয়ারে কর্মরত কেরাণীকুলের ভাগ্যবিধাতা ও হৃদপিণ্ড ছিল। ওই সময়ে ডালহৌসিতে সকাল দশটায় হাজার হাজার লোক পদার্পন করেই প্রথমে ওই ঘড়িটির দিকে নজর দিতেন। তারপরে সেই ঘড়ির নির্দেশানুযায়ী তাঁদের পা দ্রুত অথবা লঘু হত। আবার বিকেলে কাজ সেরে বাড়ী ফেরবার সময়েও তাঁদের দৃষ্টি একবারের জন্য হলেও ওই ঘড়িটির দিকে নিবদ্ধ হত। একটা দীর্ঘ সময় ধরে পথচলতি কত মানুষের দৃষ্টিকে ওই ঘড়িটি যে নীরবে হজম করেছে, তার কোন হিসাব নেই। চার্চের মাথায় সেই ঘড়িটি আজও থাকলেও, সেটি এখন আর নির্ভুল সময় বলে না; এখন আর ঘন্টাও বাজে না। ওই চার্চের কাছেই রয়েছে সেই গলিটি, সুদূর অতীতে যেটার নাম ছিল - রানী মুদিনীর গলি। সেখানে ডান পাশে আজও গ্রেট ইষ্টার্ণ হোটেলের প্রাসাদতম অট্টালিকাটি টিকে রয়েছে। ’৭০-এর দশকে সেটার নীচের তলায় ওই গলির মুখে দ্বাররক্ষীর মত নিউম্যানের বইয়ের দোকানটা দাঁড়িয়ে থাকত। বাঁ পাশে থাকা বৃটিশ ইনফরমেশন সার্ভিসের নতুন সুদৃশ্য বাড়ীটা তখন সবে জন্মগ্রহণ করেছিল। আজও ওল্ড কোর্ট হাউস দিয়ে সেই গলিটিতে ঢুকতে গেলে ওই বাড়িটি দেখে একবার হলেও দাঁড়াতে হয়। তারপরে তো কলকাতার ইতিহাস বিখ্যাত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল রয়েছেই।
ওই গলির মুখে দাঁড়িয়ে একটু কল্পনার আশ্রয় নিলেই অনায়াসে ১৭৫৭ সালের মধ্যভাগে চলে যাওয়া যায়। সেই বছরই সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেছিলেন। ইতিহাসটা জানা থাকলে, ওই গলির মুখে দাঁড়িয়ে চোখ বুজে একটু কল্পনা করলেই সেদিনের দৃশ্যপট অনায়াসেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আজকের কলকাতার জেনারেল পোষ্ট অফিসের সংলগ্ন জায়গাটি জুড়ে তখন পুরানো ফোর্ট উইলিয়ম কেল্লা দাঁড়িয়ে ছিল। সিরাজ ইংরেজদের অধিকারে থাকা সেই কেল্লা আক্রমণ করবার জন্যই কলকাতায় হানা দিয়েছিলেন। এখন যেখানে রাইটার্স বিল্ডিং রয়েছে, তখন সেটার ঠিক পিছনে একটি প্লে-হাউস ছিল। সেখানেই নবাবের সৈন্যেরা একটি ব্যারাক তৈরী করে কেল্লার উদ্দেশ্যে তোপ দাগতে শুরু করেছিলেন। ওদিকে সিরাজকে বাধা দেওয়ার জন্য সেই দুর্গের ভেতর থেকে কলকাতার গভর্নর ‘ড্রেক’ সাহেব ও ‘হলওয়েল’ মিলে ইংরেজ সৈন্যদের নিয়ে প্রাণপনে দুর্গটি রক্ষা করবার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সময়ে নবাবের সৈন্যবাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য লালদীঘির চারপাশে থাকা বিরাট বিরাট বাড়ীগুলিকে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল, ও সেখানে একটি অস্থায়ী খাতও খনন করা হয়েছিল। সে খাতের একদিকে ছিলেন নবাবের সৈন্যরা, অপরদিকে ছিলেন সৈন্যরা, আর তাঁদের উভয়ের সঙ্গী ছিল কামানের জ্বলন্ত গোলা। উভয় পক্ষের মধ্যে গলা ছোঁড়াছুঁড়িতে সেই সময়ে ওখানে যে কয়টা বড় বড় বাড়ী ছিল, সেগুলোর অধিকাংশই হয় কামানের গোলার কবলে পড়ে ধরাশায়ী হয়েছিল, আর নয়ত পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল। তখন ইংরেজরাও ওই অঞ্চলের চারিদিকে তোপমঞ্চ তৈরী করে কামান দেগে নবাবের সৈন্যদের তাড়াবার তোড়জোড় করেছিলেন। লালদীঘির চারিদিকেই তখন তোপমঞ্চ তৈরী করা হয়েছিল। ওই সময়ে ওল্ড কোর্ট হাউস স্ট্রীটেই দুটো তোপমঞ্চ ছিল। এখন যেখানে অতীতের ক্লাইভ স্ট্রীট বা বর্তমানের নেতাজী সুভাষ সরণি, সুদূর অতীতে যেখানে কোম্পানীর সোরার গুদাম ছিল, সেখানেও একটি তোপমঞ্চ তৈরী করা হয়েছিল। তাছাড়া অতীতের হেষ্টিংস হাউস স্ট্রীট, কাউন্সিল হাউস স্ট্রীট আর গভর্ণমেন্ট প্লেসের সন্ধিস্থলেও ইংরেজরা তখন একটি তোপমঞ্চ বানিয়েছিলেন। আর ওই রানী মুদিনীর গলির মুখেও একটি তোপমঞ্চ ছিল। কিন্তু তখন অত কিছু করেও ইংরেজরা কলকাতাকে রক্ষা করতে পারেন নি। সিরাজ অনায়াসে তাঁদের হাত থেকে কলকাতা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। তারপরে তিনি সেই সময়ের কলকাতায় থাকা ইংরেজদের বড় বড় গির্জাগুলিকে ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছিলেন। বিখ্যাত সেইন্ট এন্ড্রুজ গির্জাও সেই সময়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সে দিনের সেই রানী মুদিনী গলিই পরবর্তীকালে বৃটিশ ইণ্ডিয়ান স্ট্রীট হয়ে এখন সিরাজুদ্দৌল্লা সরণি। একদা ওই পথের পাশেই বৃটিশ ইণ্ডিয়ান বা জমিদার সভার অবস্থান ছিল বলে রাস্তাটির নাম হয়েছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রীট। ওই গলিটিই এখনো প্রমান করে যে সুদূর অতীতে কলকাতা শহরে সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের তুমুল একটা যুদ্ধ হয়েছিল। তখন ইংরেজরা ওই গলির মধ্যে ঢুকে লুকিয়ে লুকিয়ে নবাব সৈন্যদের ওপরে গোলাবর্ষণ করেছিলেন, আর নবাবের সৈন্যরাও ইংরেজদের নিধন করবার জন্য সেই গলির মধ্যেই ঢুকে পড়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে সুপ্রসিদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিদ ‘এ. কে. রায়’ ও ইংরেজ ঐতিহাসিক ‘মিঃ কটন’ বলেছিলেন যে, সেই থেকেই ওই গলির নাম হয়েছিল - ‘রণ মর্দ গলি’। আর সেই রণ মর্দ থেকেই নাকি পরবর্তীকালে রানী মুদি নামটি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কোনটা যে ঠিক সেটা নিয়ে আজও সন্দেহ রয়েছে। রানী মুদি থেকে রণ মর্দ, নাকি রণ মর্দ থেকে রানী মুদি? রণ মর্দ যদি নাম হয় তাহলে সেই নামের একটা অর্থ পাওয়া যায়। কিন্তু রানী মুদিনীর গলি হলে সেই রানী মুদিনীর অস্তিত্ব এখন কোথায়? ওই গলির মধ্যে কোথায় সেই মেয়ে মুদিনীর মুদির দোকান ছিল? এখন ওখানে সেসবের কোন চিহ্ন পাওয়া অসম্ভব। ওই পথটি ধরে সামনে এগিয়ে গেলে দেখা যাবে যে সেটা ক্রমে সরু হয়ে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটের সঙ্গে মিশে গিয়েছে। আগে ওখানে অনেক পুরানো বাড়ী ছিল। এখন দু’-একটা বাদে বেশিরভাগই নতুন বাড়ী। শোনা যায় যে, অতীতে ওই সব বাড়ীতে নাকি ইহুদীরা বাস করতেন, তাঁরা নাকি রাতের অন্ধকারে ওই সব বাড়ীর দরজায় দাঁড়িয়ে পথচারীদের প্রলুব্ধ করে নিজেদের ঘরে নিয়ে যেতেন। একদিন কলকাতার ওই জায়গাটি যে বারবনিতাদের আস্তানা হয়ে উঠেছিল - সে কথাও এখন গল্প। অতীতে ওই রানী মুদিনী গলির মুখে একটি কাঠের বন্ধনী ছিল। ’৭০-এর দশকে ওই গলিতে যেখানে কুক এণ্ড কেলভে কোং ছিল, ঠিক সেটার পাশ দিয়েই তখন লারকিন্স লেন শুরু হত। তখন ওয়েলেসলী প্লেস পার করে সেই লারকিন্স লেন দিয়ে একটা কাঠের রক্ষা বন্ধনী রাণী মুদিনীর গলি পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। অতীতে ওই ধরণের রক্ষা বন্ধনী সারা কলকাতার চারিদিকে ছিল। আসলে, সেকালের কলকাতাকে কেবলমাত্র দুর্গ দিয়ে সুরক্ষিত করা সম্ভব ছিল না বলেই শহরের চারিদিকে একটি সুদীর্ঘ কাঠের রক্ষা বন্ধনী দিয়ে শহরকে সুরক্ষিত করবার একটা চেষ্টা করা হয়েছিল। তাতে আর কিছু না হোক, তখনকার দিনের কলকাতা শহরে অন্ততঃপক্ষে চোর ডাকাতের ঢোকবার অসুবিধে হয়েছিল। কিন্তু রানী মুদিনী কোথায় তাঁর দোকান তৈরী করেছিলেন? কোথায় সেই সুন্দরী মহিলা মুদিনী দোকানের পাটায় বসে দাড়িপাল্লায় ওজন করে জিনিষ বিক্রী করতেন, আর ওই চত্বরের সব লোক তাঁর দোকানে ভীড় জমিয়ে জিনিষ সওদা করতেন? হয়ত শুধু জিনিষ কেনাই তাঁদের উদ্দেশ্য ছিল না, রানী মুদিনীর মিষ্টি কথা, চটুল চাউনি, মধুভরা হাসি - সে সবও হয়ত তাঁদের উপরি পাওনা ছিল। এসবই অবশ্য কল্পনা। কিন্তু তবুও যদি চিন্তার আরো গভীরে ঢোকা যায় তাহলে প্রশ্ন জাগে যে, রানী মুদিনীর বয়স কত ছিল? তিনি কি দেখতে সুন্দরী ছিলেন? তা না হলে কলকাতার ইতিহাসের বিখ্যাত রানী মুদিনী তখনকার দিনে কেমন করে ইংরেজদের করুণা লাভে ধন্য হয়েছিলেন? তিনি কি যাদু জানতেন? কোন আকর্ষণে তিনি কোম্পানীর কাছ থেকে অত বড় উপাধিটা পেয়ে গিয়েছিলেন? তিনি সেই সময়ের কোন সম্মানী ইংরাজের মনের মানুষ ছিল কিনা - সেটার কোন ইতিহাস সেই সময়ের ঐতিহাসিকেরা লিখে যান নি। তাই সবই এখন প্রশ্ন হয়ে রয়ে গিয়েছে। তবে এটুকু বলা যেতে পারে যে, চন্দ্রনাথ পাল যেমন চাঁদ পাল ঘাটে মুদির দোকান করে বিখ্যাত হয়েছিলেন, তেমনি ওই গলিতে রানী মুদিনী। তবে কারণ যেটাই হোক না কেন, এটাই সত্যি যে রানী মুদিনী আজও প্রাচীন কলকাতার ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হয়ে বেঁচে রয়েছেন, আর ভবিষ্যতেও থাকবেন।