16/07/2022
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর-- পাকিস্তান এয়ারওয়েজের (পিআইএ) ৭২০বি উড়োজাহাজটি ফ্রান্সের অর্লি বিমানবন্দর থেকে যাত্রা করার কথা পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে। যাত্রীবেশে বিমানে ঢুকে পড়েন ২৮ বছর বয়সী টগবগে এক ফরাসি যুবক "জ্যাঁ কুঁয়ে" । তিনি ককপিটে ঢুকেই পাইলট আর কো-পাইলটের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে ঘোষণা দিলেন বিমানটি ছিনতাই হয়েছে এবং কেবলমাত্র তাঁর দাবি পূরণ করা হলেই বিমানটি রক্ষা পাবে।
এ সময় জ্যাঁ কুয়ের বুকে ছিল একটি ব্যাগ, সেটি দেখিয়ে তিনি বলেন, এটি একটি শক্তিশালী টাইমবোমা। আমার দাবি মানা না হলে এটির সুইচ টিপে ফাটিয়ে ফেলা হবে। এতে যাত্রীসহ পুরো বিমান ধ্বংস হবে। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি বিমানবন্দরসহ পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
২৮ বছরের এক যুবক ছিনতাইকারী। তার দাবি আর কিইবা হতে পারে! কাড়ি কাড়ি টাকা, সম্পদ এই তো! কিন্তু সকলেই ভীষণ হতবাক হয়ে পড়ে তাঁর দাবিকৃত মুক্তিপণের বিষয়টি শুনে। মুক্তির পণ হিসেবে তিনি যা চেয়েছিলেন সেটা সেদিনের প্রেক্ষাপটে, মানব ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে তো অবশ্যই অতি আশ্চর্যের বিষয়।
জ্যাঁ কুয়ে সংবাদমাধ্যমে জানতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের দোসরদের ভয়ে বাংলাদেশ নামে একটি পরাধীন দরিদ্র দেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে খাদ্য ও চিকিৎসার অভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। কুঁয়ে ছিনতাইকৃত বিমানের বদলে চাইলেন অসহায় মানুষগুলোর জন্য মেডিকেল যন্ত্রপাতিসহ ২০ টন ঔষধ এবং যথাযথ পরিমাণে খাদ্যদ্রব্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হতাহতের খবর বিভিন্ন সংবাদপত্র এবং অন্যান্য মিডিয়ার মাধ্যমে জেনে এই যুবকের প্রাণ বারবার কেঁপে উঠেছে। তাঁর মন এই মানুষগুলোর মানবেতর জীবনের কথা ভেবেছে। কিন্তু নিজের পরিণতির কথা তিনি একবারও ভাবেননি। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন ধরা পড়লে অথবা ব্যর্থ হলে তাঁর নিয়তি। জানতেন কাজটিতে ঝুঁকির মাত্রাও।
তবুও জ্যাঁ কুয়ে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারেননি। হাজার মাইল দূরের ভিনদেশী এই ফরাসি যুবক, অজানা অচেনা এক পরাধীন বাংলাদেশের মানুষের জন্য তাঁর জীবন বাজি ধরলেন।
বিমানটির দখল নেওয়ার পর আশ্বস্ত করা হয় তার দাবি মেনে নেয়া হবে। এই আশ্বাস দিয়ে রেডক্রসের কর্মী এবং উড়োজাহাজের টেকনিশিয়ান হিসেবে দুজন কর্মী বিমানে ঢুকে পড়ে। আসলে তারা ছিল ছদ্মবেশী পুলিশ। তারা কৌশলে জ্যাঁ কুঁয়েকে বিমান থেকে নামিয়ে আনে।
এক পর্যায়ে গ্রেপ্তার করা হয় তাকে। আর বুকে ছোট ব্যাগে বোমা আছে উল্লেখ করে সেটি বিস্ফোরণ ঘটাবেন বলে যে ভয় দেখিয়েছিলেন সেই ব্যাগে পাওয়া গেল দুটো ডিকশনারি ও একটি বাইবেল।
এরপর জ্যাঁ কুঁয়ের বিচার করা হবে বলে ঘোষণা দেয়া হলো। কিন্তু সে সময়ে যত সাক্ষী ছিলেন এবং যারা এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তাঁরা প্রত্যেকে সাক্ষ্য দিলেন, জ্যাঁ কুঁয়ে যা করেছেন তা মানবতার জন্য, মানুষের জন্যই। কারো ক্ষতি করেননি এবং আদতে তা করতেও চাননি, সে উদ্দেশ্য তাঁর ছিলও না।
তবুও শেষ রক্ষা হলো না। ফরাসি সরকার সেদেশের আইন অনুযায়ী তাঁকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়। তবে ক্যুঁয়ের দাবি অনুযায়ী ফ্রান্স সরকার বাংলাদেশকে ২০ টন মেডিকেল সরঞ্জাম পাঠিয়েছিল। এই ঘটনার আগে বা পরে কখনো বাংলাদেশে আসেননি তিনি, শুধু নিপিড়িত মানুষদের ভালোবেসেছেন দূর থেকে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এই না বলা সত্য ইতিহাস নিয়ে প্রথম ইংরেজি ভাষায় আন্তর্জাতিক সিনেমা ‘জেকে ১৯৭১’ নির্মাণ করলেন পরিচালক ফাখরুল আরেফিন খান।
(তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট)