27/06/2022
অনুভূতি…
পায়েল মণ্ডল
[পারফিউম এবং আউট অফ ডার্ক এর ভাবানুবাদ প্রকাশনা উপলক্ষে 'নট ফর সেল' এর ভিডিও বাণীর উত্তরে অনুবাদক পায়েল মণ্ডল তার অনুভূতি প্রকাশ করেছেন]
"প্রথমেই আন্তরিক ধন্যবাদ শিরিন শবনম এবং প্রকাশককে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে অসাধারণ একটি কনজয়েন্ড ভাবানুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হলো। নিঃসন্দেহে এটি একটি আভঁ-গার্দ প্রকাশনা। শুধু প্রচ্ছদ নয় গ্রন্থটির প্রতিটি পাতায় যেন যত্নের সুস্পষ্ট ছোঁয়া। নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, প্রকাশক বইটির বিষয়বস্তুর সাথে সুবিচার করেছেন। প্রকাশক যেন শিল্পের অনবদ্য নান্দনিকতা ছড়িয়ে দিয়েছেন প্রচ্ছদ থেকে গ্রন্থটির পাতায় পাতায়। গ্রন্থটি পাঠকদের শুধু দৃশ্যমানতায় সীমাবদ্ধ রাখে না বরং যেমনটি প্রকাশক বলেছেন, এটি স্পর্শঅনুভূতিকে আবিষ্ট করে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সম্মানিত পাঠকবৃন্দ পারফিউমের মহাকাব্যিক সুগন্ধিতে হারিয়ে যাবেন, প্রতিটা মুহূর্ত হবে পাঠানান্দে পরিপূর্ণ এবং 'আউট অফ দ্যা ডার্ক' এর বোহেমিয়ানিজমের সাথে যাত্রা করে পৌঁছে যাবেন মর্ডানিস্ট মানুষের যাপিত জীবনে। এমন গ্রন্থ ভাষান্তর করা যায় না, তা করলে মূল গ্রন্থের ভাষার সৌন্দর্য, চরিত্রদের চিন্তার প্রবাহ চিত্রিত হয় না, ক্ষুন্ন হয় মূল লেখকের বার্তা! ভাষান্তরিত গ্রন্থটি হয়ে পড়ে শব্দের সমাধি। সম্মানিত পাঠকেরা বঞ্চিত হন সাহিত্যের রসাস্বাদন থেকে। আমি এটাই মনে করি।
আমার ভাবানুবাদের প্রচেষ্টা কোন পেশাদার লিখিয়ে হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস থেকে নয় বরং পাঠানন্দে বিভোর হয়ে বন্ধুদের সাথে সেই আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়ার ইচ্ছে থেকে। শিরিন শবনম এবং প্রকাশককে ধন্যবাদ দিলে খাটো করা হয় তবুও এটা না বললেই নয় যে, তারাও আমার মত উপন্যাসদু'টির প্রতি একাত্ম হয়েছেন আর তারই ফলশ্রুতিতে বাংলা ভাষাভাষী পাঠক হাতে পেতে যাচ্ছেন অসাধারণ দু'টি উপন্যাসের বাংলা ভাবানুবাদ।
প্লানেট আর্থের কোন ওয়ার্ক অফ আর্টই নিখুঁত নয়, এই ভাবানুবাদ গ্রন্থে কোন ত্রুটি থাকলে পাঠকরা মার্জনা করবেন, তবে পরের সংস্করণে ত্রুটিগুলো সংশোধনের দাবি রাখে! দু'টি ভিন্ন মেজাজের, ভিন্ন সময়ের পটভূমির গল্প, ভিন্ন বিষয়বস্তু এবং ভিন্ন স্তরের ভাষার উপন্যাসকে প্রকাশক একটি ফ্রেমে বন্দি করে, করেছেন বাংলাদেশে প্রথম ‘কনজয়েন্ড এডিশন'।
উপন্যাসদু'টির এতো ভিন্নতা থাকলেও দুই লেখকই তাদের কেন্দ্রীয় চরিত্রদের মাধ্যমে চিত্রিত করেন মানুষের একাকিত্বকে - যা সময়োত্তীর্ণ হয়ে ধ্রুপদী শিল্প হয়ে পাঠকদের বোধে ধরা দেয়। এ কথা অনস্বীকার্য যে, এভাবেই এই ভাবানুবাদ গ্রন্থ বাংলাদেশে এক এবং অদ্বিতীয় ‘কনজয়েন্ড প্রকাশনা'র সম্মানে সম্মানিত হবে।
সম্মানিত পাঠকেরা শুধু উপন্যাসের গল্পই পড়বেন না তারা যাত্রা করবেন চরিত্রদের বিচিত্র মনোজগতের জিগ'স পাজলে। নিঃসন্দেহে বলা যায় পাঠকেরা দ্রব হয়ে যাবেন গল্পের গতিময়তায়, চরিত্রদের বহুবর্ণময় মনোজগতে, টানটান উত্তেজনায়, পরবর্তি ঘটনা কী ঘটবে সেটা জানার জন্য। অর্থাৎ পাঠকেরা যেন পুরো বন্দি হয়ে যাবেন উপন্যাসদু'টির হিপনোটিক স্পেলে। পাঠক হিসেবে যেমনটা আমি হয়েছিলাম। কথা দেয়া যেতে পারে পাঠকেরা মূল উপন্যাসের মেজাজ থেকে কখনোই বঞ্চিত হবেন না।
উপন্যাসদু'টির ভাবানুবাদক হিসেবে নয়, বরং একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার অনুভূতি - নট ফর সেল ক্লাবের এই অসাধারণ প্রকাশনা অনবদ্য শৈল্পিক কারুকাজে মূল লিখিয়ে এবং ভাবানুবাদকের লেখাকে সম্মাননা জানিয়েছেন। একজন পাঠক হিসেবে আমার এটা নিয়ে কিছু বলার কোনো অবকাশই রাখেনি প্রকাশনা শিল্পে নবীন ‘নট ফর সেল ক্লাব’। একটি কথা না বললেই নয় - সেটা হলো, এই প্রকাশনা হাতে পেলে দেশের প্রথিতযশা প্রকাশকরা হয়তো মুহূর্তের জন্য ভাববেন একদল তরুণ প্রকাশনা শিল্পী বাংলাদেশের প্রকাশনার দিগন্তে উড়িয়ে দিয়েছেন শিল্পচ্ছটায় জ্যোতিবিদলিত পতাকা!
'পারফিউম'! সেই ১৯৯১ সালে বইটির সাথে প্রথম পরিচয়।
এলিফ্যান্ট রোড হয়ে শাহবাগের সিনোরিটায় আড্ডা দিতে যাওয়ার এবং ফেরার পথে পড়তো আজিজ সুপার মার্কেট। আজিজ সুপার মার্কেট তখন এতো রমরমা ছিল না। মার্কেটের শাহাবাগ প্রান্তের সর্বশেষ কোণে বইয়ের একটি দোকান ছিল। নাম ভুলে গিয়েছি সম্ভবত 'পাঠক সমাবেশ'! ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে গেলে ওটার কাচে মোড়া ডিসপ্লেতে 'পারফিউম' এর কপি দেখতে পেতাম। অনবদ্য প্রচ্ছদের সোনালী অক্ষরে স্পট প্রিন্টেড শিরোনাম – 'পারফিউম' আমাকে টানতো। কিনবো, কিনছি করে কেনা হয় না।
ঐ সময়টাতে আমি কবি শামসুর রহমানের সম্পাদিত বাংলা সাপ্তাহিক - 'মূলধারা' এবং ইংরেজি পত্রিকা - 'দ্যা নিউ পেপার' এ এ্যাসিসটেন্ট এডিটরের পদে কর্মরত ছিলাম। ইস্কাটনের পত্রিকা অফিসে দূর্দান্ত আড্ডা জমতো পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক প্রয়াত বেনজির ভাই, সহকারী ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আলী সানোয়ার মিলন, প্রতিবেদক চুন্নু ভাই এবং আরো অনেকে মিলে। পত্রিকা পেস্টিং এর রাতে আমরা সবাই সারা রাত কাজ করতাম। এমন এক রাতে চুন্নু ভাইয়ের হাতে দেখি ‘পারিফিউম’ এর সেই কপি। প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে পড়তে শুরু করি। রাতের আড্ডা বাদ দিয়ে সারা রাত ধরে পড়ে পরের দিন দুপুরে শেষ করি। মনে পড়ে বইটি শেষ করে বাকী আধাবেলা বিষণ্ণ থাকি উপন্যাসটির প্রটাগোনিস্টের শেষ পরিণতির বেদনায়। পুরো বইটি পড়তে গিয়ে একটুও মনযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারিনি। তখনই চিন্তায় ঝিলিক দিয়ে যায় উপন্যাসটির ভাবানুবাদ করার ইচ্ছে। এরপরে অনেক বছর কেটে যায়।
২০১৯ সালের পুরোটা জুড়ে আমার নির্জন সময়ে 'পারফিউম' ছিল একমাত্র সঙ্গী। একটি দু'টি প্যারার ভাবানুবাদ এক, এক করে শেষ হয় আর নিজের অজান্তেই দেখি উপন্যাসটির পূর্ণ অবয়ব। আমার পারফিউম জার্নিতে উৎসাহ জুগিয়েছেন বাংলাদেশ, ভারত এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রবাসী বন্ধুরা - যারা ধারাবাহিকভাবে আমার ফেসবুক টাইমলাইনে প্রকাশিত পর্ব পাঠ করতেন। কোনোদিন পোস্ট মিস করলে ওরা ইনবক্সে জানতে চাইত কবে আসবে পরের এপিসোড।
এর পরে কেটে যায় অনেক দিন। শিরিন শবনম এবং নট ফর সেল এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভাবানুবাদ গ্রন্থটি আজ দেখতে পেলো পৃথিবীর আলো। 'পারফিউম' পূর্ণতা পাবে তখনই যখন এটা ছুঁয়ে দিতে পারবে পাঠকের মন। প্রকাশক এবং লিখিয়ে কেউই পেশাদার নয়, আবেগে ধারণ করে লেখা এবং আবেগে ধারণ করেই এই প্রকাশনা। আর তাই আমরা সবাই বাধিত হবো যদি আপনাদের আবেগের স্থানে এই ভাবানুবাদ গ্রন্থটি স্থান পায়।
'আউট অফ দ্যা ডার্ক'! সাল ২০১৪, বিশ্বসাহিত্যের নামকরা লিখিয়ে এবং সাহিত্য বোদ্ধারা বিস্মিত হন ফ্রান্সের লিখিয়ে প্যাট্রিক মোদিয়ানোকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করায়। তারা নড়েচড়ে বসেন মোদিয়ানোকে আবিষ্কার করার জন্য। বাংলাদেশের একজন পাঠক হিসেবে আমিও কৌতুহলী হই মোদিয়ানোর লেখার সাথে পরিচিত হতে। পাঠক সমাবেশ বিদেশ থেকে বইটি এনে দেয়। খুব বড় আয়তনের বই নয়, আল বেয়ার কামুর 'দ্যা স্ট্রেঞ্জারর এর মতো ক্ষুদে উপন্যাস। এক নতুন টেকনিকের সাথে পরিচিত হই। মোদিয়ানো পুরো উপন্যাসে উপন্যাসটির প্রধান চরিত্রের নাম উল্লেখ করেন নি। উপন্যাসের একটি বড় সময় জুড়ে তিনি নির্মাণ করেন এমন সব চরিত্র যারা প্রত্যেকেই বোহেমিয়ান, হোমলেস। তার কাহিনির পটভূমি বিস্তৃত হয় প্যারিস থেকে লন্ডন অবধি। তার চরিত্ররা জানে না তারা আসলে কী চায়। মোদিয়ানো নির্মাণ করেন মর্ডানিস্ট এলিয়েনেটেড চরিত্র। ছোটো পরিসরে মোদিয়ানো লেখেন মর্ডানিস্ট ক্রাইসিসের মহাকাব্য।
উপন্যাসটি এতোই ভালো লেগে যায় যে, আমার মনে হয় বন্ধুদের নিয়ে কো-রিড করি। সেই থেকে উপন্যাসটি ভাবানুবাদের শুরু। ফেসবুকে আমার টাইম লাইনে ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশ করি। পাই বন্ধুদের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা। লেখা শেষ হলে অনেক দিন আটকে থাকে হার্ডডিস্কে। শিরিন শবনম এবং নট ফর সেল ক্লাবের নজরে আসলে এই ভাবানুবাদটি পারফিউমের জুটি হয়ে পাঠকদের হাতে পৌঁছনোর জন্য আজ সেজেছে অপরূপ সাজে।
আবারও বলতে হয় আবেগের স্থান থেকেই বইটির ভাবানুবাদ হয়েছে এবং আবেগের স্থান থেকেই বইটি প্রকাশিত হয়েছে। শিরিন শবনম এবং প্রকাশক পরম মমতায় পাঠকদের জন্য প্রস্তুত করেছেন বাংলাদেশের প্রথম কনজয়েন্ড এডিশন। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ যদি সাদরে গ্রহণ করেন তবেই সব শ্রম হবে সার্থক।
আবারও আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা শিরিন শবনম এবং প্রকাশককে - যাদের নিরলস শ্রমে বাংলাদেশ পেলো অসাধারণ গ্রন্থজুটি!"