গল্প নাম্বার-২

গল্প নাম্বার-২ This is an official page. Please, Follow this page.

12/01/2023

জীবন যেখানে যেমনঃ

সময়টা ২০১৫ কি ২০১৬।আমার জীবনে তখন একটার পর একটা ঝড় তার ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছে।দিনের বেশীরভাগ সময় মনটা খারাপ থাকে, বাইরের কাউকে বুঝতে দেই না, সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলি। হাসপাতালে ডিউটির শেষে সব ডাক্তাররা আনন্দিত মনে বাসার পথে রওনা হয়, আমি বুক ভরা কষ্ট নিয়ে বাসা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করি...

এমন সময় আমাকে যখন পদ্মা পাড়ের এক চেম্বারে বিকেল টাইমে বসার অফার করা হয়, আমি তখন হেজিটেট না করে সেই সুযোগটা দ্রুতই গ্রহণ করি।মনের ইচ্ছা ছিলো চেম্বার শেষে গোধূলিবেলায় পদ্মা পাড়ের হিমশীতল বাতাসে মন ও প্রাণটা জুড়িয়ে নেয়া, পারিবারিক ঝামেলা থেকে মনটাকে অন্য কোথাও ডাইভার্ট করা। আমি পদ্মা পাড়ে চেম্বার শুরু করলাম...

সেদিনটার কথা আমার বেশ মনে আছে। বেশ মোটাসোটা হাসিখুশি মধ্যবয়সী এক লোক তার সাথে এক মহিলাকে নিয়ে আমার চেম্বারের রুমে প্রবেশ করলেন।লোকটি মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত, সাথের মহিলাটি তার স্ত্রী। তার স্ত্রী মাঝে মাঝে তার কাছে মাথা ব্যথা কমপ্লেইন করে বলে তাকে আমার কাছে নিয়ে আসা, প্রেসারটা ঠিক আছে কিনা-- এটাই ছিলো লোকটির জিজ্ঞাস্য...

আমি মহিলার দিকে ফিরলাম।বয়স ৩২-৩৫ হবে।নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের মহিলারা এই বয়সে অনেকটাই বুড়িয়ে যায়, চেহারায় লাবণ্য বলে কিছু থাকে না। এই মহিলাটি তেমন নন, দেখতে বেশ সুশ্রী এবং চপল স্বভাবের, ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিপ দেয়া...

হিস্ট্রি নিলাম। মাইগ্রেনের সমস্যা, প্রেসার স্বাভাবিক। তাই প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মাসখানেক পর আবার আসতে বললাম...

লোকটি বললেন 'যতবার বলবেন ততবারই নিয়া আসবো, খালি আমার বউয়ের মাথা ব্যথাটা ঠিক কইরা দেন...' কথাটি বলেই লোকটি আর তার স্ত্রী'র মাঝে একধরণের হাসি খেলে গেলো, একেই বোধ হয় দাম্পত্য ভালোবাসা বলে...

লোকটি যাবার সময় একবার বললেন, "ডাক্তার সাব, আমার শরীরটাও বেশী ভালো না, আইজকা আর টাকা নাই, পরের বার এর সাথে আমিও আপনারে দেখামু..."

লোকটি তার কথা রেখেছিলো, মাসখানেক পর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে আবার আসলেন।উনার স্ত্রীর মাথা ব্যথার সিভিয়ারিটি এবং ফ্রিকোয়েন্সি দুটোই কমেছে। ব্যথাটা পুরোপুরি দূর করে দিতে হবে-এটাই এবার লোকটির আবদার...

লোকটির সাথে কথোকপথের সময় আমি খেয়াল করলাম লোকটির চোখ অনেকটা হলুদ, ওজনও বোধ হয় বেশ কমেছে। আমি তাই বলে বসলামঃ

--আজ তো বোধ হয় আপনিও আমাকে দেখাবেন....

--(হাসি দিয়ে) টাকা পয়সা শর্ট স্যার, আমারে পরে দেখলেও চলবো, এরে(তার স্ত্রী'র দিকে ইঙ্গিত করে) ভালোমতো দেখেন।দুই মাইয়া আর এই বউই আমার জীবন...

--সেটা বুঝলাম, কিন্তু আপনার শরীরটা বোধ হয় খুব একটা ভালো না...

--টাকা পয়সা শর্ট স্যার, মাছের ব্যবসাটা এহন ভালা চলতেছে না...

ইন্টারেস্টিংলি উনি টাকা পয়সা যতই 'শর্ট' বলুন না কেন, ভিজিট দিতে উনি কোন কার্পণ্য আগের দিনেও করেননি, আজও করলেন না। এর থেকে অনেক অবস্থাসম্পন্ন লোককে আমি ভিজিট নিয়ে খাটাশগিরি করতে দেখেছি। যাই হোক, লোকটি তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে গেলেন। যাবার আগে তার দুই মেয়ের জন্য দোয়াও চাইলেন...

দিন ১৫ পর লোকটি আর তার স্ত্রী আবার আমার চেম্বারে আসলেন। আমি লোকটিকে দেখে ভুত দেখার মত চমকে উঠলাম।মাত্র ১৫ দিনে কারো এত "রেপিড ওয়েট লস" হতে পারে-সেটা আমার জানা ছিলো না। চোখের হলুদটাও বেড়েছে। আজব ব্যাপার এই যে, আজও উনি উনার বউকেই দেখাতে এসেছেন, নিজের দিকে কোন খেয়াল নেই...

আমি তার বউকে ইগনোর করলাম, বললামঃ

" আপনার ওয়াইফকে আমি পরে দেখবো, আগে আপনাকে দেখে নেই, টাকা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না, আপনার ভিজিট লাগবে না..."

হিস্ট্রি নিলাম, টয়লেট করার সময় গত দু'মাস ধরে রক্ত যায়। ক্লিনিক্যালি এক্সামিন করলাম, লক্ষণ ভালো লাগলো না। ঢাকা মেডিকেলে রেফার করলাম...

মাসখানেক পর তারা আবার আমার চেম্বারে আসলেন। লোকটি ততদিনে শুকিয়ে কাঠ।ঢাকা মেডিকেলের ডিসচার্জের হলুদ কাগজে রোগের নামটা লেখা রয়েছে। মলাশয়ের ক্যান্সার, সেটা শরীরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সিম্পটোমেটিক চিকিৎসা দেয়া ছাড়া তেমন কিছু করার নেই কারও...

আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। লোকটিকে আর তার স্ত্রীকে হাসপাতাল ছাড়ার আগে সব বোধ হয় বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ কোন কথা বলছে না।পিনপতন নীরবতা।লোকটি চলে যাবার আগে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে একবার খালি বললেনঃ" আমার মাইয়া দুইটার কি হইবো স্যার, এদের কে দেখবো?..."

আমি কোন উত্তর দেইনি। সব প্রশ্নের উত্তর হয় না...

এরপর মাঝে মাঝেই তারা আমার চেম্বারে আসতেন। একেক সময় লোকটি একেক সমস্যা নিয়ে হাজির হতেন, কখনো কাশি, কখনোও বা জ্বর, কখনো তীব্র ব্যথা নিয়ে। ব্যথা এত তীব্র থাকতো যে লোকটি মাঝে মাঝে বলে উঠতেনঃ"স্যার, আমারে ওষুধ দিয়া মাইরা ফালান, আর সহ্য করতে পারতেছি না..."

আমার মনে আছে জীবনে প্রথম আমি তখন কাউকে মরফিন ট্যাবলেট প্রেসক্রাইব করলাম।এটা খেয়ে তিনি কিছুটা ভালো থাকতেন। আমাকে ধীরে ধীরে ডোজ বাড়াতে হয়েছিলো। একটা সময় তিনি এতো দূর্বল হয়ে পড়েন যে তিনি আর আসতেন না, লোকটির স্ত্রী আসতেন। স্ত্রী'র কাছে সমস্যা শুনে নিয়ে আমাকে লোকটির জন্য প্রেসক্রিপশন রেডী করতে হতো। ততদিনে লোকটি আর তার স্ত্রী'র সাথে আমার বেশ আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিলো...

যে ফ্যামিলিতে ক্যান্সার আর ডায়ালাইসিস এর পেশেন্ট থাকে সে ফ্যামিলিকে অনেক তিক্ত অভিজ্ঞতার মাঝ দিয়ে যেতে হয়। মহিলাটিও তার ব্যতিক্রম নয়।আর্থিক সমস্যা, দুই মেয়ের ভবিষ্যৎ, অন্যদিকে নিজের জামাইয়ের এহেন দশায় তিনি বোধ হয় হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষবার যখন তার হাজব্যান্ডের ওষুধ এর জন্য এসেছিলেন তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেনঃ"স্যার, হ্যায় আর কয়দিন বাঁচবো? হ্যায় এহন মরলেই আমরা বাঁচি, খাওনের টাকাও এহন নাই..."

হায়রে জীবন! জীবন কত কিছুই না আমাদের দেখায়, শেখায়! যে জীবনে একসময় অফুরন্ত ভালোবাসা খেলা করতো, সময়ের পরিক্রমায় আজ সে ভালোবাসার ছুটি হয়েছে। যেখানে একসময় ভালোবাসার খুনসুটি চলতো, সেথায় আজ বিষাক্ততা তার ভ্রুকুটি মেলে ধরেছে...

তারপর প্রায় মাস তিনেক চলে গিয়েছে।চেম্বার শেষ করে পদ্মা পাড়ে সূর্যাস্ত দেখছি, একটু পর ঢাকায় রওনা দিবো। চেম্বারের লোক ফোন দিয়ে জানালো আবার নাকি এক রোগী এসেছে। আমি হেঁটে চেম্বারে ঢুকলাম...

রোগী কোথায়! ঐ মহিলা বসে রয়েছেন, সুন্দর পরিপাটী চেহারা, আজ দ্বিতীয়বারের মত তার ঠোঁটে লিপস্টিক চোখে পড়লো...

--কি ব্যপার? ভাই সাহেবের কি অবস্থা?
--স্যার, আপনারে জানাইতে পারি নাই, উনি তো তিন মাস হইলো মারা গেছে...
--ওহ, আচ্ছা...আপনার মাথা ব্যথার কি খবর?
--সেইটা ভালো অনেকটা...

উনি একটা বিয়ে টাইপের নিমন্ত্রণ কার্ড টেবিলে আমার দিকে ঠেলে দিলেন...

--এটা কি?
--স্যার, আমার বিয়ের কার্ড। মাত্র কয়টা ছাপাইছি, আপনে কিন্তু আসবেন...

আমি কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলাম। এরপর জিজ্ঞেস করলামঃ

--যাকে বিয়ে করছেন, সে কি আপনার পূর্বপরিচিত?
--জ্বি স্যার, আপনার রোগীর বন্ধুমানুষ। আমাদের বিপদআপদে উনি অনেক সাহায্য করছেন, উনি সাহায্য না করলে উনার চিকিৎসাটাও হইতো না...
--ওহ, আচ্ছা...

আমার নির্লিপ্ততা দেখে উনি বললেনঃ "স্যার, আপনে মনে হয় আমার উপর রাগ করছেন।(তারপর দৃঢ় কণ্ঠে) মাইয়া দুইটার একটা গতি করতে হইবো না? "

--জ্বি, একটা গতি তো করতে হবে..
--স্যার, বিয়া করা ছাড়া আমার আর উপায় ছিলো না। মনে কোন দুঃখ রাইখেন না।আপনে আমাগো অনেক উপকার করছেন।যাই স্যার, যদি সম্ভব হয় তবে বিয়াতে আইসেন...

মহিলা ঘোমটা ঠিকঠাক করে চলে গেলেন। সাথে সাথে কারেন্ট চলে গেলো।পুরো রুম অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। আমি চোখ বন্ধ করে রিভলভিং চেয়ারে হেলান দিলাম।বুকের মধ্যে দমটা আটকে রইলো। প্রথম দিনের কথা মনে পড়লো, স্বামী-স্ত্রীর সেই হাসিমাখা মুখগুলো আমি কেমন করে ভুলবো? জীবনকে মাঝে মাঝে এত নিষ্ঠুর মনে হয় কেনো?...

"স্যার, যাবেন না?"--শব্দে সম্বিৎ ফিরে পেলাম।রাত ৮ টার মত বাজে, ঢাকায় যেতে হবে। কেউ এসে এর মাঝে টেবিলে মোমবাতি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। আমি রেডী হলাম। ড্রাইভার এসে ব্যাগটা নিয়ে গেলো।বিয়ের কার্ডটা টেবিলে পড়ে আছে। আমি কার্ডটা হাতে নিলাম। মোমবাতির আগুনে কার্ডটি পুড়িয়ে ফেললে কেমন হয়?...

"Some men aren't looking for anything logical, like money. They can't be bought, bullied, reasoned, or negotiated with. Some men just want to watch the world burn..."

পদ্মা পাড়ের চেম্বারটায় আমার আর কখনও যাওয়া হয় নি...

-ডা.জামান আ্যলেক্স

04/11/2022

❤️❤️😭😭

17/10/2022

ডিভোর্সের ৪ বছর পর আজ হঠাৎ করেই পাশের সিটে আমার প্রাক্তন স্বামীর সাথে দেখা। প্রথমে অবশ্য খেয়াল করিনি, কিন্তু যখন খেয়াল করেছি তখন সিট থেকে আর উঠতে পারলাম না। কেমন একটা অনুভূতি মনে কাজ করছিল। হয়তো ভেতরে ভেতরে খুব সংকোচ করছিলাম। ২ জন ২ জনকে দেখার পর কেন জানি আর কারো দিকে তাকাতে পারছিলাম না। কেন জানি চোখে চোখ রাখতে অনেক লজ্জাবোধ কাজ করছিল। ইচ্ছে করছিল জিজ্ঞেস করতে সে কেমন আছে। কিন্তু কেন জানি আর পারলাম না... মুখটা অনেক হাসফাস করছিল। অবশেষে...

-কেমন আছো?(আমি)
- হুম, ভালো। (সে)
- আমাকে চিনতে পেরেছ?
- হুম, খুব পেরেছি।
- বাসার বাকি সবাই কেমন আছে?
- বাবা একটু অসুস্থ। তাছাড়া বাকি সবাই ভালোই আছে। আমিও আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো আছি। তোমার বাসার সবাই কেমন আছে?
- এইতো চলছে... আব্বু মারা গেল ২ বছর হতে লাগলো। আব্বু মারা যাবার পর থেকে আম্মু হাই প্রেসারের রুগী। আর ছোট ভাইটা আছে ওর মতো...
- কি বলো, আব্বা মারা গেছে!? আর আমরা কেউ জানলাম না!
- জানবে কি করে তোমার সাথে তো কোনো যোগাযোগই ছিল না।
- হুম। তাহলে, এখন তোমরা কি করে চলছো?
- আমি এইতো যেখান থেকে বাসে উঠলাম সেখানে ছোটখাটো একটা চকরি করছি আর আব্বুর পেনশনের টাকায় চলছি কোনো রকম।
- এই ক বছরে কত কি পরিবর্তন হয়ে গেল তাই না?
- হুম, অনেক কিছুই..। তুমি কি তোমার চিকিৎসা চালাচ্ছো?
- কিসের?
- ঐ যে, আমি আমাদের শেষের দিকে তোমাকে ডাক্তার দেখালাম, সেই ঔষধ কি খাচ্ছো এখনো?
- না।
-না কেনো?! তুমি ঐ চিকিৎসা করতে থাকলে তারাতারি সুস্থ হয়ে যেতে।
- আর সুস্থ, এসবের আর দরকার নেই। যা হয়েছে এবং তুমি যা করে এসেছ তা থেকে আমি আজো মুক্ত হতে পারিনি।
- মানে!! আমি কি করেছি!? আমি তো তোমাকে বাঁচিয়ে আমাকে দোষী বানিয়ে চলে এলাম৷ তাহলে তুমি কেনো আজো মুক্ত হতে পারছো না।
- সব দোষ আমার ছিল। অথচ তুমি নিজে সব দোষ নিজের ঘারে চাপিয়ে সবার চোখে খারাপ প্রমানিত হয়ে চলে এলে। এমন ভালো আমি কখনোই হতে চাইনি।

ওর কথাগুলো শুনে সেই বিয়ের সময়ের কথা মনে পরে গেল। কত পালিয়ে বেরাতে তুমি আমার থেকে। বিয়ের পর টানা ৬ টা মাস আমি বুঝতে পারিনি স্বামি কি জিনিস। কত দূরে দূরে থাকতে তুমি। রাত করে বাসায় ফিরে এসেই ঘুম দিতে আবার সকাল সকাল চলে যেতে। বিয়ের পরে নারী নামক অস্তিত্বকেই আমি বুঝতে পারিনি। মনে হতো একটা রোবটের পাশে আমি শুয়ে আছি। না আছে আমাদের মাঝে প্রেম, আর না আছে আমাদের মাঝে ভালোবাসা। এইতো বিয়ের দিন রাতে বাসর ঘরে নতুন বউকে ফলে মিথ্যে একটা অযুহাত দিয়ে পালিয়ে গেলে। আচ্ছা, আমি তো তোমার বউ ছিলাম। আমি কি একেবারেই বুঝতাম না তেমার সমস্যাগুলো? একটা বার বলেই দেখতে। শুরু থেকেই আমাকে পর ভেবেছ। আর এমন দূরত্ব তৈরি করেছিলে যে আমি তোমার বিষয়ে অন্যকিছু ভাবতে বাধ্য হয়েছিলাম। কি আর করার ছিল বলো? আমি তো নারী। আমারওতো স্বাদ জাগে স্বামীকে স্বামী রূপে ফিরে পেতে। ভেবেই নিয়েছিলাম তুমি তোমার পরিবারের জোরে আমাকে বিয়ে করেছ। আর তুমি মিশে আছো অন্য কারো সাথে।

আমি এখন বুঝি ঐ ভাবনাগুলো আমার একদম ভুল ছিল। শেষের দিকে যখন স্ত্রীর অধিকার চেয়ে তোমার মুখোমুখি হই, তখনও তুমি আমাকে এড়িয়ে যেতে চেয়েছিলাম। আমি তেমাকে আড়াল হতে দেইনি। আমি আমার অধিকার দাবি করেছি তোমার কাছে। এক পর্যায়ে এসে তুমি নিজেই শিকার করলে তোমার পুরুষত্ব নেই আর তুমি কখনো বাবা হতে পারবে না। সেই লজ্জায় তুমি আমার কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াতে। বিশ্বাস করো, আমি সেদিন আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারিনি। তুমি তোমার লজ্জাবোধের কারণে আমার কাছে আসতে না, এমনকি কথাও বলতে না। একসময় তুমি ই ডিসিশন দিলে ডিভোর্স হওয়ার কথা। আমার সুন্দর একটা ভবিষ্যৎ আছে, আমি আরো ভালো স্বামী পাবো, অমুক-তমুক আরো কতো কি...

নিজ থেকে আমি ই তোমাকে ডাক্তার দেখিয়েছিলাম। আহ, সেই তোমার লজ্জা!! সেই লজ্জার কারনে তুমি তোমার ঔষধগুলোকেও অবহেলা করা শুরু করলে। একসময় আর না মানতে পেরে ডিসিশন হলো ডিভোর্সের। কিন্তু তোমার শারীরিক অক্ষমতার কথা কারো কাছে প্রকাশ করা যাবে না৷ কি অযুহাতে ডিভোর্স হবে!! শ্বশুর-শাশুড়ি, ননদ সবাই তো ভালো। বড়লোকও বেশ৷ কোনো কিছুর কমতি নেই। তাহলে ডিভোর্স কেনো হবে?! আর কিছু মিলাতে না পেরে আমি নিজেই সব আমার মাথায় নিয়ে নিলাম। আমি নিজেই অক্ষম। একটা বাচ্চার সুখ আমি দিতে পারবো না এই অযুহাতেই হয়ে গেলো ডিভোর্স। এরপর দেখতে দেখতে এই ৪ বছর...

দীর্ঘএকটা নিশ্বাস ফেলে...
- কি আর করার আছে বলো।
- বাসার বাকি সবাই আজো তোমাকে অপরাধী মনে করে। আজো কথায় কথায় তোমাকে বকা দেয়। না চাইতেও প্রতিটা কথায় উদাহরণ হিসেবে তুমি ই উঠে আসো।
- ভালোই হয়েছে। তবুও আমকে যা বলার বলুক। তুমি কিছু না শুনলেই হলো। তোমার বিষয়টা জানলে তো তুমি সবার থেকে অনেক দূরে সরে জেতে। এটা আমি ই বা মেনে নিতাম কিভবে বলো। যা হবার হয়েছে। এখন সবাই ভালো থাকলেই ভালো হয়..
- সত্যি বলতে আমি ভালোই। আমার খুব ইচ্ছে করে সবাইকে সত্যিটা বলে দিতে যে, "কমতিটা আমার ছিল, তোমার না।" এতটা অপরাধ বোধ মাথায় নিয়ে বাঁচা যায় না।
- মানে! কিন্তু কেনো? আর হ্যাঁ, সত্য কাউকে বলতে হবে না। যা যেমন আছে ঠিক তেমনই থাকুক। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। একসময় এসব সব ভুলেও যাবে। একটু সময় লাগবে এই আর কি..
- তোমাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছিল। না চাইতেও বিয়েতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম এমন একটা পরীর জন্য যে শুধু নীরবে সব সহ্য করতে জানে। ভালোও বেসে ফলেছিলাম৷ রাত করে বাসায় ফিরে তোমার ঐ ঘুমন্ত নিস্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে কত কেঁদেছি, আর নিজেকে যা ইচ্ছে নয় তাই বলেছি। আমি তোমার জীবনে ডিভোর্সের দাগ টেনে অনেক বড় ভুল করেছি। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দেও।
- এভাবে বলো না, প্লিজ। যা হয়েছে ওটা ছিল আমাদের কপালের লিখন। তাই সব মানতে হবে।

কথা বলতে বলতে আমরা আমাদের গন্তব্য স্থান পার হয়ে অনেক দূর কখন যে চলে এসেছি তা আমরা নিজেরাই জানি না। হঠাৎ খেয়াল করেই মনে হলে এখন বাসায় ফিরতে আরো দেরী হবে। কন্টেকরকে বললাম পরের বাস স্টপে সাইডে চাপিয়ে গাড়ী রাখতে। আর ওর চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, "ওর চোখে জল"...

কি করবো আমি এই মুহূর্তে? না চাইতেও আলতো করে ওর হাতটা ধরে বললাম নিজেকে আর অপরাধী মনে করো না৷ আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
হঠাৎ করেই ও আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বলে উঠলো, " তুমি কি এখনো সিঙ্গেল আছো?"
আমি মুখ বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বলাম, "আমি বিয়ের জন্য আর সহস করিনি। আর সাহস হবে বলে মনেও হয় না।"...

বাস স্টপে গাড়ী থেমে গেছে। আমার এখন নামতে হবে। হাতটা ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম এমন সময়...

- আমি ধীরে ধীরে একটু একটু করে ঠিক হচ্ছি। আর আমরা না হয় একটা বাচ্চা পালক নিলাম। তুমি চাইলে আমি তেমাকে নিয়ে আবার সংসার করতে রাজি আছি। তাহলে কপালে লেগে থাকা ডিভোর্সের সীলটাও উঠে যাবে।
- হুম, তাহলে আবার নতুন করে বিয়ের প্রস্তাবটা বাসায় পাঠিয়ে দিও। আর এবার দূরে দূরে থাকলে চলবে না। সব কিছু খুলে বলতে হবে। কোনো কিছু গোপন করা যাবে না।
- আচ্ছা, তাহলে দাড়াও আমিও আসছি তেমার সঙ্গে। বিয়ের প্রস্তাবটা দিয়ে ঘরের বউকে একবারে সঙ্গে করে নিয়ে যাই, কি বলো??
- হুম, তোমার বউ। তোমার বউকে তুমি কি করবে তা তুমি ই ভালো জানো, আমি এসবের কি জানি...
- হুম, চলো তাহলে।
- চলো....

(বিঃদ্র- কিছু ভালোবাসা অপ্রাপ্তি থেকেই প্রাপ্তি লাভ করে। একটু হলেও আমাদের নিজেদের একান্ত একার জন্য একটু হলেও ভাবা দরকার। কারণ, আমাদের ঘীরে আমরা একারাই বাস করি না। আমাদের ঘীরে বাস করে একগুচ্ছ গোপন ভালোবাসা। যা খুঁজে খুঁজে অর্জন করে নিতে হয়। ভালো থাকুক পৃথিবীর সকল ভালোবাসারা।।)

27/09/2022

ইডেন কলেজের ঘটনা নারী মুক্তি, নারী অধিকার এবং নারী ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটা বাস্তবতা, ফান করে বলছি না। দেখুন, একটা ইসলামী সমাজে একজন নারী এধরণের অবস্থায় পড়বে না। বলা ভালো, এমন অপুরটুনিটি সে পাবে না। কিন্তু লিবারেল-সেক্যুলার ব্যবস্থা তাকে এখানে অনেকগুলো সুযোগ দিচ্ছে। যেমন -
ইসলামী ব্যবস্থায় যৌন সঙ্গী হিসেবে নারী কেবল তার স্বামীকে পাবে সেক্যুলার ব্যবস্থা তাকে বিভিন্ন "বড় ভাইয়ের" সাথে শরীরের উষ্ণতা ভাগাভাগির সুযোগ দিচ্ছে। তাকে স্বাধীনতা দিচ্ছে। তার ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং অটোনমি ম্যাক্সিমাইযড হচ্ছে।
যেসব নারীর মধ্যে উদ্যোক্তা হবার স্পিরিট আছে, নিজের কিংবা অন্য মেয়েদের শরীরকে তারা আর্থিক এবং ক্যারিয়ারের উন্নয়নের সিড়ি বানাতে পারছে। হলিউডের কতো বিশ্ববিখ্যাত মিলিয়েনেয়ার অভিনেত্রীরাও এভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার গড়েছেন MeToo মুভমেন্টের সময় সেটা আমরা দেখেছি। আর পশ্চিমা বিশ্ব যে কাজ করেছে, করছে - সেটা খারাপ হয় কিভাবে?

মনে রাখবেন, এই অভিনেত্রীদের অনেকেই কিন্তু ফেমিনিস্ট আইকন। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত হিসেবে তারাই কিন্তু আমাদের গরীব, পিছিয়ে পড়া দেশগুলোতে এসে নারী স্বাধীনতা ও ক্ষমতায়নের পক্ষে কথা বলেন। কাজেই এখানে লজ্জা বা সোশ্যাল স্টিগমার কিছু নেই। সেক্যুলার ব্যবস্থা এভাবে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের সুযোগ দিচ্ছে। ইসলামী ব্যবস্থায় এমন কোন সুযোগ নেই।
ইসলামী ব্যবস্থায় নারীর সময়, শ্রম, যৌবন, ব্যয় হচ্ছে পরিবারের পেছনে। কিন্তু সেক্যুলার ব্যবস্থা তাকে সুযোগ দিচ্ছে এভাবে বৃহত্তর সমাজের সেবা করার। সমাজ ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার।
দেহ ব্যবসাও একটা ব্যবসা। এধরণের ব্যবসা দেশের অর্থনীতিতে যেমন ভূমিকা রাখে তেমনি যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেরও মাধ্যম হতে পারে। কিন্তু ইসলামী ব্যবস্থায় এ সুযোগ নেই। সমাজের যে অর্ধেক অংশকে ইসলামী ব্যবস্থা ঘরে বন্দী করে, সেক্যুলার ব্যবস্থা সমাজের ঐ অর্ধেককে দেহ ব্যবসা করার স্বাধীনতা ও সুযোগ করে দেয়।
ইসলামী ব্যবস্থা নারীকে এমন অবস্থায় পড়া থেকে রক্ষা করবে। সেক্যুলার ব্যবস্থা নারীর এমন অবস্থায় পড়ার স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে। দুটোর পার্থক্য একটু ভেবে দেখুন।
সব শেষে বলি, এধরণের ঘটনা শুধু ইডেন কলেজে হয় না। আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে, অফিসে, প্রতিষ্ঠানে, মিডিয়া হাউসে হয়, হচ্ছে। লেনদেনের এই সম্পর্ক সেক্যুলার নারী ক্ষমতায়নের অবিচ্ছিন্ন অংশ। বাজার বাজারের নিয়মেই চলে। একে পসিটিভ ভাবে নেয়া উচিৎ। রাজনৈতিক বা অন্য কোন উদ্দেশ্য প্রনোদিত হয়ে শুধু ইডেন নিয়ে প্রচারণা কাম্য নয়।
©Asif Adnan

17/09/2022
29/08/2022

সবাই নিজ নিজ জীবনের একটি করে গল্প বলে যান।

খাঁটি কথা
23/08/2022

খাঁটি কথা

"আমাকে ভালোবাসেন তাই না? ভালো না বাসলে একটা মেয়েকে দেখার জন্য রোজ রোজ এখানে বসে থাকতেন না। আপনাকে আমি প্রতিদিনই দেখি, দে...
31/07/2022

"আমাকে ভালোবাসেন তাই না? ভালো না বাসলে একটা মেয়েকে দেখার জন্য রোজ রোজ এখানে বসে থাকতেন না। আপনাকে আমি প্রতিদিনই দেখি, দেখে ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হয়। ঐ যে গলিটা দেখছেন না? সেই গলি দিয়ে একটু এগিয়ে গেলেই দেখবেন গেটে লেখা "অবন্তী নিবাস" অবন্তী নামটা আমারই, সেখানেই থাকি আমি। বাবা রোজ এই পথ দিয়েই যাওয়া আসা করে। কাল আমার কাছে জানতে চাইলো আপনারা আমাকে কোনো প্রকার বিরক্ত করেন কিনা। জানেন তো আমার বাবা কী করে? থানায় যে নতুন অফিসার এসেছে তিনিই আমার বাবা। এখানে বসে থাকবেন না। কাছে কলম আছে?"
নীল মাথাটা একবার ডান পাশে আরেকবার বাম পাশে নাড়ায়। মেয়েটা আবার বলতে শুরু করে,
- থাক তার আর দরকার পড়বে না, শুধু মনে রাখলেই চলবে। আমি রোজ নয়টায় টিউশনে যাই, কোথায় সেটা আপনি জানেন কারণ আমি দেখেছি বেশ কয়েকবার আপনি আমার পিছু নিয়েছিলেন। বাইকটা বন্ধুর ছিলো তাই না?
এবারও মুখে কোনো কথা না বলে কেবল মাথা নাড়ায় নীল। মেয়েটা বলতে শুরু করে,
- জানি, কারণ একটা ছেলের কাছ থেকে বাইকের চাবি নিতে দেখেছি একদিন। তাই ধরেই নিয়েছি বাইকটা আপনার না। সকালে যেখানে টিউশন করতে যাই সেখানেও এমন একটা টঙয়ের দোকান আছে। সকালটা সেখানেই দাড়াবেন। সেখানে বাবা যায় না। তাছাড়া আমার কলেজও তো চেনেন আপনি, কারণ কলেজের গেটেও আপনাকে বেশ কয়েকবার দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি। দাড়াবেন, সুযোগ পেলে কথা বলবো। প্রথম প্রথম ভয় ভয় করবে আমার, তাই আপনাকেই একটু কষ্ট করতে হবে। পরে সব ঠিক সামলে নিতে পারবো। ততদিন আপনাকেই একটু দৌড়াদৌড়ি করতে হবে। আপনি তো এখনও বেকার তাই না?
এবারও মাথা নাড়ালো নীল। উত্তরের অপেক্ষা না করেই মেয়েটা আবার বলতে শুরু করলো,
- জানি, কারণ যে ছেলে সারাদিন এখানে বসে থাকে সে আর যাই হোক বেকার না হয়ে যায় না। এখানে বসে থাকবেন না, সেই সময় টুকু একটা চাকুরির খোজ করবেন। আপনাকে দেখে শিক্ষিত বলেই মনে হয়। যদিও চাকুরি খুব সহজ নয় আজকাল তবুও চেষ্টা করবেন। মনে রাখবেন মেয়েরা প্রেম করার জন্য বেকার ছেলে পছন্দ করলেও বিয়ে করার সময় একটা জিনিসই লক্ষ্য করে সেটা হলো ছেলেটা কোনো কাজ করে কিনা। সে কাজ যত ছোটোই হোক তবুও মেয়েরা চায় না কোনো বেকার ছেলেকে বিয়ে করতে। আর যারা চায় তাদের দলে আমি নয়। আজ আমি যাই।
কথাগুলো বলে চলেই যাচ্ছিলো মেয়েটা, হঠাৎ আরেকবার পিছন ঘুরে বললো,
- আর একটা কথা, কখনোই পিছু নিবেন না। মেয়েদের পিছন পিছন ঘোরা আমি একদম পছন্দ করি না। যা বলার সামনা-সামনি বলবেন। আর হ্যাঁ আমার ফোন নেই, বাবা বলেছে কিনে দিবে। আজ যাই, যা বললাম মনে রাখবেন।
প্রথম কথাগুলো দাড়িয়ে বললেও শেষ কথাটা বলতে বলতে অনেকখানি এগিয়ে গেলো মেয়েটা। আর পিছন ফিরে তাকালো না। নীল তখনও ঠাঁই দাড়িয়ে রইলো একই জায়গায়। দেখতে দেখতে মেয়েটা ঢুকে পড়লো গলিটার ভেতর। মেয়েটা চোখের আড়াল হতেই টঙয়ের দোকানটার দিকে এগিয়ে গেলো নীল। তারপর দোকানের সামনে পাতানো একটা বেঞ্চের উপর বসতে বসতে বললো,
- মামা, একটা চা ধরেন তো।
মেয়েটা রোজই এই পথ দিয়ে যাওয়া আসা করে। কখনো কখনো আড় চোখে তাকায় টঙ দোকানটার দিকে। দাড়ায় না। নীল কোনো কোনো দিন বাইক নিয়ে পিছু পিছু যায়, কখনো বা জোরে বাইক চালিয়ে মেয়েটা যেখানে টিউশন করতে যায় সেখানকার টঙয়ের দোকানটায় গিয়ে দাড়ায়। কখনো বা কলেজের গেটের সামনে। আজকের আগে মেয়েটার সাথে কথা হয়নি নীলের, কথা তো দূর মেয়েটার নাম যে অবন্তী সেটাও জানা ছিলো না ওর। কেবল দেখতো মেয়েটাকে। সেটাও খুব বেশি সময়ের জন্য নয়। কিন্তু এই এক পলকের দেখায় যেনো নীলের ভেতরটা চঞ্চল হয়ে উঠে। অপেক্ষা করে আবার কখন দেখা মিলবে মেয়েটার। সামনা সামনি কথা বলার সাহস হয়নি কখনোই। নীল জানে মেয়েটা এই মহল্লায় এসেছে মাস খানেক হলো। চেনা নেই জানা নেই একটা অচেনা অজানা মেয়ের সাথে হুট করেই তো আর কথা বলা যায় না। আর বললেই বা কী বলবে সে? বলবে যে,
আপনি এখানে নতুন, আপনার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? তাছাড়া আমরা এই মহল্লার ছেলে, যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে জানাবেন। এইসবই বলবে? এখনকার দিনে এইসব বলা সাজে না। তার চেয়ে বরং যেভাবে চলছে চলুক।
আজও সকাল থেকে টঙয়ের দোকানটায় বসে ছিলো নীল। সে জানে মেয়েটা ঠিক নয়টায় বের হয় বাসা থেকে। যদিও বাসা সে চেনে না, আসলে বাইক নিয়ে পিছু বেশ কয়েকবার নিয়েও বাসার দিকটায় যেতে সাহস হয়নি কখনো। তবে মেয়েটা যে খুব বেশি দূরে থাকে না সেটা বুঝতে পারে, কারণ একবার রাস্তা ছেড়ে গলিতে ঢোকার একটু পরই বাইক নিয়ে গিয়েছিলো নীল। এটা তার নিজের এলাকা, ছোট থেকেই মানুষ হয়েছে এখানেই, সে যেতেই পারে। সে তো আর কোনো মেয়ের পিছু নিচ্ছে না। এমনটাই ভাবে গিয়েছিলো, মেয়েটাকে আর দেখতে পায়নি। হয়তো আশেপাশেই কোনো এক বাসাতে ঢুকে পড়েছিলো মেয়েটা।
প্রতিদিনের মতই মেয়েটা নয়টার দিকে গলি থেকে বের হলো। মেয়েটা বের হতেই যেনো বুকটা ধুকধুক করতে শুরু করে নীলের। না এটা ভয়ে নয়, কোনো এক অজানা সুখের অনুভুতি বলা চলে। পছন্দের মানুষটা সামনে আসলে নাকি এমনটা হয়। বন্ধুদের কাছ থেকে সে বেশ কয়েকবার শুনেছে কথাটা। নীল কথাটা শুনে দুই একবার বলেও ছিলো যে, ভালোবাসায় সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা দরকার সেটা হলো সাহস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিজের ক্ষেত্রে তেমনটা হলো না। নীল এখন বোঝে, অন্যের ক্ষেত্রে যে কথাটা বলা খুব সহজ, সেই কাজটাই নিজের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা ততটাই কঠিন। এমনই হাল হয়েছে ওর। মেয়েটা গলি পথ ছেড়ে রাস্তায় উঠতেই ওর ভেতর একটা অজানা ভয় কাজ করে। ঠিক ভয় বলা উচিত হবে কী? আসলে সেই সময়ে ওর ভেতরে যা চলে সেটাকে প্রকৃতপক্ষে কী বলা যায় সে নিজেই জানে না। তবে মনে একটা প্রশান্তি আসে বটে। যদিও সেটা খুবই সামান্য তবুও সেই সামান্য প্রশান্তিটুকুর সময় ওর প্রতিক্ষার অবসান যেনো কাটে না।
অপেক্ষা আর প্রতিক্ষা দুইটা দুই জিনিস। অপেক্ষা যা এক সময় ফুরিয়ে আসে। কিন্তু প্রতিক্ষা? সে তো ফুরোবার নয়, ঠিক যেমন দাড়িয়ে থাকা বটবৃক্ষের মত। পায়ে হাজারও শিঁকড় গজায়। মনে একটাই আশা, মানুষটা আসবে, হুমম ঠিক আসবে। অপেক্ষার প্রহরের ন্যায় প্রতিক্ষার প্রহরও ফুরােই। মেয়েটা আসে, সেই এক পলকের দেখায় যেনো মনে বইয়ে দিয়ে যায় বসন্তের স্নিগ্ধ শীতল হাওয়া। তাকিয়ে থাকে নীল, ঠিক যেনো বাংলা গানের মত, "পড়ে না চোখের পলক কী তোমার রুপের ঝলক।" তবে এই মেয়েটি কিন্তু আহামরি সুন্দর নয়। তবে আমাদের দেশে একে অসুন্দরও বলার সাহস রাখে না কেউ।
প্রতিদিনের মত আজও মেয়েটা মাথা নিচু করে হেটেই যাচ্ছিলো। কিন্তু টঙয়ের দোকানের সামনে আসতেই থমকে দাড়ালো। মেয়েটা দাড়াতেই নীলের বুকের হৃদপিণ্ডটা যেনো দ্বিগুণ হারে বাড়তে লাগলো। দাড়িয়ে মাথা নিচু করেই কি যেনো ভাবলো। ঠিক যেমন ঝড়ের পূর্বে আশপাশের পরিবেশটা থমথমে নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কয়েক সেকেণ্ড পর মাথা তুললো মেয়েটা। তারপর ধীরে ধীরে তাকালো টঙয়ের দোকানের দিকে। তারপর গলাটা একটু উচিয়ে বললো,
- এই যে কালো শার্ট, হ্যাঁ হ্যাঁ আপনাকেই বলছি।
কথাটা বলেই হাতের ইশারায় ডাকলো মেয়েটা। মনে হলো হৃদযন্ত্রটা কয়েক সেকেণ্ডের জন্য থেমে গেলো। কিন্তু সে তো কোনো অন্যায় করেনি। তাছাড়া বাইক নিয়ে কোনো মেয়ের সামনে দিয়ে গেলেই তো তাকে বিরক্ত করা বলা না। যদিও কয়েকবার পিছু নিয়েছে কিন্তু কথা তো বলেনি। তাছাড়া লোকের কাজ থাকতেই পারে। আর সে কাজে গিয়ে এক জনের সাথে বার বার দেখা হওয়াটাও দোষের কিছু কী? নাহ্ দোষের কিছু বলে তো মনে হয় না। তাছাড়া মেয়েটা যে কলেজে পড়ে নীল নিজেও সেই কলেজ থেকেই লেখাপড়া শেষ করেছে। তাই হঠাৎ করে কলেজে কোনো কাজ লেগে যেতেই পারে। এমন নানান যুক্তি আওড়াতে আওড়াতে নীল যখন মেয়েটার সামনে গিয়ে দাড়ালো তখন অতিরিক্ত কোনো কথা বলে সময় নষ্ট না করেই কথাগুলো বললো মেয়েটা।
রাত আনুমানিক বারোটা। হাজার চেষ্টা করেও যখন ঘুম আসলো না তখন এক প্রকার বাধ্য হয়েই ছাদে গেলো নীল। চাঁদের আলো ছড়িয়ে আছে ছাদের কোণায় কোণায়। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করে তাতে লাইটারের আগুন ছোয়াতেই যেনো প্রান ফিরে পেলো বস্তুটা। মুহূর্তের মধ্যে নিকটিকের গন্ধ ভরে উঠলো চারিপাশটা।
নীল ভাবতে শুরু করে, এখন যেহেতু রাত তাহলে তখন দিনই ছিলো। আর দিনের বেলা সে ঘুমায় না কখনোই, আর জেগে জেগে তো আর স্বপ্ন দেখা যায় না। মানে মেয়েটা আজ সত্যিই ওর সাথে কথা বলেছে। মানে সেটা স্বপ্ন নয় বাস্তব। কিন্তু তবুও যেনো বার বার মনে হচ্ছে, বাস্তব নয় বরং স্বপ্নই ছিলো।
ঐদিকে অবন্তীরও চোখে ঘুম নেই। সে তো এমনটা ছিলো না। বরাবরই সে ভীতু আর শান্ত মেয়ে। কোনো অপরিচিত ছেলে তো দূরের কথা পরিচিতদের সাথেও কথা বলতে বেশ বেগ পেতে হয় ওকে। কিন্তু আজ যা ঘটলো তার ব্যাখ্যা সে কীভাবে দিবে? জানা মতে এতটুকুও ভয় আর সংকোচ কাজ করেনি ছেলেটার সাথে কথা বলার সময়। ওর যতদূর মনে পড়ে ছেলেটাই বরং চুপ চাপ শুনে যাচ্ছিলো। একটা কথা পর্যন্ত বললো না। তবে কী ভালোবাসা বদলে দেয় মানুষকে? কিন্তু ভালো তো সে বাসে না ছেলেটাকে। এটা সত্যি যে ছেলেটাকে তার ভালোই লাগে। ছেলেটা আর দশটা ছেলের মত নয় মোটেও। যদিও সে নিজেও জানে ছেলেটা তাকে দেখার জন্য বসে থাকে। কয়েকবার টিউশনের জায়গাটাও গিয়েছিলো, জানালা দিয়ে দেখেছিলো অবন্তী টঙয়ের দোকানটায় বসে বসে সিগারেট টানছিলো ছেলেটা। যদিও সিগারেট একদমই পছন্দ করে না অবন্তী তবুও ছেলেটাকে তখন ভালোই লেগেছিলো। কয়েকবার তো কলেজের গেটেও দেখা হয়েছিলো, অবন্তীকে দেখেই তাড়াহুড়ো করে সিগারেটটা ফেলে দিয়েছিলো ছেলেটা। ছেলেটার এমন কাণ্ড দেখে বেশ হাসিই পাচ্ছিলো সে সময়। কিন্তু হাসেনি, পরে অবশ্য বাসায় ফিরে বেশ খানিকটা হেসে নিয়েছিলো। কেমন যেনো একটা ভালোলাগা কাজ করছিলো সে সময়ে। তাই তো বাবা যখন বললো কথাগুলো তখন সে কখনোই চায়নি যে বাবার চোখে বখাটে খেতাব পাক ছেলেটা। যদিও তার এতে খারাপ লাগার কথা ছিলো না। তবুও খাবার লেগেছিলো। কেনো লেগেছিলো সে জানে না। তবে কী ভালোবাসা বলে এটাকে? নাকি প্রেম?
অবন্তী জানে প্রেম আর ভলোবাসা দুইটা দুই জিনিস। প্রেম হলো কিছু দেখলাম খুব ভালো লাগলো, সেটাকে পেতে মনে চায় বড্ড। না পেলেও খুব একটা ক্ষতি নেই। যদিও প্রেমে না পড়লে ভালোবাসা যায় না। তবুও ওর কাছে ভালোবাসা হলো অন্য এক জিনিস। যদিও তার মাথায় আসে না এর অর্থ তবুও সে জানে, যাকে ভালোবাসা যায় তাকে হারানো যায় না। আর যদি হারিয়ে যায় তবে..... এর পর যে কী সেটা জানে না অবন্তী। তবে একটা কথা সে জানে কোনো পরিবারই চাইবে না তার মেয়েটাকে কোনো বেকার ছেলের হাতে তুলে দিতে। সে জন্যই কী তখন ছেলেটাকে সেসব কথা বলেছিলো অবন্তী?
আয়নার সামনে দাড়িয়ে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে চেহারাটা লজ্জায় লাল হয়ে উঠে বার বার। আয়নার সামনে থেকে সরে আসে। মনে মনে ভাবে,
কাল ঠিক আসবে ছেলেটি, ওর নিজেরই দেখানো জায়গায় টঙয়ের দোকানদার সামনে। হয়তো একটু আগেই আসবে। আর এসেই হয়তো দোকানদারের কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে নিবে। অবন্তীকে দেখে হয়তো আবার সেটা তাড়াহুড়ো করে ফেলেও দিবে। ওর হয়তো তখন খুব হাসি পাবে, তবে সে হাসবে না। সে হাসবে বাসায় এসে, দরজা বন্ধ করে।
অবন্তীর ভাবনায় কিন্তু সত্য হলো, ছেলেটা হয়তো অনেকক্ষণই এসেছে। এসেই হয়তো চেয়ে নিয়েছে একটা সিগারেট। যা এখনো কিছুটা বাকি। কিন্তু সেই বাকি অংশ আর টান দিলো না ছেলেটা। ওকে দেখেই তাড়াতাড়ি ফেলে দিলো পায়ে নিচে। অবন্তী না চাইতেও মুখ টিপে হাসে, ছেলেটা তাকিয়ে থাকে, কিছু বলে না।
ফেরার পথেও দেখলো ছেলেটা সেখানেই দাড়িয়ে আছে। অবন্তী কাছে গিয়ে একটু কথা বলতে চেয়েও থেমে যায় মাঝপথেই। ছেলেটার পিছনে যত্ন করে হাতের আড়াল করা সিগারেটটা চোখ এড়ায় না অবন্তীর। অবন্তী হাসে, হাতে আড়াল করা সিগারেটটা বিনা টানে পুড়ে যায়। টান আর দেওয়া হয় না, অবন্তী চলে যাওয়ার পরও ঘোর থাকে বেশ ক্ষণ। হুশ ফেলে টান বিহীন পুড়ে যাওয়া সিগারেটের ছোয়ায়। হাত থেকে পড়ে যায় জলন্ত সিগারেটের ফিল্টার। মেয়েটা ততক্ষণে চোখের আড়ালে চলে যায়। নীল তবুও তাকিয়ে থাকে সেদিকে। মনে হয় ফিরে আসবে বোধহয় আবার। আবার হাসবে মুখ টিপে। বলবে, বাকি পথ টুকু না হয় এক সাথে হাঁটা যাক?
বলে না, চোখের আড়াল হয়ে যায় অবন্তী।
- টিকিট টা?
কথাটা কানে যেতেই ঘোর কাটে নীলের। জানালার বাইরে থেকে চোখটা সরিয়ে নিতেই দেখে কালো কোট পড়া একটা লোক দাড়িয়ে আছে কামড়ায়। টিটি। লোকটা আবার বলে,
- টিকিট টা।
প্যান্টের পকেট থেকে ভাজ করা টিকিটটা এগিয়ে দেয় লোকটার দিকে। লোকটা সেটা ভালো করে পরিক্ষা করে বলে,
- পরের স্টেশনে ট্রেনটা একটু দাড়াবে। রাস্তার কাজ চলছে, আধঘন্টা পর আবার ছাড়বে।
কথাটা বলেই কামরা থেকে বেরিয়ে যায় লোকটা। নীলের চোখটা আবারও খোলা জানালার দিকে যায়। সবকিছুই যেনো ছুটছে, ঠিক তারই মত। একা।
আবারও আস্তে আস্তে চোখটা বুজে আসে ওর। ভেসে উঠে পুরোনো স্মৃতিগুলো। অবন্তী মুখ টিপে হাসে। বলে,
- কাল ওমন করে দাড়িয়ে ছিলেন যে? পিছু নিতে বারণ করেছি বলে কী সে নিয়ম ভাঙতে নেই?
নীল কোনো কথা বলে না, কেবল হাসে। কিছুক্ষণ পর প্রশ্ন করে,
- আজ নিবো পিছু?
অবন্তী হাটা শুরু করে, হাটতে হাটতে একবার পিছন ফিরে তাকায়। নীলের চোখে তখনও প্রশ্নটা। মেয়েটা হাটতে হাটতেই পিছন ঘুরে একবার মাথা দোলায়। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় মেয়েটার দিকে। পাশাপাশি হেটে চলে দুইজন। কথা বলে না। গলি পথটার কাছাকাছি যেতেই মেয়েটা সর্তক হয়ে উঠে, নিচু স্বরে বলে,
- কাল টিউশনে যাবো না, কলেজের কাছটায় দাড়াবেন। ক্লাস ফাঁকি দেওয়ার অভ্যাস নেই যদিও তবুও কালকে দিবো।
একটু তাড়াতাড়িই সেদিন কলেজ গেটের সামনে গিয়ে দাড়ায় নীল। মেয়েটা অবশ্য সময়ের আগে আসেনি। কিন্তু যখনই এসেছে সাথে করে এক চিলতে প্রশান্তির রেশ নিয়ে এসেছিলো। যা এসে লেগেছিলো নীলের ঠিক বা'পাশে। বলেছিলো,
- আপনাকে না আমি অনুভব করতে পারি। আপনি পাশে না থাকলেও । পাশে থাকলে ভয় করে। দূরে গেলে সে ভয়টা আর আসে না, বরং কাছে টানার আকুতি জাগে মনে। চাকুরির চেষ্টা করছেন তো? আমি কিন্তু ওদের দলে নয়।
নীল মাথা নাড়ায়। বলে,
- কালকে একটা ইন্টারভিউ আছে। বলেছে হবে।
কথাটা শুনে অবন্তীর মুখে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠে। বলে,
- সময়টা হোক অল্প তবুও যখন চাই পুরোটা জুড়েই কেবল আপনাকেই চাই। পাবো তো?
কথাটা বলতে বলতে একবারের জন্য গলাটা হালকা কেঁপেই উঠেছিলো মেয়েটার। নীল প্রথম বারের মত হাতটা ধরেছিলো অবন্তীর। আর তাতেই যেনো কম্পনটা আরও বেড়ে গেলো চোখটা বুজে উঠে আয়েশে। নীল কানে কানে ফিসফিস করে বলে,
- পুরোটা জুড়েই।
চাকুরিটা কিন্তু হলো না। খবরটা যখন পরেরদিন নীল অবন্তীকে বললো, অবন্তী হাসলো একটু। তারপর সেই হাসি মাখা কণ্ঠেই বললো,
- হয়নি, হবে। চেষ্টাটাই আসল।
অবন্তীর এই কথা কিন্তু সত্যিই হলো। পর পর কয়েকবার চেষ্টা করার পর অবশেষে যখন সোনার হরিণ নামক চাকুরিটা মিললো তখন ওদের প্রনয় আরও বেড়েছে। এক জনের প্রতি আরেকজনের যে টানটা আগে খানিক খাপছাড়া ছিলো, সে খাপছাড়া ভাবটা কেটেছে পুরোপুরি ভাবে। মেয়েটা হয়ে উঠেছে সাহসী, আর রিকশায় ঘুরতে ভয় করে না মোটেও। রিকশায় উটে হুটটা টেনে দিয়ে নীলের কাঁধে মাথা রাখতেও হয় না এতটুকু সংকোচ।
ভালোবাসা যখন এমনই দুর্নিবার গতিতে বাড়ছিলো ঠিক তখনই নীল একদিন বললো,
- চাকুরিটা হয়েছে অবন্তী। এক তারিখ থেকে জয়েন তবে তার আগে ওরা পনেরো দিনের একটা টেনিং করাবে। সেটাও শহরের বাইরে। কী করবো বুঝতে পারছি না।
কথাটা শুনে অবন্তীর মনটা একটু দমে গেলো বটে। যে মানুষটার সাথে একটা দিন দেখা না হলে মন থাকে ঊদাস, কথা না বললে মনটা ছটফট করে তাকে ছাড়া থাকতে হবে পনেরোটা দিন? বাবাকে বেশ কয়েকবার একটা ফোনের জন্য তাগাদা দিয়েছে অবন্তী। বলেছে দিবে। অবন্তী বললো,
- শুনেছি দুরত্ব ভালোবাসা কমায়। মাঝে মাঝে হারিয়েও যায়, কথাটা ভুল প্রমাণিত করবে?
কথাটা বলতে বলতে নীলের কাঁধে মাথা রাখে অবন্তী। নীল একটা হাত রাখে ওর বাহুতে। তারপর শক্ত করে চেপে ধরে বলে,
- করবো।
সেদিন প্রথম মেয়েটাকে কাঁদতে দেখেছিলো মেয়েটাকে। মনে হয়েছিলো অবন্তীর চোখে কান্নাটা ঠিক মানায় না। হাসিতে ওকে আরও বেশি সুন্দর লাগে।
কথাটা রাখা হয়নি নীলের। দুরত্ব বাড়েনি মোটেও কিন্তু চিরোদিনের জন্যই হারিয়ে ফেলেছে মেয়েটাকে। পনেরো দিন পর ফিরে এসে আবিরের মুখে শোনে কথাটা। নীল যাওয়ার তিন চার দিন পর হঠাৎ করেই অবন্তীর বাবার হার্ট ফেল করলে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েও লাভ হয়নি। তারপর আর কিছুই জানে না কেউ। সবার ধারণা স্বামীর মৃত্যুর পর অবন্তীর মা গ্রামে ফিরে গেছে। কথাটা শুনেই নীল দৌড়ে গিয়েছিলো অবন্তী নিবাস বাসাটার সামনে। নেম প্লেটটা নেই। কেবল একটা নতুন টু-লেট ঝুলছি জায়গাটায়। বড় বড় অক্ষরে লেখা "বাসা ভাড়া দেওয়া হবে।"
এর পর নীল অনেক খুজেছে অবন্তীকে। থানায় গিয়েও খোজ নিয়েছে। একজন অচেনা অজানা মানুষকে ঠিকানা দিতে রাজি হয়নি ওরা। কিন্তু অনেক চেষ্টার পর নীল যতদিনে সেই ঠিকানায় গিয়ে পৌছালো ততদিনে সেখানকার জায়গা জমি বিক্রি করে ওরা চলে গেছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না।
সেদিনের পর আর অবন্তীর দেখা পায়নি নীল। জীবন তবুও থেমে নেই, থেমে থাকে না। চলছে, তাকে চলতে দিতে হয় বাঁচার তাগিদে, কখনো কখনো স্মৃতিগুলো বয়ে বেড়াবার তাগিদেও জীবনকে চলতে দিতে হয়। মোট কথা বাঁচতে হয়। নীলও বেঁচে আছে। চলছে তার জীবন, জীবনের নিয়মে। কিন্তু ট্রেন থেমে গেলো। ট্রেনটা যে পরের স্টেশনে এসে থামবে সেটা সে আগেই জানতো। তখন টিটি টিকিট দেখতে এসেই বলে গেছে। ট্রেন থামতেই ভাবনাগুলো উবে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। লাইনের কাজ চলছে, যদিও যাত্রীদের বলা হলো মাত্র তিরিশ মিনিট তবে এর বেশি সময় লাগলো মোটেও অবাক হওয়ার কিছুই নেই।
ট্রেন থেকে নেমে পড়ে নীল। একটু অন্যমনস্ক ভাবেই নামছিলো হয়তো। আর তাই তো ভদ্রলোকটার সাথে এমন ভাবে ধাক্কা লেগে গেলো। লোকটা আর একটু হলেই ট্রেনের প্যাদানিতে পড়ে যেতো যদি না নীল হাত বাড়িয়ে না ধরতো। ভদ্রলোক কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বললো,
- কিছু মনে করবেন না, আসলে আমারই একটু তাড়া ছিলো তাই.....
- না না সে কী, আমিই একটু অন্যমনস্ক ভাবে নামছিলাম। কিন্তু আপনার হয়তো ব্যথা লাগেনি তাই না?
- না কিন্তু হাত থেকে দুধের বোতলটা পড়ে গেছে।
- ইশ, কি একটা অবস্থা দেখুন তো। নিশ্চয় এই দুধ টুকু আপনার বাচ্চার জন্য?
- হুমমম, সে যাই হোক। আমি আরেকটা কিনে নিবো। আসলে এটার জন্যই একটু তাড়া। বাচ্চাটা কান্না করছে।
- মা নেই?
- নাহ্
নীল আর কোনো কথা বলে না। ভদ্রলোকটা ততক্ষণে দোকানের দিকে হাটা শুরু করেছে। নীল মনে মনে হিসাব মিলাতে থাকে, অবন্তী যদি পাশে থাকতো তাহলে তাদেরও ঠিক এমনই একটা বাচ্চা থাকতো না কী? বছর ছয় হলো মেয়েটা নেই পাশে। একবার চোখের দেখাও দেখেনি নীল।
একটা সিগারেট ধরিয়ে ইট পাথরের তৈরি বেঞ্চে বসে পড়ে নীল। লোকটা ততক্ষণে আরেকবার দুধের বোতল কিনে নিয়ে ট্রেনের দরজা দিয়ে উঠলো। তারপর পাশেরই একটা কামরায় ঢুকলো বোধহয়।কারণ লোকটা যে কামরায় গিয়ে বসলো নীলও ঠিক তার সামনেই বসে। সিটে একটা ছোট বাচ্চা বসে আছে। মেয়ে না ছেলে ঠিক বোঝা গেলো না। লোকটা কামরায় ঢুকতেই বাচ্চাটা বাবার কাছে চলে গেলো। নীল চোখ ফিরিয়ে নিলো সে দিক থেকে। হাতের সিগারেটটা ততক্ষণে ফুরিয়ে এসেছে। সেটা ফেলে দিয়ে আরেকটা সিগারেট ধরালো। কারণ এতক্ষণ সে একা আসলেও এই স্টেশনে আরও দুইজন ওর কামরায় উঠার কথা। তারা নিশ্চয় নীলের সিগারেট খাওয়াটাকে পছন্দ করবেন না। তাই এখন একটু বেশি করে খেলে মন্দ হবে না। তাছাড়া বসে বসে করার মতও তো কাজের কাজ নেই।
অবশেষে ট্রেন ছাড়া সময় হলো। বলায় বাহুল্য যে তিরিশ মিনিটে কাজ হলো না। তাড়াতাড়ি হাতের সিগারেটে শেষ বারের জন্য একটা টান দিয়ে সেটা পায়ের তলে পিষ্ট করেই উঠে পড়লো ট্রেনে। হুমম যে যাচ্ছি দুইজন উঠার কথা ছিলো তাড়া উঠেছে। দেখে স্বামী স্ত্রী বলেই মনে হলো, পাশাপাশি বসে আছে দুইজন। ভদ্রলোকের কোলে একটা দুই আড়াই বছরের বাচ্চা। সম্ভবত মেয়ে। মায়ের মুখটা কিন্তু দেখা গেলো না দরজা থেকে। নিজের সিটে বসতে বসতে হাসি মুখে একবার তাকালো ভদ্রলোকের দিকে। আর বসার পরই মেয়েটার দিকে তাকাতেই শরীরে যেনো একটা বিদ্যুৎ খেতে খেলো। মনে হলো শরীরের সব গুলো ইন্দ্রীয় যেনো ক্রমেই অকেজো হয়ে উঠছে। বুকের ভেতরটা কেউ যেনো আঘাত করছে বার বার। মেয়েটার চেহারা দেখে কিন্তু কিছু বোঝা গেলো না। কেবল তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। ঠোঁটটা কেঁপে চলছে অস্বাভাবিক ভাবে। যেনো কিছু বলতে চায়, কিন্তু পারলো না তার আগেই পাশে বসা ভদ্রলোকের দিকে ঢলে পড়লো ধীরে ধীরে। স্ত্রীর এমন অবস্থা দেখে ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি বললেন,
- প্লিজ একটু হেল্প করুন। আমার স্ত্রীর এমন হয় মাঝে মাঝে, ব্যাগে দেখুন পানির বোতল আছে, একটু চোখে মুখে ছিটিয়ে দিন প্লিজ। আর সেখানেই দেখুন একটা ইঞ্জেকশন আছে। আপনি পুশ করতে পারেন?
নীল তখনও হতভম্ভের মত তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। হিতাহিত জ্ঞান যেনো হারিয়ে গেছে। এখন কী করা উচিত সেই জ্ঞানটুকুও লোপ পেয়েছে।
- কী হলো বলুন আপনি পুশ করতে পারেন?
- হ্যাঁ....
ছোট্ট একটা শব্দ। কিন্তু নীলের মনে হলো এই হ্যাঁ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়েও কয়েকবার গলাটা আটকে গেলো। মনে হলো সব কথাগুলো যেনো গলার মাঝ বরাবর এসে দলা পাকিয়ে গেছে। মুখ দিয়ে বের হবে না একটা শব্দও।
নীলের উত্তর পেয়ে লোকটা আরও উত্তেজিত হয়ে বললেন,
- বেশ আগে চোখে মুখে একটু পানি দিন। তারপর ইঞ্জেকশনটা পুশ করে দিন শিরায় আসলে আমি একটু ভয় পাই।
ব্যাগের চেইন খুলে পানির বোতল আর একটা ইঞ্জেকশন সাথে সিরিঞ্জ বের করলো নীল। তারপর লোকটার কথা মত চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে দিয়ে ডান হাতের শিরায় ইঞ্জেকশনটা পুশ করার পর ভদ্রলোক কৃতজ্ঞতার স্বরে বললেন,
- ধন্যবাদ, আসলে আমার স্ত্রীর এই রোগটা অনেক দিন ধরেই ছিলো। আগে কিন্তু এমনটা ছিলো না, কিন্তু ওর বাবা মানে আমার শ্বশুর হঠাৎ মারা যাবার পর এমনটা হয় মাঝে মাঝে। হঠাৎ কোনো অচেনা লোক দেখলেই হৃদযন্ত্রটা বেড়ে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। চিকিৎসা চলছে। সেরেও গেছিলো পুরোপুরি। ডাক্তার বলেছিলো আর কোনো সমস্যা হবে না। হয়ও নি অনেক দিন থেকে। ধরুন প্রায় বছর খানেক তো হবেই। তবুও সাথে আমি ইঞ্জেকশনটা রাখি কোথাও বের হলে। বাসার দরকার পড়ে না কারণ আমি বাসাতে অচেনা কাউকে নিয়ে যাই না। কিন্তু ঠিক বুঝলাম না এতদিন পর হঠাৎ আবার এমন হলো......।
কথাটা শুনে ভদ্রলোকের কাঁধে মাথা দিয়ে রাখা অচেতন মেয়েটার দিকে একবার তাকালো। তারপর বাচ্চাটার দিকে তাকালো। একদম মায়ের মতই হয়েছে। প্রশ্ন করলো,
- মেয়ে?
ভদ্রলোক মাথা নাড়ালো। নীল আবারও প্রশ্ন করলো,
- নাম কী?
- অনু.....।
নীল বেরিয়ে আসে কামরা থেকে। ক্রমেই চোখদুটো ঝাপসা হয়ে উঠছে। মনে পড়ছে অবন্তীকে বলা কথাগুলো,,
- শোনো, আমাদের প্রথমে কিন্তু মেয়েই হবে বুঝলে?
নীলের এমন অদ্ভুত কথা শুনে বেশ লজ্জায় পেয়েছিলো অবন্তী। বলেছিলো,
- খুব জানো বুঝি?
- হুমম জানি তো।
- সব জানেন উনি। তা মেয়ের নামও কী ঠিক করে রেখেছেন নাকি?
- মেয়েটা একদম তোমার মত মিষ্টি দেখতে হবে। আর নাম রাখবো অনু।
কামরা থেকে বের হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলো দরজার ওপাশটায়। ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। আরও বেশ কিছুক্ষণ পর নীল শুনতে পেলো লোকটা বলছে,
এখন ভালো লাগছে অবন্তী? হঠাৎ কী হলো বলো তো। আমি তো ভয় পেয়ে গেছিলাম।
স্ত্রীর কাছ থেকে কোনো উত্তরই হয়তো পেলেন না তিনি। তাই আবার বললেন,
"উনি নাকি পাশের স্টেশনেই নামবেন। তাই চলে গেলেন, তুমি কী সেখানে একটু শুয়ে থাকবে?"
এবারও কোনো নারীকণ্ঠের উত্তর শুনতে পেলো না নীল। কামরার দরজা থেকে সরে আসে। তারপর ট্রেনের দরজাটার কাছে যায়। হাতল ধরে দাড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। মাঠের মাঝখান দিয়ে ছুটে চলছে ট্রেনটা। যেমন ছুটছে নীল। একা। ট্রেনটা হয়তো তার সঠিক গন্তব্য ঠিক খুজে পাবে। সেখান থেকে আবারও চলবে কোনো নতুন গন্তব্য আশায়। নীলও তেমনই। তবে প্রার্থক্য এতটুকুই ট্রেনটা একা নয় আর নীল একা। সম্পূর্ণ একা তার এই পথ চলা।

________ সমাপ্ত।
গল্পের নামঃ অবন্তী
লিখেছেনঃ Sajib Mahmd Neel
#রিপোষ্ট

Address

Kafrul
Mirpur
1206

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when গল্প নাম্বার-২ posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to গল্প নাম্বার-২:

Videos

Share

Category

Nearby media companies