boikini.com

boikini.com Official page of www.boikini.com All Kinds of Books & Magazine are available here with E-books.
(6)

প্রখ্যাত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-"মানুষ আপনার গান বিকৃত সু...
16/09/2024

প্রখ্যাত শিল্পী কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একবার বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিমকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন-

"মানুষ আপনার গান বিকৃত সুরে গায়। আপনার সুর ছাড়া অন্য সুরে গায়। অনেকে আপনার নামটা পর্যন্ত বলে না। এসব দেখতে আপনার খারাপ লাগে না...?"

শাহ্ আবদুল করিম বললেন-
"কথা বোঝা গেলেই হইল...
আমার আর কিচ্ছু দরকার নাই..."

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য আশ্চর্য হয়ে বললেন-
"আপনার সৃষ্টি... আপনার গান। মানুষ আপনার সামনে বিকৃত করে গাইবে। আপনি কিছুই মনে করবেন না... এটা কোন কথা... এটার কোন অর্থ আছে...?"

শাহ্ আবদুল করিম বললেন-
"তুমি তো গান গাও...
আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও তো...

ধর তোমাকে একটা অনুষ্ঠানে ডাকা হলো। হাজার হাজার চেয়ার রাখা আছে কিন্তু গান শুনতে কোন মানুষ আসে নাই। শুধু সামনের সারিতে একটা মানুষ বসে আছে...
গাইতে পারবে...? "
কালীপ্রসাদ কিছুক্ষন ভেবে উত্তর দিলেন-
"না... পারবো না..."
শাহ্ আবদুল করীম হেসে বললেন-
"আমি পারবো...
কারণ আমার গানটার ভেতর দিয়ে আমি একটা আদর্শকে প্রচার করতে চাই। সেটা একজন মানুষের কাছে হলেও। সুর না থাকুক... নাম না থাকুক... সেই আদর্শটা থাকলেই হলো। আর কিছু দরকার নাই... সেজন্যই বললাম শুধু গানের কথা বোঝা গেলেই আমি খুশি..."

কালীপ্রসাদ ভট্টাচার্য জানতে চাইলেই-
"সেই আদর্শটা কি...?"
শাহ আবদুল করীম আবার হেসে বললেন-
"একদিন এই পৃথিবীটা বাউলের পৃথিবী হবে..."
‘এই পৃথিবী একদিন বাউলের পৃথিবী হয়ে যাবে’।

এ কথাটা বলেছিলেন শাহ আব্দুল করিম। এবং উনার চোখে যে বিশ্বাস, মানে যুগ যুগ ধরে... আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, আমাদের দেশের কোনো রাষ্ট্রপতি কোনো প্রধানমন্ত্রীর চোখে এই বিশ্বাস নেই।... আমরা অনেক নেতাদের মুখে অনেক কথা শুনি, কিন্তু তারা বিশ্বাসে বলেন না কথাগুলো। তারা বলতে হয় বলে বলেন, নয় নিজের স্বার্থে বলেন, নয় লোককে ভুল বুঝানোর জন্য বলেন।...”
- কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য

একবার সুনামগঞ্জে তাকে সংবর্ধনা দেয়ার কথা। প্রোগ্রামের শেষের দিকে মাইকে ঘোষণা আসলো, এবারে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের হাতে তুলে দেওয়া হবে তিন লাখ টাকার সম্মাননা চেক।

আব্দুল করিম বার্ধক্যে উপনীত। তিনি বোধহয় কানে ভুল শুনলেন। তার বিশ্বাস হচ্ছিল না। তিনি পাশে বসে থাকা তার একমাত্র সন্তান জালালকে বললেন, জালাল ইতা কিতা কয়! তিন হাজার টাকা! এ তো অনেক টাকা! এত টাকা দিয়ে আমি কি করতাম!

আব্দুল করিমকে আস্তে করে জানানো হলো, তিন হাজার নয়, টাকার অংকটা তিন লাখ! শাহ আব্দুল করিম অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি হতভম্ব। তিনি বললেন, তিন লাখ? সর্বনাশ, অত টাকা! এগুলো নিয়্যা আমরা কিতা করমু? আমরার টাকার দরকার নাই, মানুষ যে ভালোবাসা দিছে, সেইটাই বড় প্রাপ্তি। চল চল বাড়ি চল। বলেই তিনি বেরিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন।

একজন মানুষ কতটা আর নির্লোভ হতে পারেন!

দেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সাথে সম্পর্কের অবনতি নিয়ে তিনি বলেন,

' হুমায়ূন সাহেব অত্যন্ত জ্ঞানী-গুণী মানুষ। আমি তাঁকে শ্রদ্ধাও করি। আমাকেও তিনি শ্রদ্ধা করেন, ভালোবাসেন। একবার তিনি টিভিতে একটি অনুষ্ঠান বানানোর জন্য একজন লোককে আমার কাছে পাঠালেন। প্রচার আমি কোনোসময়ই চাইনি, তখনো তা-ই করেছিলাম। কিন্তু লোকটির চাপাচাপিতে ঢাকা গেলাম। হুমায়ূন সাহেব আমার সাক্ষাত্কার নেওয়ালেন, গান গাওয়ালেন। আমি ফিরে আসার সময় উনি সৌজন্যসাক্ষাত্টুকু পর্যন্ত করলেন না, গাড়ির ড্রাইভারকে দিয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলেন। আমার হাসি পেল। এই টাকার জন্য কি আমি এতদূর ঢাকা ছুটে গিয়েছিলাম? আমি হাওরের বনে-বাদাড়ে বড় হয়েছি, মনটা সে রকমই বড়। টাকা আমার কাছে কিছুই না। এই করিম টাকার ধান্ধা করলে এতদিনে অনেক বড়লোক হতে পারত! কই, কখনো তো টাকার পেছনে ছুটিনি। এ ঘটনাটি আমাকে খুব পীড়া দেয়। পরে অনুষ্ঠানটি প্রচারের তারিখও তিনি আমাকে জানাননি। সে ঘটনাই আমি সাক্ষাত্কারে বলেছিলাম। পরে আর কখনো হুমায়ূন আহমদের কাছে যাইনি। সত্য কথা বলার কারণে যদি সম্পর্কের অবনতি হয়ে থাকে—তাতে তো আমার আর কিছুই করার নাই।'

ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ কাকে বলে বাউল দেখিয়ে গিয়েছেন।

তিনি একবার বলেছিলেন,
'এত সংবর্ধনা, সম্মান দিয়ে আমার কী হবে? সংবর্ধনা বিক্রি করে দিরাই বাজারে এক সের চালও কেনা যায় না। পেটে যদি ভাত না থাকে করিম মেডেল গলায় দিয়ে কী করবে?'

স্পষ্টতায়, স্পর্ধায় কাটিয়েছেন এক বাউল জীবন।

প্রকৃতি ছিল তার প্রথম শিক্ষক। প্রকৃতিই তাকে নিখাদ সোনা করে গড়ে তুলেছে। পার্থিব জীবনের প্রায় দুই যুগ ধরে প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা গ্রহণ করেনি। এরপর তিনি ভর্তি হন নাইট স্কুলে। স্বাক্ষরজ্ঞান লাভের পর তিনি তার সহপাঠীদের নিয়ে গাজীর গান, বাউলা গান, ঘাটু গান, পালাগান, সারিগান, মালজোড় গান, কবিগানসহ বিভিন্ন অতি প্রাকৃতজনের গান গাইতেন। সে সময় ভাটি অঞ্চলের হাওরে নাও বাইছ (নৌকা বাইছ) হতো তখন করিম তার সহপাঠীদের নিয়ে নাওয়ে উঠে গাইতেন ‘কোন মেস্তুরী নাও বানাইছে কেমন দেখা যায় ঝিল-মিল-ঝিল-মিল করেরে ময়ূরপঙ্খী নাও’। এভাবে গানের মধ্য দিয়ে চলে তার বাউলগান চর্চা।

ছিলেন রাখাল বালক। স্কুলে কয়েকদিন মাত্র গিয়েছেন। সারাজীবন দরিদ্রতার সাথে লড়াই করেছেন। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন প্রিয়তমা স্ত্রী সরলা। তবু গান ছেড়ে যান নি করিম। বরং এইসব প্রতিকূলতা তাকে আরো দৃঢ়চেতা করেছে।

ঈদের নামাজে গেছেন। এক মুরুব্বি তাকে দেখেই বললেন, 'করিম ইসলাম ধ্বংস কইরা ফালাইতাছে। গানবাজনা ইসলামে হারাম, এরপরও সে গান গাইতাছে। এইটার বিহিত করা দরকার'।

তিনি ইমাম সাহেবকে সামনে রেখে সব মানুষের সামনে তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, 'গান গাওয়া ইসলামে হালাল কি না?' ইমাম সাহেব বললেন—'গানের সুরে যদি আল্লাহকেও ডাকে, তাহলেও গুনা হবে'।

ব্যাস, আর যায় কই? ওই মুরুব্বি তাকে জিজ্ঞেস করলেন—গান ছাড়ব কি না?তিনি বললেল—সেটা কখনোই আমি পারব না। উত্তর শুনে ওই মুরুব্বি মানুষটি রেগে গেলেন। তিনি বললেন, 'এত স্পর্ধা, ইমাম সাহেব ও মুরুব্বিদের মুখের ওপর কথা। সেটা মেনে নেওয়া যায় না।'

এরপর তিনি বললেন, 'এখন বললাম গান ছেড়ে দেব, পরে ছাড়লাম না। তাই এ ধরনের মিথ্যা কথা আমি বলতে পারব না। নিজে যা বিশ্বাস করি, তা-ই বলেছি। আপনার যদি এ কারণে আমাকে গ্রামে জায়গাও না দেন, তাতেও আমি রাজি।

এরপর থেকে প্রায় প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামাজের আগে-পরে মসজিদে মুসল্লিরা তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে—গান-বাজনা করে তিনি নাকি বেশরা কাজ করছেন।

তখন গ্রামের আশপাশে সারারাত ধরে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই ওয়াজে দেশের বিশিষ্ট ওয়াজিরা এসে আল্লা-রসুলের নাম না-নিয়ে উনা শ্রাদ্ধ করার কাজে যোগ দিয়েছিল। রাতভর অকথ্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করত। শেষে একসময় পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে গ্রাম ছাড়েন।

গানের জন্য তাকে ধর্মজীবীরা একঘরে করেছে, স্ত্রী সরলা আর শিষ্য আকবরের জানাযায় অংশ নেয় নি এলাকাবাসী।

শাহ আবদুল করিম লালনের সুযোগ্য শিষ্য। কেন? কারণ-শাহ্ আবদুল করিম তাঁর স্ত্রীকে মনে করতেন মুর্শিদ। ‘মুর্শিদ’ শব্দটার অর্থ-নেতা (আধ্যাত্মিক অর্থে অবশ্য)। শাহ আবদুল করিমের স্ত্রীর নাম ছিল আবতাবুন্নেছা। করিম আদর করে ডাকতেন: 'সরলা।'

স্ত্রীকে ‘মুর্শিদ’ মনে করাটা সহজ নয়। অনেক শিক্ষিত আধুনিক পুরুষও এক্ষেত্রে পিছিয়ে। কেন? ঈশ্বর পুরুষ বলেই?। করিম কেন পারলেন? করিম বাউল বলেই পারলেন। বাউল বাংলার ধর্ম- বাংলা মাতৃতান্ত্রিক বলেই।

বাউলের স্ত্রী সরলা মারা যাওয়ার পর গ্রামের ইমাম সাহেব বললেন—'বাউলের স্ত্রীর জানাজা পড়ানোর দরকার নাই।' আবার তার প্রিয় শিষ্য আকবর মারা যাওয়ার পর মসজিদের মাইকে তার মৃত্যুর সংবাদ প্রচার করেনি। তার দোষ, সে বাউলের সঙ্গে থেকে গানটান গেয়ে নাকি বেশরা ও ইসলাম বিরোধী কাজ করেছে। তাই সে বাউলের মতোই কাফের হয়ে গেছে। তিনি বলেন,'বেতনভোগী ইমামের কথা শুনে আর রাগে-দুঃখে নিজেই আমার বাড়িতে কবর খুঁড়েছি। আকবরের জানাজা পড়িয়ে দাফন করেছি। গ্রামের কেউ কেউ আইছিল, কেউ কেউ আয়ে নাই।'

গ্রামীণ ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের আচরণে বাউল আবদুল করিম নিজেকে পরিচয় দিয়েছিলেন 'কুলহারা কলঙ্কিনী' বলে। শহরে এসে বাউল আবিষ্কার করেন, এখানকার 'শিক্ষিত' মানুষেরাও তাকে মানুষ ভাবতে পারে না। সেজন্যই হয়ত আবদুল করিমকে গাইতে হয়েছে, 'এ জীবনে দূর হলো না.. বাউল করিমের পেরেশানি!'

'মানুষের' দেওয়া এসব কষ্ট বুকে নিয়ে আজকের এই দিনে পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বাউল শাহ আবদুল করিম!

বাড়ির কাছে উজানধল বাজার। চাল আনতে সেখানে গেছেন তিনি। ফিরে এলে চুলো জ্বালাবেন— এ অপেক্ষায় বসে রইলেন গিন্নি। সামান্য সময়ের ব্যাপার এ বাজারসদাই। অথচ ঘণ্টা পেরিয়ে দিন যায়, সপ্তাহ পেরোয়। অবশেষে ১৮ দিন পর খবর পাওয়া গেল তিনি আছেন হবিগঞ্জে। এক ভক্তের বাড়িতে গান করছেন। এমনই খেয়ালি মানুষ ছিলেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম।

শাহ আবদুল করিম শুধুমাত্র বাউল ছিলেন না, তিনি একাধারে গণসংগীত শিল্পীও। সারাজীবন শোষিত বঞ্চিতদের পক্ষে গান লিখেছেন। তাঁর আঘাতের লক্ষ্য ছিলো ভণ্ড রাজনীতিবিদ, শোষক, পুঁজিবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ। ধর্মের অপব্যবহার তো অবশ্যই।

শাহ আবদুল করিমের গানে বৈষ্ণব ধারার মীড়াশ্রয়ী সুরের ঝংকারের সঙ্গে সুফী ধারার গতিপ্রধান ছন্দের সম্মিলন ঘটেছে।

শাহ আব্দুল করিম রচিত পাঁচশতাধিক গানে যেমন সিলেটের ঐতিহ্য ও শিকড়ের সন্ধান মেলে তেমনি বৈষ্ণব-সুফী ধারার সাধন-ভজনের পরিচয়ও পাওয়া যায়। একদিকে বাস্তবজীবনের কঠিন কঠোর পথপরিক্রমা অন্যদিকে জগত-জীবন সম্পর্কে গভীর পর্যবেক্ষণ, সৃষ্টির রহস্য নিয়ে কৌতূহল শাহ আব্দুল করিমকে করে তুলেছে বাউল মরমী।

বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের পূর্বসূরি মরমি সাধকরা তত্ত্বকথা বলে গেছেন। সমাজে সাম্য সৃষ্টির আন্দোলন করেছেন। কিন্তু শাহ আবদুল করিমের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন মাত্রার। দেশের, দশের, জনগণের, সমাজের দুঃখ-দুর্দশার কথা তিনি তাঁর রচনায় উল্লেখ করে ভিন্নধর্মী সংগ্রাম করেছেন।

আবদুল করিমের জীবন সংগ্রাম এবং গানের সাধনা দেখে মনে হয়, এ যেন বিদ্রোহী কবি নজরুলেরই গল্প। নিজের দারিদ্রের কথা গানের মধ্য দিয়ে বলতে গিয়েই শাহ আবদুল করিম লিখেছিলেন, ‘মাঠে থাকি গরু রাখি, ঈদের দিনেও ছুটি নাই, মনের দুঃখ কার কাছে জানাই’।

শাহ আবদুল করিম কাগমারী সম্মেলনে গান করে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্যে আসেন এবং তাদের শ্রদ্ধা আদায় করে নেন।

শাহ আবদুল করিম বেড়ে ওঠার সময় লোক সাহিত্যের একটি উজ্জ্বল পরিবেশ ছিল। শাহ আবদুল করিম ৫৪'র নির্বাচন ৬৯,এর গণ আন্দোলন, ৭১'এর মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর গণঅভ্যুত্থানসহ প্রতিটি পর্যায়ে স্বরচিত গনসঙ্গীত পরিবেশন করে জনতাকে দেশ মার্তৃকার টানে উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। তাঁর গণসঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে মাওলানা আবদুল হামিদ থান ভাসানী তাঁর পিটে হাত রেখে বলেছিলেন-বেটা, গানের একাগ্রতা ছাড়িও না, তুমি একদিন গণ মানুষের শিল্পী হবে।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গণসঙ্গীত শুনে একশ পঁচাশি টাকা দেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১১ টাকা দিয়ে বলেন, তোমার মতো শিল্পীকে উপযুক্ত মর্যাদা দেয়া হবে।

মুখের বোল কাইড়া নিবে
রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে
আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলবো
প্রয়োজনে রক্ত দেবো
জীবন দিয়ে বাংলা রাখবো
ঢাকায় রক্ত দিছে বাংলা মায়ের সন্তান
আমরা রাখবো তাদের মান।।
~বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম,

(গানটি তাৎক্ষণিকভাবে বেধেছিলেন যখন শোনেন ঢাকার রাজপথ ভাষার জন্য রক্তে রঞ্জিত হয়েছে; ১৯৫২'র ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি নেত্রকোনার একটি মঞ্চে গান গাইছিলেন।)

তার লেখা বইগুলো হচ্ছে- ‘আফতাব সঙ্গীত’ (আনু. ১৯৪৮), ‘গণসঙ্গীত’ (আনু. ১৯৫৭), ‘কালনীর ঢেউ’ (১৯৮১), ‘ধলমেলা’ (১৯৯০), ‘ভাটির চিঠি’ (১৯৯৮), ‘কালনীর কূলে’ (২০০১) ও ‘শাহ আব্দুল করিম রচনা সমগ্র’ (২০০৯)।

শুধু সুরের মূর্ছনায় সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে তাঁর কাছ থেকে বাহবা কুড়িয়ে নেয়ার লক্ষ্য আর সাধারণ গায়কের মতো ছিল না। তিনি সাধারণ মানুষের খুব কাছাকাছি থাকতেন বলেই তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও সুখ-দুঃখের সাথে তাঁর গভীর পরিচয় ছিল। তাঁর গানের কথা বা ভাষাগুলো তাই প্রমাণ করে। তাঁর গানের মধ্যে সাধারণ মানুষেরই চাওয়া-পাওয়ার সুরই বেজে উঠেছে।

“কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া
আমি ফুল, বন্ধু ফুলের ভ্রমরা
সখী গো আমি ফুল, বন্ধু ফুলের ভ্রমরা।”

একবার এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন- ‘আমি বেহেস্ত, দোজখ চাই না। জীবিত অবস্থায় আমার ভাটি অঞ্চলের বিপন্ন মানুষের সুখ দেখতে চাই। ওই মানুষগুলোর সুখ যারা কেড়ে নিয়েছে আমার লড়াই তাদের বিরুদ্ধে। একসময় তত্ত্বের সাধনা করতাম, এখন দেখি তত্ব নয়, নিঃস্ব-বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেহতত্ত্ব, নিগূঢ়তত্ত্ব, আর সোনার বাংলা সোনার বাংলা করলে হবে না। লোভী, শোষক, পাপাত্মাদের আঘাত করতে হবে।’

'বসন্ত বাতাসে সইগো
বসন্ত বাতাসে
বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ
আমার বাড়ি আসে
সইগো বসন্ত বাতাসে...'
-বাউল শাহ আব্দুল করিম

একবার তিনি রেডিও'র একটা চেক ভাঙ্গাতে গেলেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। আব্দুল করিমের পরনে ছেঁড়া পাঞ্জাবি। তাকে দেখে ব্যাংকের কেউ কি ভেবেছে কে জানে! কিন্তু আব্দুল করিম ভীষণ অপমানিত বোধ করেছেন। তিনি বিলাতে গান গাইতে গিয়েছেন। সেখানে দেখেছেন, মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখা হয়। কিন্তু নিজের দেশে দেখলেন এখানে মানুষের মর্যাদা পদ পদবিতে, পোষাকে, চেহারায়।

সাক্ষাৎকারে তিনি আক্ষেপ নিয়ে বলেছিলেন,
আমার পাঞ্জাবি ছেঁড়া তো কি হয়েছে, আমি কি এই দেশের নাগরিক না? আমার লুঙ্গিতে নাহয় তিনটা তালি বসানো, কিন্তু আমি তো ট্যাক্স ফাঁকি দেই নাই কখনো। তাহলে এত ব্যবধান, এত বৈষম্য কেন? মানুষ তো মানুষের কাছে যায়। আমি তো কোনো বন্যপশু যাইনি। বন্যপশুরও অনেক দাম আছে, এদেশে মানুষের কোনো দাম নেই, ইজ্জত নেই।

বসন্তে জন্মছিলেন বলেই হয়ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মাটির গন্ধ গলায় তুলে নিয়েছিলেন বাউল শাহ আব্দুল করিম।লাল সবুজের সুরের ডাক নাম শাহ আব্দুল করিম।

শাহ আবদুল করিমের ভাটির সুরের গান শুনে মনের তলায় জল ছলছল করে। বাঙালি মন লোকসুরের জাদুতে যত ভোলে, আর কিছুতে ততটা মজে বলে মনে হয় না। মায়ার টান খুব শক্তিশালী, যেমন তিনি লিখেছেন, ‘বন্ধে মায়া লাগাইছে’!

এই মায়ার টানে তিনি কোনোদিন কালনি নদী ছেড়ে যাননি। মায়ার টানে পড়েই গ্রামীণ মানুষের সুখ–দুঃখ, প্রেম–ভালাবাসার ব্যালাড রচনা করে গেছেন।

গ্রিক নন্দনের শক্তি যেমন ট্র্যাজিক চেতনা, বাংলা সংস্কৃতির মর্মে তেমন পাই মায়া। মানুষের প্রতি মায়া, ছেড়ে আসা গ্রামের প্রতি মায়া, প্রকৃতির প্রতি মায়া—এমন হাজারো মায়ার টানে ভোগা মানুষ জানে, মায়ার বন্ধন কত শক্তিশালী। মৃত্যু ছাড়া তার বন্ধন নাকি ছেঁড়া যায় না।

শাহ আবদুল করিমের জীবন ও সৃষ্টিকর্ম ছেঁকে নিলে যা পাই, তা এই মায়া। মায়া বাংলাদেশের কৃষক সংস্কৃতির মূল রস। এটা আমাদের আধুনিক সাহিত্যেও ছড়িয়ে গেছে।

একজন স্বশিক্ষিত কবি। তার চেতনাই তার সৃজনের জ্ঞানশিক্ষা। বাংলার মাটি, জল, সবুজ, সুন্দরমা প্রকৃতিই তাঁর পাঠশালা। সেই পাঠশালার চিত্রছায়ায় পাঠ নিতে নিতে তিনি অনুধাবন করেছেন জীবনকে, জীবনের একক নিয়ামক শক্তিকে।তাইতো তিনি অকপটে বলতে পারেন, ‘কেউ বলে দুনিয়া দোজখ, কেউ বলে রঙের বাজার / কোনো কিছু বলতে চায় না, যে বুঝেছে সারাসার।’

তাঁর সবচেয়ে বড় পুরস্কার বোধহয় মানুষের ভালোবাসা। শাহ আবদুল করিমের গান মানুষের মুখে মুখে। আরও হাজার বছর বেঁচে থাকবে তার গান। তার গান গেয়ে অনেক শিল্পী জনপ্রিয় হয়েছেন। ভবিষ্যতেও হবে। দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও বহুল চর্চা হচ্ছে তার গান। একজন সুর সাধকের জন্য এরচেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে!!

শেষ বয়সে এসে বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিম দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্ট, কিডনির জটিলতা, ফুসফুসে ইনফেকশন এবং বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন।

চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায়ই ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে উজান ধল গ্রামে স্ত্রী সরলা বিবির কবরের পাশে সমাহিত করা হয়।

কালণীর ঢেউ আছড়ে পড়া উজানধলের বাড়িতে প্রিয়তমা স্ত্রী সরলার পাশে আজ চিরনিদ্রায় শায়িত বাউল সম্রাট । সেই সমাধি ঘিরে আজো প্রতিটি ক্ষণে বেজে উঠে তার শিষ্যদের বাঁশির করুণ রাগিনী কখনোবা কাঠিঢোলে উতাল শব্দে মুখর হয়ে উঠে উজান ধলের আকাশ বাতাস।

‘চলিতে চরণ চলেনা, দিনে দিনে অবশ হই, আগের বাহাদুরি এখন গেলো কই’ মৃত্যুর কিছুদিন আগেই তিনি গানটি লিখেছিলেন।

প্রতিটি মানব জীবনের চরম বাস্তবতার কথা এতটা সহজে বলতে পারার অসম্ভব ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন শাহ আবদুল করিম।

বসন্তে বাতাসে মিশেও থাকে বাউল, মিশে থাকেন শাহ্ আব্দুল করিম।

আজ ১২ই সেপ্টেম্বর, বাউল আব্দুল করিমের ১৫তম মৃত্যুবার্ষিকী
❝আশা করি আলো পাব ডুবে যাই অন্ধকারে
কেমনে চিনিব তোমারে...

মৃত্যুদিনে স্মরণ!

বিনম্র শ্রদ্ধা বাউল সম্রাট শাহ্ আব্দুল করিম ❤
কলমে মোশাররফ মাতুব্বর

#স্বাধীনতা

---------|জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি|---------.........||ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ||..........প্রথম জীবনের প্রণয়ঘটিত ব্যর্থতার যন্ত্র...
14/09/2024

---------|জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি|---------.........||ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ||..........

প্রথম জীবনের প্রণয়ঘটিত ব্যর্থতার যন্ত্রণা উপশমে তার সঙ্গী হয়েছিল মদের বোতল! মদ ছেড়ে পরে আবার ধরেছিলেন আফিমের নেশা, তখন তিনি রেঙ্গুনের এক মিস্ত্রিপল্লিতে ঘর ভাড়া করে থাকতেন। আবার আপদে-বিপদে সর্বদা এলাকার মানুষজনের একমাত্র সহায় ছিলেন সেই তিনিই, হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিতেন মানুষের অসুখে। এই অদ্ভুত ছন্নছাড়া মহাপ্রাণ আসলে আমাদের শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

ফ্রেঞ্চ বোহেমিয়ানিজমের স্পষ্ট প্রভাব ছিল তার জীবনযাপনে। লেখালিখির ক্ষেত্রে গুরু মানতেন ফরাসি সাহিত্যিক এমিল জোলা'কে, যদিও তার সৃষ্টির সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশি দেখা যায় চার্লস ডিকেন্সের সাথে। দু'জনের সাহিত্য রচনার পেছনেই যেন সবকিছুকেই পূনর্গঠনের একটা তাগিদ ক্রিয়মাণ ছিল। চরিত্র নির্মাণের ধরনে পার্থক্য থাকলেও দু'জনের লেখাতেই আবেগের আতিশয্য, অতিনাটকীয়তা, মানসিক সহানুভূতির সংবেদনশীল দৃষ্টিকোণের উপস্থিতি নিশ্চিত, সে দৃঢ় চরিত্রের 'সব্যসাচী' হোক কিংবা ধ্বসে যাওয়া 'দেবদাস' হোক!

শেষ করার আগে শুধু একটি কথা ...
অবনত শিরে সশ্রদ্ধ সালাম, অপরাজেয় কথাশিল্পী।

সেই ১৬ বছর বয়সে পালিয়ে গিয়েছিলেন ৩১ বছরের প্রেমিক গণপত রাও ভোঁসলের সঙ্গে। বিয়ের পর প্রেমিক হয়ে গেলো অত্যাচারী, মদ্যপ। দি...
10/09/2024

সেই ১৬ বছর বয়সে পালিয়ে গিয়েছিলেন ৩১ বছরের প্রেমিক গণপত রাও ভোঁসলের সঙ্গে। বিয়ের পর প্রেমিক হয়ে গেলো অত্যাচারী, মদ্যপ। দিনে চারটে লোকের বাড়িতে রান্না করে ছেলেমেয়ে মানুষ করেন, নিজে চালিয়ে যান গান। গান ছাড়া আপনার প্রিয় নেশা রান্না, তা ওই পুরোনো অভ্যাস থেকে। একবার বলেওছিলেন, "গায়িকা না হলে আমি শেফ হতাম।"

অত্যাচার সীমা ছাড়ালে স্বামীকে ছেড়ে দুই সন্তানকে নিয়ে যখন সংসার ছাড়েন, তখন আপনি অন্তঃস্বত্তা। তবু ভোঁসলে পদবি ছেড়ে আবার মঙ্গেশকর হতে চাননি ।
তাতেও কি যন্ত্রণা কমেছে আপনার‌ ?

সুরকার ও পি নায়ারের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, ভেঙেছে। দিদি লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তিক্ত হয়েছে সম্পর্ক।
রাহুলদেবের সঙ্গে প্রেম করে বিয়ে করেছেন, শেষ দিকে আগের মতো সম্পর্ক মধুর ছিল না। রাহুল থাকতেন আলাদা।

২০১২ সালে আপনার সাংবাদিক মেয়ে বর্ষা আত্মহত্যা করে অবসাদ থেকে।
২০১৫ সালে ছেলে হেমন্ত মারা যায় ক্যান্সারে, আপনি তখন সিঙ্গাপুরে শো করছেন। ছেলের সঙ্গেও সম্পর্ক শেষ দিকে ভালো ছিল না, ওর বউকে কেন্দ্র করে।

এত ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি সহ্য করে জনসমক্ষে যখন আজও আপনি গান করেন, মনে হয়, কোটি টাকার ঝাড়বাতি জ্বলে উঠলো সুরে, প্রাণশক্তিতে। এত প্রাণশক্তি কোথায় পান ? নিশ্চয়ই ‘জীবন গান’ থেকে। যে গানে গলা একবার তারসপ্তকে ওঠে, একবার নামে। একবার সুখ হাসে, একবার যন্ত্রণা এসে হাজির হয়। একদম আপনার জীবনের মতো।
আর একাকিত্ব ? সেতো আপনি লাখো মানুষের মাঝে থাকলেও অনুভব করতে পারেন .... যদি সেটাই হয়ে থাকে আপনার নিয়তি !
শুভ জন্মদিন আশা ভোঁসলে।
🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏🙏

*************************************
_সংগৃহীত পোস্ট _
#অনুপ্রেরণা #কলকাতা #বন্দেমাতরম

প্রাচীন চীনের সিল্ক রোড বিষয়ে প্রামাণ্য ইতিহাস চীনা ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত।
30/08/2024

প্রাচীন চীনের সিল্ক রোড বিষয়ে প্রামাণ্য ইতিহাস চীনা ভাষা থেকে বাংলায় অনূদিত।

কলকাতায় প্রায় দেড় বছর বস্তির ঘরে জীবন কাটিয়েছেন। খেতেন পাইস হোটেলে, কিন্তু তাঁর নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানা ছিল না। খিদের সময়...
26/08/2024

কলকাতায় প্রায় দেড় বছর বস্তির ঘরে জীবন কাটিয়েছেন। খেতেন পাইস হোটেলে, কিন্তু তাঁর নির্দিষ্ট কোনও ঠিকানা ছিল না। খিদের সময় পথের ধারে যেটি চোখে পড়ত সেখানেই বসতেন৷ হাতে তিনটি টাকা থাকলে লাভপুর যেতেন৷ কিছু লিখে দশটা টাকা জোগাড় হলেই কলকাতায় ফিরে আসতেন৷ বিভিন্ন-পত্রিকা সম্পাদকের কাছে নিজের লেখা গল্পগুলো দিয়ে করুণ আবেদন, যেন ওই গল্পগুলো প্রতিমাসে প্রকাশিত হয় তাহলে তিনি কিছু টাকা পাবেন,কারণ চুড়ান্ত আর্থিক অনটন..💫🌿

১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছ'মাস জেল খেটে কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছিলেন 'সাহিত্যে সেবার পথেই দেশের সেবা'৷ নিজের প্রথম উপন্যাস 'চৈতালী ঘূর্ণি' নিজের খরচে ছাপিয়েছিলেন শুধু তাই নয়,বইগুলি বিক্রির জন্য যে দোকানে রেখেছিলেন সেই দোকানের কর্মচারী বলেছিলেন 'বইগুলো নিয়ে যান আপনি৷ঝাঁকামুটে ডেকে আনুন,বিক্রি হয় না৷ ও দিয়ে জায়গা জুড়ে রাখতে পারব না আমরা'৷ সাহিত্যিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে তারাশঙ্কর কে সহ্য করতে হয়েছে অনেক অবহেলা,অবজ্ঞা,এই ঘটনা তার এক উদাহরণ।

একদিন হঠাৎ দেখা হয়েছিল শিল্পী যামিনী রায়ের সঙ্গে,তিনি তারাশঙ্কর কে অনুপ্রাণিত করে বলেছিলেন কেন দেশে? কলকাতায় চলে আসুন৷ তারাশঙ্কর কলকাতায় এসে আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছিলেন,তবে সেখানে আত্মসম্মান নিয়ে বেশিদিন কী করে থাকা যায়! অশ্বিনী দত্ত রোড,মহানির্বাণ রোড ও মনোহরপুকুর রোডের সংযোগস্থলে একটি টিনের ঘর ভাড়া করলেন৷ গাঁয়ের জমিদার সেদিন হয়েছিলেন মহানগরীর একটি টিনে ছাওয়া বাড়ির পাঁচ টাকার ভাড়াটে৷

কলকাতায় তখন এক পেয়ালা চায়ের দাম মাত্র দু'পয়সা আর সেই আমলে কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এক মাসে শুধু চা খেয়ে ফেলেছিলেন অনেকটা টাকার৷ সারাদিন ধরে শুধু লিখেই চলেছেন,খিদে পেলে কেবল চা খেয়ে নেন,খাওয়া-দাওয়ার দিকে নজর দেওয়ার ফুরসৎ নেই৷ লেখার ঝোঁকে দুরারোগ্য কোলাইটিস-গ্যাসট্রিকের শিকার হয়েছেন৷

বস্তি আর বউবাজারে থাকার সময় শরীরের উপর সাংঘাতিক অত্যাচার করেছেন, জেলজীবনে শরীরে বাসা বেঁধেছিল অর্শ সহ নানা আন্ত্রিক ব্যাধি৷ তারাশঙ্কর সেসব কিছু ধর্তব্যের মধ্যে আনতেন না,চোখে তখন কেবল স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক হবেন,আর্থিক অনটন কাটিয়ে উঠবেন৷

কৈশোর বেলায় রাজনীতি দোলা দেয়, তিনি যখন নবম শ্রেণীর পড়ুয়া৷ রামপুরহাট থেকে গ্রেফতার হলেন বিপ্লবী দু'কড়িবালা দেবী, শুনেছিলেন সেই মহিয়সী নারী #বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠেছেন,তাঁকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ মনের আবেগে তাঁকে দেখতে গেলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা না হলেও দেখা পেয়েছিলেন আরেক বিপ্লবী নলিনী বাগচীর সাথে,যিনি পুলিশের সাথে মুখোমুখি লড়াইয়ে আত্মহুতি দিয়েছিলেন৷ বিপ্লবীদের সঙ্গে তারাশঙ্করের যোগাযোগ ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশের চোখ এড়ায়নি। ১৯৩০ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে ছ'মাস জেল খেটে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রকাশ্যে বলেছিলেন 'সাহিত্যে সেবার পথেই দেশের সেবা'৷
মেজভাই কে সঙ্গে নিয়ে বোলপুরে একটি প্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভেবে রেখেছিলেন ওই প্রেস থেকে তিনি একটি দেশপ্রেম প্রচার পত্রিকা প্রকাশ করবেন৷ প্রশাসন ওই প্রেসে খানাতল্লাস করেছিল৷ দাবি করা হয়েছিল দু'হাজার টাকার জামানত, নেতাজি সুভাষচন্দ্র তারাশঙ্কর কে পরামর্শ দিলেন জামানত না দিয়ে বন্ধ করে দিন প্রেস..🥀

তারাশঙ্করের বউবাজারের মেস ছিল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মেস৷ এই মেস প্রবাসে বিচিত্র সব মানুষের সঙ্গে পরিচয় কিংবদন্তি কথা সাহিত্যিকের শিল্পিমানসকে বিপুল সমৃদ্ধ করেছে৷ ১৩৪৪সালে বসন্ত কালে বউবাজারের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মেস থেকে চলে এলেন হ্যারিসন রোডের 'শান্তিভবন'বোডিংয়ে৷ ততদিনে তাঁর মুদ্রিত গল্পের সংখ্যা পঁচাত্তর, প্রকাশিত গ্রন্থ সাত, সাহিত্য সাধনার জন্য পুরস্কার পেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের কাছে৷

পল্লী-কর্মী সন্মেলনে তাঁকে দেখে রবীন্দ্রনাথ চিনতে পেরেছেন অভিভূত হয়েছিলেন। তারাশঙ্কর, কথাপ্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ তারাশঙ্কর কে বলেছিলেন, “তোমার মত গাঁয়ের মানুষের কথা আমি আগে পড়িনি...।”💙🌻

♦️তথ্যসূত্রঃ তারাশঙ্করের শিল্পী মানস (ড.নিতাই বসু)

১৯৩৩ সালে রোমানিয়ান সাহিত্যিক মির্চা এলিয়াদ লিখেছিলেন "লা নুই বেঙ্গলি" অথবা "দ্যা বেঙ্গলি নাইটস"। প্রত্যুত্তরে প্রায় ৪১ ...
25/08/2024

১৯৩৩ সালে রোমানিয়ান সাহিত্যিক মির্চা এলিয়াদ লিখেছিলেন "লা নুই বেঙ্গলি" অথবা "দ্যা বেঙ্গলি নাইটস"। প্রত্যুত্তরে প্রায় ৪১ বছর পর ১৯৭৪ সালে মৈত্রেয়ী দেবী লিখলেন "ন হন্যতে"। অর্থাৎ- যার কোন মৃত্যু নেই। কিন্তু কেন এই গল্পের প্রত্যুত্তরে গল্প?

মির্চা এলিয়াদ ভারতবর্ষে এসেছিলেন ১৯৩০ এর দশকের গোড়ায়। উদ্দেশ্য ভারতীয় দর্শনশাস্ত্রে দীক্ষা গ্রহণ। বয়স তখন হয়তো নিতান্তই চব্বিশ কিংবা পঁচিশ। মাথা গোঁজার আর জলখাবারের ব্যবস্থাও হয়েছিলো গুরুগৃহেই। আর সেই গুরুর কন্যাই ছিলেন মৈত্রেয়ী দেবী।

মৈত্রেয়ী দেবী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছাত্রী। তৎকালীন গোঁড়া সমাজে তিনি ছিলেন বেশ উন্নত চিন্তার অধিকারী। তার পরিবারও ছিল অনেকটাই উদারপন্থী। আর তাই সুযোগ হলো দুজনের আলাপের। সেই আলাপ থেকে ক্রমে ভালো লাগা, আর অবশেষে প্রণয়।

কিন্তু মির্চা আর মৈত্রেয়ী দুজনই জানতেন, মৈত্রেয়ীর পরিবার যতই উদারপন্থী হোক, এই সম্পর্ক তারা কোনদিনই মেনে নিবেন না। বরং মির্চা হবেন ঘরছাড়া। আর মির্চাও গুরুর কথার অমান্য করবেন না।

আর হলোও তাই। মৈত্রেয়ীর ছোট বোন, যিনি কিনা আগে থেকেই মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত ছিলেন, ভাবতে থাকলেন মির্চা কেবল মৈত্রেয়ীকেই কেন ভালোবাসে? আর এই কষ্ট থেকেই মা'কে পুরো ঘটনা জানিয়ে দেন।

ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মির্চাকে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন মৈত্রেয়ীর বাবা। গুরুর আদেশ ফেলেননি মির্চা। এক কাপড়ে বেরিয়ে পরেন। আর দোতলা থেকে মির্চাকে বেরিয়ে যেতে দেখে জ্ঞান হারান মৈত্রেয়ী। জানা যায়, পরবর্তীতে মির্চা আর মৈত্রেয়ী বিচ্ছেদের দায় আর অপরাধবোধে মৈত্রেয়ীর ছোট বোন আত্মহত্যা করেন।

মৈত্রেয়ী এরপরও অনেকবার অনেকের মাধ্যমেই মির্চার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু মির্চা কোন পথ খোলা রাখেননি। এরপর বহু বছর পরও যখন মৈত্রেয়ী মির্চার ভারতে আসার খবর পান, তখনও মির্চাকে দেখার চেষ্টা করেন। কিন্তু মির্চা দেখা করেননি।

আমি দুটো বই-ই পড়েছি। সত্য বলতে মির্চার দিকটা আমার কাছে এখন অব্দি ভীষণ ঘোলাটে। তবে মৈত্রেয়ীর ভালোবাসা যে আদতেই ন হন্যতে ছিল, তাতে বোধহয় কোন সন্দেহের স্থান নেই।

#অনুপ্রেরণা #কলকাতা

ক্ষমা করো হে বাঙালি জাতির পিতা...
15/08/2024

ক্ষমা করো হে বাঙালি জাতির পিতা...

একশ’ একুশ বছর আগের কলকাতা। চৌরঙ্গি অঞ্চলে তখন অনেক ফাঁকা। রাস্তাঘাটও নতুন। ১৯০৩ সালে একদিন লোকজন অবাক হয়ে দেখল একটা অদ্...
12/07/2024

একশ’ একুশ বছর আগের কলকাতা। চৌরঙ্গি অঞ্চলে তখন অনেক ফাঁকা। রাস্তাঘাটও নতুন। ১৯০৩ সালে একদিন লোকজন অবাক হয়ে দেখল একটা অদ্ভুত জিনিস বেশ জোরে ছুটে চলেছে ধর্মতলার দিকে। একটা গাড়ি। কিন্তু তাতে চারটে চাকা লাগানো। সম্পূর্ণ ঢাকা। ভেতরে সামনের আসনে বসে এক সাহেব একটা চাকার মত কী যেন ঘোরাচ্ছে। ঘরঘর আওয়াজ করতে করতে গাড়িটা ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে পোঁ পোঁ করে হর্ণ বাজছে। ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক ভদ্রলোক বিজ্ঞের মত বললেন, 'এর নাম মটর গাড়ি। এটা হাওয়ায় চলে। বিলেত থেকে এয়েচে।
১৮৯৫ সালে ফ্রান্সের ডেইমলার মোটর কোম্পানির প্রতিনিধি কলকাতায় এসে ম্যাজিক লণ্ঠনে রঙীন ছবি দেখিয়ে মোটরের নানারকম সুবিধের কথা বুঝিয়ে দিলেন। এর পরের বছরে অর্থাৎ ১৮৯৬ সালে কলকাতার পথে প্রথম মোটর দেখা গেল প্রাথমিক অবস্থায়। প্রথম দিকে মোটরের ইঞ্জিন, টায়ার সবকিছুই আসত বিলেত থেকে। এখানে বিখ্যাত গাড়িওয়ালা স্টুয়ার্ট আর ডাইকস্ সেই সব জিনিস দিয়ে ঘোড়ার গাড়ির নকসায় মোটরের বডি তৈরি করত। ১৯২৫ সালে সারাভারতে মোটর ছিল তিরিশ হাজার। এর মধ্যে বেশির ভাগই ব্যাক্তিগত গাড়ি। ১৯০৫ সালে ৮ ঘোড়ার শক্তি বিশিষ্ট এক সিলিন্ডারের একটা রোভার গাড়ির দাম ছিল ছত্রিশশ’ টাকা। ১৯০৭ সালে কলকাতায় ভারতের প্রথম মোটর প্রদর্শনী লেডি মিন্টো মোটর একজিবিশন হয়। ১৯০৫ সালের একটা বিজ্ঞাপনে কলকাতায় মোটরকে জনপ্রিয় করবার জন্যে ঘণ্টায় ৩৫ মাইল গতিসম্পন্ন সাত ঘোড়ার শক্তি বিশিষ্ট ওল্ডস মোবাইল আর উলসলি গাড়ি হায়ার পারচেজ পদ্ধতিতে বিক্রির কথা জানা যায়। ১৯০৯ সালে ভারতে মোটরগাড়ি আর মোটর সাইকেল আমদানি হয়েছিল তিনলক্ষ দশহাজার পাউণ্ডের। কলকাতায় বাস চালানোর কাজে উদ্যোগ নেয় দু'টি কোম্পানি—অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান মোটর ক্যাব কোম্পানি আর মেসার্স ব্র্যানডেলস্ কোম্পানি। ১৯০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হল অটোমোবাইল অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গল। এই অ্যাসোসিয়েশন ১৯০৮ সালে কলকাতায় বাস চালাননি, চালিয়েছিলেন ট্যাক্সি। খুব মজার কথা--তখন গ্র্যাণ্ড হোটেলের সামনে ছিল কলকাতার একমাত্র ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড। কলকাতায় নিয়মিত বাস চলতে শুরু করে ১৯২৯ সালে। প্রথম বাস চলেছিল আপার সার্কুলার রোড দিয়ে। কোন বিদেশী কোম্পানি কিন্তু বাস চালায়নি। বাস চালিয়েছিলেন একজন মুসলমান ব্যবসায়ী আবদুল সোবহান। শ্যামবাজার-কলেজ স্ট্রীট বীবাজার ডালহৌসি রুটে প্রথম বাস চালায় ওয়াল ফোর্ড কোম্পানি।
#অনুপ্রেরণারগল্প

প্রথম জীবনে ছিলেন ভাল খেলোয়াড়। আবৃত্তির ঝোঁক আর সুকণ্ঠ তাঁকে ঠাঁই করে দিল অভিনয়ে। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে গড়লেন রেকর্ড। সত্য...
30/06/2024

প্রথম জীবনে ছিলেন ভাল খেলোয়াড়। আবৃত্তির ঝোঁক আর সুকণ্ঠ তাঁকে ঠাঁই করে দিল অভিনয়ে। পেশাদার রঙ্গমঞ্চে গড়লেন রেকর্ড। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে লিখছেন সোমেশ ভট্টাচার্যনাম শ্রীমান সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীমান পৃথ্বীরাজের বাবা হয়ে উঠতে তখনও তাঁর ঢের দেরি। বরং ফুটবল আর ব্যাডমিন্টনের নেশাই প্রবল।

রমানাথপুর ফ্রি কিক পেয়েছে। শট নিতে আসছেন শৈলেন মান্না।

তিনকাঠির নীচে যিনি দাঁড়িয়ে তাঁর বাড়ি রমানাথপুরের পাশেই, মশাটে। দু’জনেই খেলছেন যে যার গ্রামের হয়ে। শৈলেন ছুটে এসে ধাঁ করে শট নিলেন। কিপারের হাত মুচড়ে গোলার মতো বল ঢুকল গোলে। কব্জিটা বোধহয় ভেঙেই গিয়েছে। কিন্তু ছেলে গোঁয়ার, মাঠ ছাড়তে নারাজ। ফুলে ওঠা হাত নিয়েই খেলে গেলেন ম্যাচ।

নাম শ্রীমান সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। শ্রীমান পৃথ্বীরাজের বাবা হয়ে উঠতে তখনও তাঁর ঢের দেরি। বরং ফুটবল আর ব্যাডমিন্টনের নেশাই প্রবল।

গাঁয়ের বাড়ি হুগলি জেলায় হলেও সত্যর জন্ম কিন্তু কলকাতায়, ১৯২৫ সালে। রানী ভবানী স্কুলে পড়ার সময় থেকেই স্কুলটিমের বাঁধা গোলকিপার। খেপও খেলে বেড়ান। স্কুলশেষে সিটি কলেজে। মা চারুশীলা আগেই মারা গিয়েছিলেন। আইকম পাশ দিতে না দিতেই মারা গেলেন বাবা বনমালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাগ্য ভাল, টিটাগড় পেপার মিলে কেরানির চাকরি জুটল। শ্রাদ্ধশান্তি সেরে নেড়া মাথায় অফিস গেলেন। বত্রিশ টাকা মাসমাইনে, তার বিশ টাকা যায় এক আত্মীয়ের করা ধার শোধে।

অফিসের হয়েই জুটে গেল প্রথম ডিভিশনে খেলার সুযোগ। উল্টো দিকে সাত্তার, মেওয়ালাল‍! ভবানীপুর ক্লাবের হয়ে খেললেন সেকেন্ড ডিভিশনে। শোভাবাজার ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপে দারুণ লড়ে হারলেন নামী খেলোয়াড় মনোজ গুহের কাছে।

ইতিমধ্যে জীবন অন্য দিকে বাঁক নিতে শুরু করেছে। তাঁর খেলা যে ঘাসের মাঠে নয়, অন্য কোথাও তা ক্রমশ টের পেতে শুরু করেছেন সত্য। ছোট থেকেই ঝোঁক ছিল আবৃত্তির। উত্তরপাড়ায় নিখিল ভারত আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় যাওয়া তো ছিলই। নিজেও লিখতে শুরু করেছিলেন। স্বকণ্ঠে তাঁর ‘চোর’ বা ‘ডাস্টবিন’ আবৃত্তি ক্রমশ জনপ্রিয় হচ্ছিল।

আর আহিরিটোলার অ্যামেচার ক্লাবে মকশো চলছিল নাটকের। এক বার পাড়ায় নাটক হচ্ছে। প্রধান অতিথি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মহালয়ার বাইরে তাঁর বড় পরিচয়, তিনি বেতার নাটকের অন্যতম পুরোধা। নাটকের শেষে তিনি সত্যকে ডেকে বললেন, ‘‘তোমার কণ্ঠস্বরটি তো বেশ ভাল। রেডিয়োয় অডিশন দিচ্ছ না কেন?’’ কাঁচুমাচু হয়ে সত্য জানালেন, এক বার নয়, নাম পাল্টে পাল্টে দশ বার অডিশন দিয়েছেন, প্রতি বারই ফেল। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘‘কাল এক বার রেডিয়ো স্টেশনে এসে আমার সঙ্গে দেখা কোরো।’’

তখনকার রেডিয়ো স্টেশন ছিল গার্স্টিন প্লেসে। সকাল হতেই সত্য ছুটলেন সেখানে। অডিশন হল এবং জুটে গেল রেডিয়ো নাটকে অভিনয়ের সুযোগ। সেই যে শুরু হল, টানা করে গিয়েছেন পাঁচশোরও উপর রেডিয়ো নাটক। তার বেশির ভাগ আর শোনার উপায় নেই। তবে কে ভুলতে পারে রেকর্ডবন্দি ‘আলিবাবা’ শ্রুতিনাটকে আলিবাবার কণ্ঠ— ‘চিচিং ফাঁক!’

কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। প্রথম বড় মঞ্চে ওঠার সুযোগ এল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের ‘শহিদের ডাক’ নাটকে। সলিল চৌধুরী তাতে গান গাইতেন আর সত্য করতেন ভাষ্যপাঠ। সত্যর খুব সাধ, শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে অভিনয় করবেন। মণি শ্রীমানী তখন শ্রীরঙ্গমে তাঁর সঙ্গে নাটক করেন। সেই সূত্রে সত্যজিৎ রায়ের ছবিতেও অভিনয় করা হয়ে গিয়েছে। সত্য তাঁকে ধরে পড়লেন। কিন্তু বহু ঘোরাঘুরি করেও শিশিরবাবু পর্যন্ত পৌঁছতে পারলেন না।

উত্তরপাড়ায় নৃত্যগোপাল স্মৃতি মন্দিরে আবৃত্তি করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তখন মিনার্ভা থিয়েটারে ‘ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ’ নাটক করছেন তাঁরা। গুরুদাস সাজেন ঠাকুর, মহেন্দ্র গুপ্ত মথুর আর মলিনা দেবী রাসমণি। সত্য চাইলে হৃদয়ের পার্টটা করতে পারেন। চাইলে মানে? এ তো হাতে চাঁদ পাওয়া!

শুরু হল নতুন জীবন। কিন্তু সে নাটক বেশি দিন চলল না। কিছু দিন পরে ফের এল সুযোগ— বিশ্বরূপায় ‘জাগো’। তার পর রঙমহলে ‘শেষ লগ্ন’। পরিচালক বীরেন্দ্রকৃষ্ণই। সত্যর বয়স তখনও তিরিশ ছোঁয়নি, অথচ যে চরিত্রটি করতে হবে তার বয়স পঁচাত্তর। গোড়ায় হোঁচট। তার পর যখন পার্ট প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে, মরিয়া হয়ে এমন অভিনয় করলেন যে হইহই পড়ে গেল। এর পর ‘সাহেব বিবি গোলাম’-এ ঘড়িবাবু, ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এ হাজারী ঠাকুর। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় হাজারীর ভূমিকায় কমেডি-ঘেঁষা অভিনয় করে খুব নাম করেছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। সত্য চরিত্রটি করে নিলেন সিরিয়াস ধাঁচের। দু’জনের বিপরীতেই পদ্ম ঝিয়ের ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। সে নাটক চলেছিল ছ’শো রজনী!

মজার ব্যাপার, সিনেমায় সাবিত্রীর প্রথম নায়ক কিন্তু সত্যই। স্বাধীনতার পরের বছর হেমেন গুপ্তর ‘ভুলি নাই’ ছবিতে তাঁর প্রথম মুখ দেখানো। বছর তিনেক বাদে ফের সুযোগ। ‘বরযাত্রী’ ছবিতে চার বাঁড়ুজ্জে— কালী, ভানু, সত্য, হারাধন আর অনুপকুমার মিলে হইহই কাণ্ড। গড়িয়া তখন প্রায় ধু-ধু। এক দিন শুটিংয়ের ফাঁকে অনুপ এসে সত্যকে বললেন, ‘রিকশা চালাতে জানিস?’ সত্য বললেন, ‘ততটা জানি না।’ অনুপকুমার বললেন, ‘আমি খুব ভাল জানি।’ কাছেই একটা রিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। সত্যকে তাতে বসিয়ে দিলেন প্যাডেলে চাপ। দিব্যি চলছিল। হঠাৎ চাকার নীচে পড়ল পাথর আর রিকশা উল্টে দু’জনেই সোজা নর্দমায়! রক্তারক্তি কাণ্ড!

তবে ভাগ্যের চাকা ঘুরছিল। পরের বছরই মিলে গেল একেবারে নায়কের রোল। ‘পাশের বাড়ী’ ছবিতে সত্য ক্যাবলা নায়ক, বিপরীতে সাবিত্রী। আগের বছর ‘সহযাত্রী’ ছবিতে সাবিত্রী মুখ দেখিয়েছেন, নায়িকা এই প্রথম।

আর সেই বছরেই হঠাৎ় স্বপ্নপূরণ হয়ে গেল সত্যর। নানা থিয়েটারের শিল্পীদের নিয়ে ‘কম্বিনেশন নাইট’ হত তখন। তেমনই এক রাতে শরৎচন্দ্রের ‘বিজয়া’ নাটকে রাসবিহারীর চরিত্রে শিশির ভাদুড়ী আর বিলাসের চরিত্রে সত্য। হল কী, শিশিরবাবুর অভিনয় দেখে সত্য নিজের পার্ট বলতেই ভুলে গেলেন। কাণ্ড দেখে একটা সংলাপ বলে শিশিরবাবু মঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। পরে সত্য যখন ক্ষমা চাইতে গেলে, শিশিরবাবু বললেন, ‘জীবনে কখনও কম্বাইনড নাটক কোরো না, এতে তোমার ক্ষতি হবে।’’

ইতিমধ্যে নিজেও নাটক লিখতে শুরু করেছেন সত্য। এক বার এক আত্মীয়কে দাহ করতে গিয়েছেন কাশী মিত্র ঘাটে। সে কালে তো ঘরে ঘরে ক্যামেরা, হাতে হাতে স্মার্টফোন ছিল না। শ্মশানে কিছু ফোটোগ্রাফার ঘুরঘুর করতেন। শেষ ছবি তুলে দিতেন। এঁদের নিয়েই সত্য লিখলেন ‘শেষ থেকে শুরু’। সত্যজিৎ রায় সেই নাটক দেখতে এসে মুগ্ধ। ‘‘সত্যজিৎবাবু হলে বসে নাটক দেখে হাসছেন— এই দৃশ্যটা এখনও চোখ বন্ধ করলেই ছবির মতো আমার সামনে ভেসে ওঠে,’’ বলেছেন সত্য। এ-ই তাঁর প্রথম লেখা নয়, কিন্তু এই নাটকই তাঁকে প্রথম জনপ্রিয়তা এনে দেয়। পরে তা থেকে ছবিও হয়।

‘শেষ থেকে শুরু’ ছবির মহরতে

মঞ্চে খ্যাতি যত বাড়ে, সিনেমার ডাকও আসে বেশি। তপন সিংহ কাজ দিলেন ‘টনসিল’ ছবিতে। নরেশ মিত্র ডাকলেন ‘উল্কা’য়। ঠিক তার আগে রঙমহল ছেড়ে মিনার্ভায় এসে সত্য বড় বাজি ধরেছিলেন। নিজেরই লেখা ‘এরাও মানুষ’ নাটকে প্রতিবন্ধী দাশুর চরিত্র। সত্যের নিজের বিচারে, তাঁর করা অন্যতম সেরা কাজ। এমনই জীবন্ত সেই অভিনয় যে সত্যিই তিনি প্রতিবন্ধী কি না, তা পরীক্ষা করতে ডাক্তারদের বোর্ড বসানো হল। এই অভিনয়ই পরে তাঁকে এনে দিল ‘উল্কা’ ছবিতে প্রতিবন্ধী চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ।

তবে বড় ঘটনাটা ঘটল যখন ‘কাপুরুষ মহাপুরুষ’ ছবিতে অভিনয় করতে ডাকলেন সত্যজিৎ। সত্যর কথায়, ‘‘আমার লাঠি নিয়ে একটা অ্যাকশন ছিল। শুটিংয়ের আগে আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, লাঠিটা ঘোরাতে গিয়ে আমার মাথায় খটাস করে লেগে যাবে, এ রকম করব কি? সত্যজিৎবাবু বললেন, করে দেখাও। আমি করলাম। উনি খুব খুশি হয়ে বলেছিলেন, হ্যাঁ ঠিক আছে, করো।’’

তার পরের বছরেই ‘নায়ক’। সেখানে সত্য এক বাবাজি। রাজধানী এক্সপ্রেসে আপার বাঙ্কে বসে উল্টো দিকের বিজ্ঞাপনী সংস্থার কর্তাকে জিগ্যেস করবেন— আপনি ওয়ার্ল্ড ওয়াইড উইল ওয়ার্কার্স-এর নাম শুনেছেন? এত ডব্লিউ-এর ছড়াছড়ি দেখে সত্য জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমি যদি শুধু ডব্লু ডব্লু ডব্লু ডব্লু বলি, তা হলে কেমন হয়?’’ সত্যজিৎ রাজি। ছবির মুক্তির পরে অনেকেই খুব একচোট হেসেছিলেন সংলাপ শুনে। সত্যজিৎ কিন্তু বলতে ভোলেননি যে, ওটা সত্যর মাথা থেকে বেরিয়েছে!

পরের বছর তরুণ মজুমদারের কাছ থেকেও ডাক এল। ছবি ‘বালিকা বধূ’। তার পরে ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘সংসার সীমান্তে’, ‘দাদার কীর্তি’, ‘খেলার পুতুল’, ‘ভালবাসা ভালবাসা’, ‘পরশমণি’— বার বারই ডাক পড়েছে সত্যর। তরুণ বলেছেন, ‘‘আসলে যে কোনও চরিত্র দিলেই উনি অসম্ভব মসৃণ ভাবে তা উতরে দিতে পারতেন।’’ কথাটা মনে রাখার মতো। কেননা কমেডি করলেও কমেডিয়ানের একরঙা ছাপ সত্য পড়তে দেননি গায়ে। একই সঙ্গে কমেডি এবং সিরিয়াস রোলে অভিনয় করে গিয়েছেন দাপটে। ছোট-বড় বিচার করেননি। ‘‘ছোট দৃশ্যকেও উনি এমন উচ্চতায় নিয়ে যেতেন যে, হল থেকে বেরিয়ে ওঁর নাম করতেই হবে,’’ বলছেন চিরঞ্জিৎ চক্রবর্তী।

ঠিক সেই কারণেই তো বিশ্বরূপায় ‘চৌরঙ্গী’ নাটকে তাঁর করা ‘ন্যাটাহরি’ প্রবীণদের স্মৃতিতে আজও অক্ষয়। ‘বেগম মেরী বিশ্বাস’, ‘আসামী হাজির’— এক-এক নাটকে এক-এক পরত! এক দিকে মৃণাল সেন তাঁকে নিচ্ছেন ‘কোরাস’-এ। আবার ‘মঞ্জরী অপেরা’ থেকে ‘দেবী চৌধুরানী’ হয়ে ‘হীরে মানিক’, তিনি সমান স্বচ্ছন্দ। টেনিদা-কাহিনি ‘চারমূর্তি’-তে ঘুটঘুটানন্দ তিনিই— ‘ঘচাং ফু খাব তোকে!’ মজা আর শয়তানির আশ্চর্য মিশেল। টানা অভিনয় করে গিয়েছেন শ’দুয়েক ছবিতে! ’৯২ সালে ‘সিটি অব জয়’ ছবিতেও ছিলেন ছোট ভূমিকায়। শেষ লগ্নে এক মরমী চরিত্রে তাঁকে ব্যবহার করলেন রাজা সেন, জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী ‘দামু’ ছবিতে। একটা বৃত্তই সম্পূর্ণ হল যেন।

কিন্তু সত্য বাঁড়ুজ্জের জীবনবৃত্তান্ত অসম্পূর্ণই থেকে যাবে একটি মানুষ আর একটি নাটকের কথা না বললে। মানুষটির নাম তরুণকুমার, নাটকটি ‘নহবত’। সত্য যখন ছবিতে কল্কে পেতে স্টুডিয়ো থেকে স্টুডিয়োয় ছুটে বেড়াচ্ছেন, সঙ্গী ছিলেন আরও এক তরুণ। খাদ্যরসিক দু’জনেই, আলাপ জমেছে টিফিনের সময়ে। পরে বাংলা তাঁকে উত্তমকুমার নামে চিনবে, তখন তিনি চাকরি করেন পোর্ট কমিশনার্সে। সেই সূত্রেই বাড়িতে আসা-যাওয়া আর উত্তমের ছোটভাই তরুণের সঙ্গে বন্ধুত্ব। অন্তত তিরিশটা বছর তাঁরা একে অপরের সঙ্গে জুড়ে ছিলেন ওতপ্রোত। কল্পতরু নাট্যগোষ্ঠী তো ছিলই, ‘মামা-ভাগ্নে’ নামে জনপ্রিয় একটা স্কেচও করতেন দু’জনে।

মিনার্ভায় ‘এরাও মানুষ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার বেশ কিছু দিন পরে এক বার রঙমহলের মালিকেরা এসে হাজির সত্যর কাছে। কী? না, লাখ পাঁচেক টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে। এমন একটা নাটক ফাঁদতে হবে, যা রাতের পর রাত হইহই করে চলবে। সত্য তখন সবে নিজের গ্রুপের জন্য একটা নাটক লিখেছেন। কিছু দিন আগে বালিগঞ্জে এক বিয়েবাড়িতে একটি মেয়েকে দেখেছিলেন। চার-পাঁচ দিন আগেই তার স্বামী মারা গিয়েছে, কিন্তু তাকে কিছু জানানো হয়নি। সকলের সঙ্গে সে-ও দিব্যি হইহই করছে। সেই ঘটনার ছায়ায় লেখা নাটক— ‘নহবত’। ওই মেয়েটির আদলেই কেন্দ্রীয় চরিত্র কেয়া।

গ্রুপের নাটক করতে জামশেদপুরে গিয়ে সত্যর আলাপ হয়েছিল একটি মেয়ের সঙ্গে। নাম আরতি ভট্টাচার্য। অভিনয় করতে চায়। হঠাৎই এক দিন সে কলকাতায় এসে হাজির। বাজিয়ে দেখে তাকেই কেয়ার রোলটা দিলেন সত্য। রঙমহলে পর্দা উঠল। এবং রাতারাতি নাটক হিট! পাঁচ লাখ টাকার দেনা শোধ তো হয়েই গেল, জনপ্রিয়তার চোটে আরতি সিনেমায় সুযোগও পেয়ে গেলেন।

‘নহবত’ দেখতে এলেন সস্ত্রীক সলিল চৌধুরী

পরে ‘নহবত’ সরে যায় তপন থিয়েটারে। আরতির বদলে কেয়ার ভূমিকায় আসেন রত্না ঘোষাল। তরুণ তো ছিলেনই, এ বার এলেন বিকাশ রায় আর প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ও। সেটা ১৯৭৬ সাল। সত্যজিতের ‘জন অরণ্য’ মুক্তি পেয়েছে, তার নায়ক হিসেবে প্রদীপ তখন চেনামুখ। ‘নহবত’ নাটকে তরুণ প্রেমিকের পার্ট করার জন্য ছেলে খুঁজছিলেন সত্য। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় খবর দিলেন প্রদীপকে। জুটে গেল রোল। সপ্তাহে তিনটে শো। বৃহস্পতি আর শনি একটা করে, রবিবার ডাবল শো।

প্রদীপ তার আগে গ্রুপ থিয়েটারে অভিনয় করেছেন। ‘নহবত’ নাটকেই তাঁর পেশাদার রঙ্গমঞ্চে হাতেখড়ি। মঞ্চে সত্যর দাপট দেখে তিনি অবাক, ‘‘ওহ, সে যে কী অভিনয়! এই হয়তো বেশ চড়া, আবার তার পরেই এত নিচু পর্দায় চলে আসছেন! দর্শক একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেত!’’

শুধু তপন থিয়েটারেই ‘নহবত’ চলল ষোলোশো রজনী! তার বাইরে কল-শো তো ছিলই। দিনের পর দিন একই অভিনয়ে একঘেয়েমি আসেই। তা কাটাতে মঞ্চে দুষ্টুমি করাটা তাই সত্যর স্বভাব হয়ে গিয়েছিল। সংলাপ পাল্টে অন্যদের ভড়কা দেওয়া তো ছিলই, ঠাট্টা-ইয়ার্কিও চলত। নদিয়ার বেথুয়াডহরিতে কল-শো হচ্ছে, প্রদীপ উইংসের পাশে দাঁড়িয়ে। ‘‘সত্যদা সংলাপ বলতে বলতে সরে এসে টুক করে একটা গালি দিয়ে আবার গলা চড়িয়ে সংলাপে ফিরে গেলেন। দর্শক কিছু টেরও পেল না,’’ বলতে গিয়ে এখনও হেসে ফেলেন প্রদীপ।

১৯৮১ সালে টানা তিন মাসের জন্য আমেরিকা সফরে গেল ‘নহবত’। নিয়মিত বেতন দেওয়া হবে না বলে প্রদীপ যাননি। দেশে ফেরার পরেও টুকটাক কল-শো হত। তখন প্রদীপের জায়গায় অভিনয় করতেন চিরঞ্জিৎ। ‘নহবত’ শেষ হয়ে ‘নাগপাশ’ সবে শুরু হয়েছে। যাদবপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায় ইতি টেনে চিরঞ্জিৎ দূরদর্শনে খবর পড়ছিলেন। কয়েকটা ছবিতে অভিনয় করাও হয়ে গিয়েছে। যাদবপুরে তাঁরই বিভাগের শিক্ষক সমীর রক্ষিতের উপন্যাস ‘হত্যাকারী’ বেরোয় ‘দেশ’ পত্রিকায়। নাট্যরূপ দেন সুভাষ বসু। সেই ‘নাগপাশ’-এ চিরঞ্জিৎকে নামালেন সত্য। ‘‘উনিই আমার নাটকের গুরু। বড় অভিনেতা তো বটেই, কিন্তু শিক্ষক হিসেবে উনি ছিলেন সেরাদের এক জন,’’ বলছেন চিরঞ্জিৎ। সেই নাটকও চলল সাড়ে সাতশো রজনী!

হাতে তখন কাজ নেই। অগত্যা যাত্রায় নামলেন সত্য এবং তরুণ। নট্ট কোম্পানি দিয়ে শুরু। পরে সত্য নিজে লিখেছেন, নির্দেশনাও দিয়েছেন— ‘মাটির ঘরে মেম বৌ’, ‘মাকে প্রণাম বাবাকে সেলাম’... সাত বছর বাদে কাজ শেষ হল, ’৯৩ সালে খুলল উত্তম মঞ্চ। কিন্তু তখন পেশাদার থিয়েটারের পালে আর হাওয়া নেই। শ্যামবাজারের থিয়েটার একের পর এক বন্ধ হচ্ছে। উত্তম মঞ্চও মার খেতে লাগল। ফের ‘নহবত’ করে, রবি ঘোষকে এনেও লোক টানা গেল না। মঞ্চ বন্ধ হল। ব্যাঙ্কে দেনা জমল। শুরু হল প্রোমোটারদের উঁকিঝুঁকি।

এরই মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লেন সত্য। পেট জুড়ে অস্থিরতা, রক্তবমি। হাসপাতালে ভর্তি রইলেন এক মাস। ১৯৯৭ সালের ২৮ জুলাই রাতে যবনিকা পড়ল। ছ’বছর পরে মারা গেলেন তরুণকুমারও। ২০১১ সালে উত্তম মঞ্চ নিজেদের হাতে নিয়ে কলকাতা পুরসভা যে তাকে রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত করেছে, তা আর তাঁদের দেখা হল না।

নাটকের জীবন শুধু নয়, নাটকীয় জীবন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সত্য খেলা ছাড়েননি। তিনি যে জাত খেলোয়াড়! দিনভর ব্যস্ততা, চাপ, ডামাডোল। তবু রাতের পর রাত জেগে দেখেছেন বিশ্বকাপ। পি কে ব্যানার্জি আর চুনী গোস্বামীর বড় ভক্ত তো ছিলেনই। পরে মারাদোনারও খুব ভক্ত হয়ে যান।

’৮০-র ১৬ অগস্ট ছিল ইডেনের সেই কালো দিন। ইস্টবেঙ্গল আর মোহনবাগানের খেলায় দু’দলের সমর্থকদের মারপিটে মারা গেলেন ষোলো জন। সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে মান্না দে রেকর্ড করলেন তাঁর সেই বিখ্যাত গান— ‘খেলা ফুটবল খেলা, খোকা দেখতে গেল সেই সকালবেলা... তোমরা আমার একটা কথাই রেখো, খেলার মাঠে কারও খোকা আর না হারায় দেখো।’

ষোলোটি নামের তালিকায় সত্যিই কাঁকুড়গাছির একটি ছেলে ছিল, যার নাম খোকা। গীতিকারের নাম সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়।

ইডেনে আর ফুটবল হয় না। কিন্তু মাঠ আছে নানা কিসিমের, মারপিটও আছে।

কথাগুলো তাই থেকেই গেল!

আনন্দবাজার আর্কাইভস, নন্দন গ্রন্থাগার, সাতরঙ (রবি বসু), বর্তমান ও আজকাল পত্রিকা

#সত্য_বন্দ্যোপাধ্যায় #অনুপ্রেরণারগল্প

Address

18/1 Naya Paltan, 6th Floor, Masjid Lane
Dhaka
1000

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when boikini.com posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to boikini.com:

Videos

Share


Other Book & Magazine Distributors in Dhaka

Show All