05/09/2023
মানিকগঞ্জে জীবন-জীবিকার তাগিদে পুরুষ বেসে ইজিবাইক চালাচ্ছে রুনা।
শুভংকর শুভ, মানিকগঞ্জ সংবাদদাতা:
জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে হয়। জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকাটা রণক্ষেত্রে টিকে থাকার চেয়েও কঠিন। ‘বহুদূর প্রসারিত এদের বিচিত্র কর্মভার/তারি ’পরে ভর দিয়ে চলিতেছে সমস্ত সংসার।’ রবিঠাকুরের এ কথার বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় মানিকগঞ্জের পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও ইজিবাইক চালক রুনার জীবনে।
জীবিকার তাগিদে মানুষ বিচিত্র পথে যাত্রা করে। আর পরিবারের প্রধান যিনি, তার উপার্জনেই চলে একেকটি পরিবার। কিন্তু সেই পরিবার প্রধান'ই যখন বার্ধক্যজনিত হয়ে যায় তখন তার দায়িত্ব পালন করতে হয় অন্য কাউকে।
তাই যে বয়সে পড়াশোনা কিংবা স্বামীর সংসার করার কথা সেই সময় জীবন জীবিকার তাগিদে হাতে তুলে নিতে হয়েছে লোহার হ্যান্ডেল। সেই লোহার হ্যান্ডেলের ইজিবাইক চালিয়ে অসুস্থ বাবা-মা এবং ছোট ভাইয়ের মুখে দু-বেলা খাবার তুলে দিচ্ছে রুনা আক্তার (২২) নামের এক তরুণী ।
সম্প্রতি সকালের দিকে প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের পৌলি এলাকায় ওই তরুনীর সাথে। ওই তরুণী জানান, আর্থিক অনটনে পড়াশোনা না করতে পারায় ছোট্ট বেলা থেকেই জীবন সংগ্রামে নামতে হয় পৌরসভার পৌলি এলাকার আলতাফ জহুরা দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে ৪র্থ রুনা আক্তারকে(২২)।
জানা যায়, শহরের পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের পৌলি এলাকায় ভাঙ্গা চারচালা ঘড়ে বসবাস করেন আলতাফ জহুরা দম্পতি এবং ছোট দুই সন্তান। বড় ছেলে কয়েক বছর আগে বিয়ে করে নিজ স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে আলাদা থাকছে। দুই মেয়ের বিয়েও দিয়েছে আলতাফ-জহুরা তবে বার্ধক্য জনিত কারণে আগের মতো আর কোন কাজ কর্ম করতে পারছে না তারা। দিন মজুর বাবা ( আলতাফ হোসেন ) ২০১৬ সালে পরিবারের সচ্ছলতা আনতে জমি বিক্রি করে, সেই টাকা দিয়ে সৌদি আরবে যায় রুনা। কিন্তু পাঁ ভেঙ্গে যাওয়ায় ফিরে আসতে হয় তাকে। বাধ্য হয়েই জীবন সংগ্রামের হাতিয়ার নিজের কাধে তুলে নেন রুনা আক্তার। প্রথম দিকে সমাজের মানুষের কাছে লাঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে তাকে। সকল বাঁধাকে পিছনে ফেলে প্রতিদিন ভোর বেলায় ভাড়া চালিত ইজিবাইক নিয়ে বেড় হন রুটি-রুজির সন্ধানে। সন্ধা গড়িয়ে রাত হলে ফিরে আসে নিজ বাড়িতে। সারাদিন যে আয় হয় তার বড় একটি অংশ (পাঁচশত টাকা) দিতে হয় ইজিবাইকের মালিককে বাকি টাকা দিয়ে অসুস্থ বাবা-মা’র ঔষধ এবং সংসারের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয় করে রুনা আক্তার।
রুনা আক্তারের বয়স্ক মা জহুরা বেগম বলেন, মেয়ের বয়স হচ্ছে কিন্তু অভাব অনটের জন্য মেযেকে বিয়েও দিতে পারছি না। আমরা দুজনেই অসুস্থ, অনেক ঔষধ খেতে হয় প্রতিদিন, সেই কারনেই রুনা লোক-লজ্জার ভয় না করে এখন ইজিবাইক চালাচ্ছে। অনেক ভয় করে মেয়ে মানুষ, তারপরও নিরুপায় হয়ে আমাদের কথা চিন্তা করে সকল ভয় মাথায় নিয়েই সংসারের যাবতীয় খরচ বহন করে যাচ্ছে রুনা। বড় ছেলে বিয়ে করার কিছুদিন পরেই আলাদা হয়ে যায়। সে আমাদের খোঁজ খবরও নেয়না। দুই মেয়েকে অনেক কষ্ট করে বিয়ে দিয়েছি। এখন ছোট ছেলে-মেয়েকে নিয়েই কোন মতে চলছে আমাদের জীবন। জানি না কবে আল্লাহ আমাদের মুখের দিকে তাকাবে।
রুনা আক্তার বলেন, আমি মেয়ে মানুষ তাই কি আমার কোন দ্বায়িত্ব নেই বাবা-মায়ের প্রতি। যতদিন জীবন থাকবে তত-দিন বাবা-মায়ের সেবা যত্ন করবো। তাদের সকল ভরন-পোষণ করাটা আমার একান্ত দ্বায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাবা-মা সারাটা জীবন আমাদের পাঁচ ভাই-বোনদের জন্য অনেক কিছু করেছে, এখন আমাদের পালা। বড় ভাই অনেক বছর আগেই বিয়ে করে আলাদা থাকেন। বাবা দুই বোনের বিয়ে দিয়েছে, এখন তিনি অসুস্থ। কোন কাজ করতে পারে না। তাদের-তো আর না খাওইয়ে মেরে ফেলা যাবে না। সে জন্য আমি কোন উপায় না পেয়ে ইজিবাইক চালাচ্ছি। প্রতিদিন যে টাকা আয় করি তার সিংহভাগ মালিককে দিয়ে যা থাকে তা দিয়েই কোন মতে চলে যাচ্ছে আমাদের চার জনের সংসার।
মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোঃ কবির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, রুনা আমার ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তাকে এর আগে একটি ইজিবাইকের প্লেট দিয়ে ছিলাম। পৌরসভার মেয়রের সঙ্গে কথা বলে দেখি রুনার জন্য স্থায়ী ভাবে কোন কিছু করা যায় কিনা।