07/04/2024
Rights khata ❤️❤️
প্রসঙ্গ: 'ফুল বিঝু'তে ফুল ভাসায়? নাকি 'গোঝায়'(নিবেদন করা)?
দীর্ঘকাল থেকে চাকমারা জুম চাষের উপর নির্ভরশীল ছিল। জুম চাষ যেহেতু উঁচু জায়গায় বা পাহাড়ে করা হয় সেহেতু সেখানে ছড়া-ছড়ি থাকা স্বাভাবিক। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে পানি প্রবাহিত হয়ে সৃষ্টি হয় ঝর্ণা। ঝর্ণার জীবিতাবস্থায় ছড়া বা ছোট নদীর অস্তিত্ব থাকে। সেই পাহাড়ী ঝর্ণা ও ঝর্ণা থেকে সৃষ্ট ছোট নদী তাদের পানির অভাব পূরণের প্রধান উৎস।
মিথ অনুসারে, পানির দেবতাকে কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য গঙা মা বা জলদেবীর উদ্দেশ্য করে ছড়া পাড়ে বা গাঙের তীরে কলাপাতায় ফুল রেখে তার উপর তেলচাদি (বাঁশের কুপি) জ্বালিয়ে প্রণাম জানানো হয়। এ রীতি অবশ্যই তান্ত্রিক সমাজে বিশেষ কোন উৎসব হিসেবে নয় বরং পূজা হিসেবে পরিগণিত হয়। এ রীতির পরিসর যখন বৃহদাকার ধারণ করে তখন সেটা আর পূজার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, হয়ে ওঠে দারুন এক উৎসব। নামকরণ হয় 'ফুল বিঝু'।বিঝু উৎসবের তিন দিনের মধ্যে ফুল বিঝু প্রথম দিন। ফুল বিঝু শুরু হয় বসন্তের শেষদিকে। বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী চৈত্র মাসের ২৯ তারিখ অর্থাৎ বছর শেষ হওয়ার একদিন আগে। ঐদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আনন্দের সহিত হরেক রকমের ফুল তোলা হয়। উল্লেখ্য যে, ঐসময় বাড়ির আঙ্গিনায় ফোঁটা ফুল সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে। সেজন্য সকল বয়সী ছেলে-মেয়েরা বিনা অনুমতিতে ফুল সংগ্রহ করতে পারে। অনেকে আবার বিনা অনুমতিতে ফুল তোলাকে ফুল চুরি করা বলতে প্রয়াস পান; যা অত্যন্ত লজ্জাজনক। যে সময়টাতে বিনা অনুমতিতে ফুল তোলা বৈধ (ঐতিহ্যগতভাবে) তা মোটেই চুরি হতে পারে না। বুনো ফুলের মধ্যে ভাতঝরা ফুল আর বাড়ির আঙ্গিনায় উৎপাদিত দেশি-বিদেশী ফুলের মধ্যে কাঠগোলাপ (বক ফুল), জবা, গোওই ফুল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিঝু আসলে ‘বিঝুফুল’ এর নাম মুখে মুখে উচ্চারিত হয়, প্রকৃতপক্ষে নির্দিষ্ট কোন ফুলকে চাকমারা বিঝুফুল বলে না; কেননা, একেক জায়গায় বিঝুফুল একেক রকম বলে জানে। অনেকে ভেক-ফুলকে বিঝুফুল বলে, অনেকে ভাতঝরা ফুলকে ‘বিঝুফুল’ বলে, আবার অনেকে ছোট ছোট সাদা রঙের সুগন্ধিযুক্ত একপ্রকার ফুলকে বিঝুফুল বলে। একইভাবে বিঝুর সময় আগত পাখিকে বিঝুপেক বলা হয়। প্রকৃতপক্ষে বিঝুপেক কোন পাখির নাম নয়, এটা তার বিশেষিত নাম।
ফুল সংগ্রহের পর একভাগ ঘর সাজানোর জন্য এবং একভাগ গাঙে নিবেদনের জন্য রাখা হয়। যারা সকালে নদীতে ফুল দিতে যায় তারা ছোট ছোট বাচ্চাদের ‘বিঝুগুলো’ খাওয়ার নাম করে নিয়ে যায় এবং গোসল করতে উৎসাহ দেয়। খুব সকালে ছড়ায় অথবা গাঙে অথবা কুয়ার পাশে মোট কথা বিভিন্ন পানির উৎসে মাটির ঢিবি বানিয়ে কলা পাতায় ফুল রেখে গঙা মা’র উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয়। অনেকে বাঁশের কুপি জ্বালায়।
বর্তমান সময়ে অবশ্য অধিকাংশই বাঁশের প্রদীপের বদলে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করে। যেই কথা না বললেই নয় তা হলো অতি উৎসাহী হয়ে বিগত কয়েক বছর ধরে অনেকে ঐতিহ্যগত নিয়মে ফুল নিবেদন না করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেয়, সেই হিসেবে বলা হচ্ছে “ফুল ভাসানো অনুষ্ঠান”! যার কারণে দেখা দিয়েছে এক হ-য-ব-র-ল অবস্থা। অনেকে হয়ত বলবে, সময়ের সাথে অবস্থার পরিবর্তন হয়, অবস্থার পরিবর্তনের সাথে সংস্কৃতিরও পরিবর্তন হয়। তা হয়। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে এই পরিবর্তনে সংস্কৃতির মূলধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ছি কিনা। অতীতের দিকে ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, তখন ফুল ভাসানো হতো না বরং ছড়া/গাঙ/কুয়ার ধারে কলা পাতায় করে ফুল দেয়া হতো, যা অত্যন্ত পরিবেশ বান্ধব।
অথচ বর্তমান সময়ে দেখা যাচ্ছে- অনেকে ইচ্ছাকৃতভাবে প্লাস্টিকের প্লেটে ফুল রেখে জলে ভাসিয়ে দেয়, যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। মিডিয়ায় যেভাবে প্রচার করা হয় তা দেখে যে কেউই ফুল ভাসাতে উৎসাহিত হতে পারে!
ফুল হচ্ছে পবিত্রতার প্রতীক। তাহলে ফুলকে বা পবিত্রতাকে ভাসিয়ে দেওয়ার কোনো মানে আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং ফুল ভাসানো নয়, ফুল নিবেদনই ফুল বিঝুর তাৎপর্য বহন করে। ফুল নিবেদন হতে পারে প্রিয় কোন মানুষের প্রতি, হতে পারে শ্রদ্ধার পাত্রের প্রতি কিংবা হতে পারে ভক্তিপূর্ণ কোন বস্তুর প্রতি। তবে ফুল বিঝুর দিনে ঐতিহ্যগত নিয়মে গঙা মা’র উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করা হয়ে থাকে। ফুল বিঝুর দিন ভোরে সচেতনভাবে মাটির ঢিবি বানিয়ে ফুল নিবেদনের পরও হয়ত ফুল ভেসে যেতে পারে পানির ঢেউ কিংবা স্রোতের কারণে। তাতে কিন্তু আপনার আমার হাত নেই। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে ফুল ভাসানোকে অবশ্যই ভুল সংস্কৃতি চর্চা।এখন কথা হচ্ছে- যারা গঙা মা’কে কিংবা উপগুপ্ত বুদ্ধকে যারা বিশ্বাস করে না তারা কার উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করবে? আমার কথা হলো- গঙা মা কিংবা উপগুপ্ত বুদ্ধের প্রতি বিশ্বাস থাকাটা এখানে মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হচ্ছে- পানি যে আমাদের জীবনে অপরিহার্য তার জন্য পানির প্রতি কৃতজ্ঞতা বা শ্রদ্ধা জানানোই মুখ্য। পানির প্রতি আপনার কৃতজ্ঞতাবোধ ও শ্রদ্ধাবোধ থাকলে আপনি পানি ব্যবহারে সচেতন হবেন, পানির উপর প্লাস্টিক, বর্জ্য, পলিথিন জাতীয় পদার্থ বা পানি দূষিত হয় এমন কোন পদার্থ ফেলার সময় অন্তত একবার হলেও ভাবতে বাধ্য হবেন। আর এভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে ফুল বিঝুর তাৎপর্য বৃদ্ধি পাক এ কামনাই করি।
লেখা: Ranyeful (সুজন)