09/11/2024
শিল্পকলা একাডেমির ডিজি হিশেবে নিয়োগ পাওয়া জামিল আহমেদের একটা বক্তব্য নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে৷ তিনি বলেছেন—
‘শিল্পকলা একাডেমিতে যদি আমি নিয়োগ পাই, আমি চাইবো ওখানে জামায়াত যেন আসে। এইজন্য যে, জামায়াত বলুক, কেন ২০২৪ সালে এসেও মেয়েদের বোরকা পরতে হবে? তারা আমাদের নিশ্চিত করবে যে, কেন এই ২০২৪ সালে এসেও শরিয়তী রাষ্ট্রব্যবস্থা দরকার? কারণ, কুরআনেই বলা আছে, কোনো নারীর দিকে দৃষ্টি পড়লে দৃষ্টি নামাও। আমি যদি দৃষ্টি নামাই, আমি যদি সংযত হই, তাহলে নারীকে কেন মাথায় ঘোমটা দিতে হবে?’
শুরুতেই জামিল আহমেদ একটা ধন্যবাদ পেতে পারেন এই কারণে যে—ইসলামকে রিপ্রেজেন্ট করে এমন একটা দল বা গোষ্ঠীর কাছে তিনি একটা বিষয় জানতে চেয়েছেন। তার এই আগ্রহ এবং কৌতূহলকে স্বাগত জানাই।
তবে, তিনি মোটাদাগে একটা ভুল প্রশ্ন করেছেন এবং সেটা যে ইসলাম সম্পর্কে তার অজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
খেয়াল করুন, তিনি বলতে চেয়েছেন—কুরআন যেহেতু পুরুষদের দৃষ্টি নামিয়ে রাখতে বলেছে, তাহলে আপনারা যদি নিজেদের দৃষ্টিকে নামিয়ে রাখেন, যদি নিজেদের সংযত করে চলেন, তাহলে তো নারীদের আর বোরকা পরতে হয় না।
আচ্ছা। যদি সকল পুরুষ দৃষ্টি নামিয়ে চলতো আর দৃষ্টিকে সংযত করে চলতো, বাইরে বের হলে নারীরা তাহলে কী পরতো?
জামিল আহমেদকে এই প্রশ্ন যদি করা হয়, হয়তো তিনি উত্তরে বলবেন—‘স্বাধীন পোশাক, যেমন শাড়ি বা থ্রি-পিছ বা অন্যান্য কাপড়চোপড়’।
এখানে জামিল আহমেদরা যে ফিলোসফিটা দাঁড় করাতে চান তা হলো—বোরকা একটা স্বাধীন পোশাক নয়, ঠিক যেরকমভাবে শাড়ি বা থ্রি-পিছ বা শার্ট প্যান্ট পরাটা স্বাধীন পোশাক৷ বোরকা হলো অনিচ্ছাকৃত, জোরপূর্বক এবং চাপিয়ে দেওয়া একটা পোশাক’।
আর, এই অনিচ্ছাকৃত, জোরপূর্বক এবং চাপিয়ে দেওয়া পোশাক মেয়েরা কেন পরে?
কারণ—পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাঁচতে।
তো, জামিল আহমেদ বলতে চাচ্ছেন— ‘জামায়াত এতোদিন করলোটা কী? এতো দ্বীনের দাওয়াত, এতো নাসীহা, ওয়াজ মাহফিল, এতো বড় বড় কুরআনের মজলিস, এখন পর্যন্ত পুরুষদেরকে নিজেদের দৃষ্টি সংযত করতে কনভিন্স করতে পারল না কেন? তারা যদি কনভিন্স করতে পারতো, আজকে, ২০২৪ সালে এসেও নারীদেরকে বোরকা পরতে হতো না৷ তারা শাড়ি পরে, সেজেগুজে, খোঁপায় ফুল দিয়ে, পায়ে আলতা পরে বাইরে আসবে। অথবা—তারা হাতকাটা ব্লাউজ পরে আসতে পারবে রমনার বটমূলে কিংবা শিল্পকলা একাডেমিতে। কিন্তু, জামায়াত কী করলো এতোদিন?’
জামিল আহমেদরা যেটা বরাবরই ভুল করেন সেটা হলো—তারা নিজেদের জন্য যে সংস্কৃতি, যে পোশাক, যে লাইফস্টাইল পছন্দ করেন, সেটাকেই সত্য, সহজাত আর সকলের পছন্দ বলে মনে করেন।
তারা ভাবেন যে—সকালে উঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা করাটাই হলো বাঙালিয়ানা৷ কিন্তু, ভোরবেলা উঠে ফযরের নামায পড়া, তারপর কুরআন তিলাওয়াত করাটা তাদের কাছে বাঙালিয়ানা না, সেটা আরবের সংস্কৃতি।
তারা ভাবেন, শাড়ি পরে, কপালে বড়সড় লাল টিপ দিয়ে, খোঁপায় ফুল গুঁজে সেজেগুজে যে রমনী বাইরে আসে, সে হলো প্রকৃত স্বাধীন নারী। তার ভেতরে আছে খাঁটি দেশ আর সংস্কৃতিপ্রেম।
কিন্তু, যে মেয়েটা বোরকা পরে, যে কপালে টিপ দেয় না কিংবা যে ছেলেটা মুখে দাড়ি রাখে, সে কোনোভাবেই প্রকৃত বাঙালি নয়।
জামিল আহমেদরা খুব স্বাধীনতা স্বাধীনতা করলেও, তারা এটা বিশ্বাস করতে চান না যে—একজন নারী স্রেফ নিজের ভালো লাগা থেকেও, নিজের পছন্দ থেকেও বোরকা পরতে পারে। তারা মানতে চান না যে—দুনিয়ার সকল নারী পরপুরুষের সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রদর্শনে স্বঃস্তিবোধ করে না। তারা কল্পনাও করতে পারেন না যে—অন্য সবার কাছ থেকে লুকিয়ে, শুধুমাত্র স্বামীর সামনে নিজের সৌন্দর্য প্রকাশ করাটাও ‘লয়ালিটি’ হতে পারে।
সকালবেলা রবীন্দ্রনাথ চর্চা করা, ছবির হাটে গিয়ে এলিটিজম করা, গান বাজনা, আর্ট কালচার করাটাকে জামিল আহমেদরা ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’, ‘প্রগতিশীলতা’, ‘সংস্কৃতিমনা’ হিশেবে ভাবতে পারেন।
তবে, কেউ তাদের বিশ্বাসের ওপর ভর করে, আল্লাহর দেওয়া বিধানকে ভালোবেসে বোরকা পরছে কিংবা দাড়ি রাখছে, সেটাকে তারা ‘ব্যক্তিস্বাধীনতা’ বা ‘প্রগতিশীলতা’ বলে ভাবতে পারেন না৷
তারা ভাবেন, ধর্ম সবসময় ‘চাপিয়ে দেওয়া’ কোনো বস্তু।
জামিল আহমেদদের আর দোষ কী! এই দেশে প্রগতিশীলতা জিনিসটাই তো দাঁড়িয়ে আছে ইসলাম নিয়ে অজ্ঞতা আর বিদ্বেষের ওপর ভর করে।
©আরিফ আজাদ