24/06/2022
দুষ্কৃতীর বাঁধ-কাটা, প্রশাসনের অদূরদর্শিতায় অনন্তভাসানে শহর
অরিজিৎ আদিত্য
শিলচর শহরটা যে গত তিনদিন ধরে ভেসে যাচ্ছে, স্রেফ ভেসেই যাচ্ছে, এর কারণটা কী? নদী হঠাৎ করে কীভাবে শহরে উঠে এলো, কীভাবেই বা অলিগলি রাজপথ, গরিবের কুঁড়েঘর, মধ্যবিত্তের ছাপোষা দোতলা বাড়ি, বিত্তবানের অট্টালিকা ভাসিয়ে দিয়ে সবাই, সব্বাইকে জলবন্দি করে রেখে দিল? ১৯ জুন শনিবার জেলা প্রশাসন সন্ধ্যা সাতটা দশে একটি প্রেস রিলিজ ইস্যু করে, সেখানে এই বিপর্যয়ের কারণ খুব আলতোভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল। কেন 'আলতোভাবে' উল্লেখ করা হয়েছিল, সে বিষয়ে বিস্তারিত আসার আগে একবার বিবৃতিতে ঠিক কী বলা হয়েছিল, সেটা দেখে নেওয়া যাক। বলা হয়েছিল, "এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রশাসনের হাতে আসা তথ্য অনুযায়ী বেতুকান্দি বাঁধটি কিছু দুষ্কৃতী নষ্ট করে দিয়েছে, বাঁধের ওই ক্ষতিগ্রস্ত অংশটুকু মেরামত করার চেষ্টা চালানো সত্ত্বেও নদীর জল শিলচর শহরের নিচু এলাকা ও বেতুকান্দির আশপাশের এলাকাগুলোতে ঢুকে পড়তে পারে।"
শনিবার মধ্যরাত থেকে শহরে জল ঢুকতে শুরু করে, এবং প্রশাসন শুধু নিচু এলাকায় জল ঢুকতে পারে বলে যে আশঙ্কা করেছিল সেটাকে জলে ভাসিয়ে বরাক শহরের রাজপথে উঠে এসেছে। অজস্র দোতলা বাড়ির একতলার জানালা ডিঙিয়ে গেছে জলস্তর।
কথা হল, বেতুকান্দির বাঁধটি কোন দুষ্কৃতীরা নষ্ট করেছিল? কবে করেছিল? জানা গেছে, একটি এফআইআরও হয়েছিল। সেটা কবে হয়েছিল? সবচেয়ে বড় ও জরুরি যে প্রশ্ন, তা হল, প্রশাসন এতোদিন ভাঙা বাঁধ মেরামত করার জন্য কী উদ্যোগ নিয়েছিল? আদৌ নিয়েছিল কি? এবং এসব প্রশ্নকে ছাপিয়েও যে প্রশ্নটি সবচেয়ে মারাত্মকভাবে উঠে আসে, তা হল, কারা কেটেছে বাঁধ? দুষ্কৃতীরা কারা? তারা কি বেতুকান্দির স্থানীয় মানুষ? স্থানীয় মানুষ কেন খাল কেটে কুমীর আনার মতো বাঁধ কাটতে যাবে? কারণ প্রশাসনের বিবৃতিতেই তো বলা হয়েছে, ভাঙা বাঁধ দিয়ে জল বেতুকান্দি ও আশপাশের এলাকায় ঢুকে পড়বে?
শহরের এই অনন্তভাসানের যাবতীয় রহস্য লুকিয়ে রয়েছে এই প্রশ্নগুলোর গভীরে।
মে মাসের বন্যার সময় আমরা বেতুকান্দি গিয়েছিলাম। এবং এমন কিছু যে ঘটতে পারে, এর আঁচ পেয়েছিলাম বেতুকান্দির মানুষগুলোর ক্ষোভের উদগীরণ থেকে।
শিলচর মধুরবন্দ পিএইচই রোড ধরে সোজা এগিয়ে গেলেই হাতের ডান দিকে পড়বে মহিষাবিল। বাঁদিকে বরাক নদী। গত মাসে বন্যার সময় বেতুকান্দি কাড়ারপাড় এলাকায় গিয়েছিলাম। রাস্তার দু'পারে যতদূর চোখ যায়, শুধু পলিথিন টাঙানো, একেকটি পলিথিনের নিচে একেকটি সংসার। বানভাসির মেকশিফট সংসার। তাঁদের একদিকে বন্যার আগ্রাসী বরাক। অন্যদিকে নিশ্চলা মহিষাবিল।
এই বিশাল বিলটি শিলচর শহরতলির মধুরবন্দ, বেরেঙ্গা, বেতুকান্দি, ভাগাডহর, বরজুরাই, বাদ্রিঘাটের বাঁধ লাগোয়া হাজার হাজার মানুষকে বছরের ন'মাসই জলে ডুবিয়ে রাখে। বিশাল আকারের এই বিলটি প্রচুর পরিমাণ জল ধারণ করে রাখে বলেই শহরের মানুষ নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন। বিলের জল রাঙ্গিরখাল, সিঙ্গিরখাল হয়ে স্বাভাবিক গতিতে বেরিয়ে যেতো। কিন্তু শহরের মানুষ অপরিকল্পিতভাবে বাড়িঘর বানানোয় খালগুলো ক্রমশ বেদখল হয়ে যায়। এবং এর চাপ পড়ে মহিষাবিলের ওপর।
বেতুকান্দির মানুষরা জানান, বর্ষার সময়টুকু বাদ দিয়ে বছরের অন্য সময় মহিষাবিল শুকনো থাকতো। অনেকে চাষবাস করতেন। কিন্তু শহরে যত বেদখল হয়েছে ততই জলাভূমি হয়ে উঠেছে মহিষাবিল। বছরের নয় মাসই জলের তলায় থাকে গোটা মহিষাবিল। ফলে চাষবাস লাটে উঠেছে। রোজগার গেছে অনেকের। তাঁদের ছেলেরা বাঙ্গালোরে চলে গেছেন সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করতে।
কংগ্রেস আমলে মহিষাবিল হয়ে ওঠে সোনার ডিম পাড়া হাঁস। বরাকপারে সন্তোষ মোহন দেবের কাছের কিছু মানুষ মহিষাবিলের নাম করে স্কিমের পর স্কিম গায়েব করে দিয়েছে। তবে তরুণ গগৈর আমলে একটি স্লুইসগেটের কাজ শুরু হয়। মহিষাবিলের জল বরাকে এনে ফেলার জন্য এই স্লুইসগেটটির ভীষণ প্রয়োজন ছিল। কাজ ভালোই হয়েছিল। কিন্তু দিলীপ পাল বিধায়ক হওয়ার পরই স্লুইসগেটের অর্ধনির্মিত কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এটাই অভিযোগ স্থানীয় মানুষের। তাঁরা বলেন, স্লুইসগেটের কাজ আশি শতাংশই হয়ে গিয়েছিল, দিলীপবাবু এমএলএ হওয়ার পর থেকে আর কাজ এগোয়নি। সাংসদ রাজদীপ রায় একদিনও গিয়ে খোঁজ নেননি। অর্ধনির্মিত স্লুইসগেটটি আমাদের দেখালেন এলাকার কালা লস্কর, সুধীর দাসরা। দেখালেন, বরাক নদীর দিকে ঢালাই করে রড বসানোর কাজ পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। মহিষাবিলের দিকের নিচু জায়গায়ও বসানো হয়ে গিয়েছিল কংক্রিটের ভিত। কাজের বাকি বলতে লোহার পাত বসানো ও এরপর বসানো বাকি দুটে হিউম পাইপ। ব্যস, এতোটুকু করলেই মহিষাবিলের নয় মাস জলের তলায় থাকার হাত থেকে নিস্তার মিলত।
গত বন্যার সময়ই এলাকার মানুষ আমাদের স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, জল নামুক, এবার আমরাই রাস্তা কেটে দেবো, যাতে মহিষাবিলের জল বরাকে গিয়ে পড়তে পারে। কালা লস্করের মতো এলাকার মুরুব্বি মানুষেরা আমাদের বলেছিলেন, রাস্তা কেটে দেওয়ার তোড়জোড় মাঝেমধ্যেই শুরু করে দেয় মাসের পর মাস জলবন্দি মানুষগুলো। এলাকার মুরুব্বিরাই বোঝান, এমনটা করো না, একবার রাস্তা কেটে দিলে বর্ষার সময় বরাকের জল ঢুকে পড়বে মহিষাবিলে, আর এরপর পুরো শহরকে ভাসিয়ে দেবে। কয়ামত হয়ে যাবে। মুরুব্বিরা বলেছিলেন, শহরের মানুষ আমাদের খোঁজ রাখেন না, আমাদের যে বছরের পর বছর ধরে জলের মধ্যে থাকতে হয়, এটার খবর কেউ রাখে না। তবু আমরা সবাইকে বোঝাই, রাস্তা কাটা চলবে না, পুরো শহর ভেসে যাবে।
মে মাসের ২১ তারিখ আমরা বেতুকান্দি গিয়েছিলাম। ওইদিনই এই কথাগুলো বলেছিলেন ওঁরা। এক পক্ষ রাস্তা কেটে ফেলতে চায় নিজেদের জলবন্দি জীবন থেকে নিস্তার পেতে। আরেক পক্ষ শহরকে কেয়ামতের হাত থেকে রক্ষা করতে রাস্তা কাটা আটকে রাখছেন।
প্রশ্ন হল, বাঁধ বা রাস্তা তা হলে কবে কাটা হল? ১৩ জুন থেকে তুমুল বর্ষণ শুরু হয়েছে। এর পরে তো বাঁধ কাটবেন না দুষ্কৃতীরা, কারণ বরাক তখন ফুলে ফেঁপে উঠছে, পথ পেলে সবচেয়ে আগে তো বেতুকান্দিকেই ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
বুধবার স্থানীয় এক এনজিও-র সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারি অন্তত পনেরো দিন আগে রাতের অন্ধকারে রাস্তা বা বাঁধটি কেটে ফেলা হয়েছে।
প্রশ্নটা ঠিক সেখানেই। এতোদিন প্রশাসন তা হলে কী করছিল? জলসম্পদ বিভাগ থেকে এফআইআর করা হয়েছে বলে শোনা গেছে। বুধবার জেলাশাসককে এর সত্যতা জানার জন্য হোয়াটসঅ্যাপ করেছিলাম। জবাব পাইনি। আমরা জানতে চেয়েছিলাম, প্রশাসন বলছে বাঁধ ড্যামেজ করা হয়েছে। এখন সেটা সারাই করার কোনও কাজ চলছে কি? চললে কতদিন লাগতে পারে? না, কোনো প্রশ্নের জবাব আসেনি।
কিন্তু প্রশ্নগুলো থেকেই যায়। কবে কাটা হয়েছিল বাঁধ? কেন সঙ্গে সঙ্গে তা মেরামতের কাজে হাত দেওয়া হল না? এটা কি প্রশাসনের অদূরদর্শিতা নয়? শহর কি এই অদূরদর্শিতার জন্য আজ ভেসে যাচ্ছে না?
মে মাসের বন্যার সময় বিধায়ক দীপায়ন চক্রবর্তী বেতুকান্দি গিয়েছিলেন। ২৭ মে দীপায়নবাবু বার্তালিপিকে বলেছিলেন, বন্যা কমলেই আধিকারিকদের সঙ্গে কথা বলে তিনি মহিষাবিলের স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে উদ্যোগ নেবেন।
আমাদের প্রশ্ন, কী উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি? বাঁধ কাটা হয়েছে, এই খবর কি তিনি জানতেন? যদি জানতেন, তা হলে কেন কোনো ব্যবস্থা নিলেন না? দূরদর্শিতার অভাব। যদি তাঁকে জানানো না হয়ে থাকে, তাহলে সেটার জন্য দায়ী কে?
এই প্রশ্নগুলোর জবাব মানুষের চাই। আমাদের প্রশাসন, আমাদের জনপ্রতিনিধিদের দূরদর্শিতার দৌড় কতটুকু, এটা জানার অধিকার আমাদের রয়েছে। কার ভুলে শহর আজ অথৈজলে, এটা জানতে হবে না?