21/10/2021
আরণ্যক পড়েছেন ? বিভূতিভূষনের ? একটি চরিত্র ছিল - যুগলপ্রসাদ ; সরল আপনভোলা যুগলপ্রসাদ গাছ লাগিয়ে বেড়াতেন , এটাই তাঁর ভালোলাগা, নেশা ছিল ; লেখক অবাক বিস্ময়ে দেখতেন যুগলপ্রসাদকে !
বাগমুন্ডীর সিন্দরী গ্রামের দুখু মাঝির গল্পটাও একইরকম ! এই অরণ্যপ্রেমিকেরা একইরকমই হন বোধহয়...
পড়াশোনা করেননি কোনদিন, সেই স্বাচ্ছল্য ছিলওনা কখনো .. দুখু মাঝি তখন কিশোর,প্রথম গাছ লাগিয়েছিলেন ;কিশোর দুখুর অবাক চোখের সামনেই সেই গাছে পাতা গজায়, মাটির রসে পুষ্ট হয়ে পল্লবিত হয় ধীরে ধীরে ! সেই অশ্বত্থের বটের মহুল পলাশের নেশা লাগা শুরু !
দুখু বাবু তারপর গাছ লাগাতে শুরু করলেন ফাঁকা জায়গায়, মাঠে, হাটে, রাস্তার দুপাশে...সর্বত্র ! বট, আম,জাম, মহূল, অশ্বত্থের বীজ কুড়িয়ে ইঁট পাঁজায় বা গাছের কোটরে রাখেন ;তারপর অযোধ্যার ঢাল বেয়ে একদিন তুমুল বর্ষা নামে, বীজ থেকে নরম অঙ্কুরিত চারা বের হয়, সেই চারা দুখু লাগিয়ে দেন বর্ষাসিক্ত উর্বর মাটিতে !
এবার বেড়া দেওয়ার পালা , প্রথমে লতা পাতা, ডাল দিয়ে বেড়া দিতেন ; লোকজন সেইসব বেড়া ভেঙে জ্বালানির কাজে লাগাতো ; নির্বিরোধ, বিনয়ী মানুষটি কাউকেই কিছু বলেন না,বলেন নি, উনি নতুন বুদ্ধি আঁটলেন ; শ্মশানে সৎকারের পর পড়ে থাকা কাঠ, কাপড়, মশারি,খাটিয়া, দিয়ে বেড়া দিতে শুরু করলেন !এখন আর কেউই বেড়া ভাঙে না ! মৃতের কাপড়, খাট ছুঁতে নেই যে !
বাগমুন্ডীর সিন্দরীর হাটে দেখা পেলাম ওনার ! বয়স ষাটের কোঠায়, একমাথা ধবল চুল ...গাছ লাগানোর জায়গা পরিস্কার করছিলেন আপনমনে ;
তখন 2019 , থাকেন একটি কুঁড়ে ঘরে ; সদাহাস্যময় ! জিজ্ঞেস করলাম, আজ পর্যন্ত কতগুলো গাছ লাগিয়েছেন ? উত্তর দিলেন : হাজার দুয়েক তো হবেই ! আরো লাগাবো বাবা !
আত্মপ্রচারের বাসনা নেই, নেই অভিযোগ, নেই কিছু পাওয়ারও বাসনা ! বট, অশ্বত্থ বড় হয়ে প্রচুর ছায়া দেবে, কত কত পাখি বাসা বাঁধবে, এটা দেখতে ভীষন ভালো লাগে ওনার ; চোখের সামনে বীজ থেকে বৃক্ষে পরিনত হওয়া গাছটির গুঁড়িতে হাত বোলানো স্বপ্নালু চোখের অযোধ্যার এক প্রান্তিক গ্রামে কুঁড়েঘরে থাকা এই ষাট বছরের বৃদ্ধ জানেন না ডিফরেস্টেশন কি, কার্বনমনোক্সাইড কি, ওজোন স্তর কি....
সিন্দরী, বাগমুন্ডী, বীরগ্রাম সহ সমস্ত এলাকায় ওনার হাতে লাগানো গাছ বড় হচ্ছে ! যত্রতত্র দেখতে পাবেন চিতাকাঠ, মৃতের ধুতি, শাড়ি দিয়ে বেড়া দেওয়া বট, অশ্বত্থ , আম জাম ! ওগুলো সবই ওনার লাগানো !
বাগমুন্ডী ফরেস্ট অফিস থেকে পুরস্কৃত করা হয়েছে তাঁকে ; বড়ই আনন্দ পান সেটা জানিয়ে ;
কেউ তাঁর গাছ ভেঙে দিলে খুব দুঃখ পান ; পরে আবার লাগান , সেইখানেই !দুখুকে সবাই চেনেন ; সামনের গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষক জানালেন, তাঁর স্কুলের বাইরে প্রচুর গাছ লাগিয়েছেন দুখু বাবু ; আশেপাশের গ্রামের লোক বট, অশ্বত্থের চারা পেলেই খোঁজ দেন তাঁকে ! শীত, গ্রীষ্ম , বর্ষা যাই হোক না কেন, এই সরল হাসিমুখ মানুষটিকে প্রতিদিন দেখা যায় খাটো ধুতি পরে গ্রামের রাস্তায় তাঁর লাগানো গাছগুলোর পরিচর্যা করছেন ;
গোটা দুপুর ঘুরে ঘুরে তাঁর গাছ দেখালেন দুখু বাবু ; শ্মশান থেকে পিচরোডের ধারে,ফাঁকা মাঠ থেকে স্কুলের আঙিনায়, নদীর পাড় বা মন্দির প্রাঙ্গন... অসংখ্য গাছ লাগিয়েছেন ! মুক্ত জীবনানন্দ !
তখন হেমন্তের ছোট্ট বিকেল , সূর্যাস্তের মৃদু রঙিন আলো মানুষটির শুভ্র কেশে, সরল মুখে খেলা করছে ; সামনে মৃদু বাতাসে চঞ্চল দুখুর পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা অশ্বত্থের পাতা ;
আমরাও বাড়ি ফিরবো ;বিদায় নিলাম ;
শেষ বিকেলের মেঠো পথ ধরে একাকী হেঁটে চলেছেন প্রৌঢ় মানুষটি, দীর্ঘ ছায়া ফেলে ! মনে হচ্ছে বট, অশ্বত্থ, কেঁদ, মহুল, পলাশের আন্দোলিত পাতাগুলো অভিবাদন জানাচ্ছে মানুষটিকে ! পুষ্ট ধানের শীষে ঢেউ খেলানো পাহাড়ী বাতাস লুটোপুটি খাচ্ছে তাঁর খালি পায়ের ওপর.....
সবাই পারেন না, কেউ কেউ বুক ঠুকে বলতে পারেন : "এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে আমি ..."
সিন্দরীর প্রকৃতিসাধক দুখু বাবু তেমনই একজন 🙏