06/05/2023
ইতিহাসের শিক্ষা।।।
1757 সালের 23শে জুন পলাশী যুদ্ধের মাধ্যমে সারা বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয় । ইংরেজ ও একদল বিশ্বাসঘাতকের বিশ্বাসঘাতকতায় বাংলার শেষ স্বাধীন চেতনা সম্পন্ন নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে আপামর বাঙালি ইংরেজ দাসত্বের শৃংখলে আবদ্ধ হয় । সেদিন ইংরেজ বাহিনী ও বিশ্বাসঘাতকদের মাত্র "৩০০০" সৈনের কাছে নবাবের "৫০০০০" সৈন্য হার মেনেছিল । ইংরেজদের কথা নয় বাদই দিলাম, কেননা তারাতো নবাবের প্রত্যক্ষ শত্রু ছিল । যারা নবাবের নুন খেয়ে পরের গুন গেয়েছে, যারা নবাবের দুধ-কলা খেয়ে বিনিময়ে কালসাপ এর মত বিষাক্ত দংশন ছাড়া নবাবকে কিছুই দেয়নি।
একদিকে যখন সারা বাংলা বিহার উড়িষ্যার একচ্ছত্র শাসনে মগ্ন নবাব সিরাজ উদ দৌলা, অন্যদিকে নবাবের বিরুদ্ধে সেই মুর্শিদাবাদেই চলছিল নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার নানান ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র । সেই ষড়যন্ত্রকারীরা হলেন নবাবের মাসি ঘষেটি বেগম, মীরজাফর, ইয়ার লতিফ, মিরণ, জগৎশেঠ, রায় দুর্লভ, উমিচাঁদ, রাজবল্লভ।
"ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না" বা "ধর্মের বাতি ধীরে ধীরে জ্বলে" প্রবাদ বাক্য গুলো সত্যি হয়েছে এই বিশ্বাস ঘাতকদের জীবনে । স্বাভাবিক মৃত্যু কারো হয়নি । এবারে চলুন জেনে আসি বিশ্বাসঘাতকদের জীবনের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল ??
👉 ঘষেটি বেগম :
আলীবর্দী খা এর এক কন্যা হলেন ঘষেটি বেগম । নিজ সন্তানকে বাদ দিয়ে অন্য বোনের সন্তানকে নবাব করায় তার মনঃক্ষুণ্ণ হয় এবং তিনি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন । যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের পর মীরজাফরের পুত্র মিরন তাকে ঢাকার জিঞ্জিরা দুর্গে বন্দী করে রাখেন । পরে একদিন ভোরে বুড়িগঙ্গা নদীতে এক নৌকায় করে তাকে ডুবিয়ে মারা হয় ।
👉 রবার্ট ক্লাইভ :
ভারতবর্ষে দোর্দণ্ডপ্রতাপ শাসন চালিয়ে বহু অর্থ সহ ক্লাইভ দেশে ফিরলে দেশের আদালত তার ফাঁসির সাজার আদেশ দেয় । পরে মৃত্যুদণ্ডের হাত থেকে বাঁচলেও উন্মাদ হয়ে যান । পরে উন্মদগ্রস্ত অবস্থায় খুর দিয়ে নিজের গলার নলি কটে আত্মহত্যা করেন ।
👉 মোহম্মদি বেগ :
সিরাজের খুব কাছের লোক ছিলেন মোহম্মদি বেগ । কিন্তু ৩রা জুলাই মিরণের নির্দেশে ইনিই সিরাজকে হত্যা করে । হত্যার পূর্বে সিরাজ নামাজের প্রার্থনা জানালেও শোনেনি এই মোহাম্মদি বেগ । পরবর্তী কালে এই বিশ্বাসঘাতক উন্মাদ হয়ে যায় । এবং কুয়োর জলে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে ।
👉 ইয়ার লতিফ :
নবাবের একজন সেনাপতি ছিলেন ইয়ার লতিফ । বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি সৈন্যসহ যুদ্ধক্ষেত্রে মূর্তির মতোই দাঁড়িয়ে থাকে । যুদ্ধের পর তার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি অনেক ইতিহাসবিদ মনে করেন ইংরেজরা তাকে গোপনে হত্যা করেছে ।
👉 রায় দুর্লভ :
নবাবের খানেক সেনাপতি ছিলেন রায়দুর্লভ । তিনিও যুদ্ধক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্বিকার ছিলেন । পরে 1765 সালে গলায় পাথরের বস্তা বেধে মুঙ্গেরের দুর্গ থেকে রায় দুর্লভ কে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা হয় ।
👉 উমিচাঁদ :
যুদ্ধ শেষে নবাবের সম্পত্তির এক চতুর্থাংশ দাবি ছিল উমিচাঁদের । টা থেকে বঞ্চিত হলে উমিচাঁদ বদ্ধ উন্মাদ হয়ে পথে ঘাটে ঘুরতে থাকে । এভাবেই একদিন তার মৃতদেহ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা যায় ।
👉 রাজবল্লভ :
ঢাকার নবাব রাজবল্লভ প্রচুর পরিমাণে নবাব সিরাজ উদ দৌলার অর্থ তসরুপ করে । এবং তার পুত্র কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেন । 1763 সালে নবাব মীরকাসিম ইংরেজদের সঙ্গে আঁতাতের অভিযোগে রাজবল্লভকে জলে ডুবিয়ে হত্যা করেন ।
👉 মীরণ :
মীর জাফরের পুত্র মীরনই নবাব সিরাজউদ্দৌলা কে হত্যা করার নির্দেশ দেয় । সিরাজের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ ঘোড়ার পিঠে বেঁধে সারা মুর্শিদাবাদ ঘোড়ায় । পরে সিরাজের মা এবং ভাইকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে এই মীরন । পরবর্তীকালে বিহারের পাটনায় বজ্রাঘাতে এই মিরনের মৃত্যু হয় । অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন বজ্রাঘাত নয় ইংরেজর মিরণকে আগুনে পুরিয়ে বজ্রাঘাত বলে চালিয়েছে ।
👉 মীরজাফর :
বিশ্বাসঘাতক যার নামের সমার্থক হয়ে গেছে সে হল মীরজাফর । ইংরেজদের সঙ্গে গোপন আঁতাত করে নবাব সিরাজদুল্লাহ কে হারিয়ে তিনি বাংলার নবাব হয়েছিলেন । খুব বেশিদিন তিনি নবাবী করতে পারেননি, তাকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাসেমকে বাংলার সিংহাসনে বসায় ইংরেজরা । তার জীবনের অন্তিম পরিণতি সুখের হয়নি । দুরারোগ্য কুষ্ঠ ব্যধিতে অনেকদিন কষ্ট করার পর 1765 সালে মিরজাফর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ।
👉 জগৎশেঠ :
তৎকালীন বাংলার ধনকুবের ছিলেন জগৎশেঠ শোনা যায় তিনি নবাব এবং ইংরেজদের প্রচুর পরিমাণে টাকা ধার দিতে নেই পলাশী ষড়যন্ত্রের অন্যতম পুরোধা ছিলেন এই জগৎ শেঠ । বক্সার যুদ্ধে যাওয়ার পূর্বে চাহিদামত অর্থ সাহায্য না পাওয়ায় নবাব মীর কাসিম মুঙ্গেরের দুর্গের চূড়া থেকে গলায় বালির বস্তা বেঁধে জগৎশেঠকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করে ।
👉 মিরকাশিম :
ভগবানগোলায় ছদ্দবেশী সিরাজ-উদ-দৌলাকে এই মীরকাসিমই ধরিয়ে দেয় পরবর্তীতে তিনি বাংলার নবাব হন । নবাবের সঙ্গে ইংরেজদের মতানৈক্য দেখা দেওয়ায় কয়েকটি যুদ্ধ হয় ইংরেজদের সাথে নবাবের এবং তাতে পরাজিত হয়ে মীরকাসিম পথে-প্রান্তরে পালিয়ে বেড়াতে থাকেন । পরে 1777 সালে 6ই জুন দিল্লির রাজপথে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পড়ে থাকেন ।
অবশেষে মনে পড়ে আরও একটি প্রবাদ বাক্য "পাপ ছাড়ে না বাপকে" । পাপ করলে তার ফল ভোগ করতেই হবে । তার জন্য নরক বা পরবর্তী জন্মের দরকার নেই এইজন্মেই ভোগ করতে হবে কৃত পাপের ফল।