15/10/2022
বিহার একসময় তাচ্ছিল্যের পাত্র ছিল। তাচ্ছিল্যের কারণও ছিল। লালুজীর মেয়ে ডাক্তারি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে দিল্লিতে পড়তে গেল, এবং ফেল করলো। সেটা বুঝিয়ে দিল শিক্ষাব্যবস্থার কি হাল। শিক্ষাহীন বিহারে ছিল জাতপাতের রাজনীতি, মাফিয়া রাজ। তাদেরকে শিক্ষা না দিয়ে লড়াই লাগিয়ে দেওয়া হত অন্যদের সাথে। বাইরের কেউ বিহারে চাকরির পরীক্ষা দিতে যেতে পারতো না। স্টেশনের বাইরে বেরোতে দেওয়া হতো না। সারা দেশ হাসতো বিহারকে নিয়ে, লোক হাসা-হাসি করতো লালুজীকে নিয়ে।
বিহারের নতুন জাগরণ হলো নীতিশ কুমারের হাত ধরে। পরীক্ষায় টোকাটুকি বন্ধ করলেন। পাশের হার অনেক কমে গেল। তিনি অটল রইলেন। কোয়ান্টিটি নয় জোর দিলেন কোয়ালিটির ওপর। যে মদ থেকে প্রচুর রাজস্ব আসতো, সেই মদ বন্ধ করলেন রাজ্যকে বাঁচানোর জন্য। কড়া হাতে দমন করলেন জাতপাতের রাজনীতি। দলিত আর রণবীর সেনার লড়াই, রক্তপাত বন্ধ হল। নতুন বিহারের অঙ্কুরোদগম হল। মানসিকতা পরিবর্তন হল বিহারের। হাত পাতা বা গা-জোয়ারি করে নয়, নিজের যোগ্যতায় অর্জন করতে শিখল সর্বভারতীয় চাকরি।
দু'টি ঘটনা আমার নিজের দেখা। প্রথমটি কনকনে এক শীতের ভোরে গয়া বাসস্ট্যান্ড; চায়ের দোকান। বৃদ্ধ চা ওয়ালার কষ্ট শুনে স্থানীয় একজন পরামর্শ দিলেন, ছেলেকে তো দোকানে বসাতে পারো। ফুঁসে উঠলো দোকানদার। আপনাদের ছেলে গভমেন্ট নকরি করবে, আমার ছেলে চা বেচবে? আমি ছেলেকে আইপিএসের কোচিংএ ভর্তি করিয়েছি। ও অফিসার বনবে বাবু।
অবাক হয়েছিলাম। এক চা'ওয়ালাও এইভাবে ভাবতে পারে!! আর একবার আমাদের স্কুলে একটা গ্রুপ'ডি পরীক্ষার সিট পড়েছিল। বিহার ইউপি থেকে দলে দলে ছেলে এসেছিল পরীক্ষা দিতে। জেনারেল কম্পার্টমেন্টে গাদাগাদি করে এসে, প্ল্যাটফর্মে শুয়ে পরীক্ষা দিয়ে গেছিল।বলেছিল যেখানে যে চাকরির বিজ্ঞাপন বেরোয়, ওরা ফর্ম ফিল আপ করে। চাকরির জন্য সব কষ্ট সহ্য করতে রাজি তারা।....
এরপর দেখেছিলাম একটা খবর। বিহারের সাসারাম প্ল্যাটফর্মে প্রতিদিন বিকেলে জড়ো হয় কয়েকশো ছেলে। গ্রামে তাদের পাওয়ার থাকে না।প্ল্যাটফর্মে ইন্টারনেটের সুবিধা আর কারেন্ট দুই'ই পাওয়া যায়। সেই সুযোগ নিয়ে তারা স্টাডি করে জিআই, জিকে, কারেন্ট টপিক, অংক, ইংরাজি। লক্ষ্য একটাই সরকারি চাকরি পেতে হবে। সারা ভারত অবাক হয়ে দেখেছিল সেই ছবি। চাকরি পাবার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এক যুব সমাজ।
আবার গতকাল ভাইরাল হয়েছে একটি ছবি। পাটনার গঙ্গার তীরে সপ্তাহের শেষে জমায়েত হয়েছে বহু যুবক। রেলের চাকরির ফ্রি কোচিং আর টিপস দেওয়া হচ্ছে সেখানে। সেই কোচিং নিতে গঙ্গার তীর ভরে গেছে।
এবার আমাদের দিকে যদি তাকাই। গর্বিত বাঙালি জাতি। আমরাও ভিড় করি, তবে মেলায়, পুজোয়, মিছিলে, উৎসবে। চাকরির প্রতি আমাদের আগ্রহ কম।আমরা ক্লাব, রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত। ফ্রি নেট পেলে পাবজি খেলি, রিল বানাই, ফেসবুক করি, সিনেমা দেখি। দিনের শেষে বলি ওরা মাউরা, গুঠখা, খোট্টারা আমাদের সব দখল করে নিল। তারপর ভিড় করি বেকার'ভাতার লাইনে। ফলে যা হবার তাই হয়, আমরা মাটি কুপিয়ে ১০০ দিনের কাজে সেরা হই, আর ওরা আইএএস, আইপিএস হয়।
একটা পিছিয়ে পড়া রাজ্য নিজের চেষ্টায় উঠে দাঁড়াচ্ছে, প্রতিষ্ঠার জন্য লড়ে যাচ্ছে, আমরা কি শিখছি কিছু ? নাকি ইতিহাস আর আত্মগরিমায় আজও তৃপ্তির চোঁয়া ঢেঁকুর তুলেই যাচ্ছি? মানসিকতায় পরিবর্তন দরকার। তাহলেই ভিক্ষা দিয়ে,প্রাদেশিকতার জিগির তুলে, জাতপাত দিয়ে মাতিয়ে রাখা যাবে না আর। এই ছবি, এই ঘটনাগুলো কি একটুও ভাবায় না! বাঙালির এই জড়ত্ব কি ঘুচবে না! জানি না এ কোন অন্ধকার সময়!