25/02/2024
সুলেখক Nayaan Basu প্রোফাইল থেকে কপি পেস্ট করা পাঠ প্রতিক্রিয়া।
হার না মানা হার
শুভব্রত বসু
এবারত প্রকাশনী
পাঠের শ্রদ্ধা
শ্রদ্ধার পাঠ
জর্জ রায়, ছেলেটার নাম ছিল জর্জ রায়। একমাথা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, বেশ লম্বা, আর হয় না কিছু কিছু ছেলে বেশ ভব্যিযুক্ত ধরণের, জর্জ ছিল সেই টাইপের। জর্জ আমাদের স্কুলের ছেলে ছিল। সেই বছর লাগান সিনেমাটা রিলিজ করেছে, আমীর খান, গ্রেসি সিং। সেই একজন সর্বহারা কৃষকের রঙিন রূপকথার স্বপ্ন দেখা আর দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই। আসলে আমরা স্বপ্ন বলতে নরম নীল বুঝি তো, আসলে স্বপ্ন মানে ঘাম রক্ত আর জল। রকি সিনেমায় স্ট্যালোন বলেছিলেন, তুমি কতবড় যোদ্ধা সেটা তুমি কতটা জোরে মারতে পারছ তার ওপর নির্ভর করছে না, কতবার পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়াতে পারছ তার ওপর নির্ভর করছে। আর ওই বারবার পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ানটার জন্য গায়ের জোর লাগে না, কোনো সুমহান দার্শনিক তত্ত্ব লাগে না, লাগে হার না মানার জেদ। তখন আমাদের ইলেভেন। জর্জ হাত পা নেড়ে খুব উত্তেজিত হয়ে বলেছিল, “লাগান সিনেমাটা আমাদের স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে দেখান উচিত।” জর্জ খুব আবেগী ছেলে ছিল, এখনও আছে সম্ভবত। বলতে বলতে ওর হাত পা মুখ কাঁপছিল। আমি মনে মনে ভাবছিলাম, ধুর ব্যাঙ, একটা হিন্দি সিনেমা, তাতে আবার নায়ক নায়িকা হাত ধরে নাচানাচির করছে, সেটা স্কুল থেকে অ্যারেঞ্জ করে দেখাবে! দাবী দেখ একবার! তখনও আমি সিনেমাটা দেখিনি। বাজে কথা বলব না, সিনেমাটা দেখার পর আমারও মনে হয়েছিল, জর্জ ঠিক কথা বলেছে। কারণটা এটা নয় যে লাগান সিনেমায় সবশেষে একটা রূপকথার মতো জয় ছিল, সব রূপকথার শেষে “লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার” থাকে না। কিন্তু ওই যে একটা আদ্যন্ত অলৌকিক স্বপ্ন দেখার অসহ্য ছেলেমানুষী, বারবার হেরে যেতে গিয়েও ফিনিক্স পাখির মতো আরেকবার উঠে দাঁড়ান, দাঁতে দাঁত চেপে সব ব্যঙ্গ, সব তামসিকরার জবাবে চোয়াল শক্ত রাখা, হাতে তুলে নেওয়া রাজসিকতার আয়ুধ, হেরে গিয়েও আর্তনাদের সঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো করে মিশিয়ে দেওয়া “আমি হারব না” এর নক্ষত্রচূর্ণ, রূপকথা এটাকে বলে। আমারও এখন মনে হয় লাগান স্কুলের বাচ্চাদের দেখানোই যায়, উচিতও হয়তো। জীবনের শিক্ষা তো এগুলোই। বাবরের বাবার নাম কে মনে রাখে? কিন্তু পরিস্থিতি, দূরের এবং অতি নিকটের মানুষও যখন নারকীয় নিস্পৃহতা নিয়ে ভেঙে দিতে চায় স্বপ্নের ডানাগুলো, তখনও “আমি লড়ব, আমি লড়ব, আমি লড়ব” বলতে শেখার নাম শিক্ষা। হার না মানা হার বইটা সেই সিলেবাসের একটা পাতলা চটি বই। লাগান যেরকম মনে হয় স্কুলের সব বাচ্চাকে দেখান উচিত, তেমনি এই বইটাও আমার মনে হয় পৃথিবীর সেই সবকটা মানুষের পড়া উচিত, যারা জানে অথবা অনাগত আগামীতে জেনে যাবে, জীবনের সব ম্যাচে শেষ বলে বোলারের পা লাইনের বাইরে পড়ে নো বল হবে না। হ্যাঁ, হার না মানা হার ঠিক এরকম একটা বই।
কিছু কিছু শব্দ হয়, যাদের পড়লে মনে হয় এরা ঠিক অক্ষর নয়, আলো দিয়ে নির্মিত। আর খুব সহজ আলো। আসলে আলো সহজই হয়, অন্ধকারের মতো। যে অন্ধকারে বসে লোধা শবরকন্যা মণি অথবা চুনী কোটাল ইতিহাস ভূগোল বই টেনে নিত। “.. ছেঁড়া কাঁথায়, মাদুরে। স্বপ্নে ভেসে আসে ভাতের গন্ধরা…” আর তারপর শুরু হতো তার লড়াই। মানুষ আসলে কেমন জানেন তো, মানুষ নিজের স্বপ্নের মতন বড়। যে স্বপ্ন দেখে পাখি হবে, তার পিঠের দুধারে দুধের গন্ধের মতন শাদা আর নীল রেখা ফুটে ওঠে, যে স্বপ্ন দেখে গাছ হবে তার শরীরে বাসা বাঁধে সবুজের আদিম গন্ধ। আর কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে আকাশ হওয়ার। মানুষ তখন আকাশ হয়। আকাশ তো অসীম, অসীমের অধিকার পেতে গেলে আগে নিঃস্ব হতে হয়, শূন্য হতে হয়। নিংড়ে দিতে হয় নিজেকে, জলে ভেজা কাপড়ের মতো। টপটপ করে ঝরে পড়ে অনাদর, অবহেলা, অভিমানের দাগগুলো। তারপর সেই কাপড় উড়তে থাকে, চুনী কোটালের ছেঁড়া জামার মতো, জাতীয় পতাকার মতো, পতপত করে। এক মায়াবী নিবিড় নীল আকাশের তলায়।
কিছু লেখা শব্দের মনিমানিক্য খচিত হয় না। কিছু লেখা পড়লে মনে হয় একজন পথ চলতি লোক একটা ব্যস্ত রাস্তার বর্ণনা দিচ্ছে যেন। ওই ওখানে একটা লোক কলের জলে চান করছে, তার পাশ দিয়ে একটা হলুদ অ্যাম্বাসেডর চলে গেল, ওপাশের বাড়ির বারান্দায় ভেজা কাপড় মেলতে এসেছে একটা মেয়ে এরকম। গদ্যময় ভাষা। কিন্তু শুনে মনে হয় একটা ছবি দেখছি। যে ছবিটা লোকটা দেখেছে, নিজের চোখে, আর সহজভাবে বলে যাচ্ছে পাশ দিয়ে এক্ষুণি যে লোকটা চলে গেল চেক জামা পরে, তার চোখে একটা রিমলেস চশমা। আসলে এরকমই তো হয়, গল্প তখন আর গল্প থাকে না, জ্যান্ত হয়ে ওঠে। এতটাই জ্যান্ত যে হলুদ অ্যাম্বাসেডরটা যখন কর্কশ শব্দে হর্ন দিয়ে ওঠে, চমকে উঠতে হয়। যেমন, মণি অথবা চুনী কোটাল যখন একঘর স্টুডেন্টদের মধ্যে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে বলে, “ছাত্র সংসদে আমি যোগদান করব কি না, সেটা আমার ব্যক্তিগত ইচ্ছা। তার জন্য কেউ আমাকে জোর করতে পারে না।” তখন সেই কর্কশ শব্দটা শোনা যায়। হ্যাঁ, তখন গোটা ক্লাসরুম নিস্তব্ধ আর সব নিস্তব্ধতা হিরন্ময় হয় না, কিছু নিস্তব্ধতা কর্কশ হয়। কান ঝালাপালা করে দেয়। এই গদ্যময় ন্যারেশনের এটাই গুণ, ওই কর্কশ আওয়াজটা শোনা যায়।
প্রত্যেক শব্দের পিছনে একটা করে পোঁ থাকে। যেমন ওঙ্কারের পিছনের ওম। অনেকটা শাঁখ বেজে যাওয়ার পরেও যে ম’টা পড়ে থাকে, সেরকম। ওটা শব্দের ওজন। সেটা বাড়ে কমে, লেখক সেই শব্দ কখন কোথায় ব্যবহার করছেন তার ওপর। ঠিক তেমনি আমাদের প্রত্যেক মানুষের পিছনেও ওই পোঁ’টা থাকে। মানুষ তো আর স্বয়ম্ভু নয়। তার ইতিহাস আছে, আর কে না জানে মানুষের ইতিহাস এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাস। আমরা সকলে প্রত্যেকে নক্ষত্রচূর্ণ দিয়ে প্রস্তুত। আবেগ নয়, বিজ্ঞান, তথ্য। তেমনি যখন লেখক কোনো চরিত্র নেন, তার পিছনের সেই পোঁ’টা ধরেই লেখেন। চরিত্রের ইতিহাস। এই গল্পে লোধা শবর কন্যাটির কথা যখন লেখক লেখেন, সেই সুদূর অতীত থেকে যেন তার সব পূর্বপুরুষ এসে দাঁড়ান, তাদের যন্ত্রণা, তাদের বঞ্চনা মূর্ত হয়ে ওঠে একটি চরিত্রের হাত ধরে। তখন ব্যষ্টি চরিত্রের নাশ হয়, একটা ইতিহাস কথা বলে। একের মুখ দিয়ে। তখন আর সেটা গল্প থাকে না, দলিল হয়ে ওঠে। একটা জাতির একটা জনজীবনের দলিল। হার না মানা হার সেই দলিল।
সাধারণত এমন অতিলৌকিক বিক্রমের মানুষগুলোর গল্প বলার ক্ষেত্রে শুধু তার লড়াইটুকু বড় করে দেখান হয়। পার্শ্বচরিত্র তেমন গুরুত্ব পায় না। অস্বাভাবিকও কিছু নয়। সূর্যের আলোয় তারারা ঢেকে থাকে যেমন। এই গল্পেও সেটাই হয়েছে। কিন্তু একইসঙ্গে মূল চরিত্রের লড়াইয়ের পাশাপাশি তার প্রেমের কবিতাও উঠে এসেছে। উঠে এসেছে তার স্বপ্নের কথা, যেখানে “মণি বসে আছে, সে আসবে। মাথায় জংলাপাতার মুকুট পরে, গলায় বনফুলের মালা দুলিয়ে, হলুদ খাটো ধুতি পরে। চকচক করবে তার কালো আদুর গা, জ্যোৎস্না ঠিকরে পড়বে তার গা থেকেও।” স্বপ্নের মতন। অথচ মণির স্বপ্ন আরও অনেক বড় ছিল। মাঝে মাঝে তাই মনে হয় জ্যোৎস্নার চেয়ে অলৌকিক নরম এবং প্রলয়ঙ্কর সর্বনাশ আর বুঝি কিছু নেই। তবু, যে আকাশ হতে চেয়েছিল, সে যতটা না জানত তাকে কোথায় যেতে হবে, তার চেয়ে ঢের বেশি জানত তাকে কোথায় থামতে হবে। জ্যোৎস্নার মায়াপ্লাবন কতজনই বা এড়াতে পারে! যারা পারে, তারা কঠোর নয়, তারা জ্যোৎস্নার চেয়েও বেশি জীবনবিলাসী।
ওই প্রথম প্যারাতে যেমন বলেছিলাম, জীবনের সব খেলায় শেষ বল নো’বল হয় না। এই গল্পেও হয়নি। গল্প ওখানেই থেমে যেতে পারত। কিন্তু থেমেনি। কারণ প্রতিবাদীর মৃত্যু হয়, প্রতিবাদের তো হয় না। মুখ বদলে যায় খালি, শব্দ তখনই স্লোগান হয়ে ওঠে। আর স্লোগান হয়ে ওঠে কবিতার মতো, নির্মম। যেখানে মণি’কে হারিয়ে দেওয়া হলো, তার পর থেকে আরেকটা লড়াই। আসলে প্রতিবাদ প্রতিরোধ সবই একটা রিলে রেসের মতন। একজন যেখানে ছেড়ে যান, আরেকজন সেখান থেকে শুরু করেন, করবেন। আজ নয় কাল। ঠিক যেমন করে মানুষের সভ্যতার ইতিহাস রচিত হয়, একজন এক কদম এগোলে পরের প্রজন্ম সেখান থেকে হামাগুড়ি দিতে শেখে। তারপর একদিন সাবলীল পায়ে সে এগিয়ে যায় আগামী সূর্যের দিকে। মণি গল্প যেখানে শেষ হয়, আসলে সেখান থেকেই আরেকটা গল্প শুরু হয়। ইতিহাসের পাপ চাপা থাকে না। যেমন আব্রাহাম লিংকন বলেছিলেন, “You can fool all the people some of the time and some of the people all the time, but you cannot fool all the people all the time." সেজন্যই অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তর আদায় করার জন্য আবার জাগতে হয় মণিদের। অন্য মুখে, অন্য শরীরে। একের প্রতিবাদ মিশে যায় মিছিলের গর্জনে। তাই এই গল্পের শেষেও আবার পথ চলা শুরুর বার্তা আছে। যেমন হয়ে আসছে, আবহমান কাল ধরে। যেমন হয়ে চলবে অন্তহীন।
শুভব্রত বসুর আগে আইলী আম্মা ও এক বেচুর গল্প পড়েছিলাম। এছাড়া কয়েকটি পূজা বার্ষিকীতে কিছু ভৌতিক, কিছু ঐতিহাসিক। তাদের কলেবর শীর্ণ। তুলনামূলক বিচারে যাওয়া ভুল, সব লেখার বিস্তার, গভীরতা এমনকি লেখকের বক্তব্য সমান হয় না। কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়, আইলী আম্মা পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম। পড়ে মনে হয়েছিল চোখের সামনে দেখছি যেন। এই ধরণের লেখাগুলো আলাদা ভাবে স্পর্শ করে। কিন্তু হার না মানা হার এখনও পর্যন্ত আমার পড়া লেখকের শ্রেষ্ঠ রচনা। এখনও পর্যন্ত। এই বই সেই সমস্ত মানুষের, যাদের জীবন বারবার বক্সিয়ের রিংয়ের মধ্যে ধরাশায়ী করে। আর বারবার যারা জিভ দিয়ে কষাটে রক্তের ঘ্রাণ চেটে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
হার না মানা হার গলায় পরবে বলে।।
পুঃ একটি কথা না বললে কিছুটা বাকি থেকে যাবে। মেকিং নিয়ে কোনো কথা বলার উপায় রাখেনি এবারত প্রকাশনী। তবে যেটা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য, বইয়ের ভিতরের পাতায় কিছু অলঙ্করণ আছে। লিনোকাট? আমি জানি না। কিন্তু এককথায় ধ্রুপদী। যিনিই করে থাকুন না কেন, কুর্নিশ।।