14/10/2023
শারদ সৃজন
পাঠ প্রতিক্রিয়া
সুকন্যা মিশ্র লিখলেন-
আজ, মহালয়ার দিন প্রকাশিত হয়েছে 'শব্দাশ্ব' পত্রিকার একাদশতম সংখ্যা এবং শারদীয় সংস্করণ 'শারদ-সৃজন'। বাণী বসু সহ বহু বিশিষ্ট কবি ও সাহিত্যিকের লেখায় সমৃদ্ধ এই সংখ্যা। বিভিন্ন বিভাগে বিভিন্ন লেখা পাঠের পর আমার পাঠানুভূতি তুলে ধরার এক অক্ষম প্রয়াস রইল মাত্র।
বিভাগ : কবিতামঞ্জরী
**এই সংখ্যায় বাণী বসুর লেখা কবিতাটির নাম 'দ্বৈত'। তাঁর লেখা নিয়ে মন্তব্য করার ধৃষ্টতা আমার নেই। ভালো লাগা কবিতাটির দাগ কেটে যাওয়া চারটি লাইনের উল্লেখ করলাম,
"আমরা বিচ্ছেদ, আমরা দুই পাড়, এ পশ্চিমেই
মধ্যে বেড়াজাল মধ্যে কাঁটাতার কিচ্ছু নেই
অথচ মস্তকে লুকিয়ে পরে থাকি শিরস্ত্রাণ
অথচ বাঘনখ মুঠোর সন্ধিতে মুখ ব্যাদান"
**অনুপম দত্ত 'রবিবারের পাখি' নামে দুরন্ত একখানি কবিতা লিখেছেন। 'রবিবার থেকে একটা পাখি উড়ে যাবে/সোমবারের ঠিকানায় ফিরতে পারবে না' এই দুটি লাইন মনে হয় ওঁর পক্ষেই লেখা সম্ভব।
**সাজ্জাদ সাইফের কলমে 'কীসের দম্ভ তোমার' কবিতাটি পাঠের সুযোগ হল। স্বল্প পরিসরে অত্যন্ত বলিষ্ঠ একটি লেখা।
**ফারহানা নীলার লেখা 'কারাগারে আমি' কবিতাটি জীবন নামক কারাগারে বিষণ্ন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবমনের পর্যবেক্ষণের এক বিস্তারিত ছবি হয়ে থেকে যাবে।
**সাদ জগলুল আববাস এঁর লেখা 'উড়ে গেছে চিল' কবিতাটিতে ভাষার কারুকার্য অতি চমৎকার। "হাঁসের ছানার মতো নরম প্রাতঃরোদ পড়ে থাকা আড়াআড়ি কিছুক্ষণ, এরকম আমার একখানা/গাছবাঁধানো ঘাট ছিলো" -এমন উপমা আজীবন স্মৃতিতে জায়গা করে নেওয়ার মত।
**আরাফাত রিলকের লেখা 'জলে যে রেখেছে পা' কবিতাটি নিজস্ব স্বতন্ত্রে আলাদাভাবে জায়গা করে নেয়।
**মৌমির লেখা 'অকারণ' কবিতাটি জীবনযুদ্ধে লড়াই করতে করতে জীবনের কিছু সারস্বত উপলব্ধির কথা বলে। ঝড় থেমে যাওয়ার পর ঝড়ের বিধ্বংসী ধ্বংসলীলার সাক্ষী থেকে যাওয়া ধ্বংসস্তূপের ওপর বসে যে উপলব্ধি হয় এ যেন ঠিক সেরকমই। লেখাটি বড় বিষণ্ন করে দেয়।
**অর্ঘ্য রায় চৌধুরীর লেখা 'স্বপ্নে দেখা হবে' কবিতাটি পড়ে সুবোধ ঘোষের লেখা 'জতুগৃহ' গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। কবি খোয়াই, বোলপুর, সোনাঝুরি শব্দগুলির অলিন্দে বেহালার এক করুণ সুর বাজিয়েছেন। যা কিছু বাস্তব জীবনে থেকে হারিয়ে যায় তা আমাদের কাছে একমাত্র স্বপ্নে ফেরৎ পাওয়ারই এক অলীক স্বপ্ন থেকে যায়। শেষের লাইনটি "...সোনাঝুরি মত স্বপ্নে দেখা হবে।" তাই কবিতাপাঠের শেষেও স্বপ্নের মত আচ্ছন্ন করে রাখে। কবি প্রসঙ্গে একটি কথা না বললেই নয় কবিতা কিংবা স্মৃতিচারণামূলক লেখায় উনি নিজেই একজন মাইলস্টোন হয়ে উঠেছেন। পত্রিকায় কিংবা গ্রূপে এঁর লেখাই সবার আগে চোখে পড়ে। আশা করি নানাবিধ প্রতিকূলতা কাটিয়ে উনি শীঘ্রই আরও লেখা উপহার দিয়ে পাঠককে সমৃদ্ধ করবেন।
**গীতিকার সাহির লুধিয়ানভির সঙ্গে পরিচয় গানের মাধ্যমে থাকলেও তাঁর লেখা কবিতার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। অমৃতা প্রীতমের জীবনী নিয়ে একটি লেখায় এঁর কিছু কবিতা পাঠের সুযোগ হয়। কিন্তু ভাষাগত ব্যবধানের কারণে সেই আগ্রহ এর বেশি এগোতে পারেনি। তাঁরই লেখা বিখ্যাত 'তাজমহল' এর বাংলা অনুবাদ যখন পড়ার সুযোগ হয় তখন বিশেষ আগ্রহের জায়গা তৈরি হয়েই যায়। 'শারদ সৃজন' এ দীপায়ন ভট্টাচার্য সেই কবিতাটির অনুবাদ পাঠের সুযোগ করে দিয়েছেন। এমন একটি কবিতার অনুবাদের চেষ্টাই যথেষ্ট সাহসের পরিচায়ক। শব্দের কারুকার্যে অনুবাদটি নিঃসন্দেহে নিজস্ব এক অস্তিত্বের জানান দিয়ে যায়। কবিতার বক্তব্যটি নিজেও ভীষণই মর্মস্পর্শী একটি লেখায় প্রতিফলিত হয়েছে। অনুবাদ কবিতাটি, সাহির লুধিয়ানভির প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধাজ্ঞাপন হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।
বিভাগ : গল্পবাহার
**একটি ট্রেন যাত্রার মধ্য দিয়ে গল্পের শুরু হয়। তারপর সেখান থেকে গল্প একটি গল্পের বইয়ের কেন্দ্রীয় চরিত্র নিকোলাইয়ের হাত ধরে অদ্ভুত এক জাদু রূপকথার রাজ্যে উপস্থিত হয়। বইয়ের গল্প ফুরোলে দেখা যায় ম্যাজিকটা বাকি গল্পটুকুতেও রয়ে গেছে। লেখক চিরন্তন ভট্টাচার্য তাঁর লেখা ছোটগল্প 'হাঙর হ্রদ' এ রূপকের মধ্য দিয়ে অনেকগুলি সামাজিক অলঙ্ঘনীয় বাধাকে ভাঙতে চেয়েছেন। কথার সঙ্গে কথা বুনে খুব সুন্দর একটি ছোটগল্প হয়ে উঠেছে 'হাঙর হ্রদ'।
**মৌসুমী দাশগুপ্তের কলমে 'কমলাফুলি' গল্পটি পুজোর জাঁকজমক, আনন্দের মাঝে এক বিষণ্নতার গল্প বলে। যেখানে আনন্দ এমনি এমনি আসে না, অঙ্গের মামুলি গহনা বেচে সুখ কিনতে হয়। অন্যরকম এক ভালো লাগা রয়ে যায় লেখাটির প্রতি।
**ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা মগধ এর ইতিহাসের কয়েকটি ঘটনা মনে কী ছবি এঁকে যায় তা সাধুভাষায় ব্যক্ত করলেন রাণু শীল তাঁর 'আবহমান' লেখাটিতে। অত্যন্ত সুচারুভাবে প্রেক্ষিত রচনা করে লেখাটি অনন্য এক স্থানে নিয়ে গেছেন লেখিকা।
**সুধাংশু চক্রবর্তীর কলমে 'চন্দন ঘরে ফিরবে না' হল কোল খালি করে যাওয়া ছেলের নিঃসার অপেক্ষায় থাকা, অন্তহীন আশার গল্প বুনে চলা এক মায়ের গল্প। স্বল্প পরিসরে এই অন্তহীন অপেক্ষার একটি সুন্দর ছবি এঁকেছেন লেখক। তবে গল্পে, 'চন্দন' ও 'চন্দর' নাম বিভ্রাট ঘটেছে নাকি 'চন্দন' আদরের ডাকে 'চন্দর' হয়েছে তা বোঝা গেল না।
**মজুমদার বাড়ির বড় কর্তা জিতেন্দ্র মজুমদারকে নিয়ে একটি নাতিদীর্ঘ কাহিনী এঁকেছেন লীনা রায়চৌধুরী তাঁর 'কুমিরা'র দক্ষিণরায়' নামক গল্পে। 'এঁকেছেন' শব্দটির প্রয়োগ ইচ্ছাকৃত। লেখিকা যেভাবে সূক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সুনিপুণভাবে পরিবেশ ও দৃশ্যপটের বিবরণ দিয়েছেন তাতে প্রতিটি অনুচ্ছেদই আলাদাভাবে স্বয়ংসম্পুর্ন রূপ পায়। দৃশ্যের পর দৃশ্য সাজিয়ে যেন এক চলচ্চিত্রের রূপ পেয়েছে গল্পটি।
**পাহাড় ঘেরা উত্তরবঙ্গের প্রেক্ষাপটে সৌরিন মুখার্জি 'আরশি বদল' নামে খুব সুন্দর একটি গল্প বলেছেন। গল্পের সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ের লোকেদের আন্তরিকতা, নেপালী গান, মেঘলা আকাশ, ইতিউতি বৃষ্টি ইত্যাদি সহযোগে অদ্ভুত এক রিনরিনে আবহ তৈরি হয়েছে যা কোনো নাটকের আবহসঙ্গীতের সঙ্গে তুলনীয়। নেপালী গানগুলির মধ্যে অদ্ভুত এক পাহাড়ী মায়া আছে যা ওই এলাকায় যেকোনো সফরের সঙ্গেই যেন ভোরের শিশিরের মত লেগে থাকে। সব মিলিয়ে গল্পের শেষে একটা ভালোলাগা অবশেষের মত রয়ে যায়।
বিভাগ : চিন্তন
**সম্প্রতি অবন্তী চক্রবর্তীর নির্দেশনায় 'বিনোদিনী অপেরা' নাটকটি দেখার পর বিনোদিনী সম্পর্কে অনেক না জানা কথা জানতে পারি ও তাঁর লেখা বইটি ইবুক হিসেবে পাঠের সুযোগ ঘটে। নিখিল কুমার চক্রবর্তীর কলমে 'বিনোদিনী এবং তাঁর চৈতন্যলীলা' স্বল্প পরিসরে অত্যন্ত উজ্জ্বল একটি রচনা। অনেক তথ্য সংগ্রহ করে লেখক সুনিপুণ ভাষার জালে, বিনোদিনীর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের অপূর্ব এক নৈবেদ্য সাজিয়েছেন।
**ম্যাজিক রিয়ালিজম ও যে লেখকের নাম প্রায় সমার্থক শব্দ হিসেবে উচ্চারিত হয় তিনি হলেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কোয়েজ। এবারের সংখ্যায় তাঁকে নিয়ে কলম ধরলেন জয়শ্রী গাঙ্গুলি। নাম দিয়েছেন 'গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ও জাদু বাস্তবতা'। স্বল্প পরিসরে সুন্দর একটি লেখা উপহার দিয়েছেন তিনি। তবে তাঁর কলম থেকে আরেকটু দীর্ঘ লেখার প্রত্যাশা থেকেই যায়।
**বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী সাগর সেনকে নিয়ে একটি আখ্যান 'কন্ঠই যাঁর নাম' লিখেছেন অমিতাভ সরকার। ছোটবেলায় সাগর সেনের একটি ক্যাসেট বাড়িতে প্রায় চালানো হত। তাতে 'সখী বহে গেল বেলা', 'ডাকবো না ডাকবো না', 'হে নিরুপমা', 'এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম' এই গানগুলি শুনে শুনে মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে এইসব গান অন্য শিল্পীর গলায় শুনেও ছোটবেলার মত সেই মগ্নতা আসেনি। অত্যন্ত স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ উচ্চারণে সাগর সেন যখন গাইতেন মনে হত যেন আশপাশের পরিবেশ সবটুকুই যেন ওঁর নিয়ন্ত্রণাধীন। এমন একজন প্রচারের আড়ালে থাকা শিল্পী সম্পর্কে জানতে পারার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য লেখককে অকুন্ঠ ধন্যবাদ জানাই।
বিভাগ : উড়াল
**এই বিভাগে আমার একটি লেখা আছে, নাম 'নৈসর্গিক'। এর মূল্যায়ন পাঠক করবেন।
'শারদ-সৃজন' এর প্রচ্ছদটি চমৎকার হয়েছে। বাণী বসুর কবিতার সঙ্গে অলংকরণটি খুবই সুন্দর ও যথাযথ। চিরন্তন ভট্টাচার্য ও সৌরিন মুখার্জির গল্পের অলংকরণ দুটি আলাদাভাবে ছবি হিসেবে দুর্দান্ত। তবে ব্যক্তিগত অভিমতে অলংকরণ দুটি, গল্পের মূলভাবের সঙ্গে কোথাও যেন সামান্য দূরত্ব বজায় রেখেছে।
সব মিলিয়ে শব্দাশ্বের 'শারদ-সৃজন' সংখ্যাটি নিজ জৌলুশে দীপ্যমান। এই পত্রিকাটি, পত্রিকা হয়ে এভাবে উপস্থাপিত হয়ে ওঠার সঙ্গে যুক্ত সব কলাকুশলীকে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। লেখাগুলি 'লেখকের স্বাধীনতা' এর সদস্য ছাড়াও ভবিষ্যতে আরও অন্যান্যদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ুক এই আশা রাখি।