01/07/2024
আমি অনলাইনে দুটো প্রেসার কুকার অর্ডার দেওয়াতে আমার ননদ রুপা খুব অবাক হোলো | অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, "বৌদি, দুটো প্রেসার কুকার কেন??"
আমি হেসে বললাম, "একটা আমার, একটা গুঞ্জার|"
রুপা আমার কথায় মুখ ভেটকিয়ে বললো, "ছেলেবৌ আসতে পারলো না, আগেই আলাদা করে দিচ্ছ, বৌদি !! "
আমি বললাম, "দেখো রুপা, হিপোক্রেটিভ হয়ে কি লাভ বলো?? আমি গুঞ্জার শাশুড়িমা হবো,, মা তো নয় | তাই মায়ের ভালোবাসা আমি ওকে দিতে পারবো না | ও বিয়ে করে নিজের মতো করে নিজের একটা সংসার সাজিয়ে নিক | মা হওয়ার অভিনয় করে হাতে কলমে সবকিছু শিখিয়ে দেওয়ার অভিনয়টা নাই বা করলাম শাশুড়ি হয়ে !!"
ও আমার কথায় বললো, "তা কেন?? এখন শাশুড়িমায়েরাও মায়ের মতনই হয় | আমার মা কি কখনো তোমার আর আমার মধ্যে কোনো পার্থক্য রেখেছে কোনোদিন??"
আমি বললাম, " এই দেখো, তুমি নিজেই বললে, শাশুড়িমা মায়ের মতন হয় | তার মানে তারা মা হন না, শুধু ছেলেবৌ 'মা' বলে ডাকে বলে মায়ের মতন হয় | আর তোমার মায়ের চোখে আমি তুমি সমান বুঝি!! তাহলে বলি শোনো |....
বিয়ের পরে এবাড়িতে এসে যখন রান্না পারতাম না, তখন তোমার মা ধমকে, বকে, টিপ্পনি কেটে,, ব্যঙ্গ করে কথা বলতেন,, কিন্তু হাতে ধরে রান্না শেখাননি কোনোদিনও | রজত কখনো প্রতিবাদ করলে উঁনি বলতেন, "নিজের মেয়ের মতো করে শিখিয়ে নিচ্ছি, তুই আমাদের শাশুড়ি-বৌয়ের মধ্যে পড়িস না তো |" কিন্তু মজার কথা দেখো, তোমার যখন অতনুর সাথে সম্বন্ধ ঠিক হোলো,তখন তোমার এই মা-ই কি বললেন অতনুর বাবাকে,"কিছু মনে করবেন না, আপনার স্ত্রী নেই, তাই বাইরে থেকে হোমডেলিভারিতে খাবার আসে | কিন্তু রুপা আপনাদের বাড়িতে যাওয়ার পরে সেটা হতে থাকলে কেমন দৃষ্টিকটু ব্যাপার হবে, তাই রুপা যাওয়ার আগেই রান্নার লোক, আর সবসময়ের কাজের লোক রেখে দেবেন | আমার মেয়ে এতো কাজ করায় অভ্যস্ত নয় |"... মনে আছে তোমার কথাগুলো??
যখন তুমি অতনুর টাকায় বেড়াতে যাও, তখন তুমি ভ্রমণশীল মানুষ | আর যখন আমি বেড়াতে যাবার বায়না করতাম, তখন তোমার মায়ের ভাষায় আমি ছিলাম বেহিসেবি মানুষ | তাহলে বলো, শাশুড়িমা কি করে মা হলেন ??
যখন তুমি পুজোয় মায়ের চেয়ে দামি শাড়ি কেনো, তখন তোমার মায়ের ইগোতে লাগে না,, কিন্তু যখন আমি কিনি তখন তার অপমানে লাগে,, সে তুলনামূলক কম দামের শাড়ি পেয়েছে বলে | কিন্তু দেখো, বিপরীতে, আমার মা বলতো, "বয়স হয়েছে আমার, আর অত দামি শাড়ি পরতে পারি না, তুই আমাকে একটা ছাপার শাড়ি কিনে দিস, আর ওই টাকায় তুই একটা চুড়িদার কিনে নিস্ |"... তাহলে থাকলো কিনা তফাৎ মা আর শাশুড়িমাতে !!
তোমার যখন ছেলে হোলো, তখন আয়া রাখতে তোমার মা-ই বললেন অতনুকে, অথচ আমি চাকরি করার পরেও বুবুন হওয়ার পরে তোমার মা আমাকে একটা আয়া রাখতে দেননি | অথচ আমার মা, রোজ বিকেলে বুবুনের সাথে খেলা করার অছিলায় এসে আমাকে একটু বিশ্রাম দেওয়ার চেষ্টা করতো |
তুমি উপোস করে পুজো করতে না পারলে উঁনি বলেন,"মেয়ের আমার ক্ষিদে সহ্য হয় না |" আর আমি উপোস না করলে বলেন, "সংসারে আমার অলক্ষ্মী জুটেছে | ".... হলেন কি তাহলে তিনি আমার মা?? আমি না খেলে আমার মাকে কখনো খেতে দেখিনি, কিন্তু আমার শাশুড়িমা কখনো আমার জন্য অপেক্ষা করেননি | আমার মন খারাপ হলে আমার মা ঠিক বুঝে যান, অথচ আমার শাশুড়িমা দুঃখ করেন তাঁর সাথে কথা বলিনি বলে | আমি যখন কোনো কাজে ব্যর্থ হই,, তখন আমার মা আমার মনের জোর বাড়ান পরের বার জিতবো বলে | আর আমার শাশুড়িমা সেসময় আমায় ব্যঙ্গ করেন, ধর্ম দেখেন | তোমার ভুল ত্রুটি গুলি ছেলেমানুষি, আর আমার ভুল ত্রুটিগুলি গর্হিত অপরাধ !!
ছেলেবৌকে নিজের মেয়ে বললেই সেই মেয়েটার মা হওয়া যায় না রুপা | মা কখনো সন্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী হয় না, কিন্তু দুঃখের বিষয় শাশুড়িমা তাঁর ছেলেবৌকে সেটাই মনে করেন | তাই আমি আর কিছু শাশুড়ির মতো ছেলেবৌকে মেয়ের মতো করে ভালোবাসতে চাই না | তাকে ছেলে বৌয়ের জায়গায় রেখেই তাকে তার উপযুক্ত সম্মান দিতে চাই,, আর সর্বোপরি দিতে চাই তাঁর নিজের একটা সংসার, তাঁর স্বামীর সাথে | সেই সংসারে আমার ছেলে থাকলেও সেই ছেলের সূত্র ধরে কোনো দাবি খাটাতে যাবো না কোনোদিন | অলক্ষ্যে ওদের সুখটাকে উপভোগ করবো শুধু | "
আমার কথা খুব একটা মনোপুতঃ হোলো না রুপার | কিন্তু আমি খুব তুষ্ট হলাম নিজের মুখে মুখোশ পরার খেলায় না ঢুকে | গুঞ্জা আমাকে মায়ের মতন না দেখলেও হবে | ওর মা ওর জন্য যা করেছেন, আমি তা কোনোদিন করতে পারব না | কিন্তু তাই বলে গুঞ্জার সাথে আমার ভালোবাসার সম্পর্ক থাকবে না, সেটাও না | গুঞ্জা আজ আমাকে যতটা ভালোবাসে, আগামী দিনে আমাকে আরও বেশী ভালোবাসবে, আর সেই ভালোবাসার রাস্তাটা আমি তৈরী করে দেব আমার ব্যবহার দিয়ে | কে বলে ছেলেবৌ শাশুড়িমাকে ভালোবাসতে পারে না !! aছেলেবৌ কি তাঁর শাশুড়িমাকেও কম ভালোবাসে নাকি!!... আমি গুঞ্জার শাশুড়িমা হয়েই খুশি !! গুঞ্জার মা হয়ে উঠব, এমন সাধ্য আমার নেই, সত্যিই নেই !!
©অনুভূতির আঙিনায় - কলমে অনন্যা*