09/01/2024
■■■★★★ #ঈশ্বরযাজী★★★■■■
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
পানিহাটি উৎসবের আগের রাত। ঘরের বাইরে চিৎকারে হটাৎই কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল।মাথার কাছে হাতঘড়িতে সময় দেখলাম রাত দেড়টা বাজে।
বাইরে কিছু অল্পবয়সী ছেলেদের হট্টগোল।হটাৎ কারোর গলার আওয়াজে সব হট্টগোল থেমে গেল।একজনকে বলতে শুনলাম -"তোরা এখনও আড্ডা মারছিস।কাল কিন্তু অবিনদা ভোরের প্রার্থনায় আসবেন।ঘুম না ভাঙলে তখন দেখিস।
একটা কথাতেই Pin drop silent।।
ছোটবেলায় মা ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন
"খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো,বর্গী এলো দেশে"।ছোটবেলায় বুঝিনি বর্গী কি জিনিস?
পরে জানলাম বর্গি হলো অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম। ১৭৪১ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত দশ বছর ধরে বাংলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে নিয়মিতভাবে লুটতরাজ চালাত বর্গিরা। এদের ডাকাতি, খুন, লুটতরাজ বা বর্গিহানা এই সময়ের নিত্যদিনের ঘটনা।অভিযানে যাওয়ার সময় কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত ‘বরচি’।এই নাম থেকেই বর্গা বা বর্গি নামে পরিচিত হয়।
সেকালে মানুষ ঘুমাতো বর্গীদের ভয়ে।
একালের মানুষ ঘুমায় ভালোবাসায়।।
শ্রীশ্রীঠাকুর যেমন বলেছেন- "খারাপের যেমন সংক্রমণ হয়,ভালোরই তেমনই সংক্রমণ হয়"।
এই ভালোর সংক্রমণে শুধুমাত্র একজনের নামেই সবাই চুপচাপ ঘুমাতে গেল।ভোরে কে কত আগে উঠে উৎসবের মাঠে যেতে পারে তারও প্রতিযোগিতা আরম্ভ হলো।
● ১৭ই ডিসেম্বর ২০২৩..সেদিন দাদা পানিহাটি মন্দির থেকে বেরিয়ে ভোরের প্রার্থনার আগে ৬:১০ নাগাদ উৎসবের মাঠে এলেন।ঘোলা নেতাজি সংঘের মাঠ।অত বড় মাঠে,এই কাকভোরেও লোক গিজগিজ করছে।
সেদিন প্রার্থনার পর সেই যে বসলেন, উঠলেন দুপুর ২:১৫ নাগাদ(এখানে বলে রাখা ভালো তিনি গতকয়েকদিন নদীয়া জেলার বিভিন্ন জায়গায় পরিক্রমা করে ঘন্টার পর ঘন্টা এমনি ভাবেই থেকেছেন)।
এর মধ্যে একটানা স্টেজে বসে, উঠে দাঁড়িয়ে,পায়চারি করে মানুষের সমস্যাগুলো মন দিয়ে শুনে শ্রীশ্রীঠাকুরের আলোকে তার বিহিত সমাধান করে গেলেন। একটিবারের জন্যও না তাঁকে অধৈর্য্য হতে দেখলাম, না তাকে টয়লেটে যেতে দেখলাম।
এক সময় একজনকে বললেন, ঠাকুরকে পেতে হলে ঠাকুরের কাছেই যেতে হবে। ওই যে তিনি ওখানে বসে আছেন (আঙ্গুল দিয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের সুসজ্জিত আসন কে দেখালেন।)
আর যদি টাকা-পয়সা,বাড়ি,গাড়ি চান কষ্ট করে ঠাকুর অব্দি যাওয়ারও দরকার নেই,ওর ব্যবস্থা আমিই করে দিতে পারি।
ঠাকুর বলেছেন- অর্থ,মান,যশ ইত্যাদি পাওয়ার আশায় আমাকে ঠাকুর সাজিয়ে ভক্ত হয়ো না। এখন আপনিই সিদ্ধান্ত নিন আপনি ঠিক কি চান,টাকা-পয়সা-বাড়ি-গাড়ি চান নাকি শুধু ঠাকুরকে চান।
এত মানুষের ভিড়ের মধ্যেও সবার কথাই সমানভাবে গুরুত্ব দিয়ে শুনলেন।সিঙ্গুরের জ্যোতির্ময়দার (দাস) মন্দির ও সংগঠন সংক্রান্ত কিছু প্রাইভেট ছিল।
তিনি ক্যামেরা,সাউন্ড আপাত বন্ধ করার অনুরোধ করে জ্যোতির্ময়দাকে স্টেজের সামনে ডেকে এত ভিড়েও প্রাইভেট করলেন।
এসব দেখে আমার যেন শ্রীশ্রীঠাকুরের জীবন স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল।
● শ্রীশ্রীঠাকুর প্রাতে যতি আশ্রমের প্রাঙ্গণে চৌকিতে বসে আছেন। পরপর লোক এসে ব্যক্তিগত কথা বলে যাচ্ছেন।
গত তিন-চার দিনের মধ্যে অন্তত দশ হাজার লোক এইভাবে ব্যক্তিগত প্রশ্ন করেছেন।আর, শ্রীশ্রীঠাকুর তার দুর্ব্বল শরীর নিয়ে সকলেরই কথার জবাব দিয়ে চলেছেন।কতজনের যে কত রকমারি সমস্যা, তার কোন লেখাজোখা নেই।এই হাজারো রকমের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাঁর শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়ছে,দেহ টলছে।তবুও তিনি ক্ষান্ত হচ্ছেন না। এর মধ্যে আবার প্রত্যেকের দিকে নজর,কোথায় কার অসুখ করছে, তার জন্য কি করা লাগবে; কাকে কোন কথাটা বলা হয়নি, কাকে কখন গাড়ি পাঠিয়ে আনতে হবে, কাকে কখন ফোন করতে হবে, কেউ যাতে কোনো বাজে খাবার না খান, আনন্দবাজারে সদাচারের যেন কোন ত্রুটি না থাকে, যাকে যাকে পাঞ্জা দেওয়ার তাকে যাতে দেওয়া হয়,কলকাতার উদ্বাস্তুতের জন্য যাতে কিছু টাকা সংগ্রহ করে দেওয়া যায়,এখানে দুঃস্থ দাদা ও মায়েদের জন্য কাপড় সংগ্রহ,পরবর্তী উৎসবে আরও স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা কেমন করে করতে হবে ইত্যাদি সব দিকে তার যে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এবং অদ্ভুত তৎপরতা তা দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া ছাড়া সাধারণ মানুষের কোন উপায় নেই। পুরুষোত্তম চির অতন্দ্র-এই ঐতিহাসিক সত্যের জীবন্ত নজির যে পরমপ্রেমময় পরমদয়াল,তা দেখবার অভূতপূর্ব সুযোগ পেয়েছিল সেসময়ে সৎসঙ্গের অগণিত মানুষ।( আ: প্র: -২২)
আমাদের মতো যাদের শ্রীশ্রীঠাকুরকে কেন্দ্র করে এমন অভূতপূর্ব দৃশ্য চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য হয়নি,পুরুষোত্তম রেতঃবাহির মধ্যে এই ভাবটা বর্তমানে বাস্তবিক অনুভব করছি।
●●সেসময় ঠাকুরকে দর্শন করার জন্য প্রতিনিয়ত যেসব মানুষ আসতেন,অনেকের সাথে শ্রীশ্রীঠাকুর নিজে কথা বলতেন।জিজ্ঞাসা করতেন-তাঁরা কোথা থেকে এসেছেন,এখানে কোথায় উঠেছেন,কতদিন থাকবেন, খাওয়া হয়েছে কিনা ইত্যাদি। কোন দর্শন নয়,নীতিকথা নয়,তথাকথিত কোন ধর্ম্ম-উপদেশও নয়।সহজ সরল প্রাণের কথা,সাধারণ খোঁজখবর, সমাগত কুশল প্রশ্ন। এই ছিল তার জাদুমন্ত্র।মানুষের মাথার মণি হয়ে সম্মানের শীর্ষে অধিষ্ঠিত থেকেও সকলের সাথে তার এই আপন করা ব্যবহার তাকে করেছিল প্রাণের ঠাকুর।
তিনি বলতেন এখানে যারা আসে তাদের সাথে তোরা কথা বলিস আমি হয়তো সবসময় লক্ষ্য রাখতে পারি না তোরা কিন্তু। লক্ষ্য রাখিস। একটা মানুষও যেন বঞ্চিত না হয়ে ফিরে যায়। আমরা এ কাজটি ক্ষমতা করছি কিনা সে বিষয়ে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ছিল।
●●একদিন দুপুরে দীপরক্ষীর সংকলক শ্রদ্ধেয় দেবীদাকে শ্রীশ্রীঠাকুর ডেকে পাঠালেন।ঠাকুর ঘরে ঢোকার মুখে দেখলেন স্থানীয় গ্রামের কিছু লোকজন ঠাকুর ঘরের সামনে জড়ো হয়ে আছেন। "কোথা থেকে আসছেন" শুধু এটা জিজ্ঞাসা করেই দেবীদা ঠাকুর ঘরে ঢুকতেই শ্রীশ্রীঠাকুর নিচুস্বরে বললেন-" কই, ওদের সাথে কথা বললি নে? দেবীদা বললেন-বলেছি।
-ভালো করে তো বলতে দেখলাম না!
ঠাকুরের এমন কথায় দেবীদাকে উঠতে হলো।তাদের সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে আবার ঠাকুর ঘরে ফিরতেই শ্রীশ্রীঠাকুর বললেন-"এরা গ্রামের সরল মানুষ।এদের সাথে যদি তোরা ভালোভাবে কথাবার্তা না বলিস ,ওরা মনে কষ্ট পেতে পারে।ভাবতে পারে আমরা গরিব বলে আমাদের সাথে কথা কয়না। সেই জন্য সবার সাথেই কথা বলবি। নিজেরা যখন কাজে থাকিস তখন এখানে অন্য লোক রাখা লাগে যাতে মানুষের সাথে কথাবার্তা বলতে পারে।"
আজ আশ্রমে নবীন-প্রবীণের নবজোয়ার বইছে। আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই জানে- কেউ না শুনুক,কারোর কাছে সাহস করে বলতে না পারি, একজন তো অন্তত আছেন,যিনি শুনবেন আমার মনের কথা।প্রানের তাগিদে যাকে উজাড় করে সব কথা বলতে পারি।দেখতে দেখতে তিনি আজ চব্বিশে পা দিলেন।
আজ থেকে ছ'বছর আগে যিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন,
“যখন কারো মনে হবে আমার পাশে কেউ নেই , জসিডির টিকিট কাটবেন আর চলে আসবেন...
আমি দাঁড়িয়ে আছি আপনার জন্যে",
তার এমন কথায় সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত কত মানুষ ভরসা পেয়েছেন সে হিসাব এখনও করে ওঠা সম্ভব হয়নি,কিন্তু এহেন কথায় যিনি পরম স্বস্তি পেয়েছিলেন তিনি আর কেউ নন,স্বয়ং মানুষ ভুখা পরমপ্রেমময়।।
তার শুভ জন্মদিবস উপলক্ষ্যে আমার সশ্রদ্ধ প্রনাম নিবেদন করি।।
~~~~~~~~~|||||~~~~~~|||||~~~~~~~~~
©অমিয় মৃধা
৯/১/২৪