22/04/2023
স্বামী-স্ত্রীর অধিকার ও দায়িত্ব
মানুষের অধিকারের বিষয়ে সবার সচেতনতা ও অন্তরে আল্লাহর ভয় থাকা কাম্য। এ বিষয়ে শিথিলতা মহাবিপদের অন্যতম। এ বিষয়ে অবহেলা বোঝা ও দায়ভারস্বরূপ এবং উদ্বেগ ও আফসোসের কারণ। অধিকার অত্যন্ত ভারী বোঝা, মারাত্মক ব্যাপার ও দীর্ঘ হিসাবের বিষয়। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের সম্মানহানি বা অন্য কোনো বিষয়ে জুলুমের জন্য দায়ী থাকে, সে যেন আজই তার কাছ থেকে মাফ করিয়ে নেয়, সেদিন আসার আগে যেদিন তার কোনো দিনার বা দিরহাম থাকবে না। সেদিন তার কোনো সৎকর্ম থাকলে তার জুলুমের সমপরিমাণ তা তার কাছ থেকে নেওয়া হবে। আর তার কোনো সৎকর্ম না থাকলে তার প্রতিপক্ষের পাপ থেকে নিয়ে তা তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।’ -সহিহ বোখারি
অন্য হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি বলতে পারো নিঃস্ব কে? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে যার টাকা-কড়ি ও ধন-সম্পদ নেই সেই তো নিঃস্ব। তখন তিনি বললেন, আমার উম্মতের মধ্যে সেই প্রকৃত নিঃস্ব যে কেয়ামতের দিন নামাজ, রোজা ও জাকাত নিয়ে আসবে; অথচ সে এই অবস্থায় আসবে যে, একে গালি দিয়েছে, একে অপবাদ দিয়েছে, এর সম্পদ আত্মসাৎ করেছে, একে হত্যা করেছে এবং একে প্রহার করেছে। এরপর একে তার নেক আমল থেকে দেওয়া হবে, ওকে নেক আমল থেকে দেওয়া হবে। এরপর তার কাছে পাওনাদারের প্রাপ্য তার নেক আমল থেকে পূরণ করা না গেলে তাদের পাপের একাংশ তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হবে। এরপর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।’ -সহিহ মুসলিম
পাওনাদার কিংবা হকদার যেকোনো ব্যক্তিই কেয়ামতের দিন সবচেয়ে বড় বাদী হবে। হায় আফসোস! কী অবস্থা হবে ওই ব্যক্তির, যার সঙ্গে তার সবচেয়ে নিকটতম ও প্রিয় ব্যক্তি অধিকার নিয়ে আল্লাহর সামনে ঝগড়া করবে। যেদিন মানুষ পালিয়ে যাবে তার ভাইয়ের কাছ থেকে এবং তার মাতা, তার পিতা, তার স্ত্রী ও তার সন্তান থেকে। সেদিন তাদের প্রত্যেকের এমন গুরুতর অবস্থা হবে যা তাকে সম্পূর্ণরূপে ব্যস্ত রাখবে। সুতরাং মানুষের অধিকারের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করুন। অপরিচিতদের অধিকারের বিষয়ে, যাদের সঙ্গে হয়তো সাক্ষাতের আর সুযোগ পাবেন না। যেসব পরিবার-পরিজন এবং আত্মীয়-স্বজনের হকের বিষয়ে আল্লাহতায়ালা অসিয়ত করেছেন তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করুন। মাতা-পিতা এবং সন্তান-সন্তুতিদের অধিকারের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করুন। আল্লাহকে ভয় করুন স্বামী-স্ত্রীর অধিকারের বিষয়ে।
সহমর্মিতা, ভালোবাসা এবং দয়ার ওপর আল্লাহতায়ালা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আর তার নিদর্শনাবলির মধ্যে রয়েছে যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের জোড়া; যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তি পাও এবং সৃজন করেছেন তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও সহমর্মিতা।’ -সুরা আর রুম : ২১
আল্লাহতায়ালা সদাচরণ করতে ও দাম্পত্য সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেইসঙ্গে বৈবাহিক বিধানাবলি ও স্বামী-স্ত্রীর হকসমূহ শরিয়তে প্রবর্তন করেছেন। প্রত্যেকের জন্য কিছু বিধান, হক এবং দায়দায়িত্ব নির্ধারণ করেছেন। এগুলোর ওপর প্রতিদান ও জবাবদিহি আরোপ করেছেন। সওয়াব ও শাস্তি প্রদানের ঘোষণার মাধ্যমে বিষয়টিকে আরও বাধ্যতামূলক করেছেন। এসব হক শুধুমাত্র রুচিসম্মত চরিত্র, সামাজিক শিষ্টাচার ও আইনি বিধিবিধান নয়। বরং এগুলো আল্লাহ প্রণীত ঐশী বিধান, কোরআন মাজিদের আয়াত এবং নবীর সুন্নত। যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত করা হয়। যেমন তার নাফরমানি করা হয় এগুলোর বিরুদ্ধাচারণের মাধ্যমে। এগুলো পরীক্ষার ময়দান।
প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল, প্রত্যেকেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবেন। স্বামী তার ঘরের বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং সে তার দায়িত্ব ও স্ত্রীর অধিকার বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। স্ত্রী তার গৃহের বিষয়ে দায়িত্বশীল এবং সে তার দায়িত্ব ও স্বামীর অধিকারের বিষয়ে জিজ্ঞাসিত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘সুতরাং তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করো এবং নিজেদের মধ্যে সদ্ভাব স্থাপন করো। আর আল্লাহ ও রাসুলের আনুগত্য করো, যদি তোমরা মুমিন হও।’ -সুরা আল আনফাল : ০১
স্বামী-স্ত্রীর শ্রেষ্ঠ অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হলো, সৎভাবে বসবাস, কোমল আচরণ, সহমর্মিতা প্রদর্শন এবং উত্তম আচরণ করা। সুতরাং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে একে অন্যের সঙ্গে উত্তম আচরণ করা ওয়াজিব। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমরা তাদের সঙ্গে সৎভাবে জীবনযাপন করবে।’ -সুরা আন নিসা : ১৯
সুন্দর দাম্পত্য জীবনের নিদর্শনের ভিত্তির অন্যতম হলো, স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে হারাম বিষয় থেকে বিরত রাখবে এবং সৎকাজে পরস্পরের সহযোগী হবে। সুন্দর দাম্পত্য সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, একে অপরের প্রতি মর্যাদা ও সম্মানবোধ বজায় রাখা, পরস্পরের অনুভূতির মূল্যায়ন করা এবং হৃদয়ের একান্ত অভিপ্রায় পূরণ করা। সুন্দর সম্পর্কের আবশ্যিক অনুষঙ্গ হলো, একে অন্যকে কষ্ট প্রদান এবং কথা ও কাজের মাধ্যমে মন্দ আচরণ করা থেকে বিরত থাকা। কেননা এগুলো এমন সৌহার্দ্যরে অন্তর্ভুক্ত নয় যে বিষয়ে আল্লাহতায়ালা স্বামী-স্ত্রী উভয়কে নির্দেশ দিয়েছেন।
স্বামী-স্ত্রীর মহা-অধিকারের অন্তর্গত হলো, পরস্পরের গোপনীয়তা রক্ষা করা। কেননা গোপনীয়তা হলো আমানতস্বরূপ। তা প্রকাশ বিশ্বাসঘাতকতা ও খেয়ানত। যে ব্যক্তির মাঝে আমানতদারিতা নেই তার ইমান নেই। স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয়তা যেকোনো গোপনীয়তার চেয়ে অতি একান্ত গোপন বিষয়। সুতরাং উভয়ের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি ও বিচ্ছেদ হওয়ার পরেও তা রক্ষা এবং প্রকাশ না করা ওয়াজিব। বিপদ-আপদ, বালা-মুসিবত ব্যাপক আকার ধারণ করে যদি স্বামী-স্ত্রীর গোপনীয়তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। হজরত আবু সাঈদ আল খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন ওই ব্যক্তি হবে আল্লাহর কাছে নিকৃষ্টতম পর্যায়ের, যে তার স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয় এবং স্ত্রীও তার সঙ্গে মিলিত হয়, তারপর একে অপরের গোপনীয়তা ফাঁস করে দেয়।’ -সহিহ মুসলিম
স্বামী-স্ত্রীর অধিকারের অন্তর্ভুক্ত হলো, পরস্পরের মিরাসের (উত্তরাধিকার) অধিকার। আল্লাহতায়ালা বিষয়টির দায়িত্ব নিয়েছেন এবং তা বণ্টন করেছেন। স্বামী-স্ত্রীর প্রত্যেকের জন্য একটি নির্ধারিত অংশ ধার্য করেছেন। সুতরাং আল্লাহ কর্র্তৃক ফরজ অধিকার থেকে নারীকে বঞ্চিত করা জায়েজ নয়, চাই সে মিরাস ভূসম্পত্তি হোক বা টাকা-পয়সা হোক। আল্লাহতায়ালা স্বামী-স্ত্রীর একে অপরের প্রতি কতগুলো হক নির্ধারণ করে দিয়েছেন। স্ত্রীর ওপর স্বামীর হকের অন্যতম হলো, তার প্রয়োজনে সাড়া দেওয়া, তার সম্মান রক্ষা ও তার অনুমতি ছাড়া বাইরে বের না হওয়া। স্বামীর ওপর স্ত্রীর অন্যতম হক হলো, মোহরানা প্রদান, ব্যয়ভার বহন, বাসস্থান ও পোশাক প্রদান এবং ইনসাফ বজায় রাখা।
আপনারা নিজেদের আত্মসমালোচনা করুন হিসাবের সম্মুখীন হওয়ার আগেই। মৃত্যুর আগেই আপনারা জিম্মাদারি মুক্ত হোন, পাওনাদারদের সঙ্গে মীমাংসা করে নিন, অন্যায়ভাবে অর্জিত বস্তু তার মালিককে ফিরিয়ে দিন ও প্রত্যেক হকদারকে তার হক বুঝিয়ে দিন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি শত্রুতা তোমাদের যেন সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে। তোমরা সুবিচার করো, এটা তাকওয়ার অধিক নিকটবর্তী।’
-সুরা আল মায়েদা : ০৮
সংগৃহীত
১৩ জানুয়ারি শুক্রবার মসজিদে নববিতে প্রদত্ত জুমার খুতবা। অনুবাদ মুহাম্মদ আতিকুর রহমান